কর্ম্মফল/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

কর্ম্মফল।



প্রথম পরিচ্ছেদ।

 আজ সতীশের মাসী সুকুমারী এবং মেসোমশায় শশধরবাবু আসিয়াছেন—সতীশের মা বিধুমুখী ব্যস্তসমস্তভাবে তাঁঁহাদের অভ্যর্থনায় নিযুক্ত। “এস দিদি, বস! আজ কোন্ পুণ্যে রায়মশায়ের দেখা পাওয়া গেল! দিদি না আসলে তোমার আর দেখা!” পাবার জো নেই।”

 শশধর | এতেই বুঝবে তোমার দিদির শাসন কি রকম কড়া! দিনরাত্রি চোখে চোখে রাখেন!

 সুকুমারী | তাই বটে, এমন রত্ন ঘরে রেখেও নিশ্চিন্তমনে ঘুমানো যায় না!

 বিধুমুখী | নাকডাকার শব্দে!

 সুকুমারী | সতীশ, ছি ছি, তুই এ কি কাপড় পরেছিস? তুই কি এই রকম ধুতি পরে ইস্কুলে যাস্‌ না কি? বিধু, ওকে যে ফ্রকটা কিনে দিয়ে-ছিলেম, সে কি হল?

 বিধুমুখী। সে ও কোন্‌কালে ছিঁড়ে ফেলেছে!

 সুকুমারী। তা ত ছিঁড়বেই! ছেলেমানুষের গায়ে এক কাপড় কতদিন টেঁকে! তা, তাই বলে কি আর নূতন ফ্রক তৈরি করাতে নেই! তোদের ঘরে সকলি অনাসৃষ্টি!

 বিধুমুখী। জানই ত দিদি, তিনি ছেলের গায়ে সভ্যকাপড় দেখলেই আগুন হয়ে ওঠেন। আমি যদি না থাকতেম ত তিনি বোধ হয় ছেলেকে দোলাই গায়ে দিয়ে কোমরে ঘুন্‌সি পরিয়ে ইস্কুল পাঠাতেন—মাগো! এমন সৃষ্টিছাড়া পছন্দও কারো দেখি নি।

 মুকুমারী। মিছে না! এক বই ছেলে নয়— একে একটু সাজাতে গোজাতেও ইচ্ছা করে না! এমন বাপও ত দেখি নি। সতীশ পশু রবিবার আছে তুই আমাদের বাড়ী যাস্ আমি তোর জন্য একসুট্‌ কাপড় র‍্যামজের ওখান হতে আনিয়ে রাখব। আহা ছেলেমানুষের কি সখ্‌ হয় না!  সতীশ। একসুটে আমার কি হবে মাসিমা! ভাদুড়ি সাহেবের ছেলে আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ে —সে আমাকে তাদের বাড়ীতে পিংপং খেলায় নিমন্ত্রণ করেছে—আমার ত সে রকম বাইরে যাবার মখ্‌মলের কাপড় নেই!

 শশধর। তেমন যায়গায় নিমন্ত্রণে না যাওয়াই ভাল সতীশ!

 সুকুমারী। আচ্ছা, আচ্ছা, তোমার আর বক্তৃতা দিতে হবে না! ওর যখন তোমার মতন বয়স হবে, তখন—

 শশধর। তখন ওকে বক্তৃতা দেবার অন্য লোক হবে, বৃদ্ধ মেসোর পরামর্শ শোনবার অবসর হবে না।

 সুকুমারী। আচ্ছা, মশায়, বক্তৃতা করবার অন্য লোক যদি তোমাদের ভাগ্যে না জুটত তবে তোমাদের কি দশা হত বল দেখি!

 শশধর। সে কথা বলে লাভ কি! সে অবস্থা কল্পনা করাই ভাল!

 সতীশ। (নেপথ্যের দিকে চাহিয়া) না, না, এখানে আনতে হবে না আমি যাচ্চি! (প্রস্থান)  সুকুমারী। সতীশ ব্যস্ত হয়ে পালাল বিধু?

 বিধুমুখী। থালায় করে তার জলখাবার আন্‌ছিল কি না, ছেলের তাই তোমাদের সাম্‌নে লজ্জা!।

 সুকুমারী। আহা, বেচারার লজ্জা হতে পারে! ও সতীশ, শোন্‌ শোন্‌! তোর মেসোমশায় তোকে পেলেটির বাড়ি থেকে আইস্‌ ক্রিম্ খাইয়ে আনবেন, তুই ওঁর সঙ্গে যা! ওগো, যাও না— ছেলেমানুষকে একটু—

 সতীশ। মাসীমা সেখানে কি কাপড় পরে যাব?

 বিধুমুখী। কেন, তোর ত চাপকান আছে।

 সতীশ। সে বিশ্রী!

 সুকুমারী। আর যাই হোক্‌ বিধু, তোর ছেলে ভাগে পৈতৃক পছন্দটা পায় নি তাই রক্ষা! বাস্তবিক, চাপকান দেখলেই খান্‌সামা কিম্বা যাত্রা দলের ছেলে মনে পড়ে! এমন অসভ্য কাপড় আর নেই!

 শশধর। এ কথাগুলো—  সুকুমারী। চুপি চুপি বল্‌তে হবে? কেন ভয় করতে হবে কাকে! মন্মথ নিজের পছন্দমত ছেলেকে সাজ করাবেন আর আমরা কথা কইতেও পাব না!

 শশধর। সর্ব্বনাশ! কথা বন্দ করতে আমি বলি নে! কিন্তু সতীশের সাম্‌নে এ সমস্ত আলোচনা—

 সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা বেশ! তুমি ওকে। পেলিটির ওখানে নিয়ে যাও!

 সতীশ। না মাসীমা আমি সেখানে চাপকান পরে যেতে পারব না!

 সুকুমারী। এই যে মন্মথবাবু আস্‌চেন। এখনি সতীশকে নিয়ে বকাবকি করে ওকে অস্থির করে তুলবেন। ছেলেমানুষ, বাপের বকুনির চোটে ওর এক দণ্ড শান্তি নেই। আয় সতীশ তুই আমার। সঙ্গে আয়—আমরা পালাই। (প্রস্থান)।

(মন্মথের প্রবেশ।)

 বিধু সতীশ ঘড়ি ঘড়ি করে কয়দিন আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। দিদি তাকে একটা রূপোর ঘড়ি দিয়েছেন—আমি আগে থাকতে বলে রাখলেম তুমি আবার শুনলে রাগ করবে।

(প্রস্থান)
 মন্মথ। আগে থাকতে বলে রাখলেও রাগ করব। শশধর সে ঘড়িটি তোমাকে নিয়ে যেতে হবে।

 শশধর। তুমি ত আচ্ছ লোক! নিয়ে ত গেলেম, শেষকালে বাড়ি গিয়ে জবাবদিহি করবে কে!

 মন্মথ। না শশধর, ঠাট্ট নয়, আমি এ সব ভালবাসি নে!

 শশধর। ভাল বাস না, কিন্তু সহ্যও করতে হয়—সংসারে এ কেবল তোমার এক্‌লারই পক্ষে বিধান নয়!

 মন্মথ। আমার নিজের সম্বন্ধে হলে আমি নিঃশব্দে সহ্য করতেম। কিন্তু ছেলেকে আমি মাটি করতে পারি না। যে ছেলে চাবা-মাত্রই পায়, চাবার পূর্ব্বেই যার অভাব মোচন হতে থাকে সে নিতান্ত দুর্ভাগা। ইচ্ছা দমন করতে শিখে কেউ কোনকালে সুখী হতে পারে না। বঞ্চিত হয়ে ধৈর্য রক্ষা করবার যে বিদ্যা আমি তাই ছেলেকে দিতে চাই, ঘড়ি ঘড়ির চেন যোগাতে চাই নে।

 শশধর। সে ত ভাল কথা কিন্তু তোমার ইচ্ছামাত্রই ত সংসারে সমস্ত বাধা তখনি ধূলিসাৎ হবে না। সকলেরই যদি তোমার মত সদ্বুদ্ধি থাকত তা হলে ত কথাই ছিল না; তা যখন নেই তখন সাধুসঙ্কল্পকেও গায়ের জোরে চালানো যায় না, ধৈর্য্য চাই। স্ত্রীলোকের ইচ্ছার একেবারে উল্টামুখে চলবার চেষ্টা করলে অনেক বিপদে পড়বে—তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে একটু ঘুরে গেলে সুবিধামত ফল পাওয়া যায়। বাতাস যখন উল্টা বয় জাহাজের পাল তখন আড় করে রাখতে হয়, নইলে চলা অসম্ভব।

 মন্মথ। তাই বুঝি তুমি গৃহিণীর সকল কথাতেই সায় দিয়ে যাও! ভীরু!

 শশধর। তোমার মত অসম সাহস আমার নেই। যার ঘরকন্নার অধীনে চব্বিশঘণ্টা বাস করতে হয় তাঁকে ভয় না করব ত কাকে করব? নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কি? আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলে ও কষ্ট। তার চেয়ে তর্কের বেলায় গৃহিণীর মতকে সম্পূর্ণ অকাট্য বলে স্বীকার করে কাজের বেলায় নিজের মত চালানোই সৎপরামর্শ—গোয়ার্ত্তমি করতে গেলেই মুষ্কিল বাধে।  মন্মথ। জীবন যদি সুদীর্ঘ হত তবে ধীরে সুস্থে তোমার মতে চলা যেত। পরমায়ু যে অল্প।

 শশধর। সেই জন্যই ত ভাই বিবেচনা করে চলতে হয়। সাম্‌নে একটা পাথর পড়লে যে লোক ঘুরে না গিয়া সেটা ডিঙিয়ে পথ সংক্ষেপ করতে চায় বিলম্ব তারই অদৃষ্টে আছে। কিন্তু তোমাকে এ সকল বলা বৃথা—প্রতিদিনই ত ঠেকছ তবু যখন শিক্ষা পাচ্চ না তখন আমার উপদেশে ফল নেই। তুমি এম্নি ভাবে চলতে চাও যেন তোমার স্ত্রী বলে একটা শক্তির অস্তিত্ব নেই—অথচ তিনি যে আছেন সে সম্বন্ধে তোমার লেশমাত্র সন্দেহ থাকবার কোনো কারণ দেখি নে।