কথামালা (১৯৪৪)/অশ্ব ও বৃদ্ধ কৃষক

উইকিসংকলন থেকে

অশ্ব ও বৃদ্ধ কৃষক।

এক কৃষকের এক টাটু ঘোড়া ছিল। সে, একদিন আপন পুত্রকে সঙ্গে লইয়া ঐ ঘোড়া বাজারে বেচিতে যাইতেছে। সে সময়ে ঐ পথ দিয়া কতকগুলি বালক হাস্য ও কৌতুক করিতে করিতে চলিয়া যাইতেছিল। তাহাদের মধ্যে একজন, কৃষক ও তাহার পুত্রের উল্লেখ করিয়া, আপনার সহচরদিগকে বলিল, “তোমরা ইহাদের মত নির্বোধ কখনও দেখ নাই। অনায়াসে ঘোড়ায় চড়িয়া যাইতে পারে; না যাইয়া আপনার। ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া যাইতেছে।”

 বৃদ্ধ, বালকের উপহাসবাক্য শুনিয়া, পুত্রকে ঘোড়ায় চড়াইয়া দিল, আপনি সঙ্গে সঙ্গে চলিল। পথের ধারে কয়েকজন বৃদ্ধ, কোনও বিষয়ে বাদানুবাদ করিতেছিলেন। তাহাদের মধ্যে একজন, কৃষকের পুত্রকে ঘোড়ায় চড়িয়া আর কৃষককে ঘোড়ার সঙ্গে হাঁটিয়া যাইতে দেখিয়া বলিলেন, “দেখ, আমি যাহা বলিতেছিলাম, তাহা যথার্থ কি না। এ কালে বৃদ্ধের সম্মান নাই; ঐ দেখ, বেটা ঘোড়ায় চড়িয়া যাইতেছে, আর বুড়া বাপ সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া যাইতেছেন।” এই বলিয়া, তিনি কৃষকের পুত্রকে ধমকাইয়া বলিলেন, “আরে পাপিষ্ঠ, বৃদ্ধ পিতা চলিয়া যাইতেছেন, আর তুই ঘোড়ায় চড়িয়া যাইতেছিস; তোর কিছুই বিবেচনা নাই?”

 কৃষকের পুত্র অতিশয় লজ্জিত হইল, এবং আপনি ঘোড়া হইতে নামিয়া, পিতাকে চড়াইয়া লইয়া চলিল। খানিক দূর গেলে পর কতকগুলি স্ত্রীলোক উপস্থিত হইল। তাহারা বলিল, “কে জানে এ মিন্সের কেমন আক্কেল; আপনি ঘোড়ায় চড়িয়া যাইতেছে, আর ছোট ছেলেটিকে হাঁটাইয়া লইয়া যাইতেছে।” বৃদ্ধ শুনিয়া লজ্জিত হইয়া, পুত্রকে ঘোড়ায় চড়াইয়া লইল॥ এইরূপে খানিক দূরে গেলে পর এক ব্যক্তি কৃষককে বলিল, “ওহে ভাই, তোমায় জিজ্ঞাসা করি, এ ঘোড়াটী কার?” কৃষক বলিল, “ও আমার ঘোড়া।” তখন সেই ব্যক্তি বলিল, “তোমার আচরণ দেখিয়া তোমার বলিয়া বোধ হইতেছে না। তোমার হইলে, তুমি উহার উপর এত নির্দয় হইতে না। কোন্ বিবেচনায়, এমন ছোট ঘোড়ার উপর দুইজনে চড়িয়া বসিয়াছ? ঘোড়াকে এতক্ষণ যেমন কষ্ট দিয়াছ, অতঃপর উহাকে কাঁধে করিয়া লইয়া যাওয়া উচিত।”

 এই ভৎর্সনা শুনিয়া, তাহারা পিতা পুত্রে ঘোড়া হইতে নামিল, দড়ি দিয়া ঘোড়ার পা বাঁধিল, এবং পায়ের ভিতরে বাঁশ দিয়া, কাঁধে করিয়া লইয়া চলিল। বাজারের নিকট একটি খাল ছিল। তাহারা ঐ খালের পুলের উপর উঠিলে, বাজারের লোকে এই তামাসা দেখিতে উপস্থিত হইল। মানুষে জীয়ন্ত ঘোড়া কাঁধে করিয়া লইয়া যাইতেছে, ইহা দেখিয়া, সকল লোকে এত হাসি তামাসা করিতে ও হাততালি দিতে লাগিল যে, ঘোড়া ভয় পাইয়া, জোর করিয়া, পায়ের দড়ি ছিঁড়িয়া ফেলিল, এবং দড়ি ছিঁঁড়িবা- মাত্র, খালের জলে পড়িয়া, অবিলম্বে প্রাণত্যাগ করিল।

 কৃষক লোকের ঠাট্টা তামাসায় যৎপরোনাস্তি বিরক্ত ও লজ্জিত হইল, এবং হতবুদ্ধি হইয়া, কিয়ৎক্ষণ সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। পরে, এই ভাবিতে ভাবিতে চলিয়া গেল, আমি সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পাইয়া, কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারিলাম না; লাভের মধ্যে ঘোড়াটি গেল।



কৌতুক-তামাসা, আমোদ, আহ্লাদ।
উপহাসবাক্য—ঠাট্টার কথা।
পাপিষ্ঠ—পাপী, পাপাচারী।
নির্দয়—দয়াশূন্য, নিষ্ঠুর।


সহচরদিগকে—সঙ্গীদিগকে।
বাদানুবাদ—তর্কবিতর্ক।
আক্কেল—বিবেচনা।
যৎপরোনাস্তি-যারপরনাই।