এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা/বৌদ্ধ মত

উইকিসংকলন থেকে
বৌদ্ধমত।

 বেদের অনুশীলন কালীন পুরোহিতের সৃষ্টি হইল। ক্রমে, পুরোহিতেরা আপন আপন প্রভুত্ব প্রকাশ করিতে লাগিলেন। পুরোহিত গুরুর স্বরূপ; কিন্তু—

“গুরবো বহবঃ সন্তি শিষ্যবিত্তাপহারকাঃ।
দুর্লভা গুরবো দেবী শিষ্যসন্তাপহারকাঃ॥”

 অনেক গুরু আছেন যাঁহারা শিষ্যের বিত্ত অপহরণ করেন, কিন্তু শিষ্যের সন্তাপহরণ করিবার জন্য গুরু দুর্লভ।

 সকল ধর্ম্মশিক্ষক নিষ্কাম রূপে শিক্ষা দেন না অথবা সকল ধর্ম্মশিক্ষকও শিষ্যের সন্তাপ হরণ করিতে পারেন না; কিন্তু অনেকেই আপন ক্ষমতাতে উন্মত্ত হয়েন। সেইরূপ বৈদিক পুরোহিত প্রতাপান্বিত হওয়ায় সাধারণ সমাজের ঘৃণাস্পদ হইয়া উঠিলেন। বিশ্বামিত্র ও জনক বেদের দোষারোপ করিতে লাগিলেন। বৃহস্পতি, তিন বেদের লেখকদিগকে ভাঁড়, বঞ্চক, ও ভূত বলিলেন ও ব্রাহ্মণেরাও অন্ত্যজ রূপে বর্ণিত হইলেন। এই সময়ে বৌদ্ধ মতের সৃষ্টি হইল। বৌদ্ধের হিন্দুদিগকে মাংশাসী, মদ্যপায়ী ও জাতি অনুরাগী দেখিয়া, তাহাদিগকে পরিত্যাগ করত অহিংসা পরম ধর্ম্ম প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। হিন্দু স্ত্রীজাতি স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক—যাহা আত্মা ও ঈশ্বর সম্বন্ধীয়, তাহা তাহাদিগের হৃদয়ে শীঘ্র সংলগ্ন হইল। বৌদ্ধ ধর্ম্ম প্রচারকেরা বলিল যে, জীবনের উদ্দেশ্য নির্ব্বাণ—যোগ ও ধ্যান ইহার পথ। এই উপদেশ শুনিয়া বহুসংখ্যক পুরুষ ও স্ত্রী বৌদ্ধ ধর্ম্মে দীক্ষিত হইল। ক্রমে বৌদ্ধ ধর্ম্ম ভারতবর্ষে বদ্ধমূল হইল। বৌদ্ধ ধর্ম্ম সাখ্য ও পাতঞ্জল দর্শন হইতে গৃহীত। সাংখ্যদিগের ন্যায় বৌদ্ধেরা প্রথমে নিরীশ্বর ছিলেন, পরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করিলেন। ক্রমশঃ তাঁহারা আত্মার অমরত্ব স্বীকার করিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধদিগের উদ্দেশ্য একই। যাহাকে হিন্দুরা জীবন্মুক্তি বলেন তাহাকেই বৌদ্ধরা নির্ব্বাণ কহেন। এই অবস্থাতেই ভবনদী পার—এই অবস্থাতেই বাহ্যজ্ঞান শূন্য ও অন্তর জ্ঞান পূর্ণ—এই অবস্থাতেই স্থূল শরীর বিগত ও সূক্ষ্ম শরীরের উদ্দীপন। পূর্ব্বে ভারতভূমি ব্রহ্মবাদিনীও সদ্যোবধূর দ্বারা উজ্জ্বলিত হইয়াছিল; এক্ষণে স্ত্রীলোকেরা দেখিলেন, বৌদ্ধ ধর্ম্ম সম্পর্ণ হিংসা ও দ্বেষ শূন্য, এবং অনেকেই ঐ ধর্ম্ম মতাবলম্বী হইলেন। মহা প্রজাপতি, অশোক রাজার কন্যা, ও অনেক স্ত্রীলোক এই ধর্ম্মের অনুগামিনী হইলেন। তাঁহারা প্রকাশ্য স্থানে গমন করিতেন ও ব্রহ্মবাদিনীদিগের ন্যায় পুরুষের সহিত বিচার করিতেন। যখন চন্দ্রগুপ্ত রাজা ছিলেন, তখন স্ত্রীলোক পুরুষের সহিত বাহিরে যাইতেন।

 মুদ্রারাক্ষসে, চন্দ্রগুপ্তের এই কথা লেখে—“নগরীয় লোকেরা আপন আপন বনিতা সঙ্গে লইয়া, আমোদার্থে বাহিরে আইসে না কেন?”

 বৌদ্ধ নীতিগ্রন্থে লিখিত আছে—উত্তম স্ত্রী, মাতা, ভগিনী ও সখী স্বরূপ।

 লঙ্কা দ্বীপ হইতে, বৌদ্ধ নারীরা বিবাহার্থে ভারতবর্ষে জাহাজে আসিতেন।