উৎসর্গ/৪৫
অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও ,
ওগো একি প্রণয়েরি ধরন ।
যবে সন্ধ্যাবেলায় ফুলদল
পড়ে ক্লান্ত বৃন্তে নমিয়া ,
যবে ফিরে আসে গোঠে গাভীদল
সারা দিনমান মাঠে ভ্রমিয়া ,
তুমি পাশে আসি বস অচপল
ওগো অতি মৃদুগতি - চরণ ।
আমি বুঝি না যে কী যে কথা কও
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
হায় এমনি করে কি , ওগো চোর ,
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ,
চোখে বিছাইয়া দিবে ঘুমঘোর
করি হৃদিতলে অবতরণ ।
তুমি এমনি কি ধীরে দিবে দোল
মোর অবশ বক্ষশোণিতে ।
কানে বাজাবে ঘুমের কলরোল
তব কিঙ্কিণি - রণরণিতে ?
শেষে পসারিয়া তব হিম - কোল
মোরে স্বপনে করিবে হরণ ?
আমি বুঝি না যে কেন আস - যাও
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
কহ মিলনের এ কি রীতি এই
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
তার সমারোহভার কিছু নেই —
নেই কোনো মঙ্গলাচরণ ?
তব পিঙ্গলছবি মহাজট
সে কি চূড়া করি বাঁধা হবে না ।
তব বিজয়োদ্ধত ধ্বজপট
সে কি আগে - পিছে কেহ ববে না ।
তব মশাল - আলোকে নদীতট
আঁখি মেলিবে না রাঙাবরন ?
ত্রাসে কেঁপে উঠিবে না ধরাতল
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ?
যবে বিবাহে চলিলা বিলোচন
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ,
তাঁর কতমতো ছিল আয়োজন ,
ছিল কতশত উপকরণ ।
তাঁর লটপট করে বাঘছাল
তাঁর বৃষ রহি রহি গরজে ,
তাঁর বেষ্টন করি জটাজাল
যত ভুজঙ্গদল তরজে ।
তাঁর ববম্ববম্ বাজে গাল ,
দোলে গলায় কপালাভরণ ,
তাঁর বিষাণে ফুকারি উঠে তান
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
শুনি শ্মশানবাসীর কলকল
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ,
সুখে গৌরীর আঁখি ছলছল ,
তাঁর কাঁপিছে নিচোলাবরণ ।
তাঁর বাম আঁখি ফুরে থরথর ,
তাঁর হিয়া দুরুদুরু দুলিছে ,
তাঁর পুলকিত তনু জরজর ,
তাঁর মন আপনারে ভুলিছে ।
তাঁর মাতা কাঁদে শিরে হানি কর
খেপা বরেরে করিতে বরণ ,
তাঁর পিতা মনে মানে পরমাদ
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
তুমি চুরি করি কেন এস চোর
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
শুধু নীরবে কখন নিশি - ভোর ,
শুধু অশ্রু - নিঝর - ঝরন ।
তুমি উৎসব করো সারারাত
তব বিজয়শঙ্খ বাজায়ে ।
মোরে কেড়ে লও তুমি ধরি হাত
নব রক্তবসনে সাজায়ে ।
তুমি কারে করিয়ো না দৃক্পাত ,
আমি নিজে লব তব শরণ
যদি গৌরবে মোরে লয়ে যাও
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
যদি কাজে থাকি আমি গৃহমাঝ
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ,
তুমি ভেঙে দিয়ো মোর সব কাজ ,
কোরো সব লাজ অপহরণ ।
যদি স্বপনে মিটায়ে সব সাধ
আমি শুয়ে থাকি সুখশয়নে ,
যদি হৃদয়ে জড়ায়ে অবসাদ
থাকি আধজাগরূক নয়নে ,
তবে শঙ্খে তোমার তুলো নাদ
করি প্রলয়শ্বাস ভরণ —
আমি ছুটিয়া আসিব ওগো নাথ ,
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।
আমি যাব যেথা তব তরী রয়
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ,
যেথা অকূল হইতে বায়ু বয়
করি আঁধারের অনুসরণ ।
যদি দেখি ঘনঘোর মেঘোদয়
দূর ঈশানের কোণে আকাশে ,
যদি বিদ্যুৎফণী জ্বালাময়
তার উদ্যত ফণা বিকাশে ,
আমি ফিরিব না করি মিছা ভয় —
আমি করিব নীরবে তরণ
সেই মহাবরষার রাঙা জল
ওগো মরণ , হে মোর মরণ ।