কলিকাতার ইতিহাস/দশম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে
দশম অধ্যায়।


ইউরোপীয় সমাজ।


 বৈদেশিক জাতির আচার-ব্যবহার ও রীতি-পদ্ধতি সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে যাওয়া নিতান্ত দুঃসাহসিকের কর্ম্ম। তাহাদের মনোভাবের ভিতর প্রবেশ করা এবং তাহাদের রুচি ও প্রবৃত্তির সহিত সহানুভূতি প্রকাশ করা সহজ নয়। নিজ প্রকৃতির ও স্বভাবজাত ধারণার পরিবর্ত্তন করিতে না পারিলে বৈদেশিক আচার-ব্যবহারের মর্ম অবধারণ করিবার আশা করা বিড়ম্বনা মাত্র। বৈদেশিক জাতির সামাজিক জীবনের প্রকৃত রহস্য বুঝিতে হইলে উভয়ের সতত ও অব্যাহত সংমিশ্রণ একান্ত আবশ্যক। যে সকল ইউরোপীয় লেখক—যাঁহাদিগের সাধু উদ্দেশ্যের ও সদন্তঃকরণের বিষয়ে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই, তাঁহারাও হিন্দুদিগের সামাজিক জীবন ও আচার-ব্যবহার বর্ণন করিতে যাইয়া অতি গুরুতর ভ্রমে পতিত হইয়াছেন। এতাদৃশ অবস্থায় হিন্দুরা ইউরোপীয় সমাজের আচার-ব্যবহার ও রীতি-নীতির বিচার করিতে যাইয়া যে বিষম ভ্রম করিয়া বসিবেন, তাহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কি আছে? আজন্ম বদ্ধমুল ভ্রান্তসংস্কার যারা বিচার-বুদ্ধি কিরূপ কলুষিত হয়, তাহা কলিকাতা রিভিউ পত্র হইতে পশ্চাদুদ্ধৃত বিবরণ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইবে।

 “ইউরোপীয় রমণীদিগের নৃত্য দর্শনে দেশীয়দিগের মনে এক অদ্ভুত ধারণা জন্মে। কতিপয় বৎসর গত হইল, জনৈক দেশীয় ভদ্রলোক ইংরেজদের ভোজ-ব্যাপারে একটি বিবরণ প্রকাশ করিয়াছিলেন। অন্যান্য কথার পর উপসংহারকালে তিনি লিখিয়াছেন, “ভোজের পর তাহারা অতি অশ্লীলভাবে নৃত্য করে,— পরস্পরের স্ত্রীকে ধরিয়া টানাটানি করে।”

 অতএব এবংবিধ গুরুতর বিষয়ে আমরা নিজে দৃঢ়তার সহিত কোন কথা না বলিয়া, স্বয়ং ইউরোপীয়েরা এতদ্দেশের তদানীন্তন সাহেবসমাজের যে চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহাই পাঠকবর্গের সমক্ষে উপস্থিত করিব।

 জনৈক লেখক লিখিয়াছেন, “ইংরেজেরা ফ্যাশন বা দেশাচারের যেরূপ আজ্ঞাবহ দাস অন্য কোনও জাতি সেরূপ নহে।” কথিত আছে যে, ফ্যাশনই তাঁহাদের প্রধান উপাস্য দেবতা, এবং সেই দেবতার তুষ্টি-সাধনার্থ কোন প্রকার ক্ষতি স্বীকারেই তাঁহারা কাতর হন না। তাঁহাদের জাতীয় আচার-ব্যবহার ও কুসংস্কার কিরূপ দৃঢ়, তাহা পশ্চাদুদ্ধৃত বিবরণ হইতে বেশ বুঝা যায়;“কলিকাতার ও ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে যে রোগ পীড়ার এত প্রাদুর্ভাব, তাহার একটা প্রধান কারণ এই যে, ইংরেজরা আপনাদের জীবনযাপন রীতি, পরিচ্ছদ পরিধান প্রণালীপ্রভৃতি দেশের জলবায়ুর অনুযায়ী করিয়া লইতে চাহেন না। ইংরেজ ভূমণ্ডলের যেখানেই যান না কেন, তিনি আপনার দেশাচারটি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে চাহেন,—“তিনি লণ্ডনেও যেরূপ ‘টুপি-ওয়ালা’ কলিকাতাতেও সেই রূপ ‘টুপিওয়ালা'। এ বিষয়ে তাহাকে ব্যাটেভিয়া নগরস্থ ওলন্দাজের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। আমাষ্টার্ডাম নগরে বিস্তর খাল-পরিখা আছে বলিয়া ব্যাটেভিয়ার ওলন্দাজেরা যব-দ্বীপের রাজধানীতেও জলার ভিতর সেইরূপ খাল পরিখা খনন করিয়াছিল,—তাহার ফল হইল মহামারী, জ্বর; সুতরাং যবদ্বীপের ওলন্দাজেরা তদ্দেশীয়দিগের তরবারির আঘাতে যত না হত হইল, ঐ সময় খাল জন্য তদপেক্ষা অধিক মারা গেল। দেখা যায়, ১৭৮০ অব্দে কলিকাতায় অনেকগুলি আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় তত্রত্য লোকদিগকে এইরূপ সতর্ক করিয়া দেওয়া হইয়াছিল; ভদ্রলোকেরা সাবধান হইবেন, যেন প্রখর গ্রীষ্মের সময়ে (জুন মাসে) যথেচ্ছভাবে অত্যধিক ভোজন না করেন, একখানা ইণ্ডিয়াম্যানের (জাহাজের) ডাক্তার আকণ্ঠ গোমাংস ভোজন করিয়া রাস্তায় পড়িয়া মারা গিয়াছেন; তখন তাপমানযন্ত্র ৯৮ ডিগ্রিতে উঠিয়াছিল।”

 এতদ্দেশের ইউরোপীয় সমাজের আদিম অবস্থা সম্বন্ধে কয়েকজন সাহেব লিখিয়াছেন যে, তৎকালে সাহেবসমাজে নীতিজ্ঞান অতি অল্পই দৃষ্ট হইত। ১৭৮০ অব্দে হিকি সাহেবের গেজেটে পশ্চাদুদ্ধৃত বিদ্রুপাত্মক প্রশ্নোত্তরটি প্রকাশিত হইয়াছিল।

 প্র। বাণিজ্য কি?

 উ। জুয়া খেলা।

 প্র। সর্ব্বোৎকৃষ্ট গুণ কি?

 উ। ধন।

 প্র। স্বদেশ-প্রেম কি?

 উ। আত্ম-প্রেম।

 প্র। প্রতারণা কি?

 উ। ধরা পড়া।

 প্র। সৌন্দর্য্য কি?

 উ। রঙ।

 প্র। সময় সম্বন্ধীয় নিয়মপালন কি?

 উ। দ্বন্দ্বযুদ্ধ বা অভিসারের অঙ্গীকার যথাসময়ে পালন।

 প্র। ভদ্রতা কি?

 উ। অমিতব্যয়িতা।

 প্র। সরকারী টেক্স কি?

 উ। গুন্-পালান।

 প্র। জনসাধারণ কে?

 উ। কেহই নয়।


 ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দিগের বিবাহ সম্বন্ধে কলিকাতা রিভিউ পত্রে জনৈক লেখক লিখিয়াছেন;—“যৎকালে এডিনবরা নগরী ভারতীয় বাণিজ্য-বিপণীর মাংসের হাট বলিয়া অভিহিত হইত, সে সময়ে বিবাহের কথাটা প্রাচীন কলিকাতায় একটা গুরুতর ব্যাপার ছিল। লণ্ডন হইতেও অনেক রমণী-পণ্য আসিত। গ্র্যাণ্ড গ্রে লিখিয়াছেন;—“সাধারণে ভারতবর্ষে বিবাহকার্য্য সম্পন্ন করিবার অনুরাগী, ইহা জানিয়া সর্ব্বপ্রকার বাণিজ্যব্যবসায়ে প্রবৃত্তিপ্রবণ ইংরেজজাতি প্রতি বৎসর জাহাজ ভরিয়া মধ্যম রকমের সুন্দরী রমণদিগকে তথায় প্রেরণ করে এবং তাহারা ভারতে উপস্থিত হইবার পর ছয় মাস অতীত হইতে না হইতে পতি-রত্ন লাভ করে। যে সকল সাহেব এ দেশের মাতৃপিতৃহীনা বা অসহায়া রমণীদিগকে মনোনীত না করায় আপনাদের অপরিণীত অবস্থায় বিরক্ত হইয়া পড়ে, এবং কবে আহাজ আসিবে বলিয়া হাঁ করিয়া তাকাইয়া থাকে, তাহারাই অধীরভাবে এই সমস্ত পণ্যের প্রতীক্ষা করে। অন্যান্য স্থানের ন্যায় তাহারা ঐ পণ্য-দল হইতে আপনাদের মনোমত মাল ক্রয় করিবার নিমিত্ত সমুৎসুক হয়; আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই সকল বিবাহ সাধারণতঃ সুখকর হইয়া থাকে।”

 উক্ত লেখকই আবার অন্য এক স্থানে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর এক প্রকার মত প্রকাশ করিয়াছেন। খুব তাড়াতাড়ি (অর্থাৎ যথোচিত কোর্টশিপ না করিয়া) যে সকল বিবাহকার্য্য সম্পন্ন হইত, তাহাদের ফল সাধারণত শোচনীয় হইত। প্রণয়-ব্যাপারে ভার্সেলিস নগরের বিচারালয় যেরূপ প্রসিদ্ধ, এক সময়ে কলিকাতাও প্রায় সেইরূপ প্রসিদ্ধ ছিল, এবং ইটালীয় রমণীরা সাধারণত পতিকে যে চক্ষে দেখিয়া থাকে, কলিকাতার ইংরেজ-মহিলারাও প্রায় সেইরূপ চক্ষে স্বামীকে দেখিত। অতি সামান্যমাত্র রোগে আক্রান্ত হইলেই পত্নী পতিকে ত্যাগ করিয়া ইউরোপে গমন করিত, কারণ তৎকালে পতির প্রতি পত্নীর বা পত্নীর প্রতি পতির অন্তরে টান ছিল না। অনেক স্থলে জাহাজ কেডগিরিতে উপস্থিত হইতে না হইতে পতি আপনার অন্তঃপুর কৃষ্ণকায়া উপপত্নীগণে পরিপূর্ণ করিয়া ফেলিত। কোন কোন স্থলে এরূপও ঘটিয়াছে যে, স্থান পরিবর্তনের উপদেশ দিবার নিমিত্ত পতি ডাক্তারকে উৎকোচপ্রদানে বশীভূত করিয়াছে। এতাদৃশ অবস্থায় এই সকল বিবাহ সম্বন্ধে লোকে যে নানাপ্রকার কথা বলিবে, তাহাতে আশ্চর্যের বিষয় কি আছে? এ সম্বন্ধে একজন লিখিয়াছেন,—“কলিকাতার বিবাহানুষ্ঠানে হাইমেনের (প্রজাপতির) সহিত কিউপিডকে (কামদেবকে) অতি কদাচিৎ সন্ধ্যাকালে দেখিতে পাওয়া যায়।” বিবাহানুষ্ঠান সম্পন্ন হইত; ১৭৭৮ অব্দে এইরূপ প্রথাই দৃষ্ট হয়,—তাহার কত পুর্ব্ব হইতে এই প্রথা প্রচলিত হইয়াছিল, বলা যায় না। জনৈক লেখক লিখিয়াছেন;

 —“এখানে বিবাহানুষ্ঠানটা সকল পক্ষেরই নিকট সাতিশয় আনন্দজনক; বিশেষতঃ আমার মনে হয়, পাদ্রি সাহেবের আরও আনন্দজনক, কারণ তিনি ঐ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিবার পারিশ্রমিক প্রত্যেক স্থলে বিশটি করিয়া সোণার মোহর পাইয়া থাকেন। বর ও কন্যার বন্ধুবান্ধবেরা মনোহর বেশভূষায় সুসজ্জিত হইয়া নবদম্পতির কোনও আত্মীয়ের বাটীতে সমবেত হন এবং অতি উপাদেয় ভোজ্যপানীয় দ্বারা পরিতোষিত হন। আর ঐ অনুষ্ঠান জন্য আনন্দপ্রকাশার্থ দেখা-সাক্ষাৎ-ব্যাপারে সমস্ত নগর আলোড়িত হয়।

 বোধ হয়, সে কালে কর্তৃপক্ষীয়েরাও বিবাহিত কর্ম্মচারী অধিক পছন্দ করিতেন। বিবাহিত সিভিলিয়ানদিগকে মাসিক ২০০ দুই শত টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হইত; অবিবাহিতদিগের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবার পক্ষে ইহা অল্প প্রলোভন নহে।

 সুপ্রসিদ্ধ ওলন্দাজ নৌসেনাধ্যক্ষ ষ্টাভোরিনস্ ১৭৭৩ অব্দে ইউরোপীর মহিলাদিগের সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন;—“এক ঝুড়ি রত্নালঙ্কার এক ঘর অতি সুন্দর পরিচ্ছদ ও তাকের উপর সুসজ্জিত রাজব্যবহারযোগ্য বাসনকোসন, এই সকলের বিনিময়ে গার্হস্থ্য সুখশান্তি ক্রয় করিতে হইবে; পতি হয় এই সমস্ত দ্রব্য প্রদান করিবেন, নচেৎ তাঁহার গৃহ এতদূর গরম হইয়া পড়িবে যে, তাঁহার তিষ্ঠান ভার হইয়া উঠিবে; এদিকে পত্নী কিন্তু গৃহস্থালীর কোনও ব্যাপারেই কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত করিবেন না, তিনি দাসদাসীর হস্তে সমস্ত ভার অর্পণ করিয়াই নিশ্চিন্ত যেন সাহেবের সাধারণতঃ ৮টা হইতে ৯টার মধ্যে শয্যাত্যাগ করেন। ১॥৹টার সময় মাধ্যাহিক আহার প্রস্তুত হয়; অনন্তর তাঁহারা ৪॥৹টা বা ৫টা পর্য্যন্ত নিদ্রা যান, তৎপরে যথারীতি বেশভূষা করেন এবং সায়ংকাল ও রাত্রির কিয়দংশ বন্ধুবান্ধবগণের সহিত মিলিত হইয়া বা নৃত্যোৎসবে যোগদান করিয়া অতিবাহিত করেন; এই সকল নৃত্যোৎসব শীতকালেই ঘন ঘন হইয়া থাকে। ইঁহারা বহু নরনারী একত্র মিলিয়া আমোদপ্রমোদ করিতে ভালবাসেন। সাধারণতঃ গঙ্গার মনোহর তীরের বা মনোরম বক্ষের উপর এইরূপ অমোদ প্রমোদের আয়োজন হইয়া থাকে।” ম্যাকিলটস্ সাহেব এতদ্দেশীয় ইউরোপীয়দিগের জীবনবৃত্তান্ত এইরূপ বর্ণন করিয়াছেন;—

 “প্রাতে প্রায় ৭টার সময় তাঁহার (সাহেবের) দরওয়ান ফটক খুলে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সরকারগণ, চাপরাসীগণ, হরকরাগণ, চোবদারগণ, হুঁকাবদারগণ, খানসামাগণ, কেরাণীগণ ও প্রার্থিগণ দ্বারা বারান্দা পরিপূর্ণ হইয়া যায়। হেড্বেহার ও জমাদার ৮টার সময় হলে ও তাঁহার শয়ন-মন্দিরে প্রবেশ করে। তৎক্ষণাৎ একটী কামিনী তাঁহার পার্শ্ব ত্যাগ করে এবং গুপ্ত সিঁড়ী দিয়া নয় তাহার নিজ প্রকোষ্ঠে অথবা প্রাঙ্গণের বাহিরে নীত হয়। প্রভু আপনার পদদ্বয় শয্যা হইতে বাহির করিবামাত্র, যে সমস্ত লোক তাঁহার জাগরণের প্রতীক্ষা করিতেছিল, তাহারা সকলেই সেই গৃহে প্রবেশ করে এবং দেহ ও মন্তক যথাসম্ভব নত করিয়া ও হস্তাঙ্গুলির অন্তঃপৃষ্ঠ দ্বারা স্ব স্ব ললাটদেশ ও পশ্চাৎপৃষ্ট দ্বারা গৃহতল স্পর্শ করিয়া প্রত্যেকে তিনবার সেলাম করে। প্রভু অনুগ্রহপূর্ব্বক হয়ত মস্তক ঈষৎ কম্পিত করেন। অথবা তাহার কৃপা ও আশ্রয়প্রার্থীদিগের প্রতি একবার কটাক্ষপাত করেন। অনন্তর তাঁহার লম্বা ঢিলা পাজামা উন্মোচন করা হইলে একটি পরিষ্কার ধপধপে শার্ট, প্যাণ্টালুন, স্টকিঙ্ ও জুতা যথাক্রমে তাঁহার উৰ্দ্ধাদি, জঙ্ঘায়, পাদদ্বয়ে ও পদতলে পুরাইয়া দেওয়া হয়। এই বেশপরিবর্তন ব্যাপারে তিনি কিছুমাত্র আয়াস স্বীকার করেন না, পুত্তলবৎ নিশ্চেষ্ট থাকেন। এই কার্যে ন্যূনাধিক অর্ধ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। তৎপরে ক্ষৌরকার প্রবেশ করিয়া তাহার ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন করে, নখ কাটিয়া দেয় ও কর্ণমল পরিষ্কার করে (অর্থাৎ ‘কাণ দেখে’) অতঃপর জনৈক ভৃত্য চিলম্‌জি ও ‘মগ্’ আনয়ন করে, এবং তাঁহার মস্তকে জল ঢালিয়া দেয়, হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিয়া দেয় ও হস্তে তোয়ালে অর্পণ করে। প্রভু তখন মহাড়ম্বরে প্রাতর্ভোজনাগারে প্রবেশ করিয়া আসন গ্রহণ করেন; খানসামা চা প্রস্তুত করিয়া ঢালিয়া দেয় এবং এক প্লেট রুটি বা ‘ষ্টোষ্ট্' প্রদান করে। এই সময়ে কেশ-সংস্কারক পশ্চাদ্দেশে আসিয়া আপনার কাজ আরম্ভ করিয়া দেয়, ওদিকে হুঁকাবরদার হুঁকার (গুড়গুড়ির বা ফরসির) নলের মুখটি প্রভুর হস্তে প্রদান করে। একদিকে কেশসংস্কারক আপনার কর্ম্ম করিতে থাকে, অপরদিকে সাহেব পর্যায়ক্রমে ভোজন, পান ও ধূমপান করিতে থাকেন। ক্রমে তাঁহার মুৎসুদ্দী বিনীতভাবে সেলাম করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হয় এবং অন্যান্য অনুচর অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক নিকটে গমন করে। প্রার্থীদিগের মধ্যে দুই একজন নামজাদা লোক থাকিলে, তাঁহাদিগকে বসিবার জন্য চেয়ার দেওয়া হয়। এই সমস্ত ব্যাপার প্রায় ১০টা পর্যন্ত চলিতে থাকে। অতঃপর প্রভু অনুচরবর্গে পরিবৃত হইয়া পাল্কীর ভিতর প্রবেশ করেন, এবং তাঁহার অগ্রে অগ্রে ৮ হইতে ১২ জন চোবদার, হরকরা ও চাপরাশী স্ব স্ব পদের পরিচায়ক চিহ্ন এবং ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের পাগড়ি ও কোমরবন্দবিশিষ্ট বিশেষ বিশেষ প্রকারের পরিচ্ছদ ধারণ করিয়া এক প্রকার লাফাইয়া লাফাইয়া ছুটিতে থাকে, তারারা প্রভুর কিছুমাত্র অসুবিধা না জন্মাইয়া মধ্যে মধ্যে কাঁধ বদল করে। প্রভুর যদি বন্ধু-বান্ধবগণের সহিত দেখা-সাক্ষাৎ করিবার প্রয়োজন থাকে, তাহা হইলে চাপরাসীরা অগ্রগামী হইয়া বেহারদিগকে পথ প্রদর্শন করে; আর যদি আফিসে কাজ থাকায় তাঁহার উপস্থিতিমাত্র আবশ্যক হয়, তাহা হইলে তিনি তথায় দর্শন দেন এবং বেলা ২টা পর্যন্ত কাজকর্ম্ম করেন। অতঃপর প্রভু, সদলবলে যথেচ্ছ পরিচ্ছদে উপাদেয় মাধ্যাহ্নিক আহারে বসিয়া যান,—পরিচর্য্যার জন্য প্রত্যেকেরই স্ব স্ব ভৃত্য উপস্থিত থাকে। ইহার পর, মহিলাদিগের উপস্থিতি স্বত্বেও, মদ্যসহ গেলাস আসিয়া উপস্থিত হইবামাত্র হুঁকাবরদারের প্রত্যেকে এক একটি হুঁকা লইয়া প্রবেশ করে এবং স্ব স্ব প্রভুর হস্তে নল প্রদান করিয়া পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইয়া থাকে ও আগুনে ফুঁ দিতে থাকে। বন্ধুবান্ধবেরা অপর নৈশভোজনে ফিরিয়া আসিবেন এইরূপ আশা থাকায়, তাঁহার শিষ্টাচারবর্জিত হইয়া অপহৃত হইতে থাকেন ও নিজ নিজ পাল্কীতে প্রবেশ করেন। সুতরাং কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রভু শয়ন-মন্দিরে যাইবার অবসর প্রাপ্ত হন। তথায় প্রবেশ করিবামাত্র তাঁহার শার্ট পর্যন্ত সমস্ত পরিচ্ছদই খুলিয়া লওয়া হয় ও লম্বা ঢিলা পাজামা পরাইয়া দেওয়া হয়। তখন তিনি শয্যায় শয়ন করেন ও রাত্রি, ৭টা ৮টা পর্যন্ত নিদ্রা যান। তৎপরে পূর্ব্বকথিত অনুষ্ঠানগুলি পুনরনুষ্ঠিত হয় এবং প্রাতঃকালের ন্যায় সর্ব্ব প্রকার পরিস্কৃত পরিচ্ছদ পরাইয়া দেওয়া হয়। এই সময়ে হুঁকাবরদার আসিয়া নলটি তাঁহার হাতে দেয়। তিনি চা খাইবার টেবিলে উপবিষ্ট হন, ওদিকে কেশ-সংস্কারক আসিয়া আপনার কর্তব্য করিতে থাকে। চা খাইবার পর তিনি একটি সুরম্য কোট পরিধান করেন এবং মহিলাদিগকে শিষ্টাচারসূচক দর্শনদানে গমন করেন। অতঃপর তিনি ১০ টার কিঞ্চিৎ পুর্বে প্রতাগত হন, কারণ ১০ টার সময় নৈশ আহার পরিবেশিত হইয়া থাকে। আহারার্থ সমবেত বন্ধু বান্ধবদল রাত্রি ১২টা ১টা পর্যন্ত তথায় থাকেন এবং যথাসম্ভব ধীরতা ও ভদ্রতা রক্ষা করেন। অনস্তর তাঁহার প্রস্থান করিলে প্রভু শয়নমন্দিরে নীত হন। তথায় তিনি দেখিতে পান যে, একটা সঙ্গিনী তাহাকে আমোদিত করিবার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে; তঁহার সহবাসে প্রভু প্রাতে ৭টা ৮টা পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। ইহা অপেক্ষা কিছুমাত্র অধিক ক্লেশ স্বীকার না করিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা অগাধ ধন সঞ্চয় করিয়া থাকেন। সে সময়ে সামান্য কেরাণী হইতে স্বয়ং গভর্ণর জেনারেল পর্যন্ত সকল শ্রেণীর মধ্যে ও সৰ্বত্র হুঁকার সমধিক প্রচলন ছিল। গভর্ণর জেনারেল ও তৎপত্নী কর্তৃক প্রচারিত একখানি নিমন্ত্রণ পত্রের মর্ম্ম এস্থলে প্রদত্ত হইল। তাহা হইতেই এ কথাটী প্রতিপন্ন হইবে।

 “মিষ্টার ও মিসেস হেষ্টিংস্••• •• •• ••কে অভিবাদন জানাইতেছেন এবং প্রার্থনা করিতেছেন যে, আগামী বৃহস্পতিবারে মিসেস হেষ্টিংসের সহরের বাটীতে যে কন্সার্ট ও নৈশভোজ হইবে, তাহাতে তিনি অনুগ্রহ করিয়া উপস্থিত হইবেন। ১লা অক্টোবর। ১৭৭৯।

{gap}}কন্সার্ট আটটার সময় আরম্ভ হইবে। মিষ্টার...••••••কে অনুরোধ করা যাইতেছে, যে, তিনি যেন আপনার হুঁকাবরদার ব্যতীত অপর কোনও ভৃত্যকে সঙ্গে করিয়া না আসেন।

{gap}}ওয়াল্টার হামিল্টন বলেন, তদানীন্তন কলিকাতাবাসী ইউরোপীয়দিগের মধ্যে প্রাতঃকালের শীতল বায়ু সেবন করিবার নিমিত্ত প্রত্যুষে গ্রাত্রোথ্থান করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল, কারণ সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে বায়ু বিলক্ষণ মনোরম থাকে। বর্তমান সাকুলার রোড ও পেরিনের বাগান[১] প্রভৃতি স্থানগুলি এক সময়ে সৌখীনদিগের বিচরণ-স্থল ছিল। অধুনা গোল দীঘি নামে খ্যাত ‘মেছোপুকুর’ ও চাঁদপাল ঘাট এতদুভয়ের মধ্যবর্তী আরও কতকগুলি প্রিয় বিহার-ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে। পদব্রজে বেড়াইবার প্রথাও প্রচলিত ছিল। কথিত আছে যে, সার্ উইলিয়াম জোন্স তাঁহার খিদির পুরের বাড়ী হইতে প্রতিদিন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ত্রীটের নিকটস্থ সুপ্রীম কোর্টে হাঁটিয়া যাইতেন [২] তৎকালে গভর্ণর এবং গভর্ণমেন্টের মেম্বরগণ শোভাযাত্রার আকারে সজ্জিত হইয়া প্রতি রবিবারে গির্জ্জায় হাঁটিয়া যাইতেন। পরন্তু কলিকাতার অস্থিত একটি সুন্দর ঘোড়দৌড়ের মাঠই ব্যায়ামের অর্থাৎ গাড়ীর ভিতর বসিয়া ঝিমাইবার প্রসিদ্ধ স্থান ছিল,—উহা প্রাতঃকালে ও সায়ংকালে হাওয়া খাওয়ার এক প্রকার সৌখীনের মেলা ছিল,— তথায় “লোকের উদরে এক গ্রাস হাওয়া প্রবেশ করিতে না করিতে দশ গ্রাস ধুলি প্রবেশ করিত, কারণ তৎকালে ঐ রাস্তায় জল দেওয়া হইত না।”

 কলিকাতার সাহেব-সমাজ তৎকালে সৌখীন স্ত্রীপুরুষে পূর্ণ ছিল,—আমোদ প্রমোদেরও কিছুমাত্র অভাব ছিল না। বর্তমান সময়ের ন্য়ায় তখনও বিলিয়ার্ড একটি অতি প্রীতিদায়ক ক্রীড়া মধ্যে পরিগণিত ছিল। এক ব্যক্তি লিখিয়াছে;—“যে টাকার হার জিত হয়, তাহা শুনিলে শোণিত দারুণ উত্তপ্ত হইয়া উঠে। সাধারণ গৃহস্থালয়ে বিলিয়াড় খেলিবার বরটি এক প্রকার রাজভবন তুল্য। কফি-হাউসে॥৹ আট আনা দিলেই তুমি কয়েক ঘণ্টার অশ্য বাতির আলোকে সানুচর টেবিল পাইবে-প্রত্যেক কফি হাউসেই অন্ততঃ দুইটি করিয়া টেবিল আছে; সুতরাং স্ফুর্তিযুক্ত লোকেরা এখানেও ইউরোপীয়দিগের ন্যায় আমোদ প্রমোদ করিবার নানাপ্রকার সুযোগ সুবিধা পাইয়া থাকে। সেলবিটির ক্লব, একটা বিখ্যাত জুয়া খেলার আডডা ছিল, কিন্তু লর্ড কর্ণওয়ালিস্ অতি কঠোরতার সহিত প্রকাশ্যে জুয়া খেলা নিবারণ করিয়া দেন।” মিসেস ফ্রে তাস খেলা সম্বন্ধে লিখিয়াছেন;—“চা খাওয়ার পর ১০টা পর্যন্ত হয় তাসে, না হয় গীতবাদ্যে কাটিয়া যায়, এবং ১০ টার সময় নৈশ ভোজন ব্যাপার সম্পন্ন হয়। তাস খেলার মধ্যে ফাইভ্, কার্ডলু সমধিক প্রচলিত, তাহাতে ১ টাকা হইতে ১০ টাকা পর্য্যন্ত বাজি ধরা হয়। এটা তোমার নিকট অত্যন্ত অধিক বলিয়া: বোধ হইতে পারে, কিন্তু এখানে উহা কেহ গ্রাহ্যই করে না। ‘ট্রি’ ‘ডিল’ ও ‘হুইষ্ট’ খেলায়ও খুব প্রচলন আছে, কিন্তু মহিলারা শেষোক্ত খেলায় অতি কদাচিৎ যোগদান করেন, কারণ উহাতে বাজির পরিমাণ সাধারণতঃ খুব অধিক না হলেও পুরুষদিগের মধ্যে অনেক সময়ে বাজি অনেক চড়িয়া যায়, সুতরাং যাঁহারা কেবল আমোদের জন্য খেলায় বসেন, তাঁহারা এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইয়া পড়েন, পাছে তাঁহাদের ভ্রমে অন্যান্য লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

 সাপ-নৌকা নামক সুদীর্ঘ নয়নমনোহর তরণীতে বাদ্যকর সম্প্রদায় সহ প্রধানতঃ সায়ংকালে নৌকাবিহার করিবার প্রথা সমধিক প্রচলিত ছিল। সাহেবদের আপন আপন প্রমোণ-তরি ছিল; তাঁহার সময়ে সময়ে বন্ধুবান্ধবগণকে লইয়া ঐ সকল তরিতে চন্দ্রনগর বা শুকসাগরে প্রমোদবিহারে যাইতেন। ইংরেজ ও ওলন্দাজ উভয় জাতিই বন্ধুবান্ধবগণকে লইয়া সদলবলে আমোণ করিতে ভালবাসিতেন এবং গঙ্গার সুরম্য তীরে ও মনোহর বক্ষে ঐরূপ আমোদের অনুষ্ঠান করিতেন। ষ্টাভোরিনস ১৭৭০ অব্দে লিখিয়াছেন;—ময়ূরপঙ্খী নামে আর এক প্রকার নৌকা এ দেশে প্রচলিত আছে; উহার গঠনপ্রণালী অন্তি বিচিত্র। এই সকল নৌকা সাতিশয় দীর্ঘ ও স্বল্পবিস্তার হইয়া থাকে,—সময়ে সময়ে এক একখানি দৈর্ঘ্যে ১০০ ফুটেরও অধিক হয়, অথচ বিস্তারে ৮ ফুটের অধিক নয়। এই সমস্ত নৌকা ক্ষেপণি-সাহায্যে চালিত হয়, কোন কোন নৌকায় ৪০ জন দঁড়ী থাকে। পশ্চাৎস্থিত একটি সুবৃহৎ কর্ণ দ্বারা ইহাদের গতিমুখ নিয়মিত হয়; ঐ কর্ণ কখনও ময়ূরের, কখনও সর্পের, কখনও বা অন্য জন্তুর আকারে গঠিত হয়। একব্যক্তি দণ্ডায়মান থাকিয়া ও সময়ে সময়ে বৃক্ষশালা সঞ্চালন করিয়া ক্ষেপণ-চালকদিগকে পরিচালিত করে এবং তাহাদিগকে হাসাইবার বা অধিক পরিশ্রম করাইবার নিমিত্ত নানাপ্রকার অঙ্গ ভঙ্গি করিতে ও গল্প বলিতে থাকে। নৌকার পশ্চাদ্ভাগে এক স্থানে স্তম্ভোপরি লম্বিত একটি ছাদ থাকে; তরিস্বামী বন্ধুবান্ধবগণ সহ তদুপরি উপবিষ্ট থাকিয়া স্নিগ্ধ সান্ধ্যসমীরণ সেবন করেন। এই সকল নৌকা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য, কারণ এগুলি অতি সুন্দর রঙ করা ও গিল্টি করা নানা প্রকার অলঙ্কারে সুসজ্জিত হয়, এবং ঐ সমস্ত সজ্জা অতি উজ্জ্বলভাবে বার্ণশ করা হয় ও তাহাতে বিলক্ষণ সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায়।” ওয়ারেন হেষ্টিংসের কলিকাতা পরিত্যাগ কালীন তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ সম্বন্ধে লিখিত হইয়াছে যে, “তাঁহাদের বজরা নানা প্রকার ভক্ষ্য বস্তুতে ও অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যে পূর্ণ হইল, উহাদের উপর নিশান উড়িতে লাগিল ও বাদ্যকর-সম্প্রদায়গণ সুমধুর ঐকতান বাদ্য করিতে লাগিল; এইরূপে সজ্জিত হইয়া তাঁহারা নদীর মোহনাস্থিত ‘সাগর' পর্যন্ত তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। লর্ড ভ্যালেন্‌সিয়া ১৮০৩ অব্দে লিখিয়াছেন যে, তিনি লর্ড ওয়েলেস্‌লির সরকারী বজরায় নদী দিয়া আসিয়াছিলেন; ঐ রজরা হরিৎ ও সুবর্ণ বর্ণে অতি মনোহর রূপে ভূষিত ছিল, উহার শিরোদেশে একটা গিণ্টিকরা বিস্তুৃতপক্ষ ঈগল এবং পশ্চাদ্ভাগে একটা ব্যাঘ্রের মস্তক ও দেহ শোভা পাইতেছিল; উহার মধ্যস্থলে ২০ জন লোক সচ্ছন্দে থাকিতে পারে।”

 আসল কথা এই বে, সেই ধুলিময় পথটিই শকটপরিচালনের একমাত্র রাস্তা ছিল; গঙ্গার ধার দিয়া রাস্তা ছিল না, সহরের বাহিরেও শকটপরিচালনপথ ছিল না; কাজেই তঁহাদিগকে নদীতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইত! ঘোড়দৌড়টা প্রাচীন কলিকাতার লোকের একটা বিশেষ প্রিয় পদার্থ ছিল।[৩] খিদিরপুরে গার্ডেন রীচের নীচে একটা ঘোড়দৌড়ের মাঠ ছিল; তদ্ব্যতীত কলিকাতার ময়দানেও একটা ছল। ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে একটা ২০০০ টাকার চালায় প্লেটের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হইয়াছিল, এবং তাহাতে কথিত হইয়াছিল যে, সাহেব খানসামারা কলিকাতার ইউরোপীয় ভদ্রলোক ও মহিলাগিকে ঘোড়দৌড়ের অবসানে একটি ‘বল’ দিবে। শিকারের আমোদও যেরূপ, ঘোড়দৌড়ের আমোদও সেইরূপ; উহাতে কেবল যে নিষ্ক্রিয় খাতখনকেরা অঙ্গচালনার সুযোগ প্রাপ্ত হইত এরূপ নহে, তদ্ভিন্ন দেশীয়রাও মহোপকার লাভ করিত, কারণ তৎকালে কলিকাতার উপকণ্ঠভাগে চিতাবাঘের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব থাকায় দেশীয় লোকদিগের অনেকেই বঙ্গ জন্তুর হস্তে মারা পড়িত। শুকরশিকারই অতি প্রিয় আমোদ ছিল এবং তদুদ্দেশ্যে বিগত শতাব্দীতে কলিকাতায় ১৫ মাইল দক্ষিণস্থ বকরা নামক স্থানই মনোনীত হইত।

 সুর্ত্তিখেলার তখন বড়ই বেশী প্রচলন ছিল। সৌখীন সমাজ ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাট বাজার করিতেও ভালবাসিত। এ সময়ে এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন,—“সাহেবদিগের দোকানগুলি, বিলাসিতাসূচকই হউক বা প্রয়োজনীয়ই হউক, নানাপ্রকার ইউরোপীয় পণ্যের ভাণ্ডারস্বরূপ, এবং নিষ্কর্মা ও সৗখীনদিগের প্রত্যুষে মিলনস্থল; ইহারা তথায় মিলিত হইয়া দিবসের কুৎসা প্রচার করিতে থাকে এবং অতি উচ্চ মূল্যে পিঞ্চেন্ বেক্ সাহেবের খেলানা বা ট্যাভিষ্টক্ স্ট্রীটের স্বল্পমূল্য অকিঞ্চিৎকর ভূষণ ক্রয় করে। পরিচ্ছদ প্রস্তুতকারক দরজিরা পূর্বকালে প্রচুর লাভ করিত। মার্টিন্ নামক একজন দরজির বিষয় উল্লিখিত আছে যে, সে ১০ বৎসর কাজ করার পর দুই লক্ষ টাকা লইয়া ইউরোপে প্রভিগমন করে! মহিলাদিগের পরিচ্ছদপ্রস্তুতকারিণীরাও অতি প্রাচীন কাল হইতে কলিকাতায় বসবাস করিতেছে। কলিকাতার মহিলারা লণ্ডনের মহিলাদিগেরই ন্যায় বেশভূষা করিত, প্রভেদের মধ্যে এই যে, ইঁহাদের ফ্যাশন বৎসর খানেকের মধ্যে পুরাতন হইয়া পড়িত।

 ইউরোপীয় শব-সৎকার-সাধকদিগের ব্যবসায়ও বিলক্ষণ লাভজনক ছিল; এমন কি এক একটি বর্ষাকালেই ৫০,০০০ হাজার টাকা আয় হইত। কথিত আছে যে, ১৭৮০ অব্দে কলিকাতার বাড়ীর উপরতলায় দুইটি কুঠারি এবং একটী হলের ভাড়া ছিল ১৫০ টাকা। সৌখীন অংশে উহার ভাড়া ৩০০ হইতে ৪০০ টাকা পর্য্যন্ত ছিল। 'বংলো' বাড়ীর ভাড়াও ঐরূপ উচ্চ ছিল। কাপ্তেন উইলিয়াম্‌সন্ কয়েক প্রকার খাদ্য দ্রব্যের একটি সুন্দর বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; স্থানাভাববশতঃ এস্থলে তাহার সবিস্তার উল্লেখ করিতে পারা গেল না। কথিত আছে যে, ষ্টাভোরিনসের সময়ে অর্থাৎ ১৭৬৮ খৃষ্টাব্দে বা তৎসমকালে “কলিকাতায় কেবল শীতকালেই মটর, কলাই ও কপি পাওয়া যাইত; গ্রীষ্মকালে কাঞ্চিৎ 'স্পিনেজ্' (পুতিকা) ও সসা ব্যতীত অন্য কিছুই পাওয়া যাইত না; কিন্তু ১৭৮• অব্দ গোল আলু, মটর ও ফরাসী কলাই অত্যন্ত আদরণীয় হইয়াছিল। কথিত আছে যে, ওলন্দাজেরাই তাহাদের উত্তমাশা অন্তরীপের উপনিবেশ হইতে আলু আনাইয়া এদেশে প্রথম উহার চাষের সৃষ্টি করে।” তাহাদের নিকট হইতে ইংরেজরা বৎসর বৎসর সর্ব্ব আহার্য্য উদ্ভিদের এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় গাছপালার বীজ লইতেন। তাহারা আমাদিগকে নানাপ্রকাযর দ্রাক্ষালতাও দিয়াছে; ঐ সকল লতা বইতে অসংখ্য ডালপালা কাটিয়া লইয়া বঙ্গদেশের ও উপর অঞ্চলের সর্ব্বত্র প্রেরিত হইয়াছে। বোধ হয়, ওলন্দাজেরাই ইংরেজদের হৃদয়ে উদ্যানের প্রতি অনুরাগ সঞ্চার করিয়া দিয়াছে। চুঁচুড়াতে তাহাদের নিজেদেরই একটি উদ্যান ছিল; উহা উপর্য্যুপরি নির্ম্মিত তিনটী প্রস্তরবেদিকার উপর প্রস্তুত হইয়া ছিল এবং উহার পশ্চাদ্ভাগে বৃক্ষকুঞ্জসমূহ দণ্ডায়মান ছিল। জিরেটে ফরাসীদেরও একটি অতি সুন্দর বাগান ছিল। ১৮৮০ অব্দে হিকির গেজেটে নানাস্থানের কতকগুলি বাগান-বাড়ীর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, যথা—বৈঠকখানায়, বালিগঞ্জে, টালায়, কমোডোর রিচার্ডসনের বাগানবাড়ী, রসাপাগলার ডন্ক্যান্ সোর নামক স্থানে অতি মনোহরভাবে অবস্থিত। জন্ রেলের বাগানবাড়ী, চৌরঙ্গিতে সিপাহী বারিকের পূর্ব্বদিকে ও লবণ-জলের হ্রদে যাইবার প্রধান রাস্তা হইতে ৪০০ গজ দূরে অবস্থিত; আলিপুরের নিকট কুলপি রোডের উপর অবস্থিত একটি হল, তিনটি কুঠারি ও দুইটী বারান্দাবিশিষ্ট একটী বাগানবাড়ী। ক্রফ্‌ট সাহেব গভর্ণর জেনারেল (ওয়ারেন্ হেষ্টিংস্) ও তৎপত্নী এবং আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ ভদ্রলোককে নিজের শুকসাষরস্থ বাগানে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইয়াছিলেন; উহা এক্ষণে নদীগর্ভে নিমজ্জিত।

 সেকালে সাহেবদিগের মধ্যে পদভেদে মর্যদাভেদের অত্যন্ত প্রাবল্য ছিল। কথিত আছে যে, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদিগের মধ্যে লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্কই প্রথম এই অবস্থায় বিপর্যয় ঘটান। গভর্ণমেণ্ট হাউসে তিনি যে সমস্ত লেভি (দরবার) করিতেন, তাহাতে সমাজের সকলকেই নিমন্ত্রণ করিতেন; ইহাতে সিভিলিয়ান্ ও কৌলীন্যাভিমানী অন্যান্য সাহেবেরা নিরতিশয় অসন্তুষ্ট হইতেন মিসেস্ কিণ্ডার্স্‌লি নিজ ভ্রমণবৃত্তান্তে (১৭৬০-১৭৬৮) লিখিয়াছেন-“ভারতীয় ইংরেজ পরস্পরের সাহায্যার্থ যেমন অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন, ভূমণ্ডলের আর কোন অংশেই লোকে তদ্রুপ করে না।” বস্তুতঃ এ কথাটী অদ্যাপি বিশষ্টরূপে সত্য। অত বড় সুপণ্ডিত যে অধ্যাপক ম্যাক্সমুলার, তিনিও ভারতীয় ইংরেজদিগের স্বজাতি-প্রেমে বিস্ময়বিমূঢ় হইয়াছিলেন।

 তদানীন্তন ভারতীয় ইংরেজদিগের আতিথেয়তার কথা বহু পর্যটক বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতা-সহকারে খ্যাপন করিয়াছেন। কথিত আছে যে, য়াঁহার বাটিতে আতিথ্য গ্রহণ করা যায়, তাঁহার অর্থ ও ভৃত্যবর্গ অতিথির ইচ্ছাধীন। এ সম্বন্ধে এক ব্যক্তি পশ্চাল্লিখিতরূপ কৌতুকাবহ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন;—প্রাতরাশটীই এক মাত্র সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন আহার, স্ব স্ব রুচি অনুসারে যাহার যাহা ভাল লাগে, সে তাহারই হুকুম করে, পক্ষান্তরে মাধ্যাহ্নিক আহার, চা ও নৈশ আহার যেন এক এক প্রকার রাজকীয় লেভি। ১২টার সময় একটা আহারের ব্যবস্থা হয়; তাহাতে পর্ষ্যুষিত শূকরমাংস, কুক্কুটশাবক, এবং একপ্রকার শীতল সুরামিশ্রিত সরবৎ থাকে! ১টার সময় লঘু নৈশ আহারের ব্যবস্থা, তৎসহ দুই এক গেলাস অনুগ্র সুরা, রুটি পিষ্টকাদির ছিলকা ও পনীর; তৎপরে ১১টার সময় হুঁকা ও শয্যা। লর্ড কর্নওয়ালিস্ ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের প্রথম দিবসে কতকগুলি লোককে ওল্ড কোর্ট হাউসে বেলা ৩॥৹ টার সময় মাধ্যাহ্নিক আহারে নিমন্ত্রণ করেন। কূর্ম্ম ও পেরু নিমন্ত্রিতদিগের রসনা জলসিক্ত করিয়া তুলিয়াছিল। রাত্রি ৯॥৹ টার সময় একটি ‘বল্’ নাচের ব্যবস্থা হইয়াছিল। রাত্রি ১২টায় নৈশ আহারের ব্যবস্থা হয় এবং প্রত্যুষে ৪টার সময় মজলিস ভাঙ্গিয়া যায়।

 পানীয় সম্বন্ধে এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন;—নিত্য প্রয়োজনীয় সাংসারিক দ্রব্যজাতের মধ্যে মদ্যই সর্বাপেক্ষা অধিক ব্যয়সাধ্য, কারণ প্রচলিত রীতি বলিয়াই হউক, অথবা ঔষধরূপেই হউক, সামান্য ভৃত্য পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই প্রতিদিন এক এক বোতল মদ্য পান করে, আর ভদ্র লোকেরা তাহার চতুর্গুণ পান করেন। বীয়ার ও পোর্টার পিত্তজনক বিবেচিত হওয়ায় অতি অল্পই ব্যবহৃত হইত। ম্যাডীরা ও ক্লারেট এই দুইটিই অতি প্রিয় পানীয় ছিল, তবে সাইডার এবং পেরিও কখন কখন পানীয়রূপে ব্যবহৃত হইত। মহিলারা প্রতিদিন এক এক বোতল ক্ল্যারেট পান করিতেন, আর ভদ সাহেবরা পাঁচ টাকা বোতলের তিন চারি বোতল খাইয়া ফেলিতেন। ২০ বৎসর পূর্বে যখন কতকগুলি লোক মফস্বল অঞ্চলে প্রত্যহ এক ডজন বীয়ার খাইয়াও কিছু হইল না বলিয়া মনে করিত, সে বীয়ার-পান-প্রবৃত্তি অপেক্ষাও ইহা বহুগুণে নিকৃষ্ট। দেশী বীয়ার নামে আর এক প্রকার পানীয়ের প্রচলন ছিল। এতৎ সম্বন্ধে এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন;—“আহারের সময়ে কৃত্রিম উপায়ে শীতলীকৃত মদ্য পান করা হইয়া থাকে বটে, তথাপি গ্রীষ্মঋতু উপযোগী দেশী বীয়ার নামক এক প্রকার উপাদেয় পানীয় সচরাচর ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অন্ততঃ এরূপ সময়ে, বিশেষতঃ ‘কালিয়া’ ভোজনের পর, এতাদৃশ তৃপ্তিজনক পানীয় আর নাই। সমগ্র পানীয়ের এক-পঞ্চমাংশ পেস্টার বা বীয়ার, এক গেলাস তাড়ি, কিঞ্চিৎ খাঁড় গুড় এবং একটু আদা বাটা অথবা ক মা লেবুর বা পাতি লেবুর শুস্ক খোসা এই কয়েকটী দ্রব্য একত্র মিশ্রিত করিয়া দেশী বীয়ার প্রস্তুত করা হয়।”

 গৃহসজ্জা সম্বন্ধে মিসেস কিণ্ডার্সলি লিখিয়াছেন;—“গৃহসজ্জা যারপর নাই দুর্ম্মুল্য এবং এখানে পাওয়াও দুঃসাধ্য; সেই জন্য এমন একটী প্রকোষ্ঠ দেখা যায় না যে, তাহার সমস্ত সজ্জা একজাতীয় হইয়াছে। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা আপনাদের গৃহসজ্জা ইউরোপীয় জাহাজের বা চীনদেশ হইতে আগত জাহাজের কাপ্তেনদিগের নিকট হইতে যে কোনও প্রকারে সংগ্রহ করিত, অথবা দেশীয় আনাড়ি সূত্রধরদিগের যারা প্রস্তুত করাইয়া লইত, কিন্তু বোম্বাই হইতে আনাইতে হইলে আদেশ দিবার তিন বৎসর পরে আহা আসিয়া উপস্থিত হয়।”

 কাচের জানালা তখন অত্যন্ত দুর্মূল্য ছিল। ওয়ারেন হেষ্টিংস ও তাঁহার ন্য়ায় অত্যল্পসংখ্যক লোকেরই কাচের জানালা ছিল।

 খৃষ্টোৎসব (বড়দিন) সম্বন্ধে মিসেস্ ফে লিখিয়াছেন;—"এখানে খৃষ্টোৎসব উহার সর্ব্বপ্রকার প্রাচীন আমোদ প্রমোদের সহিত পালিত হইয়া থাকে। উৎসবের দিন ইংরেজ ভদ্রলোকের বাসভবনের বাহু দৃশ্য এরূপ নবভাৰ ধারণ করে যে, তাহাতে মন আনন্দরসে নিমগ্ন হয়। প্রধান প্রধান প্রবেশদ্বারের উভয় পার্শ্বে বড় বড় কদলী বৃক্ষ স্থাপিত হয়, এবং তোরণ ও স্তম্ভগুলি মনোহরভাবে বিন্যস্ত পুষ্পমাল্যে ভূষিত হইয়া অতি সুন্দর দৃশ্য প্রদর্শন করে। মুৎসুদ্দী হইতে অতি সমান্য চাকর পর্য্যন্ত সকল ভৃত্যই উপঢৌকনস্বরূপ মৎস্য ও ফল আনয়ন করে। সত্য বটে, অনেক স্থলে এই সকল উপঢৌকনের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা হয় তো অধিক আদিগকে প্রতিদান করিতে হয়; কিন্তু তথাপি ইহা আমদেয় বড়দিনের সম্মানের চিহ্ন বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। নগরের ভদ্র সাহেদিগকে বড়লাটের প্রাসাদে একটী সরকারী ‘খানা’ দেওয়া হয়, এবং মেম সাহেবদের জন্য সায়ংকালে এটা সুন্দর ‘বল্’ নাচ ও নৈশ ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। ইংরেজী বৎসরের প্রথম দিবসে (বর্ষ-প্রবেশ-উৎসবে) এবং রাজার জন্ম দিনোৎসবে এই সমস্ত ব্যাপার পুনরনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। পর্তুগীজ ভৃত্যদিগের প্রভাবে যে এই ভাবের সঞ্চার হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই, কারণ ঐ জাতি ধর্মোৎসব সম্পর্কে আড়ম্বর ও জাঁক জমক দেখাইতে ভালবাসে। ১৭৮০ অব্দের বড়দিনে প্রাতঃকালে তোপ দাগিয়া উহার সূচনা করা হয়; গভর্ণর জেনারেল কোর্ট হাউসে একটি প্রাতর্ভোজ এবং মধ্যাহ্নে একটী উপাদেয় ‘খানা’ দেন; সেই খানার সময়ে লালদীঘির সুবৃহৎ তোপখানা হইতে রাজসম্মানার্থ অনেকগুলি তোপ দাগা হয় এবং প্রত্যেকাবার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এক এক 'লম্বা পেয়ালা লাল শরাব' পান করা হয়। সায়াহে একটী 'বল্’ নাচের অনুষ্ঠান হইয়া উৎসবের অবসান হয়।”

 পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব্বে কেবলমাত্র গভর্ণর এবং কাউন্সিলের প্রাচীনতম সমস্য গাড়ী[৪] ব্যবহার করিতেন। এখানকার মত পাকা রাস্তা অতি অল্পই ছিল; তাহার উপর দিয়া সুখ স্বচ্ছন্দে ও আরামে গাড়ী হাঁকান যাইতে পারিত না। যে কয়েকটী রাস্ত ছিল, তাহা ধর্ম্মের ষাঁড়, উষ্ট্র ও হস্তীতে পুর্ণ থাকিত। উল্লিখিত আছে যে, ১৮০৫ অব্দ পর্য্যন্ত কলিকাতার রাস্তায় হস্তী চলিতে দেওয়া হইত[৫] পাণ্ডিই সুবিধাজনক যানরূপে সমধিক ব্যবহৃত হইত। ষ্টার্ণডেল সাহেব লিখিয়াছেন যে, পাক্তিবাহকেরা চৌরঙ্গি যাইতে হইলে দ্বিগুণ ভাড়া চাহিত, কারণ চৌরঙ্গি তখন সহরের বাহির বলিয়া বিবেচিত হইত

 ষ্টার্ণডেল সাহেব লিখিয়াছেন,— “এক শতাব্দী পূর্বে এক বিষয়ে কলিকাতার অবস্থা বর্তমান সময় অপেক্ষা ভাল ছিল।” তিনি কলিকাতার আটটি হোটেলের অস্তিত্বের উল্লেখ করিয়াছেন; যথা,—(১) লণ্ডন;; ২) হার্ম্মনিক;—বর্তমান পুলিশ কোর্টের বাটী ইহার স্থান অধিকার করিয়াছে; ' (৩) ইউনিয়ন্; (৪) সেণ্ট পল্‌স গির্জার নিকট রাইটের নিউ ট্যাভার্ণ; (৫) কলিকাতা এক্সচেঞ্জ; (৬) ক্রাউন এণ্ড য্যাঙ্কর, - বর্তমান এক্সচেঞ্জ বাটী; (৭) বেয়ার্ডের হোটেল; এবং (৮) ডেকার্স লেনে মুরের ট্যাভার্ণ (ডেকার্স লেন সে সময়ে একটি সৌখীন অঞ্চল বলিয়া গণ্য ছিল)। গ্যালে নামক ফরাসীয় ট্যাভার্ণ প্রাতরাশ ও অন্যান্ত প্রকার খানার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এতদ্ব্যতীত, ১৮০০ অব্দে ১১টি “পঞ্চ-হাউস” (এক প্রকার শুঁড়িখানা) ছিল, এবং নানা দেশীয় কয়েকজন সাহেব নাবিকদিগের ও অন্যান্য লোকের নিমিত্ত সহরের নানাস্থানে ভোজনালয় ও বাসবাটী স্থাপন করে। এই সমস্ত আড্ডায় বিলিয়ার্ড খেলিবার টেবিল রাখা হইত এবং বীয়ার, লেমনেড প্রভৃতি নামে নানাপ্রকার মদ্য বিক্রয় করা হইত।

 কথিত আছে যে, সিরাজ উদ্দৌলা কর্তৃক কলিকাতা লুণ্ঠনের পূর্ব্বে তথায় একটি থিয়েটার ছিল; সিরাজ ও তাঁহার সৈন্যগণ পূর্ব্বতন দুর্গ আক্রমণ করিবার নিমিত্ত থিয়েটারটিকে তোপখানায় পরিগত করিয়াছিলেন। কিন্তু ১৭৭৫-৭৬ অব্দে সাধারণের চাঁদায় উহা পুনর্নির্ম্মিত হয়। চাঁদাদাদিগের মধ্যে ওয়ারেন হেষ্টিংস, জেনারেল মন্‌সন, রিচার্ড বাওয়েল, সায় ইলাইজা ইম্পে প্রভৃতির নাম পাওয়া যায়। সাধারণতঃ সখের অভিনেতারাই এই থিয়েটারে অভিনয়কার্য্য সম্পন্ন করিত। ইহার সহিত একটা বল্ নাচের ঘরও সংলগ্ন ছিল। নাচ সম্বল এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন:—

 “আমার নিজের কথা বলিতে হইলে, আমার যেন মনে হয়, ইউরোপীয় সুন্দরীদিগের গণ্ডদেশ হইতে স্বাভাবিক গোলাপী রঙ্, বিদূরিত হইয়া তৎপরিবর্তে যে মলিন পাণ্ডুবর্ণ দৃষ্ট হয়, তাহা অপেক্ষা তাম্রবর্ণ বদনের সমুজ্জ্বল দীপ্তি লক্ষগুণে শ্রেষ্ঠ; আর এখানকার ইউরোপীয় সুন্দরদিগের মুখের বর্ণ দেখিলে কবর হইতে উখিত ল্যাজেরসের কথা মনে পড়ে। ইংরেজ-রমণীরা অতিরিক্ত নৃত্যপ্রিয়; প্রখর-গ্রীষ্ম-তাপিত বঙ্গদেশের পক্ষে এরূপ অঙ্গচালনা একান্ত অনুপযোগী। আমার মতে, অপেক্ষাকৃত শীতল দেশের পক্ষে ইহা যতই উপযোগী হউক না কেন, যে দেশের লোক ভদ্রতার অনুরোধে যাহা অপরিহার্য্যরূপে আবশ্যক অতিরিক্ত বস্ত্রদ্বারা দেহ আবৃত করে না, সে দেশে এরূপ নৃত্যকে কতকটা অশ্লীল বলিরাই বোধ হয়। কল্পনানেত্রে ভাবিয়া দেখ দেখি, তোমার হৃদয়ের প্রেমপুত্তলি গ্রীষ্মতাপে মৃতপ্রায়, প্রত্যেক অঙ্গ থর থর কাঁপিতেছে, প্রত্যেক প্রত্যঙ্গ শ্রমে বিকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছে, বৃহদাকার স্বেদবিন্দুসমূহ তাঁহার বদনমণ্ডলে মুক্তাকারে সজ্জিত হইয়াছে, আর তাহার নৃত্য-সহযোগী প্রত্যেক হস্তে এক খানি মস্‌লিন্ রুমাল লইয়া তাহার মুখমণ্ডল মুছিয়া দিয়া অপার আনন্দ উপভোগ করিতেছে।”

 লর্ভ ভ্যালেন্‌সিয়া ১৮০৩ অব্দে লিখিয়াছেন;—“কলিকাতায় ক্ষয়কাসের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব; আমার মনে হয়, তাহাদের অবিরাম নৃত্যই ইহার প্রধান কারণ,—দারুণ গ্রীষ্মের সময়েও তো এ নৃত্যের বিরাম নাই; আবার এইরূপ প্রবল অঙ্গচালনার পরই তাহারা বারান্দায় যায় এবং দেহে শীতল সমীরণ সেবন ও আদ্র বায়ু গ্রহণ করে।”


  1. পেরিনের বাগান বর্তমান বাগবাজারের নিকটে কোনও স্থানে অবস্থিত ছিল। হলওয়েল সাহেব ১৭৫২ অব্দে উহা বিক্রয় করিয়া ফেলেন।
  2. ইউরোপীয় অধিবাসীদিগের প্রাতে ও সায়াহ্নে পদচারণার্থ “রেম্পন্ডেসিয়া ওয়াক্‌” একটা অতি প্রিয় স্থান ছিল। সায়াহ্ন ৫ টা হইতে ৮টা পর্যন্ত কেবলমাত্র ইউরোপীয়দিগেরই তথায় বিহারের অধিকার ছিল ঐ সময়ে দেশীয় লোকদিগের তথায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই নিয়ম যথাযথভাবে প্রতি গালন করাইবার জন্য কপাটে পোলের নিকট শান্ত্রী (প্রহরী) থাকিত। এই বিহার স্থানটী চাঁদপালঘাট ও দুর্গ এতদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল।
  3. লর্ড ওয়েলেসলি কিছুদিন কলিকাতায় ঘোড়দৌড় রহিত করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু রেনি সাহেব বলেন,—“গভর্নর জেনারেলের ভ্রূকুটী সত্ত্বেও কোন কোন কৌতুকপ্রিয় কৌশলে উহার যোগাড় করিয়া লইতেন।”
  4. পাদরি লঙ্ সাহেব বলেন,—“যে কিরাঞ্চি গাড়ীর অধুনা এত অনাদর..... তাহাই দেশীয় ভদ্রলোকদিগের সৌখীন যান ছিল; ইহা ইংরেজদিগের প্রাচীন পারিবারিক কোচ গাড়ীর অনুকরণ।” আর কয়েক প্রকার গাড়ী সে সময়ে প্রচলিত ছিল।
  5. ১৮০৫ খৃষ্টাব্দের ১৬ই এপ্রেল তারিখের ‘বেঙ্গন হরকরা' পত্রে লিখিত আছে:—
     “কয়েক সপ্তাহ গত হইল, হাটেনম্যান সাহেব স্বীয় পত্নী ও তিনটি সন্তান সমভিব্যাহারে একখানি গাড়ীতে বাড়ী ফিরিতেছিলেন। তাঁহারা এসপ্লানেড রো নামক স্থানে পুষ্করিণীর অপর দিকে একটা হস্তী দেখিতে পাইলেন, হাতী দেখিয়া ঘোড়া দুইটা খেপিয়া গেল এবং গাড়ীখানা ব্র্যাডি সাহেবের বাড়ীর সন্নিহিত শিকলের উপর লইয়া ফেলিল; তাহাতে গাড়ী উল্টাইয়া গেল।”