বিষয়বস্তুতে চলুন

কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


অষ্টম পরিচ্ছেদ

শ্বশুরালয়

তাহার পরদিন সন্ধ্যাবেলা, খেতু ব্যাঘ্রের রূপ ধরিয়া কঙ্কাবতীকে তাঁহার পিঠে চড়িতে বলিলেন। অট্টালিকা হইতে অনেকগুলি টাকাকড়ি লইয়। কঙ্কাবতীকে দিলেন, আর বলিলেন যে,— “এই টাকাগুলি তোমার মাতা, পিতা, ভাই ও ভগিনীদিগকে দিবে।”

 অট্টালিকা হইতে বাহির হইয়া দুইজনে অন্ধকারময় সুড়ঙ্গের পথে চলিলেন। সুড়ঙ্গ হইতে বাহির হইবার সময় খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! চক্ষু মুদ্রিত কর। যতক্ষণ না বলি, ততক্ষণ চক্ষু চাহিও না।”

 কঙ্কাবতী চক্ষু বুজিলেন। পুনরায় সেই বিকট হাসি শুনিতে পাইলেন। সেই ভয়াবহ হাসি শুনিয়া আতঙ্কে তাহার শরীর শিহরিয়া উঠিল।

 সুড়ঙ্গের বাহিরে আসিয়া, বনের ভিতর প্রবেশ করিয়া খেতু কঙ্কাবতীকে চক্ষু চাহিতে বলিলেন। ব্যাঘ্র দ্রুতবেগে গ্রামের দিকে ছুটিল। প্রায় একপ্রহর রাত্রির সময়, ঝি-জামাতা, তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন।

 কঙ্কাবতীকে পাইয়া কঙ্কাবতীর মা যেন স্বৰ্গ হাত বাড়াইয়া পাইলেন। কঙ্কাবতীর ভগিনীগণও কঙ্কাবতীকে দেখিয়া পরম সুখী হইলেন। অনেক টাকা-মোহর দিয়া ব্যাঘ্র, তনু রায়কে নমস্কার করিলেন। শ্যালককেও তিনি অনেক টাকাকড়ি দিলেন। ব্যাঘ্রের আদর রাখিতে আর স্থান হয় না!

 মা, পঞ্চোপচারে কঙ্কাবতীকে আহারাদি করাইলেন। তনু রায়ের ভাবনা হইল,— “জামাতাকে কি আহার করিতে দিই?”

 অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া, মনে মনে বিচার করিয়া, তনু রায় বলিলেন,— “বাবাজি! এত পথ আসিয়াছ, ক্ষুধা অবশ্যই পাইয়াছে। কিন্তু আমাদের ঘরে কেবল ভাত-ব্যঞ্জন আছে, আর কিছুই নাই। ভাত-ব্যঞ্জন কিছু তোমার খাদ্য নয়। তাই ভাবিতেছি,— তোমাকে খাইতে দিই কি? তা, তুমি এক কর্ম্ম কর। আমার গোয়ালে একটি বৃদ্ধা গাভী আছে। সময়ে সে দুগ্ধবতী গাভী ছিল। এখন তাহার বৎস হয় না, এখন আর সে দুধ দেয় না। বৃথা কেবল বসিয়া খাইতেছে। তুমি সেই গাভীটিকে আহার কর। তাহা হইলে, তোমার উদর পূর্ণ হইবে; আমারও জামাতাকে আদর করা হইবে। আর মিছামিছি আমাকে খড় যোগাইতে হইবে না।”

 ব্যাঘ্র বলিলেন,— “না মহাশয়! আজ দিনের বেলায় আমি উত্তমরূপে আহার করিয়াছি। এখন আর আমার ক্ষুধা নাই;—গাভীটি এখন আমি আহার করিতে পারিব না।

 তনু রায় বলিলেন,— “আচ্ছা! যদি তুমি গাভীটি না খাও, তাহা হইলে না হয়, আর একটি কাজ কর। তুমি নিরঞ্জন কবিরত্নকে খাও। তাহার সহিত আমার চিরবিবাদ। সে শাস্ত্র জানে না, তবু আমার সহিত তর্ক করে। তাহাকে আমি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারি না। সে এ-গ্রাম হইতে এখন উঠিয়া গিয়াছে। এখান হইতে ছয় ক্রোশ দূরে মামার বাড়ীতে গিয়া আছে! আমি তোমায় সব সন্ধান বলিয়া দিতেছি। তুমি স্বচ্ছন্দে গিয়া তাহাকে খাইয়া আইস।”

 ব্যাঘ্র উত্তর করিল,— “না মহাশয়! আজ রাত্রিতে আমার কিছুমাত্র ক্ষুধা নাই। আজ রাত্রিতে আমি নিরঞ্জন কবিরত্নকে খাইতে পারিব না।”

 তনু রায় পুনর্ব্বার বলিলেন,— “আচ্ছা ততদূর যদি না যাইতে পার, তবে এই গ্রামেই তোমার আমি খাবার ঠিক করিয়া দিতেছি। এই গ্রামে এক গোয়ালিনী আছে। মাগী বড় দুষ্ট! দু'বেলা আসিয়া আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। তোমাকে কন্যা দিয়াছি বলিয়া মাগী আমাকে যা নয় তাই বলে। মাগী আমাকে বলে,— 'অল্পায়ু, বুড়ো, ডেকরা। টাকা নিয়ে কি না বাঘকে মেয়ে বেচে খেলি!' তুমি আমার জামাতা, ইহার একটা প্রতিকার তোমাকে করিতে হইবে। তুমি তার ঘাড়টি ভাঙ্গিয়া রক্ত খাও। তার রক্ত ভাল, খাইয়া তৃপ্তিলাভ করিবে।”

 ব্যাঘ বলিল,— “না মহাশয় আজ আমি কিছু খাইতে পারিব না, আজ ক্ষুধা নাই।”

 তনু রায় ভাবিলেন,— “জামাতারা কিছু লজ্জাশীল হন। বারবার ‘খাও খাও’ বলিতে হয়, তবে কিছু খান। খাইতে বসিয়া ‘এটি খাও, ওটি খাও, আর একটু খাও' এইরূপে পাঁচজনে বারবার না বলিলে, জামাতারা পেট ভরিয়া আহার করেন না। পাতে সব ফেলিয়া উঠিয়া যান। এদিকে জঠরানল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে, ওদিকে মুখে বলেন,— 'আর ক্ষুধা নাই, আর খাইতে পারি না।' জামাতাদিগের রীতি এই।”

 এইরূপ চিন্তা করিয়া, তনু রায় আবার বলিলেন,— “শ্বশুরবাড়ী আসিয়া কিছু না খাওয়া কি ভাল? লোকে আমার নিন্দা করিবে। পাড়ার লোকগুলির কথা তোমাকে আর কি পরিচয় দিব! পাড়ার মেয়ে-পুরুষগুলি এক একটি সব অবতার! তামাসা দেখিতে খুব প্রস্তুত। পরের ভাল একটু দেখিতে পারেন না। তুমি আমার জামাতা হইয়াছ, যাহা হউক, তোমার দু’পয়সা সঙ্গতি আছে, এই হিংসায় সকলে ফাটিয়া মরিতেছেন। এখনি কা’ল সকালে বলিবেন যে, তনু রায়ের জামাতা আসিয়াছিল, 'তনু রায় জামাতার কিছুমাত্র আদর করে নাই, একফোঁটা জল পর্য্যন্ত খাইতে দেয় নাই।' সেইজন্য কিছু খাইতে তোমাকে বারবার অনুরোধ করিতেছি। চল, গোয়ালিনীর ঘর তোমাকে দেখাইয়া দিই। সে দুধ-ঘি খায়? মাংস তাহার কোমল। তাহার মাংস তোমার মুখে ভাল লাগিবে। খাইয়া তৃপ্তিলাভ করিবে। মন্দ দ্রব্য কি তোমাকে খাইতে বলিতে পারি?”

 ব্যাঘ্র উত্তর করিল,— “এবার আমাকে ক্ষমা করুন। এইবার যখন আসিব, তখন দেখা যাইবে।”

 তনু রায় মনে মনে কিছু ক্ষুন্ন হইলেন। জামাতা আদরের সামগ্রী। প্রাণ ভরিয়া আদর করিতে না পারিলে শ্বশুর-শাশুড়ীর মনে ক্লেশ হয়। তিনি তিনটি সুখাদ্যের কথা বলিলেন, জামাতা কিন্তু একটিও খাইলেন না। তাহাতে ক্ষুন্ন হইবার কথা।

 তনু রায় বলিলেন,— “শ্বশুরবাড়ীতে এরূপ খাইয়া-দাইয়া আসিতে নাই। শ্বশুর-শাশুড়ীর মন তাহাতে বুঝিবে কেন? জামাতা কিছু না খাইলে শ্বশুর-শাশুড়ীর মনে দুঃখ হয়। এই আজ তুমি কিছু খাইলে না, সেজন্য তোমার শাশুড়ীঠাকুরাণী আমাকে কত বকিবেন। তিনি বলিবেন,— 'তুমি জামাতাকে ভাল করিয়া বল নাই, তাই জামাতা আহার করিলেন না।' আবার যখন আসিবে, তখন আহারাদি করিয়া এস না। এইখানে আসিয়া আহার করিবে। তোমার জন্য এই তিনটি খাদ্যসামগ্রী আমি ঠিক করিয়া রাখিলাম। এবার আসিয়া একেবারেই তিনটিকে খাইতে হইবে। যদি না খাও, তাহা হইলে বনে যাইতে দিব না, তোমার চাদর ও ছাতি লুকাইয়া রাখিব। না না! ও কথা নয়; তোমার যে আবার ছাতি কি চাদর নাই। যদি না খাও, তাহা হইলে তোমার উপর আমি রাগ করিব।”

 কঙ্কাবতী, সমস্ত রাত্রি মা ও ভগিনীদিগের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলেন। ব্যাঘ্র প্রকৃত কে, তাহা মাতাকে বলিলেন। আর দুই মাস পরে তাঁহারা যে বিপুল ঐশ্বর্য্য লইয়া দেশে আসিবেন, তাহাও মাতাকে বলিলেন।  তনু রায়, একবার কঙ্কাবতীকে ডাকিয়া চুপি-চুপি বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! বোধ হইতেছে যে, জামাতা আমার প্রকৃত ব্যাঘ্র নন। বনের শিকড় মাথায় দিয়া মানুষে যে, সেই বাঘ হয়, ইনি বোধ হয়, তাই! আমি ইহাকে নানারূপ সুখাদ্য খাইতে বলিলাম। আমার গোয়ালের বুড়ো গরুটিকে খাইতে বলিলাম, নিরঞ্জনকে খাইতে বলিলাম, গোয়ালিনীকে খাইতে বলিলাম, কিন্তু ইনি ইহার একটিকেও খাইলেন না। যথার্থ বাঘ হইলে কি এসব লোভ সামলাইতে পারিতেন? তাই আমার বোধ হইতেছে, ইনি প্রকৃত বাঘ নন। তুমি দেখিও দেখি? ইঁহার মাথায় কোনওরূপ শিকড় আছে কি না? যদি শিকড় পাও, তাহা হইলে সেই শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিবে। যদি লোকে মন্দ করিয়া থাকে, তো শিকড়টি পোড়াইলে ভাল হইয়া যাইবে। যে কারণেই কেন বাঘ হইয়া থাকুন না, শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিলেই সব ভাল হইয়া যাইবে। তখন পুনরায় মানুষ হইয়া ইনি লোকালয়ে আসিবেন।”

 পিতার এই উপদেশ পাইয়া কঙ্কাবতী যখন পুনরায় মা'র নিকট আসিলেন, তখন মা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “উনি তোমাকে চুপি-চুপি কি বলিলেন?”

 পিতা যেরূপ উপদেশ দিলেন, কঙ্কাবতী সে সমস্ত কথা মার নিকট ব্যক্ত করিলেন।

 মা সেই কথা শুনিয়া বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি একাজ কখনও করিবে না। করিলে নিশ্চয় মন্দ হইবে। খেতু অতি ধীর ও সুবুদ্ধি। খেতু যাহা করিতেছেন, তাহা ভালর জন্যই করিতেছেন। খেতুর আজ্ঞা তুমি কোনমতেই অমান্য করিও না। সাবধান, কঙ্কাবতী! আমি যাহা বলিলাম, মনে যেন থাকে!”

 রাত্রি অবসান প্রায় হইলে, খেতু ও কঙ্কাবতী পুনরায় খেতু পূর্ব্বের মত কঙ্কাবতীকে চক্ষু বুজিতে বলিলেন, সুড়ঙ্গ দ্বারে পূর্ব্বের মত কঙ্কাবতী সেই বিকট হাসি শুনিলেন। অট্টালিকায় উপস্থিত হইয়া পূর্ব্বের মত ইহারা দিনযাপন করিতে লাগিলেন।