কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/দুই বিঘা জমি

উইকিসংকলন থেকে

দুই বিঘা জমি

শুধু বিঘে দুই ছিল মাের ভুঁই, আর সব গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।”
কহিলাম আমি “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই;
চেয়ে দেখ মাের আছে বড়-জোর মরিবার মত ঠাঁই।”
শুনি’ রাজা কহে “বাপু, জানত হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা,—
ওটা দিতে হবে।”—কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, “করুন্ রক্ষে গরীবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সােনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে, এমনি লক্ষীছাড়া?”
আঁখি করি’ লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, “আচ্ছা সে দেখা যাবে।”

পরে মাস দেড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে—
করিল ডিক্রি, সকলি বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি।
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম মােরে ভগবান রাখিবে না মােহগর্ত্তে,
তাই লিখি’ দিল বিশ্ব-নিখিল দু-বিঘার পরিবর্ত্তে।

সন্ন্যাসিবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য,
কত হেরিলাম মনােহর ধাম, কত মনােরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি,
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারিনে সেই বিঘা দুই জমি।
হাটে মাঠে বাটে এই মত কাটে বছর পনেরাে ষোলাে,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হােলাে।

নমােনমাে নমঃ, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগন-ললাট চুমে তব পদ-ধূলি,
ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছােট ছােট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ;
স্তব্ধ অতল দীঘি-কালােজল, নিশীথ-শীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল ল’য়ে যায় ঘরে,
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে’।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজ গ্রামে।
কুমােরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথ-তলা করি’ বামে
রাখি’ হাটখােলা, নন্দীর গােলা, মন্দির করি’ পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।

ধিক্ ধিক্ ওরে, শতধিক্ তােরে, নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার, এই কি জননী তুমি?

সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্র-মাতা,
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাকপাতা।
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাস-বেশ
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ।
আমি তাের লাগি’ ফিরেছি বিবাগী গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি’ ওরে রাক্ষসী হাসিয়া কাটাস দিন?
ধনীর আদরে গরব না ধরে, এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনােখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনাে চিহ্ন।
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি;
যত হাস আজ, যত কর সাজ, ছিলে দেবী হলে দাসী।

বিদীর্ণ হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারিদিকে চেয়ে দেখি;
প্রাচীরের কাছে এখনাে যে আছে, সেই আম গাছ এ কি?
বসি’ তা’র তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম,
অতি ভােরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি’ আম কুড়াবার ধূম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন,—
ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন?
সহসা বাতাস ফেলি’ গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে;
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।

ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা!
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকামু মাথা।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হ’তে এল মালী।
ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, “আমিত নীরবে দিয়েছি আমার সব,
দুটি ফল তা’র করি অধিকার, এত তারি কলরব!”
চিনিল না মােরে নিয়ে গেল ধরে’ কাধে তুলি’ লাঠিগাছ,
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ সাথে ধরিতেছিলেন মাছ।
শুনি’ বিবরণ ক্রোধে তিনি কন্ “মারিয়া করিব খুন।”
বাবু যত বলে, পারিষদদলে বলে তা’র শতগুণ।
আমি কহিলাম, “শুধু দুটি আম ভীখ মাগি মহাশয়।”
বাবু কহে হেসে “বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।”
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মাের ঘটে,
তুমি, মহারাজ, সাধু হ’লে আজ, আমি আজ চোর বটে!

৩১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩০২