কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/এবার ফিরাও মোরে

উইকিসংকলন থেকে

এবার ফিরাও মােরে

সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্ম্মে রত,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষগ্ন তরুচ্ছায়ে
দূর-বনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি!—ওরে তুই ওঠ আজি।
আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল? কোন্ অন্ধ কারামাঝে জৰ্জ্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায়? স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি’ করিতেছে পরিহাস
লক্ষ মুখ দিয়া। বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার। সঙ্কুচিত ভীত ক্রীতদাস
লুকাইছে ছদ্মবেশে। ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে,শ্লানমুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী; স্কন্ধে যত চাপে ভার—
বহি’ চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তা’র,—
তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি’;

নাহি ভৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনােমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া। সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে,
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে! এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা; এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে—
“মুহূর্ত্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তােমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;
যখনি দাড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার—তখনি সে
পথ-কুকুরের মত সঙ্কোচে সত্রাসে যাবে মিশে;
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার,
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে।”
কবি, তবে উঠে এস,যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লহ সাথে,তবে তাই কর আজি দান!
বড় দুঃখ, বড় ব্যথা,সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড় ক্ষুদ্র, বদ্ধ অন্ধকার!

অন্ন চাই প্রাণ চাই আলাে চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট! এ দৈন্য-মাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এস স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।

এবার ফিরাও মােরে, ল’য়ে যাও সংসারের তীরে
হে কল্পনে, রঙ্গময়ি! দুলায়াে না সমীরে সমীরে
তরঙ্গে তরঙ্গে আর! ভুলায়াে না মােহিনী মায়ায়।
বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায়
রেখাে না বসায়ে! দিন যায়, সন্ধ্যা হয়ে আসে।
অন্ধকারে ঢাকে দিশি, নিরাশ্বাস উদাস বাতাসে
নিশ্বসিয়া কেঁদে উঠে বন। বাহিরিনু হেথা হ'তে
উন্মুক্ত অম্বরতলে, ধূসরপ্রসর রাজপথে
জনতার মাঝখানে! কোথা যাও, পান্থ, কোথা যাও,
আমি নহি পরিচিত, মাের পানে ফিরিয়া তাকাও।
বল মােরে নাম তব, আমারে কোন না অবিশ্বাস।
সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টিমাঝে বহুকাল করিয়াছি বাস
সঙ্গীহীন রাত্রি দিন; তাই মাের অপরূপ বেশ,
আচার নূতনতর; তাই মাের চক্ষে স্বপ্নাবেশ,
বক্ষে জ্বলে ক্ষুধানল!—যে দিন জগতে চলে আসি,
কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি।

বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে
দীর্ঘ দিন দীর্ঘ রাত্রি চলে গেনু একান্ত সুদূরে
ছাড়ায়ে সংসারসীমা।—সে বাঁশিতে শিখেছি যে সুর
তাহারি উল্লাসে যদি গীতশূন্য অবসাদপুর
ধ্বনিয়া তুলিতে পারি, মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সঙ্গীতে
কর্মহীন জীবনের একপ্রান্ত পারি তরঙ্গিতে
শুধু মুহূর্তের তরে, দুঃখ যদি পায় তার ভাষা,
সুপ্তি হ’তে জেগে ওঠে অন্তরের গভীর পিপাসা
স্বর্গের অমৃত লাগি,—তবে ধন্য হবে মাের গান,
শত শত অসন্তোষ মহাগীতে লভিবে নির্বাণ।

কি গাহিবে, কি শুনাবে?—বল, মিথ্যা আপনার সুখ,
মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ
বৃহৎ জগত হতে, সে কখনাে শেখেনি বাঁচিতে।
মহা বিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।
মৃত্যুরে করি না শঙ্কা! দুর্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি-তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে,—জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি! কে সে? জানি না কে! চিনি নাই তারে-
শুধু এইটুকু জানি—তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হ’তে যুগান্তর পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তর-প্রদীপখানি! শুধু জানি—যে শুনেছে কানে
তাহার আহ্বানগীত—ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে
সঙ্কট-আবর্তমাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন,
নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি; মৃত্যুর গর্জন
শুনেছে সে সঙ্গীতের মত! দহিয়াছে অগ্নি তারে,
বিদ্ধ করিয়াছে শূল, ছিন্ন তারে করেছে কুঠারে,
সর্বব প্রিয়বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন
চিরজন্ম তারি লাগি’ জ্বেলেছে সে হােম-হুতাশন;—
হৃৎপিণ্ড করিয়া ছিন্ন রক্তপদ্ম-অর্য-উপহারে
ভক্তিভরে জন্মশােধ শেষ পূজা পূজিয়াছে তারে
মরণে কৃতার্থ করি প্রাণ। শুনিয়াছি, তারি লাগি
রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কন্থা, বিষয়ে বিরাগী
পথের ভিক্ষুক। মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে
সংসারের ক্ষুদ্র উৎপীড়ন, বিধিয়াছে পদতলে
প্রত্যহের কুশাঙ্কুর, করিয়াছে তারে অবিশ্বাস
মূঢ় বিজ্ঞজনে, প্রিয়জন করিয়াছে পরিহাস
অতিপরিচিত অবজ্ঞায়, গেছে সে করিয়া ক্ষমা
নীরবে করুণনেত্রে—অন্তরে বহিয়া নিরুপমা
সৌন্দর্য্যপ্রতিমা। তারি পদে, মানী সঁপিয়াছে মান,
ধনী সঁপিয়াছে ধন, বীর সঁপিয়াছে আত্মপ্রাণ,

তাহারি উদ্দেশে কবি বিরচিয়া লক্ষ লক্ষ গান
ছড়াইছে দেশে দেশে।—শুধু জানি তাহারি মহান্
গম্ভীর মঙ্গলধ্বনি শুনা যায় সমুদ্রে সমীরে,
তাহারি অঞ্চলপ্রান্ত লুটাইছে নীলাম্বর ঘিরে,
তারি বিশ্ববিজয়িনী পরিপূর্ণ। প্রেমমূর্তিখানি
বিকাশে পরমক্ষণে প্রিয়জনমুখে! শুধু জানি
সে বিশ্বপ্রিয়ার প্রেমে ক্ষুদ্রতারে দিয়া বলিদান
বর্জিতে হইবে দূরে জীবনের সর্ব অসম্মান,
সম্মুখে দাঁড়াতে হবে উন্নতমস্তক উচ্চে তুলি
যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি
আঁকে নাই কলঙ্ক-তিলক। তাহারে অন্তরে রাখি’
জীবনকণ্টকপথে যেতে হবে নীরবে একাকী,
সুখে দুঃখে ধৈর্য্য ধরি, বিরলে মুছিয়া অশ্রু-আঁখি,
প্রতিদিবসের কর্মে প্রতিদিন নিরলস থাকি
সুখী করি সর্বজনে। তার পরে দীর্ঘ পথশেষে
জীবযাত্রাঅবসানে ক্লান্তপদে রক্তসিক্ত বেশে
উত্তরিব একদিন শ্রান্তিহরা শান্তির উদ্দেশে
দুঃখহীন নিকেতনে। প্রসন্নবদনে মন্দ হেসে
পরাবে মহিমালক্ষী ভক্তকণ্ঠে বরমাল্যখানি,
করপদ্মপরশনে শান্ত হবে সব দুঃখ গ্লানি
সর্ব অমঙ্গল। লুটাইয়া রক্তিম চরণতলে
ধৌত করি দিব পদ অজিন্মের রুদ্ধ অশ্রুজলে।

সুচিরসঞ্চিত আশা সমুখে করিয়া উদঘাটন
জীবনের অক্ষমতা কাঁদিয়া করিব নিবেদন,
মাগিব অনন্তক্ষমা। হয় ত ঘুচিবে দুঃখনিশা,
তৃপ্ত হবে এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেমতৃষা।

২৩শে ফাল্গুন, ১৩০০।