কল্লুর জগৎ - মঞ্চে চড়ে মস্করা

উইকিসংকলন থেকে

কল্লুর জগত

মঞ্চে চ'ড়ে মস্করা

স্তর  

লেখন: সুভদ্রা সেনগুপ্ত
চিত্রাঙ্কন: তাপস গুহ



Original Story in English 'Kallu's World—Monkey Business on Stage' by Subhadra Sen Gupta

Illustrations:Tapas Guha

‘Kallur Jagot—Monche Chode Moskora’
Bengali Translation by Swagata Sen Pillai

© Pratham Books, 2011. Some rights reserved. CC-BY 4.0

First Bengali Edition: 2014

ISBN: 978-93-5022-245-4

Typesetting and layout by:
Pratham Books, New Delhi

Printed by:
Rave India, New Delhi

Published by:
Pratham Books
www.prathambooks.org

Registered Office:
PRATHAM BOOKS
# 621, 2nd Floor, 5th Main, OMBR Layout
Banaswadi, Bengaluru 560 043
T:+91 80 42052574/41159009

Regional Office:
New Delhi
T:+91 11 41042483

PRATHAM BOOKS Some rights reserved. The story text and the illustrations are CC-BY 4.0 licensed which means you can download this book, remix illustrations and even make a new story - all for free! To know more about this and the full terms of use and attribution visit http:/prathambooks.org/cc.

মঞ্চে চ’ড়ে মস্করা

লেখন: সুভদ্রা সেনগুপ্ত
চিত্রাঙ্কন: তাপস গুহ
বাংলা অনুবাদ: স্বাগতা সেন পিল্লই

খাজুরিয়া গ্রামে রামলীলার জ্বর ধরেছে। নতুন ব্যাপার কিছুই নয়—যেমন কল্লু বলে—প্রতিবছরই এসে থাকে এই জ্বর।

বিজয়ার মাসখানেক আগে থেকে এই জ্বর শুরু হয়। যেই শ্রাবনের কালো ঘন মেঘ কেটে গিয়ে আকাশটা উজ্জ্বল নীল হয়ে চমক ধরে, বাতাসে উতসবের রোল আর সকলের মুখে মাস্টারমশাই আর রামলীলার চর্চা শুরু হয়।

গ্রামের চারি দিকে, ধরমপালের চায়ের দোকানে, তরকারীর চাষ মাঠে, মুদির দোকানে, মুটি দিদা'র উঠানে আর কুঁয়োর ধারে, একই প্রশ্ন হাওয়ায় উড়ছে—

“এবছর মাস্টারমশাই কী করবেন?”

কলু অনেক সময়ই মাস্টারমশাইয়ের প্রশংসায় বলে থাকে—“উনি রামলীলার সর্বেসর্বা—প্রস্তুতকর্তা, নির্দেশক, লেখক এবং সঙ্গীতকার—সব কিছু—আর শুধুমাত্র উনিই জানেন আমরা এবছর কী দেখবো।”

মাস্টারমশাই গ্রামের ইস্কুলের প্রধানাচার্য, এবং খাজুরিয়ার রামলীলা পার্টির নেতা—যেটা প্রতি বছর একটা কোরে অসাধারণ নাটক প্রস্তুত করে। অবশ্যই সম্পূর্ন রামায়ন করা সম্ভব নয়—সেটা কী না বিশাল বড়ো কাহিনী, আর খাজুরিয়ায় অত অভিনেতা পাবে কোথায়? তাই মাস্টারমশাই কয়েকটা মুখ্য মুখ্য দৃশ্যের সংবাদ লিখেছেন আর তার থেকেই কয়েকটাকে বেছে নেন প্রতিবছর পুজোর সময় মঞ্চন করার জন্য। তাই খাজুরিয়া শেষ পর্যন্ত জানতেই পারতো না কোন দৃশ্যগুলি দেখানো হবে।

বদ্রীদাদা'র মোষ রাখার মাঠের কোনে একটা তাঁবু খাটানো হয়। জয় ভগবানের টেণ্ট হাউস থেকে আনা কয়েকটা নড়বড়ে টেবিল দিয়ে একটা স্টেজ তৈরী হয়। দর্শকেরা বসে মাটিতে পাতা মাদুর আর গালিচার উপর আর এখন যেহেতু গ্রামে বিদ্যুত সংযোগ আছে, মঞ্চে আলো দেওয়ার জন্য গ্যাসের বাতির সাথে সাথে ইলেকট্রিক বল্ব ও জ্বালানো হয়।

রিহার্সালের প্রথম দিন থেকেই কল্প এবং তার দল ইস্কুলের আসে-পাশেই ঘুর ঘুর করতে থাকে, এই আশায় যে মাস্টারমশাই হয়ত তাদের কিছু করতে দেবেন। কলুর দলে আছে ওর বোন মুনিয়া, ভাই শব্বো, ওর ঘনিষ্টতম বন্ধু দামু আর তার বোন সরু। দিনের পর দিন, ওরা এমন মনোযোগ সহকারে বসে বসে রিহার্সাল দেখভো যে শেষে ওরা সকলের ডায়লগ একেবারে মুখুস্ত বলতে পারতো।

প্রতি বছর মাস্টারমশাই সীতা স্বয়ম্বরের মত' দৃশ্য ভোলেন, যাভে রামের ধনুষ ভাঙ্গার রোমাঞ্চকর ঘটনা আছে; তারপর কৈকেয়ী আর মন্থরার রামকে বনবাসে পাঠানোর ষড়যন্ত্র আর দশরথের দুঃখে মৃত্যু। মুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য ছিলো লক্ষণের সূর্পনখার নাক কেটে ফেলা আর রাবণের সীতা হরণ। তার পর ছিলো হনুমানের লঙ্কা দহন আর অবশেষে রাবন, কুম্ভকর্ণ আর মেঘনাদের রাম, লক্ষণ, হনুমান আর বানরসেনার সাথে দারুণ যুদ্ধের দৃশ্য।

এবছর ওদের ঘেংটি পাড়া কাজে দিয়েছে আর মাস্টারমশাই কলু, দামু আর শব্বোকে বানর সেনায় সম্মিলিত করতে রাজি হযেছেন। ওরা শেষের দৃশ্যে অংশ গ্রহণ করছে আর
তার জন্য ওদের হাফ প্যাণ্ট পরতে হবে, বাঁদরের মতো মেক-আপ নিতে হবে আর লম্বা লম্বা লেজ লাগাতে হবে। কী মজাই না হ্য যখন ওরা লাফালাফি করে টিনের তৈরী গদা আর তরোয়াল ঘুরিয়ে যুদ্ধের ভান করে দেখে দেখে দুই মেয়ে -মুনিয়া আর সরু হিংসায় জ্বলে যায়!

“কীঈঈই বোকা বোকা!” সরু গোমড়া মুখে ইস্কুলে যাওয়ার পথে একদিন সকালে বললো। “মেয়েরা কেনো রামলীলায় ভাগ নিতে পারে না?”

“গতকাল ‘সীতা’কে দেখেছিলি?” মুনিয়া জিজ্ঞেস করলো।

“ছেলেটা কল্লুদা'র ক্লাসে পড়ে আর ওর গোঁফ গজাচ্ছে..."

"আর ওর গলা কেমন বার বার ভাঙ্গছিলো,” সরু খুকখুকিয়ে বললো। “আমার সত্যিই মনে হয় বিল্লো কাকী সীতা হিসেবে একেবারে দারুন লাগবেন।”

“হ্যাঁ, সত্যিই! এখন ওনার বর ধরমকাকা যদি রাম হতে পারেন, উনি সীতা হতে পারেন না কেনো শুনি?”

"উনি ত' মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেসাও করেছিলেন, কিন্তু উনি বললেন যে যদি আসল মহিলাদের ভাগ নিতে দেন তাহলে খাজুরিয়া পাঞ্চায়ত রামলীলা বন্ধই করে দেবে, ধ্যাত!” সরু বিরক্তিতে মাথা নাড়লো।

"যাই হোক, আজ বদ্রীদার বড়ো দৃশ্য! “মুনিয়া আনন্দে একটু লাফিয়ে নিলো, “আমার তর সইছে না।”

কল্লু আর ওর বন্ধুদের জন্য বীর মতো অভিনেতা হয়ই না-পাগলা মোষচালক যে সব সময় হনুমানের অভিনয় করে। বেঁটে আর মোটা, একমাখা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, বিরাট বুনো গোঁফ, বড়ো বড়ো গোল গোল চোখ আর গমগমে আওয়াজ। যখন ও মঞ্চে, গটগটিয়ে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে জোর গলায় ডায়লগ বলে, রাম লক্ষণও যেন ফ্যাকাশে হয়ে যান ওর সামনে।

কল্লু আর ওর দলের মতে, ওই দৃশ্যটা যেখানে হনুমান রাবণকে অপমান করে আর তারপর গোটা লঙ্কা পুড়িযে ফেলে-সেটা হলো এক্কেবারে সুপার হিট দৃশ্য। মাস্টারমশাই এমন সাংঘাতিক ডায়লগ লিখেছেন রাবণ আর হনুমানের যে দর্শকেরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে নিঃশব্দে শোনে।

সেদিন বিকালবেলায় এদের দল তাঁবুতে পৌঁছে গেলো সব্বার আগে। বদ্রীর মোষগুলো কাছেই বাঁধা ছিলো আর দামু বললো যে গোবরের উপর দিয়ে নাকি তাদের ‘হাই জাম্প’ করে যেতে হবে।

"সামনে থেকে দ্বিতীয় সারি আর এক্কেবারে মাঝা মাঝি। দারুন!” বললো শব্বো, আনন্দে গালিচার উপর বসতে বসতে।

"যাক, কাল আমাদের আর জায়গা ধরতে হবে না,” বললো কলু, মুনিয়া আর সরুকে একটু খেপিযেই মুচকি হেঁসে। “আমরা ছেলেরা ভো মঞ্চে হবো।”

"হাঃ।” মুনিয়ার কোঁকড়া চুল দুলে উঠলো। “তোমরা বোকার মতন লাফালাফি করা ছাড়া করো কী, আর মুখ ফুটে বলার মতো তোমাদের কারো কাছে ডায়লগই নেই!”

"আর শব্বোকে ত' মেঘনাদ মেরেই ফেলবে আর ও তখন মরা গাছের মত হাঁ করে পীঠের উপর পড়ে থাকবে নীচে,” হাঁসতে হাঁসতে বলে উঠলো সরু।

"জানিস, মরার পার্ট করতে গেলে কত' অভিনয় করতে হয়?” শব্বো মান বাঁচাতে ব্যস্ত। “আমায় কী ধীমে ধীমে নিশ্বাস নিতে হয় আর চোখ একেবারে জোরে বন্ধ করে রাখতে হয়!"

"হ্যাঁ বাবা, তোমায় খাজুরিয়ার সবচাইতে উত্তম মৃত বানর পুরস্কার দাওয়া হবে।” দামু হেঁসে বললো।

সূর্যাস্তের সাথে সাথে তাঁবুটাও ভরে আসতে লাগলো। মঞ্চের পেছনে সে কী ব্যস্ততা, সকলেই পোষাক পরছে আর মেকআপ লাগাচ্ছে। ধরমপালের আজ ছুটি কারণ রামের কাজ ছিলো না এই দৃশ্যে, ভাই উনি বদ্রীর চেহারায় হনুমানের রং চড়াতে ব্যস্ত।

"আহ, এই গোঁফটা কেটে ফেললেই পারো বদ্রী,” উনি বললেন। “কী অদ্ভুত লাগে। ফিল্মে আর টিভিতে হনুমান এক্কেবারে দাঁড়ি গোঁফ ছাড়া।”

"গায়ের রং করে দাও আর কেউ টেরও পাবে না,” বদ্রী গজগজ করে বললো। “আমি কাটবো না! এক্কেবারে না—ভেবোই না!” তার পর ডায়লগের কাগজটাকে মুখের সামনে ধরে চোখ কুঁচকে দেকতে দেখতে বললো, “কেনো যে মাস্টারমশাই প্রতি বছর ডায়লগ পাল্টান কে জানে?”

"উনি শিল্পী, আর সব শিল্পীরাই পাগল এমনিতেই। এই বছর ভারত মিলাপের দৃশ্যে উনি রাম আর ভরত কে দিয়ে গান গাওয়াতে চেয়েছিলেন” বললেন ধরমপাল।

"গান?” বদ্রী আবার বললো কথাটাকে।

"হ্যাঁ! এই ধরণের কিছু একটা-ভ্রাতু প্রেম অমর রইবে। ...কিছু কিছু।...আর কিছু কিছু।...” ধরমপাল হেঁসে ফেললো।

"কিন্তু তুমি ত' গাইতেই পারো না” বললো বদ্রী।

"ওই ত'! আর লাটুও পারে না, আর ও হলো ভরত! দু দিন উনি অনেক চেষ্টা করলেন আমাদের গান গাওয়াতে আর শেষে হাল ছাড়লেন। ভাগ্যিস!” ধরমপাল নিশ্চিন্তে বললেন।

হঠাত বদ্রী উঠে বসে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলোএত জোরে যে ধরমপাল আঁতকে উঠলো, “মাস্টারমশাই। মাস্টারমশাই!"

“কী হলো?” মাস্টারমশাই ঘাবড়ে দৌড়ে এলেন।

"আপনি রামের জন্য গান লিখলেন আর হনুমানের জন্য নয়? আর আমি কিনা গাইতেও পারি!” বললো বদ্রী।

"আরে বাছা!” মাস্টারমশাই মুখে একটা পান সে বললেন, “হনুমান গায় না।”

"আর ভুমি গাইবেই বা কী?” বদ্রী'র নাকটাকে টকটকে লাল রাঙাতে রাঙাতে ধরমপাল জিজ্ঞাসা করলো। “হনুমান-রাবণের শত্রুতা অমর হউক?”

"হেঃ হেঃ। ...হো হো...” মাস্টারমশাই পানের পীকের হিঁটা ছড়াতে ছড়াতে হেঁসে বেরিয়ে গেলেন।

ধরমপাল সযত্নে বদ্রী'র উজ্জ্বল হলুদ হাফ প্যাণ্টে লেজ লাগাতে লাগাতে আর খেয়াল করলেন না, বদ্রী-হনুমানের ধূসর চেহারায় ভাবুক ভঙ্গিমা...

ঘণ্টাখানেক পর, পর্দা টেনে দেখা গেলো লঙ্কায় রাবনের রাজসভা, আর সে কী আড়ম্বর গালিচা, পর্দা, সিংহাসন দিয়ে সাজানো, সব জয় ভগবানের দোকানের দেন। জয় ভগবান যেহেতু গ্রামের সবচেয়ে মোটা মানুষ, ও কুম্ভকর্ণ হবে।

বেশ চলছিলো দৃশ্যটা আর দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসেছিলো। ছোটে লাল, গ্রামের পালোয়ান সেজেছে রাবণ, আর নারায়ণ, যে ক্লাস টেনে পড়ে, গোলাপী রঙের জরি দাওয়া সাড়ি পরে হযেছে মণ্ডদরী। রাবণের ফোলা ফোলা পেশী, ঘন ভুরু, গোল করা গোঁফ আর বড়ো বড়ো চোখ সাক্ষাত রাবনের মতই ভয়াবহ ছিলো। একমাত্র অসুবিধে ছিলো যে ছোটে কিছুতেই ডায়লগ মনে রাখতে পারতো না।

"মাস্টারমশাই কী কষ্টই না পেযেছেন ছোটেকে ওর সংবাদ মুখস্ত করাতে” দামু ফিসফিস করে বললো। “সব গুলিযে ফেলে।”

"আর তার পর মাস্টারমশাই সমস্যার সমাধান পেলেন” ফিক করে হাঁসলো কল্লু।

সবাই ওর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী করে?”

"নারায়ণের ঠোঁটের দিকে তাকা, ও ছোটেকে সব বলে দিচ্ছে। মাস্টারমশাই ওকে মণ্ডদরী আর রাবন, দুজনেরই লাইন মুখস্ত করিয়েছেন!” আবার ফিসফিসিয়ে বললো কল্লু।

"কী বুদ্ধি!" প্রশংসায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুনিয়া।

"এই আসছে!” বলে উঠলো সরু উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে, যেই রাক্ষসেরা হনুমানকে টানতে টানতে মঞ্চে তুললো। সকলে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসলো, হনুমানের উপর চোখ স্থীর, যে মোটা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা কিন্তু তবু অহংকারে মাখা ভুলে রাবনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

"কে এটা?” মণ্ডদরী ছোটে কে ইঙ্গিত দিলো চুপিসাড়ে।

"মমম...” রাবণ ওর দিকে মাথা ঝুঁকিযে, শুনে, তার পর জোর গলায় বললো, “এটা কে?”

একটা রাক্ষস এগিয়ে এলো। “আমরা ওকে অশোক বনে ধরেছি মহারাজ! ও সীতা দেবীর সাথে কথা বলছিলো।

"কী...” ইঙ্গিত দিলো মণ্ডদরী।

"কী!” চেঁচিয়ে এক লাফে উঠে পড়লো রাবণ-হঠাত তার সব ডায়লগ মনে পড়ে গেছে। “ও সেখানে ঢুকলো কী করে? ওখানে করছিলটা কী শুনি?” রাগে হাত নেড়ে বললো সে।

মুনিয়া একটু হেঁসে দিলো আর তার পর যেই দর্শকেরা রাবণের মুখ দেখতে পেলো, একে একে সকলেই হাঁসতে শুরু করলো। হাত নাড়াতে গিয়ে রাবণ তার নকল গোঁফ এক কোন থেকে খুলে দিয়েছে, আর সেটা এখন কালো কেঁচোর মতো দুলে রযেছে ওর ঠোঁটের উপর।

কল্লু যেখানে বসে আছে সেখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মাস্টারমশাই উদ্ধান্ত হয়ে হাত নেড়ে নেড়ে দেখাচ্ছেন রাবণের মুখের দিকে।

নিজের ডায়লগ শুরু করার উপক্রমে, হনুমান দর্শকদের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এইটা একটা গম্ভীর দৃশ্য। ওরা হাঁসছে কী বলে?

"এই, কী হলো?” জিজ্ঞেসা করলো সে অন্ধকারে পিটপিটিযে। “তোরা হাঁসছিস কেনো?”

"রাবণের গোঁফ পড়ে গেলো যে বদ্রীদা!” কেউ দয়া করে ওকে জানিয়ে দিলো।

"ওহো! সরি!” রাবণ ঘাবড়ে গিয়ে একটু আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি গোঁফটাকে জায়গায় লাগিয়ে ঘামাক্ত চেহারা মণ্ডদরী'র দিকে ফিরিয়ে, “এর পর কী বলি আমি?”-ভুলে ভুলে ফিস ফিস না করে জোরেই জিজ্ঞেসা করে ফেললো আর সবাই আবার হেঁসে উঠলো!

মঞ্চের ধারে মাস্টারমশাই কপকপ করে পান চিবিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত আরো বেগে...

"বলো তুমি কে...চোর বান্দর!” মন্দোদরী যথারীতি ইঙ্গিত দিলো।


“কী?” রাবণ তখনও একটু ঘাবড়েই আছে “ওহ ঠিক ঠিক। বলো তুমি কে...চোর বান্দর! “অবশেষে ও হনুমানের দিকে ফিরে বললো, “কোথা থেকে এসেছো?”

"এইবার!” শব্বো ঝুঁকে পড়ে শুনছে, “আমার প্রিয় ডায়লগ।”

মাস্টারমশাই কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছন্দে সংবাদ লিখেছেন আর যেখানে হনুমান রাবনকে নিজের পরিচয় দেয়, সেই কাব্য শব্বো'র মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে একটি। আর বদ্রী'রর অভিনয় ত' সবসময় অসাধারণ!

ও সটানটান লম্বা হযে, বুক চাপড়ে রেগে জিজ্ঞেসা করে, “চোর বান্দর? তুমি কে হে আমায় তা ডাকার? জানো আমি কে?” আর তার পর দর্শকমুখি হযে শব্বো'র মুখস্ত কবিতটা বলতে শুরু করে:


আমি রামঠাকুরের চেলা, হনুমানকে করিস হেলা—

ওহে রাবণ বলবান দাঁড়া টানবো যে তোর কান

সেখানে একটা নাটকীয় বিরাম দিয়ে, আবার বুক চাপড়ে গমগমাট স্বরে বলে উঠবে...

আমি পবনপুত্র হনুমান!! ওরা নিশ্বাস ধরে অপেক্ষা করছে, হনুমান রাবণের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো, “জানো আমি কে?” দর্শকেদের দিকে ফিরে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে হঠাত বদ্রী গাইতে শুরু করলো!

"আমি রামঠাকুরের চেলা ...আ...আ।”

"ও গাইছে?” আশ্চর্য্যে সরুর চোখ বিরাট বড়ো হয়ে গেলো।

"হনুমানকে করিস হেলা ...আ...আ...আ।”

হনুমান গেয়ে চলেছে...

"ভালো গাইছে তো!” কল্লু আনন্দে কুল পাচ্ছে না। “বদ্রীদা সত্যি গাইতে পারে দেখি।”

পর্দার পাশে মাস্টারমশাই যেন বিদ্যুতের চমক থেমে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রধান নায়ক বদ্রীকে গাইতে শুনে যাচ্ছেন, আচম্ভে পান চিবোতেও ভুলে গেছেন।

বদ্রী গাইছে, উপরে চোখ তুলে আর ফিল্মের নায়কের মত হাত ভুলে। ওর সুরটা বেশ মনোরম আর দর্শকেরাও তালি বাজাতে শুরু করলো, নারায়ণও নাটকের কথা ভুলে গিয়ে তালে তাল মিলাতে লাগলো। একটা রাক্ষস কোমর দুলিযে এমন মজার নাচ নাচতে শুরু করলো! বদ্রীর মুখে একটা চাপা হাঁসি দেখা দিলো, আর আনন্দে মাথা নেড়ে ও ঠিক করলো পুরো গানটা আবার গাইবে!

শেষের লাইনে পৌঁছে ও দর্শকদের ইঙ্গিত করলো ওর সাথে গাইতে আর গেয়ে বললো, “আমি পবন পুত্র..."

আর সমস্ত দর্শক সমস্বরে চেঁচিয়ে বললো, “হনুমা... আ... আ... ন!"

বাইরের মাঠের থেকে বদ্রীর অনুগত মহিষের দল সমবেত কণ্ঠে বলে উঠলো, “হাম্বা...হাম্বা..."

ক্লান্ত-শ্রান্ত বাড়ির পথে যেতে যেতে কলু একটা বড়ো, আনন্দিত নিশ্বাস ছেড়ে বললো, “কী দারুন সুপার হিট রামলীলাই না ছিলো।”

* * * *

এই লেখাটি ক্রিয়েটিভ কমন্স অ্যাট্রিবিউশন ৪.০ আন্তর্জাতিক লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশ করা হয়েছে, যা বিনামূল্যে ব্যবহার, বিতরণ ও অভিযোজন করার অনুমতি দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত লাইসেন্সটি অপরিবর্তিত ও পরিষ্কার ভাবে বলা থাকে এবং মূল লেখককে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।