কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/পূর্ণিমা

উইকিসংকলন থেকে

পূর্ণিমা

পড়িতেছিলাম গ্রন্থ বসিয়া একেলা,
সঙ্গীহীন প্রবাসের শূন্য সন্ধ্যাবেলা
করিবারে পরিপূর্ণ। পণ্ডিতের লেখা
সমালােচনার তত্ত্ব; পড়ে হয় শেখা
সৌন্দর্য্য কাহারে বলে—আছে কি কি বীজ
কবিত্ব-কলায়;—শেলি, গেটে, কোলরীজ
কার কোন্ শ্রেণী। পড়ি’ পড়ি’ বহুক্ষণ
তাপিয়া উঠিল শির, শ্রান্ত হ’ল মন,
মনে হ’ল সব মিথ্যা, কবিত্ব কল্পনা
সৌন্দর্য্য সুরুচি রস সকলি জল্পনা
লিপি-বণিকের;—অন্ধ গ্রন্থকীটগণ
বহু বর্ষ ধরি’ শুধু করিছে রচন
শব্দমরীচিকা-জাল, আকাশের পরে
অকর্ম্ম আলস্যাবেশে দুলিবার তরে
দীর্ঘ রাত্রি দিন।
অবশেষে শ্রান্তি মানি’,
তন্দ্রাতুর চোখে, বন্ধ করি’ গ্রন্থখানি

ঘড়িতে দেখিনু চাহি দ্বিপ্রহর রাতি;
চমকি’ আসন ছাড়ি’ নিবাইনু বাতি।
যেমনি নিবিল আলো, উচ্ছ্বসিত স্রোতে
মুক্ত দ্বারে, বাতায়নে, চতুর্দিক হতে
চকিতে পড়িল কক্ষে বক্ষে চক্ষে আসি’
ত্রিভুবনবিপ্লাবিনী মৌন সুধাহাসি।
হে সুন্দরী, হে প্রেয়সী, হে পূর্ণ পূর্ণিমা,
অনন্তের অন্তরশায়িনী। নাহি সীমা
তব রহস্যের। এ কি মিষ্ট পরিহাসে
সংশয়ীর শুক চিত্ত সৌন্দর্য-উচ্ছাসে
মুহূর্তে ডুবালে? কখন্ দুয়ারে এসে
মুখানি বাড়ায়ে, অভিসারিকার বেশে
আছিলে দাঁড়ায়ে, এক প্রান্তে, সুররাণী,
সুদূর নক্ষত্র হ’তে সাথে করে আনি’
বিশ্বভরা নীরবতা। আমি গৃহকোণে
তর্কজালবিজড়িত ঘন বাক্যবনে
শুষ্কপত্রপরিকীর্ণ অক্ষরের পথে
একাকী ভ্রমিতেছিনু শূন্য মনােরথে,
তােমারি সন্ধানে। উদ্ভান্ত এ ভকতেরে
এতক্ষণ ঘুরাইলে ছলনার ফেরে।
কি জানি কেমন করে’ লুকায়ে দাঁড়ালে
একটি ক্ষণিক ক্ষুদ্র দীপের আড়ালে

হে বিশ্বব্যাপিনী লক্ষ্মী। মুগ্ধ কর্ণপুটে
গ্রন্থ হ’তে গুটিকত বৃথা বাক্য উঠে’
আচ্ছন্ন করিয়াছিল কেমনে না জানি
লােকলােকান্তরপূর্ণ তব মৌন বাণী।

১৬ই অগ্রহায়ণ, পূর্ণিমা ১৩০২