কবিতাসংগ্রহ/কিংবদন্তির ভোর/সময়-পিশাচ

উইকিসংকলন থেকে

সময়-পিশাচ


যতটুকু লিখি, শুধু শূন্য। আজ
সব কথকতা থেকে
নিভে যায় আলো। যাকে লিখি
সে আসলে শূন্যের পরিধি
নেই, কোনোকেন্দ্র নেই। শুধু
নেই-টুকু আছে, এই জানা
শূন্যকেই গাঢ় করে দেয়। লিখি
এই শূন্যের দোহাই দিয়ে


মাটি ও শস্যের মধ্যে আজ কোনো
মুখ দেখাদেখি নেই,
শুধু কিছু নম্র শোক আঁচল বিছিয়ে দেয়
প্রতিদিন, শিশুদের
গভীর কান্নার সুরে জেগে ওঠে ক্ষুধা
স্তনে দুধ নেই

দানাপানি নেই বছর-বিয়োনি মায়েদের
খামারের স্মৃতি নিয়ে
আকালের রাত গাঢ় হয়ে ওঠে, কাঙালের
অবসন্ন গানে!

ঠুকরে ঠুকরে ছিড়ে-খুঁড়ে খেয়ে নিচ্ছে কারা হাড়-মাংস
আমাদের মেধা-মজ্জা সুখ ও অসুখ
শকুনের ভোজসভা এরকম হয়, হয়ে থাকে
ফসলের মাঠ ছিল কোনোদিন, আপাতত ভাগাড়ের
বিপুল বিস্তারে কোথাও রয়েছে পালকের স্তূপ
কোথাও বা ফি্নকি দিয়ে ওঠে রক্তের প্রবাহ আর দ্যাখো ঐ
মাছিদের ওড়াউড়ি
প্রতিদিন আলোর পাঁজর ছিড়ে এভাবেই আসে অন্ধকার
প্রতিরাত এই নিয়ে যাই ঘুমের ভেতরে

এই বাকে বৈভব নেই, রূপকের অবভাস নেই


যে-কোনো শেকড় থেকে বুঝে নিই।
কতদূর ছড়িয়েছে
আগুনের আঁচ, মাটির আদলে এত
ছাই আর কালো রঙ দেখে
জানি, এই ঋতু হননের পরিহাসে ভরা
হাসতে-হাসতে দ্যাখ
শ্মশানে গড়িয়ে পড়ছে শববাহকেরা
কোনো ফুল নেই
অক্ষরের চিতায় দেওয়ার মতো
পোড়া খই
কোথায় ছড়াব, সোনামনি!


মুঠো-ভর্তি ধুলো, কেন একে এতদিন পরাগ ভেবেছি!

সময় জহ্লাদ হলো ভেঙে দিয়ে রূপোর কাঠিকে

জাগি, জেগে থাকি আজ

খড়ের প্রতিমা, তাকেই ঈশ্বরী ভেবে নিজেকে সঁপেছি!


সমস্ত আড়াল খুলে ভাষা
নিয়ে এল
ক্রোধ ঘৃণা তৃতীয় বিশ্বের
হাওয়ায় বারুদ, গর্ভকোষে
যন্ত্রণার
তুমূল সিমফনি নিয়ে এল

মা, আমার মা, ভাষা থেকে
সব বাচালতা
তুলে নিয়ে ফিরিয়ে দে শৈশবের ভোর

ভাষা, আজ শুধু দহন শেখাও


এই সার্কাস-শহরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সমস্ত মুখোশ
এবার সময় হলো, মুখগুলি নেমে এল
সিঁড়ি বেয়ে, আর
একে একে উঠোন পেরিয়ে সোজা যেদিকে
দুচোখ যায়, যেতে-যেতে
পথ আর আকাশের সঙ্গে মিশে গেল।

পাশ ফিরে, ঘুমোতেই থাকল মুখোশেরা


সমাপ্তি-রেখাকে ছুঁয়ে ফিরে আসি
প্রতিবার, সামান্য ভনিতা করে
মেনে নিই হেরে যাওয়া

যত ভাবি নতুন আঙ্গিকে শুরু হবে
ভাষা ও বয়ন।
সেই এক কথা এক হাসি একই ভব্যতা
ফিরে-ফিরে আসে

সমাপ্তি-রেখাকে ছুঁয়ে ভেঙে যায়
বিষন্ন অক্ষর

দিকে দিকে সুখের বিকল্প হয়ে এসময়
ফোটে ঐ রাত্রি-কথা
ভিক্ষাপাত্র নিয়ে আজও জাগে বিচিত্র স্বদেশ

কার কাছে বার্তা নিয়ে যাই।
নচিকেতা, ফিরে এসো মানুষের অন্তিম প্রণয়ে

১০
রেখেছে আগুন ঘিরে প্রতিদিন
পুড়ে পুড়ে কালো হলো রাত
এই তো এখন দিনলিপি
ভাষা, আর কত জানাবে নগ্নতা?

নাম নেই গোত্র নেই পরিচয় নেই কোনো
ছিড়ে-খুঁড়ে আলো, গান
এল কোন্ সময়-পিশাচ? ভেসে যাই
প্রলয়-পয়োধি জলে

মায়া-দর্পণের বুকে টুকরো-ছবি?
সে কী আমি!
ভাষা, আর কত জানাবে শূন্যতা?
১১
অস্ত্রের টংকার মুছে দিয়ে
মেঘমালা
আনো, আনো নীরবতা
ঝরে যাক

মানুষের ক্লান্ত দুঃখ রাশি
যেদিকে দুচোখ যায়
শুধু পথ
আর, পথের দু'পাশে
খরা-পোড়া মাঠ

১২
নির্জন হয়েছে যাত্রারেখা
এবার না হয় নামুক শ্রাবণ

একা গাই লাঙলের বারমাস্যা
ভোতা শব্দের ফলকে
লিখে রাখি কৃষি-সমাচার

শস্যের ফলনে ফিরে এসো
মনসামঙ্গল গীতি
সপ্তডিঙা মধুকর নিয়ে জাগে কালিদহে

আনো হেঁতালের লাঠি নিছনি নগরে
লিপিকর, লেখো এই গৌড়গাথা

গাই লাঙলের বারমাস্যা
আর, লিখে রাখি কৃষি-সমাচার

১৩
পুঁথি থেকে আখরেরা ছিটকে পড়ছে রোজ
হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে খরোষ্ঠী অক্ষর সুতনুকা লিপি
পরিব্রাজকের লাঠি আর কমণ্ডলু নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সব
পাঠ-পাঠান্তর, চৌত্রিশ-ভনিতা থেকে সরে যাচ্ছে দ্রুত
রোদ আর মেঘের আশ্রয়, ফুল্লরার বারমাস্যা থেকে খসে পড়ছে
দুখজাগানিয়া শ্রুতি, সবুজের আভাহীন পোড়া এ বাথানে
ফিরে আসবে কী কখনো লীলা কঙ্ক হারামনি হাসানরাজার ঘরদোর
শূন্যের মাঝারে শুধু নিরুত্তর আখরেরা উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়

১৪
ভাঙা সাঁকো, কবেকার কাঠ-চেরাইয়ের স্মৃতি নিয়ে জাগে
গিটে গিটে গভীর সন্ন্যাস, আজ দুলছে সাঁকো দুলে দুলে
সব একান্ত বিষাদ, পুরোনো শৈবাল ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে নিচে
অনেক নিচুতে শুকনো খাত, জলরেখা নেই কোনোখানে
কোনো শোক নেই, ছায়া নেই, খরখরে বালি ও পাথর
জমে আছে শুধু, নেই কোনো পাখিদের ওড়াউড়ি, ধু ধু
হাওয়া লোফালুফি করে বালি, ছিটকে দেয় বালির স্তব্ধতা
অনেক উপরে ঐ ভাঙা সাঁকো দুলে দুলে ঝেড়ে ফেলে
আরো কিছু পুরোনো শৈবাল, ফিরে যায় ভ্রমণকারীরা
ফের এক কাঠ-চেরাইয়ের আয়োজন নিয়ে আলোচনা করে
১৫
এই শব্দ আমার
এই শূন্যতা সে-ও আমার

ফিরে এসো বন্ধুরা
আজ নিছক বানিয়ে-বানিয়ে
ভালো কথাগুলো বলে যাও

শুনি বৃষ্টির মর্মর
শুনি কবেকার নাচ-গান গল্পগাথা

এই শূন্য আমার
বাচালতা, সে-ও তো আমার
১৬
আর কত বাকি আছে ভার?

যতই নির্মাণ করি, সমস্ত কুহক
ঝরে গেছে কাঠামোর খড়

ফিরে আসি ভাষার আকাশে, দেখি
একটি-দুটি তারা ফুটে আছে

আছে শস্যের যন্ত্রণা এই দিন-অবসানে

১৭
যাই। ব্যর্থ দিন আর কৃপণ রাতের গাথা
লিখে রাখি।

স্পর্শ রেখে যাও ওগো নিশীথিনী। ভোর এল
চোখের কোটরে

যাই। কারো কাছে নয়, শুধু পথে ভেসে-ভেসে
ভাবি সমস্ত প্রতীক

রয়ে গেছে আগুনে ঝলসানো অক্ষরের স্তুপ। এই নিয়ে
যাই কবি-সম্মেলনে

এ কী জয় নাকি পরাজয়? শুধুই স্রোতের কাছে।
ঋণ মেনে নিই


১৮
এই মাটি খুঁড়ে জল উঠেছিল কোনোদিন
অফুরান গণ্ডুষে গণ্ডুষে
জল-ভ্রমে আগুন খেয়েছি, আর
মাটির ভনিতা দিয়ে ঢেকে রেখেছি কুহক
এভাবে সময় যায় কথনের ছলে
বাক্য থেকে মেধা ঝরে গেছে, তবু
শব্দের বাকল ছিড়ে-খুঁড়ে
পদ্যের সংকেত খুঁজি রোজ

খুঁজতে-খুঁজতে ভুলে যাই ফেলে-আসা পথ
মাটির বিষাদ আর জলের বিজ্ঞতা

দেখি, রয়ে গেছে শুধু টুটো-ফাটা
স্মৃতির আদল

লিখি পোড়া তৈজসের ভাষ্য, লিখি
আগুনের পাদটীকা
কত রঙ মেখেছ হিংস্রতা
ভব্যতার মুখোশ শেখাও

এই, এই আমাদের লিখন-প্রণালী
দিনে বিদূষক হই, রাতে দার্শনিক

ভাঙা এ কলমে লিখি সমাচার
আত্মহননের।

২০
এই ভাষা চাতক পাখির
এই ভাষা গহন ঋতুর

কতখানি বর্ণচোরা আলো
পাঁজরের অন্ধকার থেকে জেগে ওঠে রোজ
সেই সব লিখে নিই বর্ণপরিচয়ে
শোকে, পিপাসায়

এই ভাষা ফিরে-ফিরে আসে ঘাসফড়িঙের
পাখায় পাখায় আর
আকাশের মেঘে-মেঘে শস্যের বাসনা নিয়ে

এই ভাষা পিপীলিকা-প্রাণে, এই ভাষা মৃত্যু-ইশারায়

২১
পথ জেগে ওঠো
কোজাগরি রাত রেখে গেছে ভাষার পাথেয়

খুব ভোরে যেতে হবে
বাথানের আলোড়ন পড়ে থাকছে আঙিনায়

শুধু শেকলের ক্লান্ত ছায়া যাত্রা-সহচর
আর মর্মছেড়া আলো

এসো পথ, নিজেকে জাগাও

২২
আর কতবার গড়া হবে স্বরলিপি
ভাষা-গুল্ম থেকে? যদিও ইশারা ছিল
ফসলের, ভিক্ষুকের জন্যে নেই
বাগর্থের মায়া! শুধু দিগন্ত রাঙিয়ে যায়
শেষ আলো, বিহানবেলার। আর কত
লিখি ভার নিথর আন্ধারে?



২৩
জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছে শ্মশান-চণ্ডাল, তার
ভূত-ভবিষ্যৎ, সবশেষে
যতটুকু ছাই পাওয়া যাবে, কোনো আর্তি
খোঁজো না সেখানে
কোনো পীড়নের স্মৃতি নেই, ক্লেদ নেই মড়কের
বাসনার পারম্পর্য নেই।
ভাষার নরক থেকে ভেসে আসে ঐ
চণ্ডালের শ্মশান-গীতিকা



২৪
কথা ফুরিয়েছে। প্রাকৃত সাঁঝের বেলা
মুড়িয়েছে নটেগাছ আর ধানের সুন্দর। ভালো,
এবার তাহলে নাচ হোক বৌ-ঝিয়ের, মাঘ-মণ্ডলের
রাতে এইসব দেখে শুনে ফের শুরু করি ভাষ্য
ব্রত-গাথা দিয়ে। বাগর্থের মন্ত্র শিখে নিই আজ
খাঁ খাঁ মাঠ, শূন্য গোলা, আকাশ-পিদিম থেকে।
ভোর হোক আরো একবার, লাঙলের নতুন ফলকে
বীজ স্পর্শ খোঁজে আজ, খোঁজে ঊষার আভাস!