কর্ম্মফল/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 শশধর। আঃ কি বল! তুমি কি পাগল হয়েচ না কি?

 সুকুমারী। আমি পাগল, না, তুমি চোখে দেখতে পাও না!

 শশধর। কোনটাই আশ্চর্য্য নয়, দুটোই সম্ভব। কিন্তু—

 সুকুমারী। আমাদের হরেনের জন্ম হতেই দেখনি ও’দের মুখ কেমন হয়ে গেছে। সতীশের ভাবখানা দেখে বুঝতে পার না!

 শশধর। আমার অত ভাব বুঝবার ক্ষমতা নেই সে ত তুমি জানই! মন জিনিষটাকে অদৃশ্য পদার্থ বলেই শিশুকাল হতে আমার কেমন একটা সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে গেছে! ঘটনা দেখলে তবু কতকটা বুঝতে পারি।  সুকুমারী। সতীশ যখনি আড়ালে পায় তোমার ছেলেকে মারে, আবার বিধুও তাহার পিছনে পিছনে এসে খোকাকে জুজুর ভয় দেখায়।

 শশধর। ঐ দেখ তোমরা ছোট কথাকে বড় করে তোল! যদিই বা সতীশ থোকাকে কখনো—

 সুকুমারী। সে তুমি সহ্য করতে পার আমি পারব না—ছেলেকে ত তোমার গর্ভে ধরতে হয়নি!

 শশধর। সে কথা আমি অস্বীকার করতে পারব না। এখন তোমার অভিপ্রায় কি শুনি!

 সুকুমারী। শিক্ষা সম্বন্ধে তুমি ত বড় বড় কথা বল, একবার তুমি ভেবে দেখ না আমরা হরেনকে যে ভাবে শিক্ষা দিতে চাই তার মাসী তাকে অন্যরূপ শেখায়—সতীশের দৃষ্টান্তটিই বা তারপক্ষে কিরূপ সেটাও ত ভেবে দেখতে হয়।

 শশধর। তুমি যখন অত বেশী করে ভাবচ তখন তার উপরে আমার আর ভাববার দরকার কি আছে! এখন কর্ত্তব্য কি বল?  সুকুমারী। আমি বলি সতীশকে তুমি বল, তার মার কাছে থেকে সে এখন কাজকর্ম্মের চেষ্টা দেখুক। পুরুষমানুষ পরের পয়সায় বাবুগিরি করে সে কি ভাল দেখতে হয়!

 শশধর। ওর মা যে টাকা পায় তাতে সতীশের চলবে কি করে?

 সুকুমারী। কেন, ওদের বাড়িভাড়া লাগে না, মাসে পঁচাত্তর টাকা কম কি!

 শশধর। সতীশের যেরূপ চাল দাঁড়িয়েছে পঁচাত্তর টাকা ত সে চুরুটের ডগাতেই ফুঁকে দেবে! মার গহনাগাঁঠি ছিল সে ত অনেক দিন হল গেছে এখন হবিষ্যান্ন বাঁধা দিয়ে ত দেনা শোধ হবে না!

 সুকুমারী। যার সামর্থ্য কম তার অত লম্বা চালেই বা দরকার কি?

 শশধর। মন্মথ ত সেই কথাই বলত। আমরাই ত সতীশকে অন্যরূপ বুঝিয়েছিলেম। এখন ওকে দোষ দিই কি করে?

 সুকুমারী। না—দোষ কি ওর হতে পারে! সব দোষ আমারি! তুমি ত আর কারো কোন দোষ দেখতে পাও না—কেবল আমার বেলাতেই তোমার দর্শনশক্তি বেড়ে যায়।

 শশধর। ওগো রাগ কর কেন—আমিও ত দোষী!

 সুকুমারী। তা হতে পারে। তোমার কথা তুমি জান। কিন্তু আমি কখনো ওকে এমন কথা বলিনি যে তুমি তোমার মেসোর ঘরে পায়ের উপর পা দিয়া গোঁফে তা দাও আর লম্বা কেদারায় বসে বসে আমার বাছার উপর বিষদৃষ্টি দিতে থাক।

 শশধর। না ঠিক ঐ কথাগুলো তুমি তাকে মাথার দিব্য দিয়ে শপথ করিয়ে নাওনি—অতএব তোমাকে দোষ দিতে পারিনে। এখন কি করতে হবে বল।

 সুকুমারী। সে তুমি যা ভাল বোধ কর তাই কর। কিন্তু আমি বলচি সতীশ যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকবে আমি থোকাকে কোনমতে বাইরে যেতে দিতে পারব না। ডাক্তার খোকাকে হাওয়া খাওয়াতে বিশেষ করে বলে দিয়েছে—কিন্তু হাওয়া খেতে গিয়ে ও কখন একলা সতীশের নজরে পড়বে সে কথা মনে করলে আমার মন স্থির থাকে না। ওত আমারই আপন বোনের ছেলে কিন্তু আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করিনে—এ আমি তোমাকে স্পষ্টই বললেম।

সতীশের প্রবেশ।

 সতীশ। কাকে বিশ্বাস কর না মাসীমা! আমাকে? আমি তোমার খোকাকে সুযোগ পেলে গলা টিপে মারব এই তোমার ভয়? যদি মারি, তবে তুমি তোমার বোনের ছেলের যে অনিষ্ট করেচ তার চেয়ে ওর কি বেশি অনিষ্ট করা হবে? কে আমাকে ছেলেবেলা হতে নবাবের মত সৌখীন করে তুলেচে এবং আজ ভিক্ষুকের মত পথে বের কল্লে? কে আমাকে পিতার শাসন হতে কেড়ে এনে বিশ্বের লাঞ্ছনার মধ্যে টেনে আনলে? কে আমাকে—

 সুকুমারী। ওগো শুনচ? তোমার সামনে আমাকে এমনি করে অপমান করে? নিজের মুখে বল্লে কিনা খোকাকে গলা টিপে মারবে? ওমা, কি হবে গো! আমি কালসাপকে নিজের হাতে দুধকলা দিয়ে পুষেচি!

 সতীশ। দুধকলা আমারও ঘরে ছিল—দুধকলায় আমার রক্ত বিষ হয়ে উঠত না— তা-হতে চিরকালের মত বঞ্চিত করে তুমি যে দুধকলা আমাকে খাইয়েচ তাতে আমার বিষ জমে উঠেচে! সত্য কথাই বলচ এখন আমাকে ভয় করাই চাই—এখন আমি দংশন করতে পারি!

বিধুমুখীর প্রবেশ॥

 বিধু। কি সতীশ কি হয়েচে, তোকে দেখে যে ভয় হয়! অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে চিন্‌তে পারচিস নে? আমি যে তোঁর মা সতীশ!

 সতীশ। মা! তোমাকে মা বলব কোন্‌ মুখে? মা হয়ে কেন তুমি আমার পিতার শাসন হতে আমাকে বঞ্চিত করলে? কেন তুমি আমাকে জেল হতে ফিরিয়ে আনলে? সে কি মাসীর ঘর হতে ভয়ানক? তোমরা ঈশ্বরকে মা বলে ডাক, তিনি যদি তোমাদের মত মা হন তবে তাঁর আদর চাইনে তিনি যেন আমাকে নরকে দেন!

 শশধর। আঃ সতীশ চল চল—কি বকচ থাম! এস বাইরে আমার ঘরে এস!