কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


অষ্টম পরিচ্ছেদ

বালক-বালিকা

কলিকাতায় গিয়া খেতু ভালরূপে লেখাপড়া করিতে লাগিলেন। শান্ত, শিষ্ট, সুবুদ্ধি। খেতুর নানা গুণ দেখিয়া সকলে তাহাকে ভালবাসিতেন।

 রামহরির এক্ষণে কেবল একটি শিশুপুত্র, তাহার নাম নরহরি। তিন বৎসর পরে একটি কন্যা হয়; তাহার নাম হইল সীতা।

 রামহরি ও রামহরির স্ত্রী, খেতুকে আপনাদিগের ছেলের চেয়ে অধিক স্নেহ করিতেন। খেতুর প্রখর বুদ্ধি দেখিয়া স্কুলে সকলেই বিস্মিত হইলেন। খেতু সকল কথা বুঝিতে পারেন, সকল কথা মনে করিয়া রাখিতে পারেন। যখন যে শ্রেণীতে পড়েন, তখন সেই শ্রেণীর সর্ব্বোত্তম বালক—খেতু; খেতুর উপর কেহ উঠিতে পারে না। যখন যে কয়খানি পুস্তক পড়েন, তাহার ভিতর হইতে প্রশ্ন করিয়া খেতুকে ঠকানো ভার। এইরূপে খেতু এক শ্রেণী হইতে অপর শ্রেণীতে উঠিতে লাগিলেন।

 জল খাইবার নিমিত্ত রামহরি খেতুকে একটি করিয়া পয়সা দিতেন; খেতু কোনও দিন খাইতেন, কোনও দিন খাইতেন না। কি করিয়া রামহরি এই কথা জানিতে পারিলেন।

 খেতুকে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন,— “খেতু! তুমি জল খাও না কেন? পয়সা লইয়া কি কর?”

 খেতু কিছু অপ্রতিভ হইলেন, একটুখানি চুপ করিয়া উত্তর করিলেন,— “দাদামহাশয়! যেদিন বড় ক্ষুধা পায়, যেদিন আর থাকিতে পারি না, সেই দিন জল খাই; যেদিন না খাইয়া থাকিতে পারি, সেইদিন আর খাই না। যা পয়সা বাঁচিয়াছে, তাহা আমার কাছে আছে। যখন মার নিকট হইতে আসি, তখন মাকে বলিয়াছিলাম যে, মা! তোমার জন্য আমি একছড়া মালা কিনিয়া আনিব; সেইজন্য এই পয়সা রাখিতেছি।”

 যখন এই কথা হইতেছিল, তখন রামহরির নিকট খেতু দাঁড়াইয়াছিলেন। রামহরি খেতুর মাথায় হাত দিয়া সম্মুখের চুলগুলি পশ্চাৎদিকে ফিরাইতে লাগিলেন। খেতু বুঝিলেন, দাদা রাগ করেন নাই, আদর করিতেছেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে রামহরি বলিলেন,— “খেতু! যখন মালা কিনিবে আমাকে বলিও, আমি ভাল মালা কিনিয়া দিব।”

 পূজার ছুটি নিকট হইল। তখন খেতু বলিলেন,— “দাদা মহাশয়! কৈ, এইবার মালা কিনিয়া দিন?”

 রামহরি বলিলেন,— “তোমার কতগুলি পয়সা হইয়াছে, নিয়ে এস, দেখি?”

 খেতু পয়সাগুলি আনিয়া দাদার হাতে দিলেন। রামহরি গণিয়া দেখিলেন যে, এক টাকারও অধিক পয়সা হইয়াছে। আট আনা দিয়া রামহরি একছড়া ভাল রুদ্রাক্ষের মালা কিনিয়া, বাকি পয়সাগুলি খেতুকে ফিরাইয়া দিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “দাদা মহাশয়! আমি এ পয়সা লইয়া আর কি করিব? এ পয়সা আপনি নিন।”

 রামহরি উত্তর করিলেন,— “না খেতু।মাকে দিও, তোমার মা কত আহ্লাদ করিবেন।”

 বাড়ী যাইবার দিন নিকট হইল। এখানে খেতুর মনে, আর সেখানে মার মনে আনন্দ আর ধরে না। তসর ও গালার ব্যবসায়ীর সকলে এখন দেশে যাইতেছিলেন। তাহাদের সহিত রামহরি খেতুকে পাঠাইয়া দিলেন, আর কবে কোন সময়ে দেশে পৌঁছিবেন, সে সমাচার আগে থাকিতে খেতুর মাকে লিখিলেন।

 দত্তদের পুকুরধারে কেন? খেতুর মা আরও অনেক দূরে গিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। দূর হইতে খেতু মাকে দেখিতে পাইয়া ছুটিয়া গিয়া তাঁহাকে ধরিলেন। খেতুর মা, ছেলেকে বুকে করিয়া স্বর্গসুখ লাভ করিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “ঐ যা! মা! আমি তোমাকে প্রণাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছি।”

 মা উত্তর করিলেন,— “থাক, আর প্রণামে কাজ নাই। অমনি তোমাকে আশীর্ব্বাদ করি, তুমি চিরজীবী হও, তোমার সোনার দোয়াত-কলম হউক।”

 খেতু বলিলেন,— ‘মা! আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি দত্তদের পুকুরধারে থাকিবে, এত দূরে আসিবে, তা’ জানিতাম না!”

 মা বলিলেন,— “বাছা! যদি উপায় থাকিত, তো আমি কলিকাতা পর্য্যন্ত যাইতাম। খেতু! তুমি রোগী হইয়া গিয়োছ।”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “না মা! রোগা হই নাই, পথে একটু কষ্ট হইয়াছে, তাই রোগা-রোগা দেখাইতেছে। মা! এখন আমি হাঁটিয়া যাই, এতদূর তুমি আমাকে লইয়া যাইতে পরিবে না।”

 মা বলিলেন,— “না না, আমি তোমাকে কোলে করিয়া লইয়া যাইব।” কোলে যাইতে যাইতে খেতু পয়সাগুলি চুপিচুপি মা'র আচলে বাধিয়া দিলেন। বাড়ী যাইয়া যখন খেতু মা'র কোল হইতে নামিলেন, তখন মা'র আঁচল ভারি ঠেকিল।”

 মা বলিলেন,— “এ আবার কি? খেতু! তুমি বুঝি আমার আঁচলে পয়সা বঁধিয়া দিলে?”

 খেতু হাসিয়া উঠিলেন আর বলিলেন,— “মা! রও, তোমাকে আবার একটা তামাসা দেখাই।”

 এই বলিয়া খেতু মালা-ছড়াটি মা'র গলায় দিয়া দিলেন, আর বলিলেন,— “কেমন মা! মনে আছে তো?”

 মা খেতুর গালে ঈষৎ ঠোনা মারিয়া বলিলেন,— “ভারি দুষ্ট ছেলে!” খেতু হাসিয়া উঠিলেন, মাও হাসিলেন।

 পরদিন খেতু দেখিলেন যে, তাঁহাদের বাটীতে কোথা হইতে একটি ছোট মেয়ে আসিয়াছে। খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা! ও মেয়েটি কাদের গা?”

 মা বলিলেন,— “জান না? ও যে তোমার তনু কাকার ছোটমেয়ে! ওর নাম কঙ্কাবতী। তনু রায়ের স্ত্রী এখন সর্ব্বদাই আমার নিকট আসেন। আমি পৈতা কাটি, আর দুই জনে বসিয়া গল্পগাছা করি। মেয়েটিকে তিনি আমার কাছে মাঝে মাঝে ছড়িয়া যান। মেয়েটি আপনার মনে খেলা করে, কোনও রূপ উপদ্রব করে না। আমার কাছে থাকিতে ভালবাসে।”

 তনু রায়ের সহিত খেতুর কোন সম্পর্ক নাই, কেবল পাড়া-প্রতিবাসী, সুবাদে কাকা কাকা বলিয়া ডাকেন।

 কঙ্কাবতীকে খেতু বলিলেন,— “এস, এই দিকে এস।”

 কঙ্কাবতী সেইদিকে যাইতে লাগিল। খেতু বলিলেন,— “দেখ দেখ, মা! কেমন এ টল-টল করিয়া চলে!"

 খেতুর মা বলিলেন,— “পা এখনও শক্ত হয় নাই।”

 একটি পাতা দেখাইয়া খেতু বলিলেন,— “এই নাও।”

 পাতাটি লাইবার নিমিত্ত কঙ্কাবতী হাত বাড়াইল ও হাসিল।

 খেতু বলিলেন,— “মা! কেমন হাসে দেখ?”

 মা উত্তর করিলেন,— “হঁ বাছা! মেয়েটি খুব হাসে, কাঁদিতে একেবারে জানে না, অতি শান্ত।”

 খেতু বলিলেন,— “মা! আগে যদি জানিতাম, তো ইহার জন্য একটি পুতুল কিনিয়া আনিতাম।”

 মা বলিলেন,— “এইবার যখন আসিবে, তখন আনিও।”