কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/নাট্য কবিতা/কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ

উইকিসংকলন থেকে

কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ

কর্ণ


পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যা-সবিতার
বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার,
অধিরথসূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত
সেই আমি,—কহ মােরে তুমি কে গাে মাতঃ!

কুন্তী


বৎস, তাের জীবনের প্রথম প্রভাতে
পরিচয় করায়েছি তােরে বিশ্ব সাথে,
সেই আমি, আসিয়াছি ছাড়ি সর্ব্ব লাজ
তােরে দিতে আপনার পরিচয় আজ।

কর্ণ


দেবী তব নত-নেত্র-কিরণ-সম্পাতে
চিত্ত বিগলিত মাের, সূর্যকরঘাতে
শৈল তুষারের মত। তব কণ্ঠস্বর
যেন পূর্ব্বজন্ম হ'তে পশি কর্ণপর
জাগাইছে অপূর্ব্ব বেদনা। কহ মােরে
জন্ম মাের বাঁধা আছে কি রহস্য-ডােরে
তােমা সাথে হে অপরিচিতা!

কুন্তী


    ধৈর্য্য ধর
ওরে বৎস, ক্ষণকাল। দেব দিবাকর
আগে যাক অস্তাচলে। সন্ধ্যার তিমির
আসুক নিবিড় হ'য়ে।—কহি তােরে বীর
কুন্তী আমি।

কর্ণ


  তুমি কুন্তী! অৰ্জ্জুন-জননী!

কুন্তী


অৰ্জ্জুন-জননী বটে! তাই মনে গণি’
দ্বেষ করিয়াে না বৎস! আজো মনে পড়ে
অস্ত্র-পরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে।
তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণকুমার
রঙ্গস্থলে, নক্ষত্রখচিত পূর্ব্বাশার
প্রান্তদেশে নবােদিত অরুণের মত।
যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত
তা'র মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী
অতৃপ্ত স্নেহ-ক্ষুধার সহস্র নাগিনী
জাগায়ে জর্জ্জর বক্ষে; কাহার নয়ন
তােমার সর্ব্বাঙ্গে দিল আশিষ-চুম্বন?

অৰ্জ্জুন-জননী সে যে! যবে কৃপ আসি
তােমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি,
কহিলেন, “রাজকুলে জন্ম নহে যার
অর্জ্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার”,—
আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী,
দাঁড়ায়ে রহিলে,—সেই লজ্জা-আভাখানি
দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে,
কে সে অভাগিনী? অৰ্জ্জুন-জননী সে যে!
পুত্র দুর্য্যোধন ধন্য, তখনি তােমারে
অঙ্গরাজ্যে কৈল অভিষেক। ধন্য তা'রে!
মাের দুই নেত্র হ’তে অশ্রুবারিরাশি
উদ্দেশে তােমারি শিরে উচ্ছ্বসিল আসি’
অভিষেক সাথে। হেন কালে করি পথ
রঙ্গমঝে পশিলেন সূত অধিরথ
আনন্দ-বিহ্বল। তখনি সে রাজসাজে
চারিদিকে কুতূহলী জনতার মাঝে
অভিষেকসিক্ত শির লুটায়ে চরণে
সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে পিতৃ-সম্ভাষণে!
ক্রুর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে
ধিক্কারিল; সেইক্ষণে পরম গরবে
বীর বলি’ যে তােমারে ওগাে বীরমণি
আশীষিল, আমি সেই অৰ্জ্জুন-জননী।

কর্ণ


প্রণমি তােমারে আর্য্যে! রাজমাতা তুমি,
কেন হেথা একাকিনী? এ যে রণভূমি,
আমি কুরুসেনাপতি।

কুন্তী


    পুত্র, ভিক্ষা আছে,—
বিফল না ফিরি যেন।

কর্ণ


   ভিক্ষা, মাের কাছে?
আপন পৌরুষ ছাড়া, ধর্ম্ম ছাড়া আর
যাহা আজ্ঞা কর, দিব চরণে তােমার।

কুন্তী


এসেছি তােমারে নিতে।

কর্ণ


    কোথা ল’বে মােরে?

তৃষিত বক্ষের মাঝে—লব মাতৃক্রোড়ে

কর্ণ


পঞ্চপুত্রে ধন্য তুমি, তুমি ভাগ্যবতী,
আমি কুলশীলহীন, ক্ষুদ্র নরপতি,
মােরে কোথা দিবে স্থান?

কুন্তী


    সর্ব্ব উচ্চভাগে,
তােমারে বসাব মাের সর্ব্বপুত্র আগে
জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি।

কর্ণ


    কোন্ অধিকার-মদে
প্রবেশ করিব সেথা? সাম্রাজ্য-সম্পদে
বঞ্চিত হয়েছে যারা, মাতৃস্নেহধনে
তাহাদের পূর্ণ অংশ খণ্ডিব কেমনে
কহ মােরে? দ্যূতপণে না হয় বিক্রয়,
বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয়-
সে যে বিধাতার দান!

কুন্তী


    পুত্র মাের, ওরে,
বিধাতার অধিকার ল’য়ে এই ক্রোড়ে

এসেছিলি একদিন—সেই অধিকারে
আয় ফিরে সগৌরবে, আয় নির্ব্বিচারে,
সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃঅঙ্কে মম
লহ আপনার স্থান।

কর্ণ


    শুনি স্বপ্নসম
হে দেবি তােমার বাণী! হের অন্ধকার
ব্যাপিয়াছে দিগ্বিদিকে, লুপ্ত চারিধার—
শব্দহীনা ভাগীরথী। গেছ মােরে ল'য়ে
কোন্ মায়াচ্ছন্ন লােকে, বিস্মৃত আলয়ে,
চেতনা-প্রত্যুষে। পুরাতন সত্যসম
তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম।
অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার,
যেন মাের জননীর গর্ভের আঁধার
আমারে ঘেরিছে আজি। রাজমাতঃ অয়ি
সত্য হােক স্বপ্ন হোক, এস স্নেহময়ী
তােমার দক্ষিণহস্ত ললাটে চিবুকে
রাখ ক্ষণকাল। শুনিয়াছি লােকমুখে
জননীর পরিত্যক্ত আমি! কতবার
হেরেছি নিশীথস্বপ্নে, জননী আমার

২২৫
5-15

এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায়,
কাঁদিয়া কহেছি তাঁরে কাতর ব্যথায়
জননী গুণ্ঠন খোল দেখি তব মুখ-
অমনি মিলায় মূর্ত্তি তৃষার্ত্ত উৎসুক
স্বপনেরে ছিন্ন করি। সেই স্বপ্ন আজি
এসেছে কি পাণ্ডব-জননী-রূপে সাজি
সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্রে, ভাগীরথীতীরে?
হের দেবী পরপারে পাণ্ডব-শিবিরে
জ্বলিয়াছে দীপালােক,—এপারে অদূরে
কৌরবের মন্দুরায় লক্ষ অশ্বখুরে
খর শব্দ উঠিছে বাজিয়া। কালি প্রাতে
আরম্ভ হইবে মহারণ। আজ রাতে
অৰ্জ্জুন-জননী-কণ্ঠে কেন শুনিলাম
আমার মাতার স্নেহস্বর? মাের নাম
তাঁর মুখে কেন হেন মধুর সঙ্গীতে
উঠিল বাজিয়া—চিত্ত মাের আচম্বিতে
পঞ্চপাণ্ডবের পানে ভাই বলে’ ধায়।

কুন্তী


তবে চলে' আয় বৎস, তবে চলে' আয়।

কর্ণ


যাব মাতঃ চলে' যাব, কিছু শুধাব না-
করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা!-

দেবি, তুমি মাের মাতা! তােমার আহ্বানে
অন্তরাত্মা জাগিয়াছে-নাহি বাজে কানে
যুদ্ধভেরী জয়শঙ্খ -মিথ্যা মনে হয়
রণহিংসা, বীরখ্যাতি জয়পরাজয়।
কোথা যাব, ল’য়ে চল।

কুন্তী


     ওই পরপারে
যেথা জ্বলিতেছে দীপ স্তব্ধ চন্দ্রাবারে
পাণ্ডুর বালুকাতটে।

কর্ণ


    হােথা মাতৃহারা
মা পাইবে চিরদিন! হােথা ধ্রুবতারা
চিররাত্রি র’বে জাগি সুন্দর উদার
তােমার নয়নে! দেবি, কহ আরবার
আমি পুত্র তব!

কুন্তী


    পুত্র মাের!

কর্ণ


     কেন তবে
আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে

কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন
অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে? কেন চিরদিন
ভাসাইয়া দিলে মােরে অবজ্ঞার স্রোতে,
কেন দিলে নির্ব্বাসন ভ্রাতৃকুল হ’তে?
রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জ্জুনে আমারে?—
তাই শিশুকাল হ’তে টানিছে দোঁহারে
নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে
দুর্ণিবার আকর্ষণে। মাতঃ, নিরুত্তর?
লজ্জা তব, ভেদ করি অন্ধকার স্তর
পরশ করিছে মােরে সর্ব্বাঙ্গে নীরবে-
মুদিয়া দিতেছে চক্ষু।—থাক্ থাক্ তবে।
কহিয়াে না, কেন তুমি ত্যজিলে আমারে।
বিধির প্রথম দান এ বিশ্বসংসারে
মাতৃস্নেহ, কেন সেই দেবতার ধন
আপন সন্তান হ’তে করিলে হরণ
সে কথার দিয়ো না উত্তর। কহ মােরে,
আজি কেন ফিরাইতে আসিয়াছ ক্রোড়ে?

কুন্তী


হে বৎস, ভৎসনা তাের শত বজ্রসম
বিদীর্ণ করিয়া দিক্ এ হৃদয় মম
শত খণ্ড করি। ত্যাগ করেছিনু তােরে
সেই অভিশাপে, পঞ্চপুত্র বক্ষে করে’

তবু মাের চিত্ত পুত্রহীন,—তবু হায়
তাের লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মাের ধায়
খুঁজিয়া বেড়ায় তােরে। বঞ্চিত যে ছেলে
তারি তরে চিত্ত মাের দীপ্ত দীপ জ্বেলে
আপনারে দগ্ধ করি’ করিছে আরতি
বিশ্ব-দেবতার।—আমি আজি ভাগ্যবতী
পেয়েছি তােমার দেখা।—যবে মুখে তাের
একটি ফুটেনি বাণী, তখন কঠোর
অপরাধ করিয়াছি—বৎস, সেই মুখে
ক্ষমা কর কুমাতায়! সেই ক্ষমা, বুকে
ভৎসনার চেয়ে তেজে জ্বালুক অনল
পাপ দগ্ধ করে’ মােরে করুক্‌ নির্ম্মল।

কর্ণ


মাতঃ দেহ পদধূলি, দেহ পদধূলি,
লহ অশ্রু মাের।

কুন্তী


   তােরে ল’ব বক্ষে তুলি
সে সুখ-আশায় পুত্র আসি নাই দ্বারে।
ফিরাতে এসেছি তােরে নিজ অধিকারে।—

সূতপুত্র নহ তুমি, রাজার সন্তান,
দূর করি দিয়া বৎস সর্ব্ব অপমান
এস চলি যেথা আছে তব পঞ্চ ভ্রাতা।

কর্ণ


মাতঃ সূতপুত্র আমি, রাধা মাের মাতা,
তা'র চেয়ে নাহি মাের অধিক গৌরব।
পাণ্ডব পাণ্ডব থাক, কৌরব কৌরব-
ঈর্ষ্যা নাহি করি কারে।—

    রাজ্য আপনার
বাহুবলে করি লহ হে বৎস উদ্ধার।
দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির,
ভীম ধরিবেন ছত্র, ধনঞ্জয় বীর
সারথি হবেন রথে, ধৌম্য পুরােহিত
গাহিবেন বেদমন্ত্র—তুমি শত্রুজিৎ
অখণ্ড প্রতাপে র’বে বান্ধবের সনে
নিঃসপত্ন রাজ্যমাঝে রত্ন-সিংহাসনে।

কর্ণ


সিংহাসনে? যে ফিরাল মাতৃ-স্নেহ-পাশ-
তাহারে দিতেছ মাতঃ রাজ্যের আশ্বাস!

একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত
সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।—
মাতা মাের, ভ্রাতা মাের, মাের রাজকুল
এক মুহূর্ত্তেই মাতঃ করেছ নির্ম্মূল
মাের জন্মক্ষণে। সূত-জননীরে ছলি’
আজ যদি রাজ-জননীরে মাতা বলি,—
কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে
ছিন্ন করে’ ধাই যদি রাজসিংহাসনে
তবে ধিক মােরে!

কুন্তী


   বীর তুমি, পুত্র মাের,
ধন্য তুমি! হায় ধর্ম্ম, একি সুকঠোর
দণ্ড তব! সেইদিন কে জানিত হায়
ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়,
সে কখন বলবীর্য্য লভি কোথা হ'তে
ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে
আপনার জননীর কোলের সন্তানে
আপন নির্ম্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে।
একি অভিশাপ!

কর্ণ


  মাতঃ করিয়াে না ভয়।
কহিলাম, পাণ্ডবের হইবে বিজয়।

আজি এই রজনীর তিমির-ফলকে
প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলােকে
ঘাের যুদ্ধ-ফল। এই শান্ত স্তব্ধক্ষণে
অনন্ত আকাশ হ'তে পশিতেছে মনে
জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত,—আশাহীন
কর্ম্মের উদ্যম, হেরিতেছি শান্তিময়
শূন্য পরিণাম। যে পক্ষের পরাজয়
সে পক্ষ ত্যজিতে মােরে কোরাে না আহ্বান।
জয়ী হােক রাজা হােক্ পাণ্ডব-সন্তান-
আমি রব নিস্ফলের, হতাশের দলে।
জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মােরে ধরাতলে
নামহীন গৃহহীন—আজিও তেমনি
আমারে নির্ম্মম চিত্তে তেয়াগ’ জননী
দীপ্তিহীন কীর্ত্তিহীন পরাভব পরে।
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মােরে
জয়লােভে যশােলােভে রাজ্যলােভে, অয়ি,
বীরের সদগতি হ’তে ভ্রষ্ট নাহি হই।

১৫ই ফাল্গুন, ১৩০৬।