এরাও মানুষ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
মেয়েরা গেয়ে চলে,
‘বাবা, তুমিই প্রকৃত সুখী,
আমরা যারা শোক করবার জন্যে পড়ে রইলাম,
আমরাই আসলে দুঃখী।’
শাদা-লোকরা যখন অপমানিত হয়, তখন তারা সদ্য সদ্য তার প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু আফ্রিকার এই কালো-লোকদের প্রতিশোধ নেবার রীতিও আলাদা।
তারা জানে, প্রতিহিংসা গরম গরম পরিবেশন করতে নেই। তাই তারা বাইরের হাসি-খুশী আর মিষ্টি ব্যবহারে প্রতিহিংসার জ্বালাকে লুকিয়ে রাখে, ছাই দিয়ে যেমন আগুনকে লুকিয়ে রাখতে হয়···ছাই-এর তলায় আগুনের কণা নীরবে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
তাই যার ওপর প্রতিহিংসা নিতে চাও, তোমার সেই শত্রুকে আদর করে তোমার বাড়ীতে ডেকে নিয়ে এসো, নেমন্তন্ন করো, পেট ভরে খাওয়াও, দরকার হলে টাকা দিয়ে সাহায্য করো। তোমার দেবার মত যা কিছু আছে, সব তোমার শত্রুর হাতে তুলে দাও। এমন কি, সে না চাইতেই, তুমি আগে থাকতে তার মনস্কামনা পূর্ণ করো। তার সন্দেহকে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে দাও। হলদে আর শাদা রঙ হলো বন্ধুত্বের চিহ্ন, সুগভীর অন্তরঙ্গতার চিহ্ন···বেছে বেছে তোমার সবচেয়ে শাদা বা হল্দে মুরগীর ছানা তোমার শত্রুর জন্যে রেখে দাও। কিছুতেই যাতে তোমাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করতে পারে।
এই বঞ্চনার খেলা, যতদিন দরকার, চালিয়ে যেতে হবে। অসহিষ্ণু হলে চলবে না। বহুদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে থাকতে হবে, যতক্ষণ না উপযুক্ত সুযোগের লগ্ন আসে। ঘৃণা হলো চরম ধৈর্যের ব্যাপার।
তারপর, যখন সবদিক থেকে সুযোগ ঘনিয়ে আসবে, তখন নিঃশব্দে তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলো,···এতদিন ভায়ের মতন যাকে কাছে কাছে রেখেছো, তাকে বিষ দিতে বিশেষ আর হাঙ্গামা করতে হবে না।
তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী···তোমার শত্রু···তার সঙ্গে তোমার আসল সম্বন্ধ হলো, নেকড়ের সম্বন্ধ···নেকড়ে···বনের সমস্ত পশুদের মধ্যে সবচেয়ে ক্রুর, সবচেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর—
আকাশে যখন চাঁদ থাকে না, অন্ধকারে থম্ থম্ করে বন, সেই সময়ে নেকড়ে বেরোয় শিকারে···
অন্ধকারে অতর্কিতে এক নিমিষে শিকারের টুটি চেপে ধরে —নখ আর দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করে তাকে জবাই করে···রক্ত পান করবার আগেই রক্তের গন্ধে মুখের সমস্ত পেশী সবল হয়ে ওঠে···টাটকা, তাজা গরম রক্ত, তখনও তা থেকে উঠছে ধোঁয়া, সে-রক্ত না হলে তার তৃষ্ণা মেটে না। সেই রক্ত পান করেও সে তৃপ্ত হয় না, সেই রক্ত সর্বাঙ্গে মেখে আনন্দে তাতে গড়াগড়ি দেয়, সুরার মত সে তপ্ত রক্ত মাতাল করে তোলে তাকে—বহুক্ষণ পর্যন্ত বাতাসে রক্তের তীব্র গন্ধ মশগুল করে রাখে তাকে···
নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে এই নেকড়েকে। অমনি চাঁদ-ডোবা এক অন্ধকার রাত্রিতে, যে-বুনো পথ দিয়ে তোমার শিকার যাবে, তার ধারে মুখেতে মুখোস পরে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে···অপেক্ষায়···
তারপর···ঐ···ঐ আসছে শিকার! একটা উন্মাদ লাফ—এক নিমিষে মাটিতে ফেলে দুই হাত দিয়ে সজোরে গলা টিপে ধরো···তারপর নেকড়ের মতন, কোমর থেকে সরু ছুরি নিয়ে, কিম্বা নিজের লম্বা ধারালো নখ দিয়ে গলার নলিটা টেনে ছিড়ে ফেলো···তারপর নেকড়ের মতন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলো···
বাতোয়ালা সত্যি সত্যি ঠিক এইরকমই মনে মনে জল্পনা করে চলেছিল···বিসিবিংগুই অনুমান করতে ভুল করে নি। বাইরের অন্তরঙ্গতার আড়ালে নিঃশব্দে বয়ে চলে প্রতিহিংসার ধারা—
“বাবা, তুমিই প্রকৃত সুখী,
আমরা যারা শোকার্ত পড়ে রইলাম,
আমরাই আসলে দুঃখী।”
একটা ছোট ছেলে আপনার মনে একটা বহুরূপী গিরগিটি ধরবার চেষ্টা করছে। ওরা তাকে বলে কলিঙ্গো। কলিঙ্গো যেখানে থাকে, তারই রঙ ধারণ করে, কখনো শাদা, কখনো হল্দে, কখনো সবুজ।
কিন্তু বাতোয়ালার কুকুর, জুমা, সে কি এই তত্ত্ব জানে? না। এ তত্ত্ব জানবার কোন উপায়ই তার নেই। তাই কান খাড়া করে সে বহুরূপীটির দিকে চেয়ে প্রাণপণে চীৎকার করে।
শববাহীরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধের শবদেহকে একটা মাদুরের ওপর তুলে নেয়, যে-মাদুরে বৃদ্ধ শুয়ে থাকতো। তারপর কবরস্থানে নিয়ে যাবার জন্যে কাঁধে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল শব্দে বাজনা বেজে ওঠে। মেয়েরা কণ্ঠ ছেড়ে বিলাপ করতে আরম্ভ করে,···
“ওগো বৃদ্ধ,
আজ এখন আমরা চলেছি,
তোমাকে নিয়ে যাব তোমার নতুন ঘরে।
এখানকার জীবন ছেড়ে চলে যেতে
হলো বলে দুঃখ করো না।
তুমি যে নতুন দেশে যাচ্ছো,
সেখানে তুমি ঢের সুখে থাকবে।
সেখানে তোমার অন্নের অভাব হবে না,
অভাব হবে না পানীয়ের।
সেখানে প্রয়োজনই হবে না খাদ্যের।
কারণ সে-দেশে নেই ক্ষুধা, নেই তৃষ্ণা।”
কয়েক গজ দূরে কবরের মাটি খোঁড়া হয়েছে। শবযাত্রীর দল গাইতে গাইতে সেখানে উপস্থিত হয়। ধীরে মাটির তলায় গর্তের ভিতর শব-দেহকে নামিয়ে দেওয়া হয়। নির্বিঘ্নে ঘুমারে এবার বৃদ্ধ।
কবরের পাশে, বৃদ্ধের যা কিছু কাপড়-চোপড়, আসবাব-পত্র ছিল সব এক জায়গায় এনে জড় ক'রে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। পৃথিবীর সঙ্গে তার সব সম্পর্ক গেল ফুরিয়ে।
একে একে শোকের পালা শেষ হয়ে এলো। বৃদ্ধের মৃত-দেহকে কবরে সমাহিত করবার পর, সেইখানেই বৃদ্ধের পার্থিব অবশিষ্ট যা কিছু ছিল, সব আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হলো।
মেয়েরা গাইতে গাইতে যে-যার ঘরে ফিরে গেলো,
“তুমি এখন পৌঁছে গিয়েছো,
ঘন অন্ধকার ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে
কলিকং বো-দেশে,
যেখানে তোমার অপেক্ষায় আছে
তোমার বংশের পিতা-পিতমহরা,
তাদের সঙ্গে আনন্দে তুমি আজ হয়েছে। মিলিত,
আমরাও একদিন সেখানে গিয়ে তোমার
সঙ্গে হবো মিলিত।”
ধীরে নেমে আসে রাত্রি। রাত্রির অন্ধকারের সঙ্গে আসে দুরন্ত হিম।
নদীর ওপারে বনের ভেতর থেকে জেগে ওঠে শার্দুলের চীৎকার···তারা বেরিয়েছে শিকারের সন্ধানে।
রাত্রির অন্ধকার···হিম···আর শার্দুলের নিশীথ গর্জন।
কেটে যায় দিনের পর দিন।
মৃত-ব্যক্তি যে কুঁড়ে ঘরে থাকতো, সে ঘরের ছাদ ভেঙ্গে ফেলে দেওয়া হয়েছে···ঘরের সামনে যে কাঠের লিঙ্গ-মূর্তি ছিল, সেটা ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছে। কোন পরিবারের কর্তা যখন মারা যায়, তখন এইভাবেই তারা তার থাকবার ঘরের ছাদটা ভেঙ্গে দেয়। যে-পুরুষ পৃথিবী পরিত্যাগ ক'রে কলিকংবোর দেশে যাত্রা করে, সে তো আর সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না, তাই তার ঘরের সামনে কাঠের লিঙ্গ-মূর্তিকেও তারা ভেঙ্গে ফেলে দেয়।
ক্রমশ সকলেই ভুলে যায় তার কথা। জ্যান্ত পৃথিবীর নেশায় মেতে ওঠে আবার তারা।
সামনেই শিকারের সময়। বর্শা-হাতে ছোটে তারা বনের দিকে। তাদের বাজনায় বেজে ওঠে শিকারের গান। সারাদিন ধরে শাণ দেয় বর্শায়। টগ বগ করে নাচতে থাকে শিরায় রক্ত। প্রমত্ত শার্দুলের সঙ্গে হবে তার মত্ত আদর···মৃতের জন্যে বসে বসে শোক করবার সময় আর নেই···চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্তমাখা বুনো-জন্তুর অন্তিম আস্ফালন···পিচ্কিরির মতন ছিট্কে পড়ে রক্তের ধারা···নিশীথ-অরণ্য কেঁপে ওঠে মৃত্যুর তাণ্ডব নৃত্যে। নেচে ওঠে বুনো মানুষের মন···জীবনের আহ্বানে।
মধ্য-আকাশকে পেরিয়ে বহুক্ষণ হলো সূর্য এগিয়ে চলেছে তার কুঁড়ে ঘরের দিকে, দিগন্ত-রেখার ওপারে অদৃশ্য-লোকে আছে তার দিনান্তে-ফিরে-আসার কুঁড়ে ঘর। আহা, ঐ আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো, হাজার হাজার বছরের ঐ বুড়ো-সূর্যি, অমন সুন্দর লোক আর হয় না। এতটুকু অবিচার নেই তার কাছে। তুমি যত বড়ই হও, কিম্বা তুমি যত ছোটই হও, যত কেন না তুচ্ছ হও, সমানভাবে সকলকেই সে দিয়ে চলে আলো। এতটুকু পক্ষপাতিত্ব নেই তার কারুর জন্যেই! সে জানে না কে ধনী, কে নির্ধন! সে জানে না···কে নিগ্রো আর কে শাদা-চামড়া।
গায়ের রঙ শাদাই হোক্ আর কালোই হোক্, ঘরেতে টাকা পয়সা থাকুক্ আর নাই থাকুক্, তার তাতে কিছু যায় আসে না-আকাশের তলায় সবাই তার সন্তান। সব সন্তানকেই সে সমান ভাবে ভালবাসে। উদয়াস্ত সকলের মন জুগিয়ে চলে। কোথায় কোন ছেলের দল বীজ বুনছে, আলো দিয়ে সেই বীজ থেকে তৈরী করে দেয় অঙ্কুর; কোথায় কারা ভোরে হিমে আর কুয়াসায় পাচ্ছে কষ্ট, তাড়াতাড়ি আলোর শর দিয়ে তাড়িয়ে দেয় কুয়াসার জঞ্জাল; আলোর মুখ দিয়ে শুষে নেয় অদরকারী বাড়তি জল···সারা দুনিয়া থেকে তাড়িয়ে বেড়ায় ছায়া-ভূতের দলকে। ছায়া সে সইতে পারে না।
ছায়া! অন্ধকার! তাদের শত্রু সে, চিরদিনের শত্রু। দয়াহীন, মায়াহীন, নির্মম সে তাড়িয়ে বেড়ায় যেখানে থাকে ছায়া। সারাদিন ছায়ার পেছনে শিকার করে বেড়ায়। এমন ঘৃণা আর কিছুকে সে করে না।
পীড়িত যে, তার বন্ধু সে। তার আলো তাদের ওষুধ। মার স্নেহের মতন আলোর স্পর্শে সে পীড়িতকে দেয় শান্তি। কে না জানে, আলোই স্বাস্থ্য, আলোই পরমায়ু? কে না জানে, ঐ বুড়ো সূর্যের জন্যেই এই জগৎ-ভরা সব প্রাণী জীবন ধারণ করে আছে?
একমাত্র চিরজীবী হলো সূর্য।
মানুষের আয়ত্তের বাইরে, শাসনের বাইরে যা কিছু, সেখানেও সূর্যের আলো গিয়ে পৌঁছোয়, সেখানেও চলে তার শাসন।
এ জগতে চিরদিনের কেউ নয়। প্রত্যেক বর্ষায় যেমন নদীর জল বেড়ে ওঠে, তেমনি বেড়ে চলেছে মানুষ। আজকে যারা শিশু, কালকে আবার তারা হবে শিশুর জনক।
মাটিকে আশ্রয় করে থাকে ঘাস। ঘাসকে আশ্রয় করে থাকে বনের প্রাণী। সেই ঘাস আর বনের প্রাণী, দুই-ই আবার নষ্ট হয়ে যায় মানুষের হাতে। মানুষকেও নষ্ট করে দেয় মৃত্যু। কিছুই থাকে না চিরদিন বেঁচে। কিছু না।
আজ যেখানে রয়েছে কুঁড়েঘর, উঠছে ধোঁয়া নড়ছে ফিরছে প্রাণী, কাল সেখানে গজিয়ে উঠবে বন, ঘন জঙ্গল। আবার মানুষ এসে ছেয়ে ফেলবে সেই বন-জঙ্গলকে। অদৃশ্য হয়ে যাবে বন। শুকিয়ে যাবে নদী। বৃথাই মানুষ আশা করে যে তার সন্তান-সন্ততির মধ্যে সে থাকবে বেঁচে। বড় বড় বংশ অদৃশ্য হয়ে যায়, লুপ্ত হয়ে যায়, সূর্যের আলোয় লুপ্ত হয়ে যায় যেমন কুয়াসা।
একমাত্র শুধু ঐ বুড়ো সূর্য, লুলু তার নাম, প্রতিদিন সে-ই থাকে বেঁচে, প্রতিদিন সমান তাজা, অক্ষয় তার যৌবন; আজও আছে, কালও থাকবে, জগতের সব মৃত্যুর ওপর সে শুধু একমাত্র জেগে আছে জীবন্ত প্রহরী। তেমনি সোনার বরণ, তেমনি আলোময়, তেমনি পরোপকারী। একজনকে ছাড়া, বিরাট সৃষ্টিতে সে আর কাউকে ভয় করে না। সে হলো ‘আইলু’, চাঁদ। চাঁদের আসবার সময় হলেই, সে তাই গা ঢাকা দেয়।