কলিকাতা কল্পলতা/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে


দ্বিতীয় অধ্যায়


ইংরাজদিগের বাঙ্গালাদেশে বাণিজ্যকরণার্থ অনুমতিপ্রাপ্তি বালেশ্বর ও হুগলীতে বাণিজ্যালয় স্থাপন—ভাগীরথীতে ইংরাজদিগের জাহাজ প্রবেশ—নিরন্তর বাণিজ্যকরণের শক্তিলাভ-সাগরসঙ্গমের নিকট দুর্গনির্মাণের অভিসন্ধি -নবাবের সহিত ইংরাজদিগের মতান্তর, পোতাধ্যক্ষ নিকলসনের দশখানা জাহাজ সমভিব্যাহারে ভাগীরথী প্রবেশ—হুগলী নগর ধ্বংস—ইংরাজদিগের বাণিজ্যালয় সমূহের প্রতি আক্রমণ—সুতালুটিতে চার্ণক সাহেবদের প্রস্থান ও তথা হইতে হিজলী উপদ্বীপে আশ্রয়-ইব্রাহিম খাঁ নবাব কর্তৃক ইংরাজদিগকে পুনরাহ্বান-~-কলিকাতা নগর স্থাপন—দোভাষী শব্দের ভ্রমক্রমে জনৈক ধোবার সৌভাগ্য।


কলিকাতা নগরের প্রতিষ্ঠা-প্রকরণ পূর্ব্বেতৎপ্রতিষ্ঠাতৃ ইংরাজ জাতির এদেশে আগমন বৃত্তান্তবিবৃতকরাকর্ত্তব্য বিবেচিত হইতেছে। অহহ! এদেশেইংরাজদিগের সৌভাগ্যসূর্যের ক্রমশঃ প্রাখর্য্য বৃদ্ধির বিষয় চিন্তা করিলে চমকৃত হইতে হয়। যেরূপ বায়সভুক্ত বটবীজ অঙ্কুরিত হইয়া শত শত জীবের আশ্রয়দাতা সুবিস্তীর্ণ ছায়াসমন্বিত প্রকাণ্ড বৃক্ষরূপে শোভা পাইতে থাকে, যেরূপঅণুমাত্র অনল স্ফুলিঙ্গ কর্তৃক স্বল্পকাল মধ্যে ভয়াবহ দাবদাহ আবির্ভূত হইয়া থাকে এবং হিমালয় শিখরোপরে তুষাররাশিচ্যুত রজত রেখাকার তটিনীসকল সঞ্চিত হইয়া পরিণামে কত কত শৈলভেদপূর্ব্বক বর্ধিষ্ণুবেশে গিরিতলে পতিত হইয়া সহস্রাধিক ক্রোশ ব্যবধানে সিদু শাখাবৎ আকৃতি ধারণকরিতেছে, সেইরূপভারতবর্ষেইংরাজদিগের আধুনিক প্রবল পরাক্রমের নিদানস্বরূপ এই বাঙ্গালাদেশে ক্ষুদ্র এক বাণিজ্যালয় স্থাপনমাত্র।

ইংরাজী ১৬৩৪ অব্দে যেসময়েশাহজাহানপাশাহভারতবর্ষের দাক্ষিণাত্যে বিগ্রহার্থ প্রবাস করিতেছিলেন, সেই সময় তাহার এক দুহিতার বস্ত্রে একদা দৈবাৎ অনল সংলগ্ন হওয়ায় তাহার শরীর গুরুতররূপে দগ্ধ হইয়া যায়। সেই রাজকুমারীর যাতনা প্রতিকার নিমিত্তসুরাটস্থ ইংলণ্ডীয় বাণিজ্যকুটি হইতে জনৈকইংরাজচিকিৎসক আনয়নার্থা সংবাদ প্রেরিত হইলে বোটন নামক একজন সাহেব উক্ত কার্য্যে বৃত হন। সৌভাগ্যবশতঃ তাঁহার চিকিৎসা কৌশলে নৃপনন্দিনী সম্পূর্ণরূপেআরোগ্যলাভকরাতে সম্রাটমহোদয়কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনার্থ বোটনকেকহিলেন—“তোমার ইচ্ছানুসারে আমি পুরস্কার করিব, অতএব তোমার কি ইচ্ছা কহ।”

উদারচিত্তস্বদেশহিতৈষী বোটন কহিলেন—“আমার আত্মস্বার্থে কিছু প্রার্থনা নাই। আমার দেশীয় লোকেরা বাঙ্গালাদেশে শুল্কবিরহে বাণিজ্য করিবার জন্য বাণিজ্যালয় স্থাপনের অনুমতি পাইলেই আপনাকে প্রভূতরূপে জ্ঞান করিব।”

সম্রাট যদিও “তথাস্তু” বলিয়া বরপ্রদান করিলেন বটে কিন্তু পর্তুগীজদিগের অত্যাচারে অনুশোচনা হওয়ায় বালেশ্বরের নিকট পিপলি নামক স্থানে বাণিজ্যকুটি নির্মাণ করিতে আদেশ বিধান করিলেন। তদনুসারে ইং ১৬৩৪ অব্দে তথায় প্রথম বাণিজ্যালয় সংস্থাপন হইল। তদনন্তর ইং ১৬৩৯ অব্দে শাহাজাহান পাদশাহের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান সুজা বাংলাদেশের নবাবী পদে অভিষিক্ত হইয়া রাজধানী রাজমহলে আসিলে পর বোটন সাহেব স্বজাতীয় পক্ষ হইতে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনকরণার্থউক্ত স্থানে যান। দৈবাধীন অন্তঃপুরচারিণী কোন রাজমহিলার সাংঘাতিক পীড়া হইলে বোটন সাহেবের চিকিৎসানৈপুণ্য সুবিখ্যাত হইয়া উঠায় নবাব উক্ত রোগ প্রতিকারার্থ তাহাকেই বরণ করিলেন।তাহাতে বোটন সাহেব স্বীয় বিদ্যাবলে ভূপতি ভামিনীকেনিরাময় করাতে সুলতান সুজাতাহার প্রতি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হইয়া বালেশ্বর এবং হুগলী নগরেইংরাজদিগকে বাণিজ্যালয় স্থাপনে অনুমতি দান করেন।

তারপর নবাব সায়েস্তা খাঁর অধিকারকালে ইং ১৬৬৮ অব্দে ইংরাজরা ভাগীরথীবাহিয়াঙ্গলীনগরীর নিকটজাহাজলইয়া যাইতে আজাপ্রাপ্তহন।ইতিপূর্ব্বেতাহারা সুলুপ যোগে দ্রব্যাদি লইয়া বাহির সমুদ্রে জাহাজ বোঝাই করিতেন। অপর প্রত্যেক নূতন নবাবের শাসনারম্ভেই তাহাদিগকে নূতন ফাৰ্মাণ অর্থাৎ বাণিজ্যকরণের অনুমতিপত্র গ্রহণ করিতে হইত—তাহা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য ছিল। কিন্তু নবাব সায়েস্তা খাঁর অনুগ্রহে সেদায় হইতেও তাহারা মুক্ত হন। এই নবাব দিল্লীতে প্রস্থান করিলে তৎসমভিব্যাহারে ইংরাজদিগের বাণিজ্যকুটির বড় সাহেব গমনকরতঃ এক ফার্ম্মাণে নিরন্তর বাণিজ্যকরণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। যদিও বিস্তর ব্যয় ও কষ্টস্বীকারপূর্ব্বক তাহা লব্ধ হউক কিন্তু তাহা পাইয়া ইংরাজেরা এরূপআহ্লাদিতহইয়াছিলেন যে,তাহারা এইউপলক্ষে তিনশতবার তোপধ্বনি করিয়াছিলেন। ১৮  ইহার পর ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানী দেখিলেন বিলাত হইতে অপরাপর অনেক ব্যবসায়ী আসিয়া বাণিজ্য করাতে তাহাদিগের লভ্যের ব্যাঘাত হইতে লাগিল।অতএব কোর্ট অব ডাইরেক্টর সভার আজ্ঞানুসারে, উক্ত প্রতিযোগীদিগের আগমন নিবারণ নিমিত্ত গঙ্গাসাগরের নিকট এক দুর্গনিৰ্মাণার্থনবাবেরস্থানে অনুমতি প্রার্থনা করিয়া পাঠাইলে তিনি তাহা অগ্রাহ্য করিলেন। ইহা ব্যতীত এই সময়ে বেহার প্রদেশে রাজদ্রোহ উপস্থিত হওয়ায় পাটনাস্থইংলণ্ডীয় বাণিজ্যকুটির সাহেবের উপর সন্দেহ হইলে নবাব ইংরাজদিগের প্রতি বিরক্ত হইয়া এই নিয়ম করিলেন যে, তাঁহাদিগের বাণিজ্য সম্পত্তিমাত্রের মূল্য অনুসারেশতকরা ৩০ টাকা কর দিতে হইবে। পূর্ব্বে সম্রাটের আজ্ঞানুসারে তাঁহারা বার্ষিক তিন সহস্র টাকামাত্র দিয়া নিস্তার পাইতেন। ইংরাজদিগের প্রতি নবাবের বিরুদ্ধ ভাব জানিতে পারিয়া তদধীন রাজকর্মচারীরা তাহাদিগের প্রতি অত্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ করিতে লাগিল। নবাবের লিখনানুসারে সম্রাট অত্যন্ত ক্রোধাপন্ন হইয়াইংরাজদিগের প্রতিউত্তেজনাকরণেঅনুমতি দেওয়ায় তাঁহারা মহাবিপদগ্রস্ত হইলেন। এই সকল সমাচার ইংলণ্ডাধীপের শ্রবণগোচর হইলে তিনি কোম্পানীর আনুকূল্যে নিকলসন নামক জনৈক পোতপতিরঅধীনে ৬শত সেনাপূর্ণদশখানা রণপোত প্রেরণ করিলেন। ঐ সকল তরণী বাতাতিপাতে সমুদ্রের দলভঙ্গ হইয়া পড়ে; কয়েকখানামাত্র ভাগীরথী মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। ইহা ব্যতীত মাদ্রাজের বড় সাহেব হুগলীস্থকুটির সাহায্যের জন্য ৪ শত পদাতিক সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন। সায়েস্তা খাঁ জলপথে এবং স্থলপথে এই সকল সমরায়োজন দেখিয়া সঙ্কুচিত চিত্তে ইংরাজদিগের সহিত সন্ধিকরণের প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু দৈবাধীন একটা সামান্য কলহোপলক্ষেতদনন্তর আকুণ্ড কুণ্ড উপস্থিত হইল। তাহা এই যে, তিনজন ইংলণ্ডীয় সৈন্য হুগলীর বাজার ভ্রমণার্থউঠিলে নবাবের সৈন্যেরা তাহাদিগকে গুরুতর প্রহারে আহত করে। তৎ শ্রবণমাত্র ক্রমে ক্রমে সমুদয় ইংরাজ সেনা তীরস্থ হইলে উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হয় এবং নিকলসন সাহেব জাহাজহইতে একাধারে গোলাবর্ষণ করিতে থাকেন; তাহাতে অন্যন ৫ শত গৃহ ধূলিসাৎ হইয়া যায়। তন্মধ্যে গুদাম সকলও বিধ্বংস হওয়াতে৩০ লক্ষ টাকা অপচয় হয়।

ইহা শ্রবণে নবাব কোম্পানীর পাটনা, ঢাকা ও কাশীমবাজারস্থ শাখা বাণিজ্যালয় সকল আক্রমণপূর্ব্বক ইংরাজদিগকে বাঙ্গালাদেশ হইতে নিষ্ক্রান্তকরণার্থ অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনাসমূহ প্রেরণ করিলেন। হুগলী কুটির বড় সাহেব ইং ১৬৮৬ অব্দের ২০শে ডিসেম্বর দিবসে সুতালুটিতেপলায়নপূর্ব্বকপ্রাণরক্ষাকরেন। যেহেতু ঐ স্থানে তৎকালে শেঠবসাকেরা অধিবসিত করিতেন এবং তাঁহাদিগের সহিত সদ্ভাব থাকাতে বাণিজ্যকার্য্য স্থগিত হইবার সম্ভাবনা ছিলনা।ঐমাসের শেষেইংরাজদিগের সহিতসন্ধিকরিবার জন্য নবাব স্বীয় পক্ষ হইতে তিনজন দূত প্রেরণ করেন তাহাতে পূর্ব্ববৎ ক্ষমতা অনুসারে ইংরাজরা বাণিজ্য করিবার আজ্ঞাপ্রাপ্ত হন, কিন্তু এই সন্ধি করিবার পক্ষে নবাবের আন্তরিক অভিসন্ধি এই যে, কোনমতে কালহরণহইলে সহসা একদা ইংরাজদিগের উপর পড়িয়া তাহাদিগকে এককালীন এদেশ হইতে তাড়াইয়া দিবেন। অতএব ইং ১৬৮৭ অব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রারম্ভে হুগলীতে প্রচুর সৈন্য প্রেরণ করিলে চার্ণক সাহেব সুতালুটিতে আপনাকে নির্বিঘ্ননা বুঝিয়া সদলে সমভিব্যাহারে সাগরসঙ্গমে গিয়া হিজলি নামক এক অস্বাস্থ্যকর উপদ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন, এস্থানে বাস করিবার অব্যবহিত পরেই রোগোপদ্রবে অধিকাংশ ইংরাজ পরলোকগত হইলেন। এই সময় ইংরাজদিগের এরূপ দুর্গতি হইয়াছিল যে, তাহারা বাঙ্গালাদেশ পরিত্যাগ করিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ বিলাতীয় কর্তৃপক্ষ পাদশাহকে স্বকীয় বল বিজ্ঞাতকরণার্থ আপনাদিগের সুরাটস্থ বাণিজ্যালয় স্থগিত করিয়া উক্ত স্থানের নিকটকয়েকখানা রণতরীরাখাইয়া দিলেন।তথা হইতে যে সকল মুসলমানীয় তরণী মক্কাভিমুখে যাত্রী লইয়া যাইত, সেই সকল নাখোদা চালিত জাহাজের উপর উক্ত পোতাধ্যক্ষেরা মহা উৎপাত আরম্ভ করিলে পাশাহ অগত্যাইংরাজদিগের সহিত সন্ধি সংস্থাপন করিতে বাধ্য হইলেন।অতএব তাহার আজ্ঞানুসারে সায়েস্তা খাঁ পুনর্ব্বার চার্ণক সাহেবকে ডাকাইয়া স্বেচ্ছানুসারে বাঙ্গলাদেশের যে কোন স্থানে বাণিজ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিলেন, আরশতকরা ৩০ টাকা হারে যে শুল্কগ্রহণের রীতি ছিল, তাহাও রহিত হইল—ইংরাজেরা উলুবেড়িয়াতে আসিয়া বাণিজ্য করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎকাল পরেই বিশ্বাসঘাতক নবাব পুনর্ব্বার তাঁহাদিগেরউপর দৌরাত্ম্য করাতে বিলাতীয় কর্তৃপক্ষকাপ্তেন হিথ সাহেবের অধীনে প্রচুরতর সামুদ্রিক সৈন্য প্রেরণ করিলেন, যদিও এই সময়ে ইংরাজদিগের সহিত নবাবের পুনর্ব্বার সৌহার্দ জননের সম্ভাবনা হইয়াছিল কিন্তু হিথ সাহেবের অব্যবস্থিতচিত্ততাবশতঃ তাহাসমূলে উচ্ছিন্ন হওয়ায় ইংরাজদিগের এরূপ দুর্দশা হইল যে তাহারা বাঙ্গালাদেশ পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করিতে বাধ্য হইলেন। তখন সমুদ্রপথে ইংরাজ রণপোতাধ্যক্ষগণ মুসলমানীয় জাহাজমাত্রের উপর অত্যাচার করিতে থাকিলে দিল্লীশ্বর অত্যন্ত জ্বালাতন হইয়া ১৬৮৯ অব্দে নবাবইব্রাহিম খাঁকেলিখিয়া পাঠাইলেন,ইংরাজদিগের পূর্ব্বাপরাধ ক্ষমা করা গেল, তাহাদিগের ৩০০০ সহস্র টাকামাত্র বার্ষিক করলইয়া পুনর্ব্বার বাণিজ্য করিবার ক্ষমতা দিবে।তদনুসারে সন্ধি হইলে ইং ১৬৯০ অব্দের ২৪শে আগস্ট দিবসে জন চার্ণক সাহেব সুতালুটিতে পুনৰ্বার উত্তীর্ণ হইয়া কলিকাতা নগর প্রতিষ্ঠা করিলেন। সুতরাং ঐ দিবস হইতেই কলিকাতানগর নামে প্রসিদ্ধ হইয়া আসিতেছে। অতএব দেড়শত বৎসরাধিক হইল এই মহারাজধানী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। উক্ত শুভকার্যের দুইবৎসর পর মহাত্মা প্রতিষ্ঠাতা চার্ণক সাহেব লোকান্তরিত হন। অদ্যাপিতাঁহার সমাধি সেণ্ট যন্স চর্চ অর্থাৎ পাতরিয়া গীর্জায় বর্তমান রহিয়াছে। ইহার নামেই চাণক গ্রামের নামকরণ হইয়াছে।

এক্ষণে এই এক প্রশ্ন উত্থাপিত হইবার সম্ভাবনা যে, ওলন্দাজ, ফরাসীসও দীনেমার প্রভৃতি অপরাপর ইউরোপীয়েরা গঙ্গার পশ্চিম পারে সকলেইনগর প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু ইংরেজেরা কি জন্য পূর্ব পারে স্থান গ্রহণ করিলেন? পশ্চিম পারে নদীর সুমধুর সমীরণ প্রবাহিতও প্রভাতে সূর্যোদয়ের শোভাবিলোকিত হয়—পূর্ব্বপারে পূর্বোক্ত ত্বগেন্দ্রিয় ও দর্শনেন্দ্রিয়ের সুখলাভ হয় না। কিন্তু পূর্ব্ব পারে কলিকাতা স্থাপনের ভিন্ন ভিন্ন তিন কারণ প্রদর্শিত হইয়াছে। প্রথম—পশ্চিম পারাপেক্ষা পূর্ব পারে ভাগীরথীর গভীরতা, দ্বিতায়—শেঠবসাকদিগের অনুরোধ এবং তৃতীয়—মহারাষ্ট্রীয়েরা গঙ্গার পূর্ব্ব পারে আসিত না।

অনেক স্থলে সামান্য একটি ভ্রমসূত্রে মহাত্মা কলম্বাস পৃথিবী পরিধির অসম্যক-জ্ঞানজনিত ভ্রমেনব ভূখণ্ড প্রকাশে উৎসাহী হন। আটলাণ্টিক সমুদ্রের প্রকৃত পরিসরের পরিজ্ঞান থাকিলে তিনি তৎকালে কদাচই উক্ত সাহসিক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইতেন না। যদি মহদ্বিষয়েরসহিত ক্ষুদ্র বিষয়ের তুলনাসাযুজ্য হয়, তবে কলিকাতা নগরের প্রথমাবস্থায় এইরূপ এক ভ্রমের কথা উত্থাপন করা যাইতে পারে। তাহা এই যে, ইংরাজরা প্রথমতঃ কলিকাতার নীচে ভাগীরথীতে জাহাজ লাগাইয়া শেঠদিগের স্থানে একজন দ্বিভাষী প্রার্থনা করিয়া পাঠান। মাদ্রাজে দ্বিভাষীশব্দের অপভ্রংশ“দোবাস” শব্দ সুতরাং সাহেবরা“দোবাস”চাইবলিয়া পাঠাইলে এই অশ্রুত অপূর্ব্ব শব্দের অর্থ বুঝিতে না পারিয়া তন্তুবায়মণ্ডলী মহাচিন্তিত হইলেন। পরে তাহাদিগের মধ্যে একজন প্রাচীন চাই বহুক্ষণ বুদ্ধিচালনাপূর্ব্বক কহিলেন যে, ইংরাজেরা জনৈক“ধোবা”চাহিয়া পাঠাইয়াছেন। অতএব উক্ত বৃদ্ধের বচন অনুসারে তাহারা একজন ধোবাকে সাহেবদিগের নিকট প্রেরণ করিলেন। ধোবা জাহাজে উত্থানমাত্র সাহেবেরা মহাপুলকিত হইয়া তোপধ্বনিপূর্ব্বক তাহাকে মহাসমাদরে গ্রহণকরতঃ রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা দিয়া বিদায় করিলেন। ঐ খোবা অত্যন্ত চতুর বুদ্ধিজীবী ছিল, সে অতি অল্পকালের মধ্যে ইংরাজদিগের সমুদয় কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করায় তাহারাতাহার উপর সন্তুষ্ট হইলেন এবং রজকপুত্র কিছুকাল পরে কলিকাতার সর্বপ্রধান ধনী হইয়া উঠে। ঐ সৌভাগ্যশালী রজকের নাম—পাতরিয়াঘাটার উত্তরাংশেরঘু-সরকারের নামে যে বক্স বিখ্যাত আছে—ধোবা ঐরঘু সরকারের পিতামহছিল। এই কোটীশ্বর রজক উক্ত স্থানে এক অট্টালিকা নিৰ্মাণপূর্ব্বকবসতি করে কিন্তু শেঠদিগের বাটীর সম্মুখে ঐ অট্টালিকার সিংহদ্বার নির্মিত হইলে প্রভাতে রজকেমুখ দেখা অশুভকর বিধায় মেয়র আদালতে শেঠেরা আপত্তি উপস্থিত করেন। তাহাতে মেয়র সাহেব, ধোবাদিগের ইতরত্ব বিষয়ে সংশয় উপস্থিত করিলে শেঠেরা বলেন—“সাহেব! তোমার বেয়ারাগণ যদি ঐ ধোপার পাল্কী বহন করে তবে তাহাদের ভদ্রত্ব বিরুদ্ধে আমাদের কোন আপত্তিনাই।”তাহাতে মেয়র সাহেব স্বীয় বেয়ারাদিগকে রজকনন্দনের পাল্কী বহিতে কহিলে তাহারা অস্বীকার করাতে বিচারপতি ধোবাদিগের নীচত্ব বিষয়ে সংশয়শূন্য হইয়া উক্ত সদর দরজা বন্ধ করিয়া বাটীর বাঢীর পশ্চাদ্ভাগে দম্য পথ প্রস্তুত করিবার অনুজ্ঞা দেন। কিন্তু এখন যদিও বাহকেরা রজক বহনে অস্বীকার করুক তথাপি রাজদ্বারে উক্ত প্রকার অবিচার কখনই হইবার সম্ভাবনা নাই।