কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/অন্তর্যামী

উইকিসংকলন থেকে

অন্তর্যামী

এ কি কৌতুক নিত্য-নূতন
ওগাে কৌতুকময়ী।
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই?
অন্তরমাঝে বসি’ অহরহ
মুখ হ’তে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মাের কথা ল’য়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কি বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সঙ্গীতস্রোতে কূল নাহি পাই
কোথা ভেসে যাই দূরে।
বলিতেছিলাম বসি’ একধারে
আপনার কথা আপন জনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনী যত;

তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে,
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে,
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মত।
সে মায়ামূরতি কি কহিছে বাণী,
কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি’,
আমি চেয়ে আছি বিস্ময় মানি’
রহস্যে নিমগন।
এ যে সঙ্গীত কোথা হ’তে উঠে,
এ যে লাবণ্য কোথা হ’তে ফুটে
এ যে ক্রন্দন কোথা হ’তে টুটে
অন্তর-বিদারণ।
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে’ যায়,
নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
নূতন রাগিণীভরে।
যে কথা ভাবিনি বলি সেই কথা,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
জানি না এসেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে!
কে কেমন বােঝে অর্থ তাহার,
কেহ এক বলে কেহ বলে আর,

আমারে শুধায় বৃথা বারবার,—
দেখে’ তুমি হাস বুঝি।
কে গাে তুমি, কোথা রয়েছ গােপনে,
আমি মরিতেছি খুঁজি’।

এ কি কৌতুক নিত্য-নূতন
ওগাে কৌতুকময়ী।
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
চলিতে দিতেছ কই?
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে,
চাষীগণ ফিরে দিবা-অবসানে,
গােঠে ধায় গরু, বধূ জল আনে
শতবার যাতায়াতে,
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায়,
মনে ছিল, দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,
ক্লান্ত হৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে।

কখনাে উদার গিরির শিখরে,
কভু বেদনার তমােগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের পরে
চলেছি পাগল বেশে।
কভু বা পন্থ গহন জটিল,
কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল,
কভু সঙ্কট-ছায়া-শঙ্কিল,
বঙ্কিম দুরগম,—
খর কণ্টকে ছিন্ন চরণ,
ধূলায় রৌদ্রে মলিন বরণ,
আশে পাশে হ’তে তাকায় মরণ,
সহসা লাগায় ভ্রম।
তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায়,
কাঁপিছে বক্ষ সুখের ব্যথায়,
তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়
চিত্ত মাতিয়া উঠে।
কোথা হ’তে আসে ঘন সুগন্ধ,
কোথা হ’তে বায়ু বহে আনন্দ
চিন্তা ত্যজিয়া পরাণ অন্ধ
মৃত্যুর মুখে ছুটে।
ক্ষ্যাপার মতন কেন এ জীবন?
অর্থ কি তা’র, কোথা এ ভ্রমণ?

চুপ করে’ থাকি শুধায় যখন
দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে তুমি গোপনে চালাইছ মােরে,
আমি যে তােমারে খুঁজি।

রাখ কৌতুক নিত্য-নূতন
ওগাে কৌতুকময়ী।
আমার অর্থ, তােমার তত্ত্ব
বলে’ দাও মােরে অয়ি।
আমি কি গাে বীণা-যন্ত্র তােমার?
ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার
মূচ্ছনাভরে গীতঝঙ্কার
ধ্বনিছ মর্ম্মমাঝে।
আমার মাঝারে করিছ রচনা
অসীম বিরহ, অপার বাসনা,
কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা
মাের বেদনায় বাজে?
মাের প্রেমে দিয়ে তােমার রাগিণী
কহিতেছ কোন্ অনাদি কাহিনী,
কঠিন আঘাতে ওগাে মায়াবিনী
জাগাও গভীর সুর।

হবে যবে তব লীলা অবসান,
ছিঁড়ে যাবে তার, থেমে যাবে গান,
আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ
তব রহস্যপুর?
জ্বেলেছ কি মােরে প্রদীপ তােমার
করিবারে পূজা কোন্ দেবতার
রহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার
মহামন্দিরতলে?
নাহি জানি, তাই কার লাগি প্রাণ
মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান,
যেন সচেতন বহ্নিসমান
নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে?
অর্দ্ধ নিশীথে নিভৃতে নীরবে
এই দীপখানি নিবে যাবে যবে,
বুঝিব কি, কেন এসেছিনু ভবে,
কেন জ্বলিলাম প্রাণে?
কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে
তােমার বিজন নূতন এ পথে,
কেন রাখিলে না সবার জগতে
জনতার মাঝখানে?
জীবন-পােড়ানাে এ হােম অনল
সে দিন কি হবে সহসা সফল?

সেই শিখা হ’তে রূপ নির্মল
বাহিরি’ আসিবে বুঝি।
সব জটিলতা হইবে সরল
তােমারে পাইব খুঁজি।

ছাড়ি’ কৌতুক নিত্য-নূতন
ওগাে কৌতুকময়ী
জীবনের শেষে কি নূতন বেশে
দেখা দিবে মোরে অয়ি?
চির দিবসের মর্ম্মের ব্যথা,
শত জনমের চিরসফলতা,
আমার প্রেয়সী, আমার দেবতা,
আমার বিশ্বরূপী,
মরণ-নিশায় ঊষা বিকাশিয়া
শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া
মধুর অধরে করুণ হাসিয়া
দাঁড়াবে কি চুপি চুপি?
ললাট আমার চুম্বন করি’
নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি’,
নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি’
জানি না চিনিব কি না।

শূন্য গগন নীল নির্ম্মল,
নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল,
না বহে পবন, নাহি কোলাহল,
বাজিছে নীরব বীণা,
অচল আলােকে রয়েছ দাঁড়ায়ে,
কিরণ-বসন অঙ্গ জড়ায়ে
চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে
ছড়ায়ে বিবিধভঙ্গে।
গন্ধ তােমার ঘিরে চারিধার,
উড়িছে আকুল কুন্তলভার,
নিখিল গগন কাঁপিছে তােমার
পরশ-রস-তরঙ্গে।
হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি
আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি,
অঙ্গে অঙ্গে অমৃত-বৃষ্টি
বরষি’ করুণাভরে।
নিবিড় গভীর প্রেম আনন্দ
বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ,
মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ
অশ্রু বাষ্প থরে।
নাহিক অর্থ, নাহিক তত্ত্ব,
নাহিক মিথ্যা, নাহিক সত্য,

আপনার মাঝে আপনি মত্ত,—
দেখিয়া হাসিবে বুঝি?
আমি হ’তে তুমি বাহিরে আসিবে,
ফিরিতে হবে না খুঁজি।

যদি কৌতুক রাখ চিরদিন
ওগো কৌতুকময়ী,
যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া
হবে অন্তরজয়ী
তবে তাই হােক্! দেবি অহরহ
জনমে জনমে রহ তবে রহ,
নিত্য মিলনে নিত্য বিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে।
নব নব রূপে ওগাে রূপময়
লুণ্ঠিয়া লহ আমার হৃদয়,
কাঁদাও আমারে, ওগাে নির্দয়,
চঞ্চল প্রেম দিয়ে।
কখনাে হৃদয়ে, কখনাে বাহিরে
কখনাে আলােকে, কখনাে তিমিরে,
কভু বা স্বপনে, কভু সশরীরে
পরশ করিয়া যাবে।

বক্ষ-বীণায় বেদনার তার
এইমত পুনঃ বাঁধিব আবার,
পরশমাত্রে গীতঝঙ্কার
উঠিবে নূতন ভাবে।
এমনি টুটিয়া মর্ম্ম-পাথর
ছুটিবে আবার অশ্রু-নিঝর,
জানি না খুঁজিয়া কি মহাসাগর
বহিয়া চলিবে দূরে।
বরষ বরষ দিবস রজনী
অশ্রু-নদীর আকুল সে ধ্বনি
রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি
আমার গানের সুরে।
যত শত ভুল করেছি এবার
সেই মত ভুল ঘটিবে আবার,
ওগাে মায়াবিনী কত ভুলাবার
মন্ত্র তােমার আছে।
আবার তােমারে ধরিবার তরে
ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে,
পথ হ’তে পথে, ঘর হ’তে ঘরে
দুরাশার পাছে পাছে।
এবারের মত পূরিয়া পরাণ
তীব্র বেদনা করিয়াছি পান;

সে সুরা তরল অগ্নিসমান
তুমি ঢালিতেছ বুঝি।
আবার এমনি বেদনার মাঝে
তােমারে ফিরিব খুঁজি’

ভাদ্র, ১৩০১।