কবিতাকুসুমাঞ্জলি/কবিতা

উইকিসংকলন থেকে

কবিতা।

ওহে নিষাদ! কি ক্ষণে তুমি বকের মিথুনে,
বাণ হেনেছিলে, যুজি নিজ ধনুকের গুণে,
তাই রত্নাকর হতে পাই কবিতারতন,
যাহা রত্নাকরে নাহি মিলে করিলে সেচন।—
ওহে রত্নাকর! কিবা সৃষ্টি করেছ সংসারে,
যত বিধাতার সৃষ্টি রত্ন তার কাছে হারে।
কিবা কবিতা-কুসুম-বন করেছ সৃজন,
ধরে তার কাছে কত শোভা নন্দনকানন।
এই সুরম্য কাননে যত মানবভ্রমরে
যবে মনের আনন্দে মধুরস পান করে,
থাকে ভোর হয়ে ভাবে, তারা ভুলিয়া ভুবন,
আহা সেই মুখ সেই জানে, জেনেছে যে জন।
শুনি, কবিতা! সে মুনিমুখে জনম তোমার,
তাই বিমল আনন্দ দানে কর উপকার।
আহা কি সুন্দর ভাব-তব কবিতা সুন্দরি!
মরি, কিবা সুখ হয় শ্রুতিপূটে পান করি।
জানি, তোমার সে সূধারসে রসে যার মন,
ভাসে আনন্দ সাগরনীরে সদা সেই জন।

নাহি তোমা বিনা হেন ধন ভুবন ভিতরে,
যাহা সহৃদয় জনগণে সুশীতল করে।
আছে কে এমন জন, ভালবাসে না তোমায়?
যদি থাকে, তবে বলি তাকে পাষাণের প্রায়।
তুমি রসিকের হৃদয়ের পরম রতন,
তাই তোমায় পাইলে হয় পুলকিতমন।
নাহি অরসিক জন জানে তোমার আদর,
কভু মুকুতামণির মান বুঝে কি বানর?
তুমি যে কথা শুনাও সব সুধার সমান,
লোকে শুনি তাহা, হয় সুধারসে ভাসমান।
যবে রামের প্রণয়-কথা সীতার সহিত
শুনি তব মুখে, মন হয় আনন্দে মোহিত।
যবে শুনি সাবধানে তব করুণ বচন,
ঝরে ঝর ঝরে নীর মম নয়নে তখন,
কিন্তু অন্তরে পরমানন্দ-সন্দেহ না ধরে,
তব চিদানন্দময় রসে বাহ্যবোধ হরে।
যবে শুনাও আমারে, তুমি ভয়ঙ্কর রণে,
কত ভীমপরাক্রম বীর বীরবেশে রণে[১]

তারা মার মার রবে মারে পরস্পরে আসি,
পড়ে কারু কক্ষ, কারু বক্ষ কারু মুগু খসি।
বহে রক্তধারে নদী, শিবা ঘোর রবে[২] রবে,
উড়ে গগনে গৃধিনী সব আস্বাদিতে শরে।
শুনি ভয়ে ভীত হয়ে কাঁপে শরীর আমার,
কিন্তু অন্তরে সঞ্চরে কিবা আনন্দ অপার।
জান এমন বচন, যাহা করিলে শ্রবণ,
মনে আসে কত ভাব, আহা, জুড়ায় জীবন।
অহো! কি অদ্ভুত ভাব তব বলা নাহি যায়,
যাহা ভাবিলে বিস্ময়রসে মানসে ভাসায়।
নাহি হেরি হেন দানবীর করি অন্বেষণ,
কাটে স্বকরে সুতের শির, হাঁসি যেই জন,
দিয়া যাচকে খাইতে তাহ সহাস্যবদনে,
হয় দাতা কর্ণ নাম তার বিখ্যাত ভুবনে।
হল, বিরাটতনয় রখী, সারথি অর্জ্জুন,
যার সম বীর নাহি হেরি সমরে নিপুণ,
এল অসংখ্য কৌরবসেনা সম্মুখসমরে,
হেরি উত্তরের মুখে আর উত্তর না সরে।

কাপে থর থর অঙ্গ, ভয়ে বসিতে না পারে,
থাকে নয়ন মুদিত করি, চাহিবারে নারে,
বলে বাবারে মরিরে রথি! মোরে রক্ষাকর,
ওগো কে যাইবে এ সমরে কাঁপিছে অন্তর,
নাহি প্রয়োজন আর মম গোধনরক্ষণে,
আর নাহি পারি মহাশয়! বসিতে আসনে।
তব পায়ে ধরি দয়া করি মোরে ছাড়ি দেহ,
ওগো এ বিপত্তিকালে মম নাহি আর কেহ।
পরে রথিরে অস্থির হেরি সূত মহাশয়,
বলে কভু নাহি হেরি ছেন ক্ষত্রিয়তনয়,
রাখে দুই পদমাঝে তারে চাপিয়া তখন,
কাঁপে বলির পশুর প্রায় ধরিয়া চরণ,
শুনি উত্তরের বিবরণ তোমার বদনে,
মুখে হাঁসি আসে, হই কত আনন্দিত মনে।
যবে আমীরে লইয়া যাও শবের নিবাসে,
হেরি গলিত পাটিত শব মনে ঘৃণা আসে!
তার পূতিগন্ধে গায় গন্ধ হয় সবাকার,
থাকি নাসায় বসন দিয়া তবু থাকা ভার।
তথা শৃগাল কুক্কুর আর গৃধিনী শকুনি,
সবে শব ধরে টানে কত করয়ে মাতুনি।

শির পাকসাট মারি করে কুক্কুরে প্রহার,
আসে ঘুরে ঘুরে শবলোভে তাহারা আবার।
সব শকুনি শবের অস্ত্র টানাটানি করে,
করে ক্রিমিকুল কিলবিল শবের ভিতরে।
যদি অকস্মাৎ কেহ তথা উপনীত হয়,
হয় তখনি তাহার বমি নাহিক সংশয়।
কিন্তু শুনিলে তোমার মুখে বর্ণন তাহার,
আহা! কত সুখোদয় হয় অন্তরে সবার।
অতিপ্রচণ্ডমার্ত্তণ্ডসম ভীম ভীম বীর
ক্রোধে ওষ্ঠাধর কাঁপে আর সমস্ত শরীর,
যেন দুই চক্ষু জবাবর্ণ ঘূর্ণিত নিয়ত,
কোপে বিপক্ষের প্রতি কহে কটুকথা কত।
যবে ঘোরতর ধ্বান্তময় নিশীথ সময়ে
ভ্রমে বনমাঝে দময়ন্তী পতিহারা হয়ে;
যত হিংস্রকুলে সমাকুল দেখিয়া কানন,
ভয়ে মলিন হইল তাঁর কমল বদন।
কবে অসার সংসারে আর বাসনা না রবে,
কবে সকল ভূতের প্রতি সমদৃষ্টি হবে,
কবে মোহনিদ্রা যাবে আমি হব সচেতন,
কবে পুণ্যবনে মহানন্দে করিব ভ্রমণ;

কবে গগন-বিতানতলে পাষাণশয়নে,
সুখে শয়ন করিব আমি পরিত্র কামনে;
কবে স্বকরে করিব পান নির্ঝরের জল,
কবে ক্ষুধাশান্তি হবে মম খেয়ে বনফল;
কবে বৃক্ষছাল পরি, তাঁরে করিব চিন্তন,
যিনি অখিল বিশ্বের পতি পতিতপাবন।
যবে কবিতা! একথা শুনি তোমার বদনে,
বহে আনন্দসলিলধারা আমার নয়নে।
দুই শব্দ আর অর্থ হয় আকৃতি তোমার,
তাহে শোভে বিচিত্রতারূপ নানা অলঙ্কার।
অয়ি গুণবতি![৩] হয়ে তুমি সজীবন রসে,[৪]
সুখে সতত বসতি কর রসিকমানসে।

  1. রণে যুদ্ধ করে।
  2. রবে রব করে।
  3. গুণবতি! হে প্রসাদাদিগুণসম্পন্নে।
  4. রসে রসদ্বারা। রস শব্দার্থ, শৃঙ্গারাদি নব রস। যথা; শৃঙ্গার, বীর, করুণ, অদ্ভূত, হাস্য, ভয়ানক, রৌদ্র, বীভৎস্য ও শান্ত। রস, কাব্যের আত্মাস্বরূপ।