কলিকাতা কল্পলতা/প্রথম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে


প্রথম অধ্যায়

কলিকাতার প্রাচীনত্ব-বাঙ্গলাদেশের আদ্য রাজধানী নিশ্চয় — প্রাচীন গ্রন্থে কলিকাতার নামোল্লেখ— কবিকঙ্কণ — ঘটকের কারিকা-কলিকাতা নামের ব্যুৎপত্তি—শেঠ, বসাকদিগের আদ্যস্থান—ঢাকা, হরিদপুর, পাতরিয়াঘাটায় প্রবাস—শেঠ, বসাকদিগের নাম—প্রথম ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ পরিবার।


 কলিকাতার প্রাচীনত্ব বিষয়ে অনেক মহাশয়ের ভ্রান্তিআছে। অনেকে কলিকাতা নাম অতি আধুনিক মনে করেন-ফলতঃ আমরা নিশ্চিতরূপে কহিতেছি যে কলিকাতা গত শতাব্দীর মধ্যে হিসাবে পরিগণিত হইলেও বস্তুতঃ বহু কালাবধি গ্রাম পদবীতে গণনীয় ছিল। কোন মহাশয় গ্রন্থবিশেষে লিখিয়াছেন যে, কলিকাতাকে বাঙ্গালাদেশের ষষ্ঠ রাজধানীরূপে গণ্য করা যাইতে পারে—প্রথম গৌড়, দ্বিতীয় রাজমহল, তৃতীয় ঢাকা, চতুর্থ নবদ্বীপ, পঞ্চম মুর্শিদাবাদ এবং ষষ্ঠ কলিকাতা। কিন্তু ইহার মধ্যে কিছু ভ্রম প্রমাদ দৃষ্ট হইতেছে। বাঙ্গলাদেশের আদ্য রাজধানী যে গৌড় নগর ছিল সে বিষয়ে সন্দেহমাত্র নাই, কিন্তু নবদ্বীপ নগর প্রকৃত প্রস্তাবে রাজধানী মধ্যে গণনীয় নহে। সেনবংশী ভূপতিরা গৌড় নগরেই অবস্থানপূর্ব্বকরাজকার্য অবধারিত করিতেন কিন্তু মধ্যে মধ্যে সুবর্ণ গ্রামে এবং নবদ্বীপে বিরাজ করিতেন—এজন্য যদিনবদ্বীপ রাজধানী মধ্যে ধর্তব্য হয়, তবে সুবর্ণ গ্রাম এবং বাঙ্গলাদেশের সর্বপ্রধান বাণিজ্যস্থল সপ্তগ্রামকেও রাজধানী বলা যাইতে পারে। সপ্তোহ প্রতিভা বিষয়ে এতদ্দেশীয় কোন প্রাচীন কবি এরূপ উক্তিকদের। যথা:—

কলিঙ্গ তৈলঙ্গ অঙ্গ বঙ্গাদিকর্ণাট।
বটেশ্বর আহুলঙ্গাপুর স্বর্ণগ্রাম॥
মহেন্দ্র মগধ মহারাষ্ট্র গুজরাট॥
শিবাহট্ট মহাহট্ট হস্তিনা নগরী।
বারেন্দ্র বন্দর বিন্ধ্য পিঙ্গল সফর।
আর যত সহর তা বলিবার নারি॥
উত্তল দ্রাবীড় রাঢ় বিজয় নগর॥
এসব সহরে যত আছে সদাগর।
মথুরা দ্বারকা কাশী কল্পপুর কায়া।
কত ডিঙ্গা লয়ে তারা যায় দেশান্তর॥
প্রয়াগ কৌরবক্ষেত্র গোদাবরী গয়া॥
সপ্তগ্রামী বণিক কোথাও নাহি যায়।
ত্রিহট্ট কাঙ্গর কোচ হাঙ্গর শিলট।
ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায়॥
মানিক করিকা লঙ্কা প্রলম্ব লাঙ্গট॥

তীর্থ মধ্যে পুণ্যতীর্থ ক্ষিতি মোক্ষ ধাম।
বাগন বলিয়া দেশ কুরুক্ষেত্র নাম।
সপ্তঋষি শাসন বলিয়া সপ্তগ্রাম॥

 পরন্তু যদিও মুর্শিদাবাদের ভঙ্গশান্তে কলিকাতার শ্রীসৌষ্ঠব বুদ্ধি হউক, বস্তুতঃ সরস্বতী নদীর স্রোতমান্দ্যবশতঃ এই সপ্তগ্রাম নগরীর গরিমা হ্রাস হওয়াতেইকলিকাতায় বাণিজ্য লক্ষ্মীর আবির্ভাব হইয়াছে; পূর্ব্বে কি ইউরোপীয় এবং কি এদেশীয় বণিকমাত্রই সপ্তগ্রামে যাইয়া বাণিজ্য করিতেন। সপ্তগ্রামের শ্রীহীনতার অব্যবহিত পরেই পর্তুগীজদের অধীনে কিছুকাল হুগলী নগরের শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল। কিন্তু সপ্তগ্রামীয় বস্ত্র ব্যবসায়ী বণিকেরা ইউরোপীয়দিগের মধ্যে ইংলণ্ডীয়দিগের সহিত ব্যবসায়ে অধিক লভ্য ওতাহাদিগের অধীনে নির্বিঘ্নে বসতিকরণের সমধিক উপযোগিতা দর্শন করিয়া কলিকাতায় আসিয়া বসতি করিলেন, তদবধি এই নগরের শোভা ও প্রতিভা পদ্মবনের ন্যায় অতি অল্পকালের মধ্যে বর্ধিত হইয়া উঠিল।

অপিচ কলিকাতার প্রাচীনত্বের বিষয় আমরা পুনৰ্বার অনুসরণ করি,—এইস্থান যে নিতান্ত আধুনিকনহে, তাহার বহুল প্রমাণ লব্ধ না হইলেও পুষ্টিপূরকবিলক্ষণ নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে। এদেশের একজন প্রাচীন কবি অর্থাৎ মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্ত, যিনি কবিকঙ্কণ নামে বিখ্যাত আছেন—তত্রচিত চণ্ডী কাব্যেশ্রীমন্ত সাধুর সিংহল দ্বীপে বাণিজ্য প্রস্থান প্রকরণে এইরূপ লিখিত হইয়াছে। যথা:—

নায়ে তুলে সদাগর নিলমিঠা পানি।
ছাগল মহিষ মেষে পূজিয়া পার্বতী।
বাহ বাহ বলিয়া ডাকেন ফরমাণী।

কুচিনাল এড়াইল সাধু শ্রীয়পতি॥।
গরিফা বাহিরা সাধু বাহে গোন্দল পাড়া।
তীরসম ছোটে তরী তরঙ্গের ঘায়।
জগদ্দল এড়াইয়ে গেলেন নপাড়া॥
চিত্রপুর এড়াইয়া শালিখাতে যায়॥
ব্রহ্মপুত্র পদ্মাবতী সেই ঘাটে মেলা।
কলিকাতা এড়াইল বানিয়ার বালা।
ইছাপুর এড়াইল বানিয়ার বালা॥
বেতরতেউত্তরিল অবসানে বেলা॥
উপনীত হইল নিমাই তীর্থ ঘাটে।
বেতাঙ্গ চণ্ডিকা পূজা করি সাবধানে।
নিমের বৃক্ষেতে যথা জবা ফুল ফোটে॥
ধনতার গ্রাম সাধু এড়াইল বামে॥
ত্বরায় চলয়ে তরী তিলেক না রয়।
ডাহিনে ত্যাজিয়া যায় হিজুলীর পথ।
ডাহিনে মাহেশ বামে খড়দহ কয়॥
কিনিয়া লইল রাজহংস পারাবত॥
কোন্নগড় কোতরঙ্গ এড়াইয়ে যায়।
বালীঘাটা এড়াইল বানিয়ার বালা।
সর্ব্বমঙ্গলার দেউল দেখিবারে পায়॥
কালীঘাটে উপনীত অবসানে বেলা॥

এক্ষণে ত্রিবেণী হইতে কালীঘাট পর্যন্ত উল্লিখিত গ্রামনিচয়ের প্রাচীনত্ব বিষয়ে সংশয়মাত্র থাকিতে পারেনা। কলিকাতা দূরে থাকুক খিদিরপুরের উত্তরে অবস্থিতবালীঘাটার নাম পর্য্যন্ত প্রাপ্ত হইতেছে অথচ খিদিরপুরের নামোল্লেখ দৃষ্ট হয় না। প্রত্যুত এই কাব্যগ্রন্থ অল্পদিনের নহে। কবিকঙ্কণ লেখেন:—

শকে রস রস বেদশশাঙ্ক গণিতা।
কব কত দিল পীত হরের বণিত॥

“অঙ্কস্য বামগতি’ এই নিয়মে গণনা করিলে চণ্ডীগ্রন্থ ১৪৬৬ শকে প্রস্তুত বিধায় ইহাই প্রমাণ হইতেছে কলিকাতা গ্রাম তিনশত বৎসরেরও অনেক পূর্ব্বে বর্তমান ছিল।

অপর, দেবীবর কর্তৃক এদেশীয় কুলীনদিগের মেল বদ্ধ হইলে পরতাঁহারা যে যে স্থানে বসতি করেন, সেই সেই স্থানের নামানুসারে বিখ্যাত হন। যথা:—ফুলিয়ার মুখুটি, খনিয়ার চাটুতি, সাগরদহের বন্দ্য, কলিকাতার ঘোষাল—ইত্যাদি। ঘোষালবংশীয় পশো হইতে কলিকাতার ঘোষাল নাম হয়। যথা করিকা-

এই পশো অন্ন... বৎসর গত হইল বর্তমান ছিলেন। সুতরাং ইহাতেও কলিকাতার প্রাচীনত্বের প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে।

কলিকাতা নামে ব্যুৎপত্তিবিষয়ে বহুতর কল্পনা কল্পিত হইয়াছে। কোন মহাশয় লিখিয়াছেন যে, অনেকনগরের নাম দেবমণ্ডপাদির আখ্যা অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে; অতএব বোধ হয় কলিকাতার অদূরবর্তী পীঠস্থান কালীঘাটের নামানুসারে ইহার নামকরণ হইয়া থাকিবে। অর্থাৎ কলিকাতার নাম, কালীঘাট অথবা কালীঘাটার অপভ্রংশমাত্র। অন্য এক মহাশয় লেখেন, ইং ১৭৪২ অব্দে মহারাষ্ট্রীয় উৎপাত নিবারণার্থ যে পরিখা খনিত হয়, সেই ‘খাল কাটা’হইতে কলিকাতা’নাম উৎপন্ন হইয়া থাকিবে, যেহেতু উক্ত অব্দের অনেক পূর্ব্বে কলিকাতা নাম প্রচলিত ছিল না। এই উভয় ব্যুৎপত্তি যে বিলক্ষণ অমূলক তাহা উপরিভাগে পদ্য ও কারিকায় সপ্রমাণ করিতেছে, কারণইং ১৭৪২ অব্দের অনেক পূর্ব্বেকলিকাতা নাম প্রচলিত ছিল। প্রাগুক্ত ব্যুৎপত্তিদ্বয় ব্যতীত আর এক রহস্যজনক জনশ্রুতি এই যে,ইংরাজেরা যখন প্রথমতঃ এইস্থানে বাণিজ্যালয় স্থাপনার্থআগমন করিলেন তখন গঙ্গাতীরে দণ্ডায়মান কোন লোককে অঙ্গুলী প্রসারণপূর্বক স্থানের নাম জিজ্ঞাসা করাতে সে ব্যক্তি সেইদিকে শায়িত এক ছিন্নবৃক্ষ দেখিয়া মনে করিল সাহেবরা কবে ঐ বৃক্ষচ্ছেদন হইয়াছে, তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছেন। অতএব সে উত্তরচ্ছলে কহিল—“কাল কাটা”। সেই হইতে ইংরাজেরা ইহার নাম “ক্যালকাটা” রাখিলেন। এই ব্যুৎপত্তি অমূলক হইলেও ইহার রচয়িতার চতুরবুদ্ধির ব্যাখ্যাকাক্য। ফলতঃ কোতরঙ্গ কুচিনান প্রভৃতি গ্রামাখ্য যেমন নিরর্থক,কলিকাতা শব্দও যে সেইরূপ নিরর্থকতাহাতে সন্দেহ করিবার প্রয়োজন নাই।

এইরূপেকলিকাতার প্রাচীনত্ব সাব্যস্ত হইলেও তাহাবহুকালাবধি ইতর লোকেরবাসস্থান ছিল,অনন্তরঅনুমানদুইশত বৎসর বিগত হইল সপ্তগ্রামের শেঠ ও বসাকখ্যাত তন্তুবায় জাতীয় ব্যবসায়ীগণ উক্ত প্রাচীন নগরের নিকটবর্ত্ত আপনাদিগের বাসস্থান হরিদপুর গ্রাম পরিত্যাগপূর্ব্বক কলিকাতায় আসিয়া বসতি করেন। এই শেঠ বসাকদের পূর্বনিবাস ঢাকায় ছিল। অদ্যাপিতৎপ্রদেশেতাঁহাদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির ভূসম্পত্তি আছে। আমাদিগের আত্মীয় কোন বসাকের নিকট তাহার পূর্ব্বপুরুষের অধিকৃত ঢাকার নিকটস্থ কতিপয় গ্রামাদির কাগজপত্র আছে; ফলতঃ অন্ন একশত বৎসর হইলতাহারা ঐ বিষয়ের অধিকার ভ্রষ্ট হইয়াছেন।

ঢাকার শেঠবসাকেরা যদিও কলিকাতার শেঠবসাকদিগের সহিত একগোত্রজ হউন কিন্তু বহুদিবস যাবৎ তাহাদিগের পরস্পর বিচ্ছেদবশতঃ এক্ষণে করণ-কারণ রহিত হইয়াছে। মুর্শিদাবাদের তন্তুবায় কারফরমাদিগের সঙ্গেও কলিকাতাস্থ শেঠবসাকদিগের এইরূপ সম্বন্ধ। মৃত রাধাকৃষ্ণ বসাক কারমাদিগের সহিত পুনর্ব্বার কুটুম্বিতাকরণের প্রস্তাব করে। তাহাতে কারফরমারা সম্মত হইয়াছিলেন কিন্তু এক সামান্য অনৈক্য সূত্রে এই বাঞ্ছনীয় সদ্ভাব সংস্থাপনে ব্যাঘাত সস্তৃত হয়। তাহা এই যে, কারফরমাকুলের অঙ্গনাগণ বামাঙ্গে রজতালঙ্কার পরিধান করেন। কারফরমারা সেই পুরুষ পরম্পরা প্রচলিত কুলাচার পরিত্যাগে সম্মত না হওয়ায় রাধাকৃষ্ণ বসাক পূর্ব্বপ্রস্তাবে পরাজুখ হইলেন। সে যাহাই হউক ঢাকাই শেঠবসাকদিগের আদ্যস্থান। তথা হইতে তাহারা প্রথমে মুর্শিদাবাদ ও তৎপরে সপ্তগ্রামের নিকট হরিদপুরে বসতি করেন। তদন্তের সপ্তগ্রাম ও স্থালীর প্রতিভা হ্রাসহইলেকলিকাতায় আসিয়া বড়বাজারে বসবাস করিতে লাগিলেন-অভিপ্রায় এই যে,সরস্বতী মন্দা পড়িয়া গেলে ভাগীরথী প্রবলা থাকায় ইউরোপীয়েরা সেই নদী হইয়া আগমনপূর্বক বাণিজ্য-ব্যবসা করিবেন—সুতরাং যত অগ্রসর হইয়া থাকা হয় ততই উভয় পক্ষের মঙ্গল। শেঠবসাকেরা ঐ স্থানে বসতিপূর্ব্বক আপনাদিগের ব্যবসানুসারে “সুতালুটি”শব্দে তাহার নামকরণ করিলেন।

হিন্দু ভদ্রগ্রামের লক্ষণ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থাদি সজ্জাতির বাস—যেহেতুতাহাদিগের অভাবে যজন, যাজন, চিকিৎসা পথ্য ও লিখন পঠনের উপায় থাকেনা। অতএব উক্ত সুসম্পন্ন তন্তুবায়েরা একঘর ব্রাহ্মণ, একঘর বৈদ্য, এবং একঘর কায়স্থ আনাইয়া আপনাদিগের নিকটেসংস্থাপিতকরেন।পারিয়াঘাটার শুদ্ধ শ্রোত্রীয় ঠাকুরগোষ্ঠী উক্ত ব্রাহ্মণের এবং সেইস্থানে মজুমদার খ্যাত বৈদ্যেরা এবং কলিকাতা নিবাস প্রথম কায়স্থের বংশধরগণ হয়েন।