কবিতাকুসুমাঞ্জলি/কল্পনা

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন

এস গো কল্পনা! মম মানস আসনে,
পূর্ণ কর অভিলাষ চাহ অকিঞ্চনে।
রচনাসাগরে যাই নাই হেন তারি,
তুমি যদি কৃপা কর তবে তাহে তরি।
কত যে শকতি তব বলা নাহি যায়,
স্বর্গের সুষমা দেবি! দেখা ও ধরায়।
শোকতাপদুঃখময় দেখিয়া সংসার,
কি কব, করুণা কত করেছ বিস্তার।
নিখিল-সন্তাপানল-নির্ব্বাণ-কারণ,
দিয়াছ মানবে মাতঃ কাব্যামৃত ধন—
অমুল্য, পরমনিধি, সংসারের সার,
ভেবে যায় দূরে যায় যন্ত্রণা অপার।
তোমার করুণাকণা পেয়ে কবিকুল,
যতনে প্রকৃতিবনে তুলি নানা ফুল,

গাঁথয়ে চিকণ মালা, পরিমলে যার,
আমোদিত হয় মাতঃ সকল সংসার।
সে মনোমোহিনী মালা হৃদয়ে যে ধরে,
আনন্দসলিল তার অন্তরে না ধরে।
হইলে তোমার কৃপা না হয় কি বল?
ধরায় বসিয়া দেখি ভুবন সকল।
ঘরে বসি জলরাশি কে দেখতে পারে?
কে এখনি লয়ে যেতে পারয়ে কান্তারে?
আজ্ঞা যদি কর তুমি করুণা বিস্তারি,
অসময়ে পেতে পারি শরদের বারি।
সুবাসিত সুশোভিত বসন্তের ফুল,
অসময়ে দেখি, যদি হও অনুকুল।
প্রশস্ত প্রান্তর আর কানন, নির্ঝর,
তটিনী, তড়াগ, তরু, মরু-ভয়ঙ্কর,
উপকূল, গিরি, এর প্রকৃতির দেহ,
ক্ষণেকে দেখিতে পাই যদি আজ্ঞা দেহ।
কত শত কবিকুল তোমার কৃপায়,
ধরায় ধরিয়া দেহ অমরতা পায়।
অমর করিতে নরে এ সংসারে আর,
তোমা বিনা আছে দেবি! শকতি কাহার।

সেই হেতু হয় বাঞ্ছা ডাকিতে তোমায়,
লোকে পাছে উপহাসে মন ভয় পায়।
বিবক্ষু হইয়া বহু গিয়াছে বাসর,
এবে লজ্জা পরিহরি হতেছি মুখর।
দয়া করি দেবি যদি দাও পদাশ্রয়,
তবে তরে যায় তব অধম তনয়।
বিদ্যাধনে অতিদীন প্রবীণ পামর,
আমায় দেখিয়া দেবি করুণা বিতর।
কিন্তু মম মনে ইহা আছয়ে নিশ্চয়,
কখন আমার মনে পাবেন উদয়—
কেনই পাইবে? ইহা সম্ভব কি হয়,
লয় কি প্রাসাদবাসী কুটীরে আশ্রয়।
মা তোমায় রত্নাকর কবি যত্ন করি,
রাখিতেন মনোরত্ন-সিংহাসনোপরি।
হোমর হাফেজ আদি কবি সমুদায়,
বসায়ে মানসাসনে সেবিত তোমায়।
কালিদাস ভবভূতি আর কবি যত,
তাঁদের প্রশস্ত মনে ছিলে অবিরত।
জ্ঞান বিনা তমোময় মম মনোভূমি,
মনে ভাল জানি, ঘৃণা করিবে গো তুমি।

তবে যে তোমায় ডাকি, দুরাশা, পবনে,
করেছে চঞ্চল মম বলহীন মনে —
অরে রে দুরাশা তোর এ কেমন কল,
সহজ মানবে কর প্রবল পাগল।
কব কত, কত শত পাব উপহাস,
তথাপি হতেছি আমি দুরাশীর দাস।
বোবা যদি বাঞ্ছা করে বক্তৃতা করণে,
খঞ্জনের নাচ দেখি নাচে খঞ্জজনে।
বধিরে সেতার যদি যায় শুনিবারে,
কেনা বল, ব্যঙ্গ করে দেখি সে সবারে।
মনে মনে ভাল জানি আপনার বল,
কবিতা রচিতে তবু হতেছি চঞ্চল।
কি আশ্চর্য্য একি বীর্য্য দেখি দুরাশার,
মোহান্ধ করেছে, হয়, মানস আমার।
যদি বল, জেনে কেন হেন কাযে সাজ,
সমাজে দেখাতে মুখ এত যদি লাজ।
সত্য বটে, কিন্তু মনে নাহি তত ভয়,
দেখি বহু বহু বঙ্গভূমির তনয়;
অধুনা এদেশে, কত গ্রন্থকারগণ,
শ্যামমুখ প্রকাশিছে আমার মতন,

ব্যঙ্গ করি কেহ যদি লজ্জাহীন বলে,
না হয় মিশিব আমি তাহাদের দলে।
কিন্তু মাতঃ! আমি সদা ডরি মনে মনে,
ছিদ্রান্বেষী ছদ্মবেশী কটুভাষী জনে।
তিলে তাল করে তারা, হৃদে দেয় ব্যথা,
বিকট কটাক্ষে চাহে, কহে কটু কথা।
অসার গ্রহণে পটু ঘুণকীট প্রায়,
পাকায় না চায়, নাচে যদি কাঁচা পায়।
কেবল ভরসা এক আছে মনে মনে,
কখন না করে ঘৃণা সহৃদয় জনে;
দোষ ত্যজি গুণ ভাগ করয়ে গ্রহণ,
মুকুতা যেমন লয় জবার বরণ।
যা হবার হইয়াছে, সাহসে নির্ভর
করেছি, এখন মাতঃ! করুণা বিতর।