কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/দেবতার গ্রাস

উইকিসংকলন থেকে

দেবতার গ্রাস

গ্রামে গ্রামে সেই বার্ত্তা রটি গেল ক্রমে
মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি
কত বালবৃদ্ধ নরনারী; নৌকা দুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে।

    পুণ্যলােভাতুর
মােক্ষদা কহিল আসি “হে দাদাঠাকুর,
আমি তব হব সাথী!”-বিধবা যুবতী,
দু’খানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
কেবল মিনতি করে,—অনুরােধ তা'র
এড়ানাে কঠিন বড়!—“স্থান কোথা আর”
মৈত্র কহিলেন তা’রে। “পায়ে ধরি তব”
বিধবা কহিল কাঁদি “স্থান করি লব
কোনােমতে এক ধারে।” ভিজে গেল মন
তবু দ্বিধাভরে তা'রে শুধাল ব্রাহ্মণ
“নাবালক ছেলেটির কি করিবে তবে?”
উত্তর করিলা নারী-“রাখাল? সে র'বে
আপন মাসীর কাছে। তা'র জন্মপরে

বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে
বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন
আপন শিশুর সাথে দিয়ে তা'রে স্তন
মানুষ করেছে যত্নে,—সেই হ’তে ছেলে
মাসীর আদরে আছে মা'র কোল ফেলে।
দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
মাসী আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন
কোলে তা’রে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
মা’র চেয়ে আপনার মাসীমার বুকে।

সম্মত হইল বিপ্র। মােক্ষদা সত্বর
প্রস্তুত হইল-বাঁধি জিনিষপত্তর,
প্রণমিয়া গুরুজনে,—সখীদলবলে
ভাসাইয়া বিদায়ের শােকঅশ্রুজলে।
ঘাটে আসি দেখে, সেথা আগেভাগে ছুটি
রাখাল বসিয়া আছে তরী পরে উঠি'
নিশ্চিন্ত নীরবে। “তুই হেথা কেন ওরে?”
মা শুধাল,—সে কহিল, “যাইব সাগরে।”
“যাইবি সাগরে, আরে, ওরে দস্যু ছেলে,
নেমে আয়!”—পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে'
সে কহিল দুটি কথা—“যাইব সাগরে।”
যত তা’র বাহু ধরি টানাটানি করে

রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে
ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে
“থাক্ থাক্‌ সঙ্গে যা।” মা রাগিয়া বলে
“চল্ তােরে দিয়ে আসি সাগরের জলে।”
যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে
অমনি মায়ের বক্ষে অনুতাপবাণে
বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
“নারায়ণ নারায়ণ” করিল স্মরণ।
পুত্রে নিল কোলে তুলি,—তা’র সর্ব্বদেহে
করুণ কল্যাণ হস্ত বুলাইল স্নেহে।
মৈত্র তা'রে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়
“ছি ছি ছি, এমন কথা বলিবার নয়।”


রাখাল যাইবে সাথে স্থির হ’ল কথা,—
অন্নদা লােকের মুখে শুনি সে বারতা,
ছুটে আসি বলে “বাছা, কোথা যাবি ওরে?”
রাখাল কহিল হাসি “চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসী।” পাগলের প্রায়
অনুদা কহিল ডাকি “ঠাকুর মশায়,
বড় যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,—

কে তাহারে সামালিবে? জন্ম হ'তে তা'র
মাসী ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকেনি কোথাও,
কোথা এরে নিয়ে যাবে? ফিরে দিয়ে যাও।'
রাখাল কহিল-“মাসী যাইব সাগরে
আবার ফিরিব আমি।” বিপ্র স্নেহস্বরে
কহিলেন—“যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
তােমার রাখাল লাগি কোনাে ভয় নাই।
এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ,
অনেক যাত্রীর মেলা,—পথের বিপদ
কিছু নাই,—যাতায়াতে মাস দুই কাল,—
তােমারে ফিয়ায়ে দিব তােমার রাখাল।”

শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি’ নৌকা দিল ছাড়ি।
দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাত-শিশিরে
ছল ছল করে গ্রাম চূর্ণী নদীতীরে।

যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হ’ল মেলা।
তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্ণ বেলা
জোয়ারের আশে। কৌতূহল অবসান,
কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ

মাসীর কোলের লাগি।—জল শুধু জল
দেখে দেখে চিত্ত তা'র হয়েছে বিকল।
মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
লােলুপ লেলিহজিহব সর্পসম ক্রূর
খল জল ছলভরা, তুলি লক্ষ ফণা
ফুঁসিছে গর্জ্জিছে, নিত্য করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমুক,
অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন,
সর্ব্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন
শ্যামল কোমলা, যেথা যে কেহই থাকে
অদৃশ্য দুবাহু মেলি টানিছ তাহাকে
অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কি বিপুল টানে
দিগন্ত বিস্তৃত তব শান্ত বক্ষপানে।
চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
অধীর উৎসুককণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে
“ঠাকুর, কখন্ আজি আসিবে জোয়ার?”
সহসা স্তিমিত জলে আবেগ সঞ্চার
দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
ফিরিল তরীর মুখ; মৃদু আর্ত্তনাদে
কাছিতে পড়িল টান,—কলশব্দগীতে
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে,—

আসিল জোয়ার।—মাঝি দেবতারে স্মরি
ত্বরিত উত্তরমুখে খুলে দিল তরী।
রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে
“দেশে পঁহুছিতে আর কতদিন আছে?”


সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
উত্তর বায়ুর বেগ ক্রমে উঠে বেড়ে।
রূপনারাণের মুখে পড়ি বালুচর
সঙ্কীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর
জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরসমীরে
উত্তাল উদ্দাম। তরণী ভিড়াও তীরে
উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল।
কোথা তীর? চারিদিকে ক্ষিপ্তোন্মত্তজল
আপনার রুদ্রনৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে। দিগন্তরে যায় দেখা
অতি দূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা;—
অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি
প্রশান্ত সূর্যাস্ত পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
উদ্ধত বিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল

মূঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে
মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক,
কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ি ঊর্দ্ধডাক,
ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
চক্ষু মুদি’ করে জপ। জননীর বুকে
রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে।
তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে-
“বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তােমাদের কেউ,
যা মেনেছে দেয় নাই তাই এত ঢেউ,
অসময়ে এ তুফান। শুন এই বেলা,
করহ মান রক্ষা -করিয়াে না খেলা,
ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।”—যার যত ছিল
অর্থ বস্ত্র যাহা কিছু জলে ফেলি দিল
না করি বিচার। তবু তখনি পলকে
তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে।
মাঝি কহে পুনর্ব্বার—“দেবতার ধন
কে যায় ফিরায়ে ল’য়ে এই বেলা শোন্।”
ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি
মােক্ষদারে লক্ষ্য করি—“এই সে রমণী
দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে
চুরি করে' নিয়ে যায়।”-“দাও তা’রে ফেলে”

একবাক্যে গর্জ্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর
যাত্রী সবে। কহে নারী “হে দাদাঠাকুর
রক্ষা কর, রক্ষা কর।” দুই দৃঢ় করে
রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।

ভৎসিয়া গর্জ্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ
“আমি তাের রক্ষাকর্ত্তা? রোষে নিশ্চেতন
মা হ'য়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে,
শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে?
শােধ দেবতার ঋণ। সত্য ভঙ্গ করে’
এতগুলি প্রাণী তুই ভুবাবি সাগরে?”

মােক্ষদা কহিল “অতি মূর্খ নারী আমি,
কি বলেছি রােষবশে,—ওগাে অন্তর্যামী
সেই সত্য হ’ল? সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বােঝনি ঠাকুর?
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা?
শােননি কি জননীর অন্তরের কথা?”
বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি দাঁড়ি
বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি
মা’র বক্ষ হ'তে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি,
দন্তে দন্ত চাপি বলে। কে তাঁরে সহসা

মর্ম্মে মর্ম্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা,
দংশিল বৃশ্চিকদংশ।–“মাসী, মাসী, মাসী”
বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
চীৎকারি উঠিল বিপ্র—“রাখ, রাখ, রাখ!”
চকিতে হেরিলা চাহি মূর্চ্ছি আছে পড়ে’
মােক্ষদা চরণে তাঁর।—মুহূর্ত্তের তরে
ফুটন্ত তরঙ্গ মাঝে মেলি আর্ত্ত চোখ
মাসী বলি ফুকারিয়া মিলাল বালক
অনন্ত তিমির-তলে;—শুধু ক্ষীণ মুঠি
বারেক ব্যাকুলবলে উৰ্দ্ধপানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
“ফিরায়ে আনিব তােরে” কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাহ্মণ মুহূর্ত্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে।
আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।—

১৩ই কার্তিক, ১৩৪।