বিষয়বস্তুতে চলুন

কথা (১৯৩৮)/বন্দীবীর

উইকিসংকলন থেকে

বন্দীবীর

পঞ্চ নদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
জাগিয়া উঠিছে শিখ্ —
নির্মম নির্ভীক্।
হাজার কণ্ঠে গুরুজীর জয়
ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্।
নূতন জাগিয়া শিখ্,
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ্।

“অলখ নিরঞ্জন—”
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়-ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝঞ্ঝন্।
পাঞ্জাব আজি গরজি উঠিল
“অলখ নিরঞ্জন।”

এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে
না রাখে কাহারো ঋণ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
চিত্ত ভাবনাহীন।
পঞ্চ নদীর ঘেরি দশতীর
এসেছে সে এক দিন।

দিল্লী-প্রাসাদ-কূটে
হোথা বারবার বাদশাজাদার
তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।
কা’দের কণ্ঠে গগন মন্থে,
নিবিড় নিশীথ টুটে,
কা’দের মশালে আকাশের ভালে
আগুন উঠেছে ফুটে।

পঞ্চ নদীর তীরে
ভক্ত দেহের রক্তলহরী
মুক্ত হইল কিরে।
লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান
ছুটে যেন নিজ নীড়ে।
বীরগণ জননীরে
রক্ত তিলক ললাটে পরাল
পঞ্চ নদীর তীরে।


মোগল শিখের রণে
মরণ-আলিঙ্গনে
কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি
দুই জনা দুই জনে।
দংশন-ক্ষত শ্যেন বিহঙ্গ
যুঝে ভুজঙ্গ সনে।
সেদিন কঠিন রণে
“জয় গুরুজীর” হাঁকে শিখবীর
সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
“দীন দীন” গরজনে।

গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দা যখন বন্দী হইল
তুরাণী সেনার করে,
সিংহের মতো শৃঙ্খলগত
বাঁধি ল’য়ে গেল ধ’রে
দিল্লী নগর পরে।
বন্দা সমরে বন্দী হইল
গুরুদাসপুর গড়ে।


সম্মুখে চলে মোগল সৈন্য
উড়ায়ে পথের ধূলি,
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া
বর্ষাফলকে তুলি।
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে
বাজে শৃঙ্খলগুলি।
রাজপথ পরে লোক নাহি ধরে
বাতায়ন যায় খুলি।
শিখ গরজয় গুরুজীর জয়
পরানের ভয় ভুলি।
মোগল ও শিখে উড়াল আজিকে-
দিল্লী-পথের ধূলি।

পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান
তারি লাগি তাড়াতাড়ি।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে
বন্দীরা সারি সারি
“জয় গুরুজীর” কহি শত বীর
শত শির দেয় ডারি।

সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ
নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি
বন্দার এক ছেলে;
কহিল, ইহারে বধিতে হইবে
নিজ হাতে অবহেলে।
দিল তার কোলে ফেলে—
কিশোর কুমার বাঁধা বাহু তার
বন্দার এক ছেলে।

কিছু না কহিল বাণী,
বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে
লইল বক্ষে টানি।

ক্ষণকালতরে মাথার উপরে
রাখে দক্ষিণপাণি,
শুধু একবার চুম্বিল তার
রাঙা উষ্ণীষখানি।
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে
ছুরিকা খসায়ে আনি—
বালকের মুখ চাহি
“গুরুজীর জয়” কানে কানে কয়—
“রে পুত্র ভয় নাহি।”


নবীন বদনে অভয় কিরণ
জ্বলি উঠে উৎসাহি’—
কিশোরকণ্ঠে কাঁপে সভাতল
বালক উঠিল গাহি—
“গুরুজীর জয়, কিছু নাহি ভয়”
বন্দার মুখ চাহি।


বন্দা তখন বামবাহুপাশ
জড়াইল তার গলে,—
দক্ষিণ করে ছেলের বক্ষে
ছুরি বসাইল বলে—

গুরুজীর জয় কহিয়া বালক
লুটাল ধরণীতলে।

সভা হোলো নিস্তব্ধ।
বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক
সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ।
স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি
একটি কাতর শব্দ।
দর্শকজন মুদিল নয়ন,
সভা হোলো নিস্তব্ধ।

৩০শে,আশ্বিন, ১৩০৬