কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/মৃত্যুর পরে

উইকিসংকলন থেকে

মৃত্যুর পরে

আজিকে হয়েছে শান্তি,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে।
রাত্রিদিন ধুকধুক
তরঙ্গিত দুঃখ সুখ
থামিয়াছে বুকে।
যত কিছু ভালােমন্দ,
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই।
বল শান্তি, বল শান্তি,
দেহসাথে সব ক্লান্তি
হ’য়ে যাক্ ছাই।

গুঞ্জরি’ করুণ তান
ধীরে ধীরে কর গান
বসিয়া শিয়রে।

যদি কোথা থাকে লেশ
জীবন-স্বপ্নের শেষ
তাও যাক্ মরে।
তুলিয়া অঞ্চলখানি
মুখ পরে দাও টানি’,
ঢেকে দাও দেহ।
করুণ মরণ যথা,
ঢাকিয়াছে সব ব্যথা,
সকল সন্দেহ।

বিশ্বের আলোেক যত
দিগ্বিদিকে অবিরত
যাইতেছে ব’য়ে,
শুধু ওই আঁখিপরে
নামে তাহা স্নেহভরে
অন্ধকার হ’য়ে।
জগতের তন্ত্রীরাজি
দিনে উচ্চে উঠে বাজি
রাত্রে চুপে চুপে,
সে শব্দ তাহার পরে
চুম্বনের মত পড়ে
নীরবতারূপে।

মিছে আনিয়াছ আজি
বসন্ত কুসুমরাজি
দিতে উপহার;
নীরবে আকুল চোখে
ফেলিতেছে বৃথা শােকে
নয়নাশ্রুধার;
ছিলে যারা রােষভরে
বৃথা এত দিন পরে
করিছ মার্জনা।
অসীম নিস্তব্ধ দেশে
চিররাত্রি পেয়েছে সে
অনন্ত সান্ত্বনা।

গিয়েছে কি আছে বসে,
জাগিল কি ঘুমাল সে
কে দিবে উত্তর?
পৃথিবীর শ্রান্তি তারে
ত্যজিল কি একেবারে,
জীবনের জ্বর?
এখনি কি দুঃখ সুখে
কর্ম্মপথ অভিমুখে
চলেছে আবার?

অস্তিত্বের চক্রতলে
একবার বাঁধা পলে
পায় কি নিস্তার?

বসিয়া আপন দ্বারে
ভালাে মন্দ বল তারে
যাহা ইচ্ছা তাই।
অনন্ত জনম মাঝে
গেছে সে অনন্ত কাজে,
সে আর সে নাই।
আর পরিচিত মুখে
তােমাদের দুঃখে সুখে।
আসিবে না ফিরে,
তবে তার কথা থাক্‌
যে গেছে সে চলে যাক
বিস্মৃতির তীরে।
জানি না কিসের তরে
যে যাহার কাজ করে
সংসারে আসিয়া,
ভালাে মন্দ শেষ করি
যায় জীর্ণ জন্মতরী
কোথায় ভাসিয়া।

দিয়ে যায় যত যাহা
রাখ তাহা ফেল তাহা
যা ইচ্ছা তােমার।
সে ত নহে বেচাকেনা
ফিরিবে না ফেরাবে না
জন্ম-উপহার।

কেন এই আনাগােনা,
কেন মিছে দেখাশােনা
দুদিনের তরে;
কেন বুকভরা আশা,
কেন এত ভালবাসা
অন্তরে অন্তরে;
আয়ু যার এতটুক,
এত দুঃখ এত সুখ
কেন তা’র মাঝে;
অকস্মাৎ এ সংসারে
কে বাঁধিয়া দিল তারে
শত লক্ষ কাজে?

হেথায় সে অসম্পূর্ণ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত,

কোথাও কি একবার
সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত;
জীবনে যা প্রতিদিন
ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি
তা’রে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থপূর্ণ করি;

হেথা যারে মনে হয়
শুধু বিফলতাময়
অনিত্য চঞ্চল
সেথায় কি চুপে চুপে
অপূর্ব নূতনরূপে
হয় সে সফল;
চিরকাল এই সব
রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর,
জন্মান্তের নব প্রাতে
সে হয় ত আপনাতে
পেয়েছে উত্তর।

সে হয় ত দেখিয়াছে
পড়ে’ যাহা ছিল পাছে
আজি তাহা আগে;
ছােট যাহা চিরদিন
ছিল অন্ধকারে লীন,
বড় হ’য়ে জাগে;
যেথায় ঘৃণার সাথে
মানুষ আপন হাতে
লেপিয়াছে কালী
নূতন নিয়মে সেথা
জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা
কে দিয়াছে জ্বালি’।

কত শিক্ষা পৃথিবীর
খসে’ পড়ে জীর্ণচীর,
জীবনের সনে,
সংসারের লজ্জাভয়
নিমেষেতে দগ্ধ হয়
চিতা-হুতাশনে;
সকল অভ্যাস-ছাড়া
সর্ব্ব আবরণহারা
সদ্য শিশুসম

নগ্নমুর্ত্তি মরণের
নিষ্কলঙ্ক চরণের
সম্মুখে প্রণম’!

আপন মনের মত
সঙ্কীর্ণ বিচার যত
রেখে দাও আজ।
ভুলে যাও কিছুক্ষণ
প্রত্যহের আয়ােজন,
সংসারের কাজ।
আজি ক্ষণেকের তরে
বসি’ বাতায়নপরে
বাহিরেতে চাহ।
অসীম আকাশ হতে
বহিয়া আসুক্ স্রোতে
বৃহৎ প্রবাহ।

উঠিছে ঝিল্লির গান,
তরুর মর্ম্মর তান,
নদীকলস্বর,
প্রহরের আনাগােনা
যেন রাত্রে যায় শােনা
আকাশের পর।

উঠিতেছে চরাচরে
অনাদি অনন্তস্বরে
সঙ্গীত-উদার
সে নিত্য-গানের সনে
মিশাইয়া লহ মনে
জীবন তাহার।

ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে
দেখ তা’রে সর্বদৃশ্যে
বৃহৎ করিয়া
জীবনের ধূলি ধুয়ে’
দেখ তা’রে দূরে থুয়ে
সম্মুখে ধরিয়া।
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে
ভাগ করি’ খণ্ডে খণ্ডে
মাপিয়াে না তারে,
থাক তব ক্ষুদ্র মাপ
ক্ষুদ্র পুণ্য, ক্ষুদ্র পাপ
সংসারের পারে।

আজ বাদে কাল যারে
ভুলে যাবে একেবারে
পরের মতন

তা’রে ল’য়ে আজি কেন
বিচার বিরােধ হেন,
এত আলাপন?
যে বিশ্ব কোলের পরে
চির দিবসের তরে
তুলে নিল তা’রে
তা’র মুখে শব্দ নাহি,
প্রশান্ত সে আছে চাহি
ঢাকি’ আপনারে।

বৃথা তা’রে প্রশ্ন করি,
বৃথা তা’র পায়ে ধরি,
বৃথা মরি কেঁদে;—
খুঁজে ফিরি’ অশ্রুজলে—
কোন্ অঞ্চলের তলে
নিয়েছে সে বেঁধে;
ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে
ফিরে নিতে চাহি মিছে;—
সে কি আমাদের?
পলেক বিচ্ছেদে হায়
তখনি ত বুঝা যায়
সে যে অনন্তের।

চক্ষের আড়ালে তাই
কত ভয় সংখ্যা নাই;
সহস্র ভাবনা।
মূহূর্ত্ত মিলন হ’লে
টেনে নিই বুকে কোলে,
অতৃপ্ত কামনা।
পার্শ্বে বসে’ ধরি মুঠি,
শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি,
চাহি চারিভিতে,
অনন্তের ধনটিরে
আপনার বুক চিরে
চাহি লুকাইতে।

হায়রে নির্ব্বোধ নর,
কোথা তোর আছে ঘর,
কোথা তাের স্থান।
শুধু তাের ওইটুক
অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
ভয়ে কম্পমান।
উর্দ্ধে ওই দেখ চেয়ে
সমস্ত আকাশ ছেয়ে
অনন্তের দেশ,

সে যখন একধারে
লুকায়ে রাখিবে তা’রে
পাবি কি উদ্দেশ?

ওই হের সীমাহারা
গগনেতে গ্রহতারা
অসংখ্য জগৎ,
ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত
হয় ত সে একা পান্থ।
খুঁজিতেছে পথ।
ওই দূর দূরান্তরে
অজ্ঞাত ভুবন পরে
কভু কোনাে খানে
আর কি গাে দেখা হবে,
আর কি সে কথা কবে,
কেহ নাহি জানে।

যা হবার তাই হােক,
ঘুচে যাক্ সর্ব্বশােক,
সর্ব্ব মরীচিকা!
নিবে যাক চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
মর্ত্ত্য জন্মশিখা।

সব তর্ক হােক শেষ
সব রাগ সব দ্বেষ,
সকল বালাই।
বল শান্তি বল শান্তি
দেহ সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হােক ছাই।