কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/নবম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


নবম পরিচ্ছেদ

মেনী

পূজার ছুটি ফুরাইলে, খেতু কলিকাতায় যাইলেন; সেখানে অতি মনোযোগের সহিত লেখাপড়া করিতে লাগিলেন। বৎসরের মধ্যে দুইবার ছুটি হইলে তিনি বাটী আসেন। সেই সময় মার জন্য কোনও না কোনও দ্রব্য, আর কঙ্কাবতীর জন্য পুতুলটি খেলনাটি লইয়া আসেন। খেতুর মার নিকট কঙ্কাবতী সর্ব্বদাই থাকে, কঙ্কাবতীকে তিনি বড় ভালবাসেন।

 খেতুর যখন বার বৎসর বয়স, তখন তিনি একটি বড়মানুষের ছেলেকে পড়াইতে লাগিলেন। বালকের পিতা খেতুকে মাসে পাঁচ টাকা করিয়া দিতেন।

 প্রথম মাসের টাকা কয়টি খেতু, রামহরির হাতে দিয়া বলিলেন, “দাদা মহাশয়! এ মাস হইতে মার চাউলের দাম আর আপনি দিবেন না, এই টাকা মাকে দিবেন। আমি শুনিয়াছি, আপনার ধার হইয়াছে, তাই যত্ন করিয়া আমি এই টাকা উপার্জ্জন করিয়াছি।”

 রামহরি বলিলেন,— “খেতু! তুমি উত্তম করিয়াছ। উদ্যম, উৎসাহ, পৌরুষ মনুষ্যের নিতান্ত প্রয়োজন। এ টাকা আমি তোমার মার নিকট পাঠাইয়া দিব। তাঁহাকে লিখিব যে, তুমি নিজে এ টাকা উপার্জ্জন করিয়াছ। আর আমি সকলকে বলিব যে, দ্বাদশ বৎসরের শিশু আমাদের খেতু, তাহার মাকে প্রতিপালন করিতেছে।”

 এইবার যখন খেতু বাটী আসিলেন, তখন মার নামাবলী, আর কঙ্কাবতীর জন্য একখানি রাঙ্গা কাপড় আনিলেন। রাঙ্গা কাপড় পাইয়া কঙ্কাবতীর আর আহাদী ধরে না। ছুটিয়া তাহার মাকে দেখাইতে যাইলেন।

 খেতু বলিলেন,— “মা! কঙ্কাবতীকে লেখাপড়া শিখাইলে হয় না?”

 মা বলিলেন,— “কি জানি বাছা! তনু রায় একপ্রকারের লোক। কি বলিতে কি বলিয়া বসিবে।”

 খেতু বলিলেন,— “তাতে আর দোষ কি, মা? কলিকাতায় কত মেয়ে স্কুলে যায়।”

 মা বলিলেন,— “কঙ্কাবতীর মাকে একথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিব।”

 সেইদিন তনু রায়ের স্ত্রী আসিলে, খেতুর মা কথায় কথায় বলিলেন,— “খেতু বলিতেছে— ‘এবার যখন বাটী আসিব, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি বই আনিব, কঙ্কাবতীকে একটু একটু পড়িতে শিখাইব।’ আমি বলিলাম— 'না বাছা! তাতে আর কাজ নাই, তোমার তনু কাকা হয়তো রাগ করিবেন।”

 তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,— “তাতে আবার রাগ কি, আজকাল তো ঐ সব হইয়াছে। জামা গায়ে দেওয়া, লেখাপড়া করা, আজকাল তো সকল মেয়েই করে! তবে আমাদের পাড়াগা তাই, এখানে ও-সব নাই।”

 বাটী গিয়া কঙ্কাবতীর মা স্বামীকে বলিলেন,— “খেতু বাড়ী আসিয়াছে। কঙ্কাবতীর জন্য কেমন একখানি রাঙ্গা কাপড় আনিয়াছে!”

 তনু রায় বলিলেন, — “খেতু ছেলেটি ভাল। লেখাপড়ায় মন আছে। দু’পয়সা আনিয়া খাইতে পরিবে। তবে বাপের মত ডোক্লা না হয়।”

 স্ত্রী বলিলেন,— “খেতু বলিতেছিল যে, এইবার যখন বাটী আসিব, তখন একখানি বই আনিয়া কঙ্কাবতীকে একটু একটু পড়িতে শিখাইব।”

 তনু রায় বলিলেন,— “স্ত্রীলোকের আবার লেখাপড়া কেন? লেখাপড়া শিখিয়া আর কাজ নাই।”

 না বুঝিয়া তনু রায় এই কথাটি বলিয়া ফেলিলেন। কিন্তু যখন তিনি স্থিরভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, তখন বুঝিতে পারিলেন যে, লেখাপড়ার অনেক গুণ আছে।

 আজকালের বরেরা শিক্ষিতা কন্যাকে বিবাহ করিতে ভালবাসে। এরূপ কন্যার আদর হয়, মূল্যও অধিক হয়।

 তবে কথা এই—কাজটি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কি না? শাস্ত্রসম্মত না হইলে তনু রায় কখনই মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইতে দিবেন না। মনে মনে তনু রায় শাস্ত্রবিচার করিতে লাগিলেন।

 বিচার করিয়া দেখিলেন যে, স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ বটে, তবে এ নিষেধটি সত্য ত্রেতা দ্বাপর যুগের নিমিত্ত, কলিকালের জন্য নয়। পূর্ব্বকালে যাহা করিতে ছিল, এখন তাহা করিতে নাই। তাহার দৃষ্টান্ত, নরমেধযজ্ঞ। এখন মানুষ বলি দিলে ফাঁসি যাইতে হয়। আর এক দৃষ্টান্ত—সমুদ্রযাত্রা এখন করিলে জাতি যায়।

 তাই তনু রায়ের মা যখন জীবিত ছিলেন, তখন তিনি একবার সাগর যাইতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তনু রায় কিছুতেই পাঠান নাই।

 মাকে তিনি বুঝাইয়া বলিলেন,— “মা! সাগর যাইতে নাই। সমুদ্রযাত্রা একেবারে নিষিদ্ধ। শাস্ত্রের সঙ্গে আর সমুদ্রের সঙ্গে ঘোরতর আড়ি। সমুদ্র দেখিলে পাপ, সমুদ্র ছুইলে পাপ। কেন মা পয়সা খরচ করিয়া পাপের ভার কিনিয়া আনিবে? কেন মা জাতি-কুল বিসৰ্জ্জন দিয়া আসিবো?”

 এক্ষণে তনু রায় বিচার করিয়া দেখিলেন পূর্ব্বকালে যাহা করিতেছিল, এখন তাহা করিতে নাই। সুতরাং পূর্ব্বকালে যাহা করিতে মানা ছিল, এখন তাহা লোকে স্বচ্ছন্দে করিতে পারে। স্ত্রীলোকদিগের লেখাপড়া শিক্ষা করা পর্ব্বে মানা ছিল, তাই এখন তাহাতে কোনও রূপ দোষ হইতে পারে না।

 শাস্ত্রকে তনু রায় এইরূপ ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া গড়িলেন। শাস্ত্রটি যখন মনের মতন গড়া হইল, তখন তিনি স্ত্রীকে বলিলেন,— “আচ্ছা! খেতু যদি কঙ্কাবতীকে একটু-আধটু পড়িতে শিখায়, তাহাতে আমার বিশেষ কোনও আপত্তি নাই।”

 তনু রায়ের স্ত্রী সেই কথা খেতুর মাকে বলিলেন। খেতুর মা সেই কথা খেতুকে বলিলেন। এবার যখন খেতু বাড়ী আসিলেন, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি প্রথমভাগ বর্ণপরিচয় আনিলেন। “লেখাপড়া শিখিব”, এই কথা মনে করিয়া প্রথম প্রথম কঙ্কাবতীর খুব আহ্লাদ হইল।

 কিন্তু দুই-চারিদিন পরেই তিনি জানিতে পারিলেন যে, লেখাপড়া শিক্ষা করা নিতান্ত আমোদের কথা নহে। কঙ্কাবতীর চক্ষে অক্ষরগুলি সব একপ্রকার দেখায়। কঙ্কাবতী এটি বলিতে সেটি বলিয়া ফেলেন।

 খেতুর রাগ হইল। খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তোমার লেখাপড়া হইবে না। চিরকাল তুমি মূর্খ হইয়া থাকিবে।”

 কঙ্কাবতী অভিমানে কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি বলিলেন,— “আমি কি করিব, আমার যে মনে থাকে না?”

 খেতুর মা বলিলেন,— “ছেলেমানুষকে কি বকিতে আছে? মিষ্টকথা বলিয়া শিখাইতে হয়! এস, মা! তুমি আমার কাছে এস! তোমার আর লেখাপড়া শিখিতে হইবে না।”


 খেতু বলিলেন,— “মা! কঙ্কাবতী রাত্রি-দিন মেনীকে লইয়া থাকে। তাতে কি আর লেখাপড়া হয়?”

 মেনী কঙ্কাবতীর বিড়াল। অতি আদরের ধন মেনী।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “জেঠাইমা! আমি মেনীকে ক-খ শিখাই; তা আমিও যেমনি বোকা, মেনীও তেমনি বোকা; কেমন মেনী, না? মেনীও পড়িতে পারে না, আমিও পড়িতে পারি না। আমিও ছেলেমানুষ, মেনীও ছেলেমানুষ। আমিও বড় হইলে পড়িতে শিখিব, মেনীও বড় হইলে পড়িতে শিখিবে। না মেনী?”

 খেতু হাসিয়া উঠিলেন। খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি পাগল নাকি?”

 যাহা হউক, ক্রমে কঙ্কাবতীর প্রথমভাগ বর্ণ-পরিচয় সায় হইল।

 খেতু বলিলেন,— “আমি শীঘ্র কলিকাতায় যাইব। তাড়াতাড়ি করিয়া প্রথমভাগখানি শেষ করিলাম, কিন্তু ভাল করিয়া হইল না। এই কয় মাসে পুস্তকখানি একেবারে মুখস্থ করিয়া রাখিবে। এবার আমি দ্বিতীয়ভাগ লইয়া আসিব।”

 পুনরায় যখন খেতু বাটী আসিলেন, তখন কঙ্কাবতীর দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইল। কঙ্কাবতীকে আর পড়াইতে হইল না। কঙ্কাবতী এখন আপনা-আপনি সব পড়িতে শিখিলেন। খেতু কঙ্কাবতীকে একখানি পাটীগণিত দিয়াছিলেন। তাহা দেখিয়া কঙ্কাবতী অঙ্ক শিখিলেন। মাঝে মাঝে খেতু কেবল একটু-আধটু বসিয়া বলিয়া দিতেন।

 কঙ্কাবতী পড়িতে বড় ভালবাসিতেন। কলিকাতা হইতে খেতু, তাহাকে নানারূপ পুস্তক ও সংবাদপত্র পাঠাইয়া দিতেন। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনগুলি পর্যন্ত কঙ্কাবতী পড়িতেন।