কলিকাতার ইতিহাস/প্রথম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে
কলিকাতার ইতিহাস।


প্রথম অধ্যায়।


সূচনা।

 বর্ত্তমান সময়ে কলিকাতাকে যে অবস্থায় দেখা যাইতেছে, তাহাতে উহাকে বস্তুতঃ একটী ঐশ্বর্য্যশালিনী মহানগরী বলা যাইতে পারে। যে স্থান এক্ষণে কলিকতা বলিয়া পরিচিত, পূর্ব্বে তাহা এরূপ সমৃদ্ধিশালী জনপদ ছিল না। ঐ স্থানে একটী সুবিস্তৃত জলা এবং তন্মধ্যে কয়েকটী অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল। সেই জলাময় গ্রামসমূহের ঈদৃশ পরিবর্ত্তন অদৃষ্টপূর্ব্ব ও অশ্রুতপূর্ব্ব। ইহার সেই প্রাচীন অবস্থার সহিত বর্ত্তমান অবস্থার তুলনাই হইতে পারে না। এরূপ বিরাট, বিচিত্র, আশু পরিবর্ত্তনের দৃষ্টান্ত জগতের ইতিহাসে অতীব বিরল। রুষিয়ার স্বনামখ্যাত প্রসিদ্ধ সম্রাট্‌ পিটার দি গ্রেটের সময়ে সেণ্টপিটার্স নগরের নির্ম্মাণ অত্যন্ত বিস্ময়জনক, সন্দেহ নাই, কিন্তু কলিকাতা নগরীর সংস্থাপন ও ক্রমোন্নতি তদপেক্ষাও আশ্চর্য্যজনক, এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে। কি আয়তনে, কি সৌন্দর্য্যে, কি বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারের গুরুত্ব-বিবেচনায়, এক লণ্ডন নগর ব্যতীত বিশাল বৃটিশ সাম্রজ্যের আর কোনও নগরই কলিকাতার সহিত তুলনীয় নহে,—তুলনীয় হইতে পারে। কলিকাতা যে কেবল ভারতসাম্রাজ্যের রাজধানী ও সেই সূত্রে ভারতের সর্বপ্রধান শাসনকর্তার ও বঙ্গরাজ্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তার প্রধান বাসস্থান, তাহা নহে, প্রত্যুত ইহাকে সমগ্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী বলা যাইতে পারে। ইতিহাসপাঠকমাত্রেই অবগত আছেন যে, প্রথমে মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সি দুইটীর গঠন হয়। সুতরাং প্রথম অবস্থায় কলিকাতা উক্ত দুইটা প্রাচীনতর প্রেসিডেন্সির অধীন ছিল। ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে কলিকাতাও একটী প্রেসিডেন্সি নগরে পরিণত এবং অপর দুইটা প্রেসিডেন্সির প্রায় তুল্য অবস্থাতে উন্নীত হয়।

 অনন্তর ১৭৭৩ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডের পার্লামেণ্ট নামক মহাসভা “ইণ্ডিয়ান রেগুলেটিঙ য়্যাক্ট” নামে একটি আইন বিধিবদ্ধ করেন। তদ্বারা বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সির প্রধান কর্মকর্তা ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল উপাধি পাইয়া ভারতের সর্বপ্রধান শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলেন, এবং একজন প্রধান বিচারপতি ও তিনজন অধস্তন বিচারপতি সহ সুপ্রীমকোর্ট নামে একটি বিচারালয় স্থাপিত হইল। ঐ সকল বিচারপতি নিযুক্ত করিবার ক্ষমতা ইংলণ্ডেশ্বরের নিজ হস্তে স্ত হয়। তদ্ভিন্ন বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সিকে ভারতের অপর দুইটা প্রেসিডেন্সির উপর প্রাধান্য অর্পিত হয়। সুতরাং তদবধি বঙ্গীয় কাউন্সিল (অর্থাৎ মন্ত্রিসমাজ) অন্যান্য প্রেসিডেন্সির উপর প্রভুত্ব করিতে লাগিল। কেবল রাজধানী বলিয়া নহে, প্রত্যুত অন্যান্য অনেক কারণে, কলিকাতা ভারতীয় অপরাপর নগরের অগ্রী। অধুনা ইহা বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল এবং উচ্চবংশীয় ও ধনাঢ্যদিগের সর্ব্বদা গতিবিধির স্থান। পূর্বে যেস্থলে কয়েক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্বাস্থ্যকর গ্রাম ছিল, তাহাই এক্ষণে স্কুল, কলেজ, প্রভৃতি বিদ্যামন্দির, বিবিধ লোকহিতকর অনুষ্ঠানের সভাসমিতি ও কার্যালয়, নানা প্রকার নয়ন-রঞ্জন মনোহর হাবলী, জনসংখ্যার ‘অতি দ্রুত বৃদ্ধি, শিল্প ও বাণিজ্যের ক্রমোন্নতি, এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যোন্নতির কল্যাণে একটি বিশিষ্ট সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী মহানগরে পরিণত হইয়াছে। কলিকাতার প্রথম অবস্থায় যৎকালে উহা মনুষ্য অপেক্ষা সরীসৃপগণেরই বাসভূমি হইবার অধিকতর উপযুক্ত ছিল, সেই অবস্থার কথা স্মরণ রাখিয়া, তৎপর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উহাতে কিরূপ বিলাসিতা, ঐশ্বর্য্য ও আড়ম্বরের বৃদ্ধি হইয়াছে, কিরূপ সুপ্রশস্ত প্রস্তরনির্ম্মিত রাজপথসমূহ চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইয়া উহার সৌষ্ঠব সাধন করিয়াছে, এবং কিরূপ মনোহর অট্টালিকাসমুহ নির্মিত হইয়া উহার প্রাসাদ-নগর” নামের সার্থকতা সাধন করিয়াছে, তাহা ভাবিলে বিস্ময় বহাল হইতে হয়।

 তুলনায় আলোচনা করিলে হারুন-আল-রশিদের নগরকেও ইহার নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হয়। বাঙ্গালার মধ্যে কলি কাতাই এক্ষণে সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর স্থান। পল্লীগ্রামের ম্যলেরিয়াপীড়িত লোকেরা রাজধানীর ব্যয়ভার বহন করিতে সমর্থ হইলে, কলিকাতাতেই বাস করিয়া থাকেন। সঙ্গতিশালী জমিদার, সমৃদ্ধ ব্যবহারাজীব, ডাক্তার ও রাজকর্মচারী সকলেই কলিকাতায় বাসস্থান নির্মাণ করি.ত ব্যস্ত, কলিকতায় বাসাটা নির্মাণ করা যেন জীবনের একটা প্রধান কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর তাহাদের মধ্যে যদি কেহ পল্লীগ্রামের পৈতৃক বাসবাটা একেবারে পরিত্যাগ করিতে অনিচ্ছুক হন, তাহা হইলে তিনি কলিকাতার বাড়ীটীকে| অজ্ঞতঃ গ্রীষ্মবাসরূপে ব্যবহার করেন। শরৎকালে কলকাতা বড়ই অস্বাস্থ্যকর হইয়া পড়ে। কিন্তু কতকালে ম্যালেরিয়ার চিহ্নও থাকে না এবং সে সময়ে নানাপ্রকার মনোমুগ্ধকর প্রলে। ভনও উপস্থিত হয়। আম্মানী, ইহুদী, পাশী, মাড়োয়ারী, ফরাসী, গ্রীক, জর্ম্মান, চীনাম্যান, সকল জাতীয় লোেকই বাণিজ্যোলক্ষে কলিকাতায় দৃষ্ট হয়, এবং তাহাদের মধ্যে অনেকেই এখানে স্থায়িরূপে বসবাস করিয়াছে। বর্তমান সময়ে কলিকাতাকে ইউরোপীয় নগর বলিলেও হয়, মাড়োয়ারী নগর বলিলেও হয়, আবার বাঙ্গালী নগর বলিলেও হয়।

 কোন মহানগর কিরূপে সংস্থাপিত হইল এবং কিরূপেই বা তাহার ক্রমোন্নতি ও পরিণতি সাধিত হইল, ইতিহাসপাঠকের নিকট তাহা প্রমাঢ় কৌতুহলের বিষয়, সন্দেহ নাই নগরের ক্রমান্নতি প্রদর্শন করিতে হইলে তাহার অধিবাসিবর্গের সামাজিক জীবন, নৈতি! চিত্র ও ধর্ম্ম, তাহার সূক্ষশিল্প ও শ্রমশিল্প এবং তাহার বাণিজ্য ও বিদ্যাশিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে মনোযোগ করিতে যে কোনও নগরের ইতিহাস সূক্ষ্মরূপে পর্যালে চন’ করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, যে সকল ঘটন। দীর্ঘকাল লোকের স্মৃতিপট ইতে অপনীত হইয়াছে বা যে গুলির কথা এখন আর লেকে ভাবে না, তাহাদের প্র: কিরূপ গভীর ও বহুদূরব্যাপী, এবং ইহাও দেখিতে পাওয়া যায় যে, যে সকল কারণ আপাতদৃষ্টিতে অতি সামান্য ও অকিঞ্চিৎকর বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তাহা হইতেও কেমন অতীব গুরুত্ববিশিষ্ট ফলের উদ্ভব হইয়াছে।

 ইংরেজের অদম্য উৎসাহ, দূরদর্শিতা, সাহসিকত ও অধ্যবসারে সমুল নিদর্শন কলিকাতার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় জ্বলন্ত অক্ষরে দুরপনেরপে অঙ্কিত রহিয়াছে। ইংরেজের অনাধগম্য রাজনীতি-কৌশল, নির্ভীকতা ও দৃঢ়তার বলেই যে ইংলণ্ড এই বিশাল ভারতসাম্রাজ্য স্বর:শ আনয়ন করিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহাতে মতদ্বৈব হইতে পারে না। সেই সম্পর্কে এই কলিকাতা নগরে যে সকল অতি গুরুতর ঘটনার সজ্জন হইয়াছে, তাহা অগতের ইতিহাসের একটি অতীব প্রয়োজনীয় অধ্যায় অধিকার করিয়াছে।

 যে স্থানটি এক্ষণে বৈঠকখানা-বাজার নামে পরিচিত, সেই স্থানে এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের ছায়াতলে উপবিষ্ট হইয়া যে দিন ইংরেজ বণিদিগের তদানীন্তন এজেণ্ট (প্রতিনিধিস্বরূপ কর্ম্মকর্ত্তা) জব চার্ণক সাহেব চিন্তাবিত ভাবে তাঁহার হুক (ফরসী) হইতে ধূমপান করিতে করিতে কলিকাতাই তাঁহার বণিকপ্রভু দিগের বাণিজ্য-ব্যবসায়ের পক্ষে সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক স্থান হইবে বলিয়া মনোনীত করেন, সে দিন তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, তিনি তাহার স্বদেশীয়দিগের নিমিত্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করিতেছেন। তৎকালে পাশ্চাত্যজনগণের একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, ভারতবর্ষের মৃত্তিকায় এক প্রকার সুবর্ণময় দেববৃক্ষ (কল্পতরু) জন্মে। সেই কল্পতরু নাড়া দিয়া সুবর্ণ সংগ্রহ করাই জব চার্থক-প্রমুখ ইংরেজগণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। এই নির্বাচন হইতে উত্তরকালে যে এইরূপ শুভফল হইবে, তাহা তিনি কল্পনাতেও মনে স্থান দেন নাই। কোন ভারি ভাবিভাগ্য-ফল গণনা করিয়া স্থির করা বড় সহজ কার্য নয়। ভবিষ্যতের অবগুণ্ঠনের পশ্চাদ্ভাগে বিবিধ শক্তি ক্রিয়া করিতে থাকে। তাহাদের ফলাফল নির্ণয় করা প্রগাঢ় ধীশক্তিসম্পন্ন ও অস্তদশী মানবের সাধ্যাতীত। পরে কালক্রমে যখন তাহারা পরিপুষ্ট হইয়া পরিণতি প্রাপ্ত হয়, সেই উপযুক্ত অবসরেই তাহা লোকলোচনের দৃষ্টিপথবর্তী হয়। যৎকালে জব চার্নক এই স্থানটি নির্বাচন করেন, তৎকালে অতীব দূরদর্শী ব্যক্তিরাও কল্পনায় আনিতে পারেন নাই যে, কলিকাতা একদিন ইংরেজের ভারতসাম্রাজ্যের রাজধানীরূপে পরিণত হইবে।

 ১৫১৯ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডে একটি সমিতির গঠন হইল, এবং পূর্ব্ব-ভারত অঞ্চলে বাণিজ্য-পোত-প্রেরণের নিমিত্ত অর্থ সংগৃহীত হইল, কারণ সে সময়ে পর্তুগীজজাতি ঐ অঞ্চলে একরূপ একচেটিয়া বাণিজ্য করিতেছিল। পরে ভারতবর্ষে ওলন্দাজদিগের প্রভাব দর্শনে ঈর্ষান্বিত হইয়া কতকগুলি ইংরেজ বণিক উক্ত অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে লর্ড মেয়রকে সভাপতি করিয়া এক সভা করিলেন। সেই সভায় স্থির হইল যে, ভারতবর্ষের সহিত সাক্ষাৎ সম্বন্ধে, বাণিজ্য করিবার নিমিত্ত একটি সমিতির গঠন করা হইবে। ইংলণ্ডের রাণী এলিজাবেথের অভিপ্রায়ানুসারে সার জন্য মিলডে হল নামক একজন সম্রান্ত সাহেব ইংরেজ কোম্পানীর অনুকূলে বিশেষ বাণিজ্যাধিকারের প্রার্থনা করিবার নিমিত্ত কষ্টাণ্টিনোপলের পথ দিয়া প্রবল-প্রতাপ মোগল সম্রাটের নিকট প্রেরিত হইলেন। ভারতবর্ষ অপরিমেয় ধনের অক্ষয় ভাণ্ডার, এই জনক্ষতি বহু ইংরেজের মনে ঔৎসুক্য ও উৎসাহ উদ্দীপিত করিয়া দিল। জলপথে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বাণিজ্য করিয়া বিদেশে ধনার্জন করাই উদ্যমশীল, ইংরেজদিগের প্রধান বাসনা হইয়া উঠিল। (খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে, মহারাণী এলিজাবেথের রাজবের শেষভাগে, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী রাজকীয় সনদ লাভ করিয়া বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করিলেন। কথিত আছে যে, তাঁহারা ৩০,১৩৩ পাউণ্ড ৫ শিলিং ৮ পেন্স (অর্থাৎ বর্তমান বিনিময়ের হারে প্রায় ৪,৫২,০০০ টাকা) মূলধন লইয়া কার্য্যারম্ভ করেন, ঐ মূলধন ১০১ অংশে বিভক্ত ছিল। ইংলণ্ডেশ্বর প্রথম চালসের রাজত্বকালে ১৬৪৫ অব্দে কোম্পানী, আবার নূতন সনন্দ প্রাপ্ত হইলেন।

 ক্রমওয়েলের সময়ে কিছুদিন ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বিলুপ্ত হইল। পরন্তু তিনি পরে উহার পুনর্গঠনের অনুমতি প্রদান করিয়া উহার যাবতীয় পূর্ব অধিকার প্রত্যর্পণ করিলেন। কেবল তাহাই নহে, ওলন্দাজদিগের দ্বারা কোম্পানীর পুনঃ পুনঃ ক্ষতি সাধিত হওয়ায় ক্রমওয়েল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রতি এতাদৃশ সহানুভূক্তিসম্পন্ন হইয়া পড়িলেন যে, তিনি কোম্পানীর পক্ষঅবলম্বন করিয়া ১৬৫২ অব্দে ওলন্দাজদিগের বিরুদ্ধে সমরঘোষণা করিলেন। কোম্পানীর মূলধন তৎকালে ৭,৪০,০০০ পাউণ্ডে উঠিয়াছিল। ১৬৬১ খৃষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডেশ্বর দ্বিতীয় চার্লস কোম্পানীকে আরও অধিকতর অধিকার প্রদান করেন। তাহাতে তাহাদের দাণিজ্য কেবল যে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত হইল তাহা নহে, পরন্তু মোগল রাজসভায় সার টমাস রো নামক একজন সম্ভ্রান্ত ইংরেজের আন্তরিক যত্ন চেষ্টার ফলে তাঁহারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে কুঠি নিৰ্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন। সার টমাস রো ইংলণ্ডের রাজা প্রথম জেমসের প্রতিনিধি ও দূতস্বরূপে ভারতবর্ষে আগমন করিয়াছিলেন। তৎকালে মোগল সম্রাট জাহাঁগীর হিন্দুস্থানের রাজচক্রবর্ত্তী ছিলেন। ভারত ইতিহাসের পাঠকমাত্রেই অবগত আছেন যে, জাহাঁঁগীর ইংরেজদিগের প্রতি সাতিশয় প্রসন্ন ছিলেন। ইংরেজেরা তাহার প্রীতির পাত্র ছিলেন। তিনি তাঁহাদিগের উপর প্রভূত অনুগ্রহ ও অধিকার অজস্র বর্ষণ করিয়াছিলেন।

 কোম্পানী; অংশীদারদিগের মধ্যে প্রথমতঃ পঞ্চশ জন ও তৎপরে চতুর্বিংশ জন, নির্বাচিত করিয়া একটি কমিটির গঠন হইল। কমিটি’ হইলেই তাঁহার একজন সভাপতি থাকা আবশ্যক। এ কমিটিতেও একজন সভাপতি হইলেন। এই কমিটির নাম হইল কোর্ট অব ডিরেক্টর” (অর্থাৎ পরিচালকগণের সম্ভা)। নবগঠিত ডিরেক্টর স ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর যাবতীয় বিষয় কর্মের তত্ত্বাবধান করিতেন। এই সভা তিন ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল,—প্রথম ভাগ কোম্পানীর আয়ব্যয়সম্পর্কীয় যাবতীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধান করিতেন, দ্বিতীয় ভাগ রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে কর্তৃত্ব করিতেন, এবং তৃতীয় ভাগ রাজ্যশাসন ও বিচারসম্বন্ধীয় কার্যের তত্ত্বাবধান করিতেন। এই তিন বিভাগের প্রত্যেকটীতে আটজন করিয়া সদস্য থাকিতেন। এতদ্ভিন্ন আর একটি গুপ্ত ‘কমিটি’ ছিল। সমরঘোষধা, সন্ধিস্থাপন এবং অপরাপর রাজনৈতিক ব্যাপারের পরিচালনার এই কমিটির হস্তে ব্যস্ত ছিল। বলা বাহুল্য যে, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাবের উৎপত্তি ও বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহার আইন, নিয়ম ও বিধিসমূহ প্রসারিত ও অবস্থানুসারে পরিবর্তত হইতে লাগিল। পরন্তু শরতে কোম্পনীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত প্রকৃতপক্ষে ১৭৫৬ অব্দে আবদ্ধ হইয়াছিল, এ কথা বলা যাইতে পারে।

 ১৭৮; খৃষ্টাব্দে পার্লামেণ্ট মহাসভা ‘বোর্ড অব কনৃট্রেল” নামে একটি সমিতির গঠন করিলেন। ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ডির ক্টর সভা যে সকল রিজোলিউশন পাশ করিতেন, সেইগুলির তত্ত্বাবধান করাই এই নবগঠিত সমিতির প্রধান কর্তব্য স্থিরীকৃত হয়। ইংরেজাধিকৃত ভারতসাম্রাজ্যের শাসনের ভারার্পণ পশ্চাল্লিখিতরূপ হয় যথা:—

 ১। পার্লামেণ্টের হস্তে। এরূপ স্থলে এই কথাটিতে ইংলণ্ডেশর এবং হাউস অব লর্ডস্ ও হাউস অব কমন নামক দুইটি সমাজ বুঝায়। কোনও আইন করিতে হইলে, ইহাদের সম্মিলিত অনুমোদন আবশ্যক।

 ২। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ৬০ ০০,০০০ পাউণ্ড মূলধনের মধ্যে যাহাদের কোনও নির্ধারিত পরিমাণ অংশ আছে, এরূপ অংশীদারদিগের দ্বারা নির্বাচিত কোর্ট অব ডিরেক্টর নমক সভারহস্তে।

 ৩। ইংরেজ গবর্ণমেণ্টের অংশীভূত বোর্ড অব কণ্ট্রোল নামক মন্ত্রিসমাজের হস্তে।

 ৪। ভারতবর্ষে গবর্ণর-জেনারেলের হস্তে। তিনি কলিকাতায় থাকিবেন, এবং অধিকিন্তু বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সির প্রাদেশিক শাসনকর্তা হইবেন।

 ৫। অবশিষ্ট তিনটি প্রেসিডেন্সির—অর্থাৎ মাদ্রাজ, বোম্বাই ও আগ্রা[১] প্রদেশের তিন গবর্ণরের হস্তে।

 ১৮৩৩ অব্দে পার্লামেণ্ট পশ্চাল্লিখিতরূপ নিয়ম করিয়া কোম্পানীর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিলেন:—

 ১। কোম্পানীর কেবল রাজনৈতিক অধিকারগুলি থাকিবে। ‘ অর্থাৎ বোর্ড অব কণ্ট্রালের তত্ত্বাবধানাধীনে ভারসাম্রাজার শাসনকার্য পরিচালন করিবেন।

 ২। কোম্পানী আর বণিক সমিতি থাকবে না, এবং তাহার ফলে কোম্পানীর ভারতবর্ষ ও চীনদেশে এ সহিত একচেটিয় বাণিজ্য করিবার অধিকার বিলুপ্ত হবে।

 ৩। বৃটিশ প্রজামাত্রেই ঐ দুই দেশের সহিত অবাধে বাণিজ্য করিতে পারিবে।

 ৪। বৃটিশ প্রজারা কত গুলি নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে বৃটিশ ভারতে বাস করিতে পাইবে (বলা বাহুল্য, এ অধিকার তাহাদের পুর্বে ছিল না)॥

 ১৮৫৮ অব্দ পর্যন্ত ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অস্তিত্ব ছিল। উক্ত অব্দে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর, ভারতবর্ষ ইংলণ্ডশ্বরের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন সাম্রাজ্যের এক অংশ হইয়া পড়িল।


  1. ১৮৪০ অব্দে বা তৎসমকালে আগ্রা প্রেসিডেন্সী বাঙ্গলা প্রেসিডেন্সি হইতে স্বতন্ত্র হইয়া পড়িল।