উৎসর্গ/৩৬
আমার খোলা জানালাতে
শব্দবিহীন চরণপাতে
কে এলে গো , কে গো তুমি এলে ।
একলা আমি বসে আছি
অস্তলোকের কাছাকাছি
পশ্চিমেতে দুটি নয়ন মেলে ।
অতিসুদূর দীর্ঘ পথে
আকুল তব আঁচল হতে
আঁধারতলে গন্ধরেখা রাখি
জোনাক - জ্বালা বনের শেষে
কখন এলে দুয়ারদেশে
শিথিল কেশে ললাটখানি ঢাকি ।
তোমার সাথে আমার পাশে
কত গ্রামের নিদ্রা আসে —
পান্থবিহীন পথের বিজনতা ,
ধূসর আলো কত মাঠের ,
বধূশূন্য কত ঘাটের
আঁধার কোণে জলের কলকথা ।
শৈলতটের পায়ের'পরে
তরঙ্গদল ঘুমিয়ে পড়ে ,
স্বপ্ন তারি আনলে বহন করি ।
কত বনের শাখে শাখে
পাখির যে গান সুপ্ত থাকে
এনেছ তাই মৌন নূপুর ভরি ।
মোর ভালে ওই কোমল হস্ত
এনে দেয় গো সূর্য - অস্ত ,
এনে দেয় গো কাজের অবসান —
সত্যমিথ্যা ভালোমন্দ
সকল সমাপনের ছন্দ ,
সন্ধ্যানদীর নিঃশেষিত তান ।
আঁচল তব উড়ে এসে
লাগে আমার বক্ষে কেশে ,
দেহ যেন মিলায় শূন্য ' পরি ,
চক্ষু তব মৃত্যুসম
স্তব্ধ আছে মুখে মম
কালো আলোয় সর্বহৃদয় ভরি ।
যেমনি তব দখিন - পাণি
তুলে নিল প্রদীপখানি ,
রেখে দিল আমার গৃহকোণে ,
গৃহ আমার এক নিমেষে
ব্যাপ্ত হল তারার দেশে
তিমিরতটে আলোর উপবনে ।
আজি আমার ঘরের পাশে
গগনপারের কারা আসে
অঙ্গ তাদের নীলাম্বরে ঢাকি ।
আজি আমার দ্বারের কাছে
অনাদি রাত স্তব্ধ আছে
তোমার পানে মেলি তাহার আঁখি ।
এই মুহূর্তে আধেক ধরা
লয়ে তাহার আঁধার - ভরা
কত বিরাম , কত গভীর প্রীতি ,
আমার বাতায়নে এসে
দাঁড়ালো আজ দিনের শেষে —
শোনায় তোমায় গুঞ্জরিত গীতি ।
চক্ষে তব পলক নাহি ,
ধ্রুবতারার দিকে চাহি
তাকিয়ে আছ নিরুদ্দেশের পানে ।
নীরব দুটি চরণ ফেলে
আঁধার হতে কে গো এলে
আমার ঘরে আমার গীতে গানে । —
কত মাঠের শূন্যপথে ,
কত পুরীর প্রান্ত হতে ,
কত সিন্ধুবালুর তীরে তীরে ,
কত শান্ত নদীর পারে ,
কত স্তব্ধ গ্রামের ধারে ,
কত সুপ্ত গৃহদুয়ার ফিরে ,
কত বনের বায়ুর'পরে
এলো চুলের আঘাত করে
আসিলে আজ হঠাৎ অকারণে ।
বহু দেশের বহু দূরের
বহু দিনের বহু সুরের
আনিলে গান আমার বাতায়নে ।