কুরু পাণ্ডব/৪
৪
একদা কৃষ্ণ শিল্পনিপুণ ময়দানবকে আদেশ করিলেন— হে শিল্পকর্ম্মবিশারদ! তুমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জন্য খাণ্ডবপ্রস্থে এমন এক সভা নির্ম্মাণ করিয়া দাও, যাহা কেহ পূর্ব্বেও দেখে নাই এবং বহু চেষ্টায়ও ভবিষ্যতে অনুকরণ করিতে সক্ষম হইবে না।
ময়দানব কৃষ্ণের এই অনুজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া সভা নির্ম্মাণের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইল।
ময়দানর পূর্ব্বোত্তর দিগ্বিভাগে প্রস্থান করিয়া কৈলাসের উত্তরাংশে মৈনাক-সন্নিধানে দানবরাজ্যান্তর্গত এক সুমহান্ পর্ব্বতে উপনীত হইল। অদূরস্থিত বিন্দুনামক সরোবরের নিকটে পূর্ব্বে দানবগণ এক মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, তদুপলক্ষে রচিত সভামণ্ডপের অত্যাশ্চর্য্য দ্রব্যসম্ভার তথায় রক্ষিত ছিল।
ইহা হইতে ইচ্ছানুরূপ দ্রব্যজাত আহরণপূর্ব্বক ময় খাণ্ডবপ্রস্থে উপস্থিত হইয়া যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করিল এবং তাঁহার দ্বারা যথেষ্ট সৎকৃত হইয়া পুণ্যদিবসে সভাভূমির পরিসর পঞ্চসহস্র হস্ত পরিমাপ করিয়া কৃষ্ণের অভিপ্রায় অনুসারে কতক দিব্য কতক মানুষ কতক আসুরচ্ছন্দে এক অলোকসামান্য সুবর্ণময় অত্যুন্নত বৃক্ষাকার-স্তম্ভরক্ষিত মণিখচিত সভামণ্ডপ-নির্ম্মাণ-কার্য্য আরম্ভ করিল।
ক্রমে মণ্ডপস্থ বিবিধ স্ফটিক মণিমাণিক্য অলঙ্কৃত কুট্টিম ও ভিত্তি অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিতে লাগিল। সভার মধ্যে স্ফটিকময়সোপান-বিশিষ্ট ও রত্নমণ্ডিত-পরিসর-বেদিকাশোভিত এক স্বচ্ছ-জল কৃত্রিম সরোবর সন্নিবেশিত হইল। মণ্ডপের চতুর্দ্দিকস্থিত ভূমি পদ্মবিশিষ্ট বিবিধ পুষ্করিণী, ছায়াসম্পন্ন তরুরাজি ও সুরভি কাননের দ্বারা অলঙ্কৃত হওয়ায় জলজ স্থলজ পুষ্পগন্ধযুক্ত সমীরণে সভাস্থলী আমােদিত হইয়া উঠিল।
এদিকে চতুর্দ্দশ মাস অবিশ্রান্ত কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিয়া অবশেষে ময়দানব যুধিষ্ঠিরকে সভাসমাপ্তির সংবাদ প্রেরণ করিলে ধর্ম্মরাজ প্রীত হইয়া নানাদিগ্দেশাগত ব্রাহ্মণগণকে ঘৃত পায়স ফলমূল মৃগমাংসাদি ভোজন ও বস্ত্রমাল্যাদিদানে পরিতৃপ্ত করিয়া সভাপ্রবেশ করিলেন। তথায় গগনস্পর্শী পুণ্যাহধ্বনিতে উদ্বোধিত হইয়া গীতবাদ্য পুষ্পাদির দ্বারা দেবার্চ্চনা ও দেব-স্থাপনা করিলেন।
একদা রাজা দুর্য্যোধন শকুনির সহিত ভ্রমণ করিতে করিতে ক্রমে ক্রমে যুধিষ্ঠিরের ময়দানবনির্ম্মিত সভার সৌন্দর্য্য সকল পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। তিনি তাহাতে যে সকল অত্যাশ্চর্য্য নির্ম্মাণচ্ছন্দ দেখিতে পাইলেন, তাহা তৎপূর্ব্বে কখন দৃষ্টিগােচর করেন নাই।
এক গৃহের স্ফটিকময় কুট্টিমে স্ফটিকদলশালিনী প্রফুল্লনলিনী দেখিয়া জলভ্রমে তথায় সন্তর্পণে পদবিক্ষেপ করিতে গিয়া সহসা ভূপতিত হইলেন। ইহাতে ভীম ও তাহার অনুচরবর্গ হাস্য করিলেন।
আর এক সময়ে স্ফটিকময় ভিত্তিতে দ্বার ভ্রম করিয়া তথা হইতে বহির্গমনের চেষ্টা করায় মস্তকে কঠিন আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বিঘূর্ণিত হইলে সহদেব দ্রুতগমনে আসিয়া তাঁহাকে ধারণ করিলেন।
পরে কৃত্রিম সরোবরের স্বচ্ছজলকে স্ফটিক ভাবিয়া সবস্ত্রে তাহাতে পতিত হইলেন। তখন ভীমার্জ্জুন বা নকুল সহদেব কেহই হাস্য সম্বরণ করিতে পারেন নাই। সময় যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় কিঙ্করগণ সত্বর উত্তমােত্তম বস্ত্র আনিয়া, তাঁহাকে প্রদান করিল।
ইহার পর দুর্য্যোধন আর বুদ্ধিস্থির রাখিতে না পারিয়া সর্ব্বত্রই জলভাগে স্থলের এবং স্থলভাগে জলের আশঙ্কা করিতে লাগিলেন এবং স্থানে স্থানে স্ফটিক ভিত্তিজ্ঞানে হস্তদ্বারা বিঘট্টিত করিতে গিয়া পতনোন্মুখ হইলেন।
এই সকল দুরবস্থা দেখিয়া পাণ্ডবগণ অনেকপ্রকার উপহাস করিতে আরম্ভ করিলেন। কোপনস্বভাব দুর্য্যোধন তাহা যেন শুনিয়াও শুনিলেন না, কিন্তু প্রকৃওপক্ষে তাহা মর্ম্মস্থলে বিদ্ধ হইয়া তাঁহার মনােমধ্যে অনেক প্রকার দুর্ম্মতির উদ্রেক করিতে লাগিল। অনন্তর বিবিধ অদ্ভুত ব্যাপার সন্দর্শনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের অনুজ্ঞা গ্রহণ করিয়া দুর্য্যোধন হস্তিনাপুরে প্রস্থান করিলেন।
পথে তিনি মহাত্মা পাণ্ডবগণের মহান্ মহিমা, পার্থিবগণের একান্ত বশবর্ত্তিতা, যুধিষ্ঠিরের অতুল ঐশ্বর্য্য এবং সভার অদৃষ্টপূর্ব্ব শোভা চিন্তা করিতে করিতে অতিশয় বিমর্ষচিত্তে গমন করিতে লাগিলেন। শকুনি তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া কহিলেন—
হে দুর্য্যোধন! তুমি কি নিমিত্ত এরূপ বিষণ্ণ মনে গমন করিতেছ?
দুর্য্যোধন কহিলেন―মাতুল! এই সসাগরা বসুন্ধরাকে যুধিষ্ঠিরের নিতান্ত বশম্বদ এবং এই ইন্দ্রযজ্ঞসদৃশ মহাযজ্ঞ নিরীক্ষণে আমি অমর্ষভরে দগ্ধ হইতেছি।
শকুনি দুর্য্যোধনকে সান্ত্বনা দিয়া কহিলেন—
হে দুর্যোধন! পাণ্ডবগণ তােমারই ন্যায় রাজ্যার্দ্ধ প্রাপ্ত হইয়া নিজ চেষ্টায় তাহা বর্দ্ধিত করিয়াছে, ইহাতে পরিবেদনার বিষয় কি আছে, বরং ইহাতে আশ্বাসের যথেষ্ট কারণ বর্ত্তমান। তুমিও বীর, তুমিও সহায়-সম্পন্ন, তুমিই বা কেন অখণ্ড ভূমণ্ডল জয় করিতে সক্ষম হইবে না?
তখন দুর্য্যোধন কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন—
হে রাজন্! তুমি যদি অনুমতি কর, আমি তােমাকে এবং অন্যান্য সুহৃদ্বর্গকে সহায় করিয়া এখনই পাণ্ডবদিগকে পরাজয় করি।
দুর্য্যোধনের আগ্রহাতিশয় দেখিয়া সুবলাত্মজ শকুনি ঈষৎ হাস্য সহকারে কহিলেন—
হে রাজন! সমিত্র পাণ্ডবগণ একত্র হইলে তাঁহারা সম্মুখসমরে দেবগণেরও অজেয়, অতএব একটু বিবেচনাপূর্ব্বক কার্য্য করিতে হইবে। যে উপায়ে যুধিষ্ঠিরকে পরাস্ত করা সম্ভব, তাহাই অবলম্বন করা আবশ্যক।
এই কথায় দুর্য্যোধন আহ্লাদে উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন—
তুমি যে উপায় বিধান করিবে, আমি ও আমার সহায়বর্গ তাহারই অনুষ্ঠান করিব।
তখন ধুর্ত্ত শকুনি বলিতে লাগিলেন— রাজা যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়াপ্রিয়, কিন্তু তাহাতে তাঁহার নৈপুণ্য নাই। আমি অক্ষক্রীড়ায় বিশেষরূপ দক্ষ, অদ্যাবধি ইহাতে কেহই আমাকে পরাস্ত করিতে পারে নাই। অতএব যুধিষ্ঠিরকে পাশক্রীড়া নিমিত্ত আহ্বান কর, আহূত হইলে তিনি অনিচ্ছা থাকিলেও লজ্জায় নিবৃত্ত হইতে পারিবেন না, তখন আমি তােমার নিমিত্ত অক্ষকৌশল প্রদর্শনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের প্রদীপ্ত রাজলক্ষ্মী জয় করিয়া লইব। কিন্তু এবিষয়ে তােমার পিতাকে পূর্ব্বাহ্ণে সম্মত করা আবশ্যক, তাঁহার অনুজ্ঞা লইয়া যুধিষ্ঠিরকে নিমন্ত্রণ করা যাইবে।
দুর্য্যোধন কহিলেন—পিতার নিকট আমি এরূপ প্রস্তাব করিতে সাহস করি না, তুমি উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া তাঁহাকে সম্মত করাইবে।
এই যুক্তি অনুসারে রাজধানীতে প্রত্যাগত হইবার পর একদিন শকুনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলিতে লাগিলেন―
মহারাজ! দুর্য্যোধন কৃশ, বিবর্ণ ও সর্ব্বদা চিন্তাপরবশ হইয়া পড়িতেছে। জ্যেষ্ঠপুত্রের শােকের কারণ আপনার পরিজ্ঞাত হওয়া কর্ত্তব্য।
ধৃতরাষ্ট্র অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া দুর্য্যোধনকে আহ্বানপুর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন—
বৎস! কি নিমিত্ত তুমি কাতর হইয়াছ, আমার যদি শ্রোতব্য হয় ত বল। তোমার মাতুল কহিতেছেন যে তুমি পাণ্ডুর ও কুশ হইয়া যাইতেছ, কিন্তু আমি ত চিন্তা করিয়াও তোমার শোকের কারণ দেখি না। এই রাজ্যের সমস্ত ঐশ্বর্য্য তােমাতেই প্রতিষ্ঠিত, তােমার ভ্রাতৃগণ ও রাজপুরুষগণ তোমার অনুগত, যাবতীয় ভোগ্যবস্তু তােমার ইচ্ছামাত্র সুলভ, তবে কি নিমিত্ত দীনচিত্তে কালক্ষেপ করিতেছ?
তদুত্তরে দুর্য্যোধন কহিলেন―
হে তাত! আমি যেদিন যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী দর্শন করিয়াছি, তদবধি আর ভােগ্য বিষয় আমাকে তৃপ্ত করেনা।
পুত্রের দুঃখে ধৃতরাষ্ট্রকে একান্ত ব্যথিত দেখিয়া শকুনি সুযােগ বুঝিয়া দুর্য্যোধনকে সম্বােধনপূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন—
হে সত্যপরাক্রম! পাণ্ডবদের যে অনুপম ঐশ্বর্য্য দৃষ্টিগােচর করিতেছ, তাহা প্রাপ্ত হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে। যুধিষ্ঠির অক্ষক্রীড়াপ্রিয় আমিও দ্যূতজ্ঞ, অতএব উহাকে ক্রীড়ার্থ আহ্বান কর, দেখা যাক্ আমি উহাকে পরাজয় করিয়া তােমার নিমিত্ত সেই দিব্য সমৃদ্ধি আনয়ন করিতে পারি কি না।
শকুনির বাক্যাবসানমাত্র দুর্য্যোধন পিতাকে কহিতে লাগিলেন—
হে পিতঃ! অক্ষবিৎ গান্ধাররাজের এ প্রস্তাব সঙ্গত এবং সম্ভবপর, অতএব আপনি এ বিষয়ে ইঁহাকে অনুমতি প্রদান করুন।
ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের উদ্বেগ দেখিয়া তাঁহাকে শান্ত করিবার জন্য তন্মতস্থ হইয়া অনুচরবর্গকে আহ্বান করিয়া বলিলেন― শিল্পগণকে অবিলম্বে স্থূনাসহস্রশােভিত শতদ্বারবিশিষ্ট রত্নাস্তরণমণ্ডিত এক স্ফটিকময় ক্রীড়াগৃহ নির্মাণ করতে বলিয়া দাও।
বিদুর দ্যূতক্রীড়া-সমাচার অবগত হইয়া চিন্তাকুলচিত্তে, দ্রুতগমনে জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট উপস্থিত হইয়া ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিলেন—
মহারাজ! আপনার এ সংকল্পের অনুমোদন করিতে পারিতেছি না। এই ক্রীড়া উপলক্ষে আপনার পুত্রগণের মধ্যে ঘোর বৈরানল প্রজ্বলিত হইবার সম্ভাবনা, এখনও সময় থাকিতে উহা নিবারণ করুন।
ধৃতরাষ্ট্র দুর্য্যোধনকে নিবারণ করা অসম্ভব জানিয়া বিদুরের পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া কহিলেন―
হে বিদুর! তুমি এ সঙ্কল্পকে আমার বলিয়া জ্ঞান করিতেছ কেন? সকলই দৈবের হাত, দৈব হইতেই ইহা ঘটিয়াছে—দৈব সুপ্রসন্ন থাকিলে কোন বিপদ্ ঘটিবে না, অতএব তুমি নির্ভয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে গমনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে ক্রীড়ার্থে আমার নিমন্ত্রণ জ্ঞাপন কর।
অনন্তর বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকর্ত্তৃক নিযুক্ত হইয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও অশ্বারোহণে পাণ্ডবগণের রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন এবং কুবেরভবনোপম রাজপ্রাসাদে প্রবিষ্ট হইয়া ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের সমীপবর্ত্তী হইলেন।
বিদুর কহিলেন―মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র তোমার অক্ষয়কুশল প্রশ্নপূর্ব্বক তোমাকে ভ্রাতৃগণের সহিত দ্যূতক্রীড়ার্থে নিমন্ত্রণ করিতেছেন। তথায় তােমার সভার অনুরূপ ক্রীড়া-সভা দেখিতে পাইবে এবং তােমাদের দর্শনে কৌরবগণের প্রীতির পরিসীমা থাকিবে না। তােমাকে এই কথা বিজ্ঞপনার্থে আমি আসিয়াছি, এক্ষণে তােমার যাহা অভিপ্রায় বল।
যুধিষ্ঠির কহিলেন―মহাশয়! দ্যূতক্রীড়া কলহের কারণ হইয়া থাকে, অতএব উহাতে প্রবৃত্ত হওয়া কি আপনার ভাল বিবেচনা হয়?
তদুত্তরে বিদুর বলিলেন—
দ্যূত যে অনর্থের মূল, তা আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, আমি ধৃতরাষ্ট্রকে এবিষয়ে নিবারণ করিবার চেষ্টাও করিয়াছি, কিন্তু তিনি আমার কথা গ্রাহ্য করেন নাই। এক্ষণে তোমার যাহা শ্রেয়স্কর বােধ হয়, তাহাই কর।
যুধিষ্ঠির ক্ষণকাল বিবেচনা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—
হে প্রাজ্ঞ! ক্রীড়ার্থে কোন্ কোন্ অক্ষবিৎ তথায় উপস্থিত থাকিবেন?
বিদুর কহিলেন―অক্ষনিপুণ শকুনি, চিত্রসেন, রাজা সত্যব্রত এবং পুরুমিত্র তথায় উপস্থিত হইবার কথা।
যুধিষ্ঠির বলিলেন―হে তাত! ধৃতরাষ্ট্র বলিতেছেন বলিয়া আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছি না, কারণ আমি জানি তিনি নিতান্ত পুত্রপক্ষপাতী। তবে আপনি যখন সভামধ্যে আমাকে ক্রীড়ানিমিত্ত আহ্বান জানাইয়াছেন, তখন আমি কোন্ লজ্জায় অস্বীকার করি? ক্রীড়ায় আহূত হইলে আমি কখনই নিবৃত্ত হই না, ইহাই আমার নিয়ম, তা না হইলে কপটদ্যূতকর শকুনির সহিত আমি ক্রীড়া করিতাম না!
এই বলিয়া রাজা যুধিষ্ঠির অনুযাত্রিগণকে প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন এবং পরদিন দ্রৌপদী প্রভৃতি স্ত্রীগণ ও ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে রথারােহণপূর্ব্বক যাত্রা করিলেন।
হস্তিনাপুরে উপনীত ধর্ম্মরাজ প্রভৃতির সহিত ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ কৃপ অশ্বত্থামা প্রভৃতি সকলের সাক্ষাৎ হইলে, প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র সকলের মস্তকাঘ্রাণ করিলেন এবং কৌরবগণ প্রিয়দর্শন পাণ্ডবদের দর্শন পাইয়া আহ্লাদের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূগণ অপ্রশান্ত মনে দ্রৌপদীর পরমােৎকৃষ্ট বস্ত্রালঙ্কার দর্শন করিতে লাগিলেন।
প্রথমত ব্যায়ামাদি করিয়া, স্নানান্তে চন্দনভূষিত ও কৃতাহ্নিক হইয়া পথশ্রান্ত পাণ্ডবগণ ভােজনান্তর দুগ্ধফেননিভ শয্যায় নিদ্রাসুখ উপভােগ করিলেন।
প্রাতঃকালে বিগতক্লম হইয়া ক্রীড়ামণ্ডপে প্রবেশপূর্ব্বক পূজার্হ পার্থিবগণকে যথাক্রমে পূজা করিয়া সকলে বিচিত্র আস্তরণযুক্ত আসনে উপবিষ্ট হইলেন। তখন শকুনি মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন—
হে পার্থ! সভাস্থ সকলে তোমার প্রতীক্ষা করিতেছেন। আইস, ক্রীড়া আরম্ভ করি।
যুধিষ্ঠির কহিলেন―ক্রীড়ায় আহূত হইলে আমি কদাচ নিবৃত্ত হই না। দ্যূতে অদৃষ্টই বলবান্, অতএব তাহার উপরই নির্ভর করিয়া আমি অদ্য ক্রীড়া করিব। আমার সহিত উপযুক্ত পণ রাখিতে কে প্রস্তুত আছেন?
দুর্য্যোধন কহিলেন—হে যুধিষ্ঠির! আমার রাজ্যের সমুদায় ধন ও রত্ন আমি প্রদান করিব, মাতুল আমার প্রতিনিধি হইয়া ক্রীড়া করবেন।
যুধিষ্ঠির কহিলেন―ভ্রাতঃ! একজনের প্রতিনিধিস্বরূপ অন্যের ক্রীড়া আমার মতে নিতান্ত অসঙ্গত, যাহা হউক ক্রীড়া আরম্ভ করা যাক্।
দ্যূতারস্তু-সংবাদে রাজপুরুষগণ ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রে করিয়া সভা প্রবেশ করলেন। মহামতি ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও বিদুর অনতিপ্রসন্নে মনে তাঁহাদের অনুবর্ত্তী হইলেন। সকল উপবিষ্ট হইলে ক্রীড়া আরম্ভ হইল।
যুধিষ্ঠির দুর্য্যোধনকে বলিলেন―
হে রাজন্! আমার এই কাঞ্চননির্মিত মণিময় হার পণ রাখিলাম, তোমার প্রতিপণের বস্তু কি?
দুর্য্যোধন কহিলেন—আমিও বহুতর মণি পণ রাখিতেছি, কিন্তু তন্নিমিত্ত অহঙ্কার করি না। যাহা হউক এক্ষণে এই গুলি জয় কর।
যুধিষ্ঠিরের অক্ষ ক্ষেপান্তে শকুনি অক্ষগুলি গ্রহণপূর্ব্বক অবলীলাক্রমে শ্রেষ্ঠ-দান-নিক্ষেপপূর্ব্বক বলিলেন—
দেখ মহারাজ! আমিই জিতিলাম।
যুধিষ্ঠির এই সহসা পরাজয়ে রুষ্ট হইয়া কহিলেন—
হে শকুনে! তুমি কি ক্ষেপনচাতুরীদ্বারা বারবার সফলতা লাভ করিবে ভাবিয়াছ? আইস, আমার অক্ষয় কোষ এবং রাশীকৃত হিরণ্য পণ রাখিলাম।
এইবারও শকুনি অক্ষক্ষেপমাত্র তাহা জয় করিয়া লইলেন।
যুধিষ্ঠির দৈবপরিবর্ত্তনের প্রতি আশাযুক্ত হইয়া এক পরাজয়জনিত লজ্জায় উত্তেজিত হইয়া উত্তরোত্তর পণ বৃদ্ধি করিতে আরম্ভ করিলেন, রথ, গজ, অশ্ব, দাস, দাসী এবং অবশেষে শ্রেষ্ঠরথী ও যােদ্ধৃগণকে একে একে পণ রাখিলেন, কিন্তু কৃতবৈর দুরাত্মা শকুনি স্বনির্ম্মিত অভ্যস্ত অক্ষের উপর সম্পূর্ণ প্রভুত্ববশত ছলনাক্রমে সেই সকলই অপহরণ করিল।
সেই সর্ব্বনাশিনী দ্যূতক্রীড়া এইরূপ ভয়াবহ আকার ধারণ করিলে বিদুর আর মৌন না থাকিতে পারিয়া বলিয়া উঠিলেন—
মহারাজ! মুমূর্ষু ব্যক্তির যেরূপ ঔষধ সেবনে প্রবৃত্তি হয় না, আপনারও সম্ভবত সেইরূপ আমার উপদেশবাক্যে অভিরুচি হইবে না, তথাপি যাহা বলি, একবার শ্রবণ করুন। আপনি পাণ্ডবগণের ধনলাভের নিমিত্ত এ বিপদের অবতারণা করিতেছেন, তদপেক্ষা ন্যায়ব্যবহার দ্বারা স্বয়ং পাণ্ডবগণকে লাভ করুন। সৌবলের কপটক্রীড়া বিলক্ষণ অবগত আছি, অতএব তাঁহাকে স্বস্থানে প্রস্থানের অনুমতি প্রদান করুন।
ধৃতরাষ্ট্র কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া কোন কথাই কহিলেন না।
শকুনি বলিলেন―হে যুধিষ্ঠির! তুমি ত পাণ্ডবগণের সমস্ত সম্পত্তিই নষ্ট করিলে। এক্ষণে আর কিছু থাকে ত বল, না হয় ক্রীড়ায় ক্ষান্ত হওয়াই শ্রেয়।
যুধিষ্ঠির রুষ্ট হইয়া বলিলেন—
হে সুবলনন্দন! তুমি কি নিমিত্ত আমার ধনসম্বন্ধে সন্দেহ করছে? আমার এখনও যথেষ্ট অবশিষ্ট রহিয়াছে।
এই বলিয়া তিনি আর যেখানে যত রজতকাঞ্চন মণিমানিক্য ছিল তৎসমস্ত ভ্রাতৃগণ ও অনুচরবর্গের পরিহিত অলঙ্কারসমেত পণ রখিয়া পুনরায় ক্রীড়া করিলেন এবং পূর্ব্ববৎই তাহা হারাইলেন।
অবশেষে হতবুদ্ধি ন্যায় বিবেচনাশূন্য হইয়া বলিলেন―হে সুবলাত্মজ! আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতৃদ্বয় আমার নিতান্ত প্রিয় এবং পণের অযোগ্য হইলেও আমি ইহাদিগকে পণ রাখিয়া তােমার সহিত ক্রীড়া করিব। শকুনি অক্ষক্ষেপমাত্রই জয়লাভ করিয়া বলিলেন―
তোমার প্রিয় মাদ্রীপুত্রদ্বয়কে জয় করিলাম। এক্ষণে বােধ করি তোমার প্রিয়তর ভীমার্জ্জুনকে লইয়া ইহাদের ন্যায় পণ্যদ্রব্যবৎ ক্রীড়া করতে সাহসী হইবে না, অতএব বিফল ক্রীড়ায় প্রয়ােজন কি?
যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন―
রে মূঢ়! তুমি কি মনে করিতেছ এরূপ অযথাবাক্যের দ্বারা আমাদের মধ্যে ভেদ উৎপাদন করবে। এই দেখ ভীমার্জ্জুন পণের নিতান্ত অযােগ্য হইলেও আমি তাঁহাদিগকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া করিতেছি।
তখন ইঁহারাও অক্ষবলে শকুনির বশীভূত হইলেন।
পরিশেষে ক্ষোভে জ্ঞানশূন্য হইয়া যুধিষ্ঠির নিজেকে পণ স্বরূপ অর্পণ করিয়া সকলে মিলিয়া দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ হইলেন।
ইহাতেও তৃপ্ত না হইয়া নৃশংস দুরাত্মা শকুনি পুনরায় বলিতে লাগিলেন―
দেখিতেছি প্রমত্ত ব্যক্তি নিতান্তই গর্ত্তমধ্যে পতিত হয়। হে ধর্ম্মরাজ! তুমি পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, তোমাকে নমস্কার। দেখিতেছি দ্যূতাসক্ত ব্যক্তি যে সকল প্রলাপ কহে, তাহা স্বপ্নেও কল্পনা করা কঠিন। হে রাজন্! তােমার প্রণয়িনী দ্রৌপদী থাকিতে তুমি নিজেকে কি বলিয়া বদ্ধ করিলে? অন্যান্য সম্পত্তি থাকিতে নিজেকে পণ রাখা মূঢ়ের কর্ম্ম। হে প্রমত্ত! আমি তোমাকে পণ রাখিতেছি, তুমি কৃষ্ণাকে পণ রাখিয়া আপনাকে মুক্ত কর।
যুধিষ্ঠির কহিলেন―হে শকুনে! যিনি সুশীলা প্রিয়বাদিনী এবং লক্ষ্মীস্বরূপিণী সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী দ্রৌপদীকেই আমি পণ রাখিলাম।
ধর্ম্মরাজের মুখে এই প্রলাপবাক্য শ্রবণ করিবামাত্র সভাসদ্গণের ধিক্কারে সভা ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। ভূপতিগণ শােকসাগরে নিমগ্ন হইলেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি মহাত্মাদের কলেবর হইতে ঘর্ম্মবারি বিনির্গত হইতে লাগিল। বিদুর মস্তক ধারণপূর্ব্বক ঘন ঘন শ্বাস পরিত্যাগ করিয়া অচেতনের ন্যায় অধােমুখ হইয়া রহিলেন। পুত্রের এই ভাগ্যবলে আনন্দ গোপন না করিতে পারিয়া ধৃতরাষ্ট্র আগ্রহভরে জয় হইল কি? জয় হইল কি? বারম্বার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠিরের মতিচ্ছন্ন দেখিয়া কর্ণ দুর্য্যোধন এবং দুঃশাসনের হর্ষের আর সীমা রহিল না।
অনন্তর পূর্ব্ববৎ শকুনিরই জয়লাভ হইলে দুর্য্যোধন পরিশোধ-লিপ্সায় উৎফুল্ল হইয়া বিদুরকে কহিলেন―
তুমি শীঘ্র গিয়া পাণ্ডবদের প্রাণপ্রিয়া দ্রৌপদীকে আনয়ন কর। কৃষ্ণা দাসীগণ-সমভিব্যাহারে গৃহমার্জ্জন করুক।
বিদুর কহিলেন—রে মূঢ়! তুমি আপনাকে পতনোন্মুখ না জানিয়া এই দুর্ব্বাক্য কহিতে সাহসী হইলে। মৃগ হইয়া ব্যাঘ্রকে কোপিত করিলে। তুমি যখন লোভ-পরতন্ত্র হইয়া সদুপদেশ শ্রবণ করিলে না, তখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, অচিরাৎ সবংশে ধ্বংশ হইবে।
মদমত্ত দুর্য্যোধন বিদুরকে ধিক্! এইমাত্র বলিয়া সভাস্থ সূত প্রাতিকামীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন—
হে প্রাতিকামিন্! দেখিতেছি বিধুর ভীত হইয়াছেন। তুমি শীঘ্র গিয়া দ্রৌপদীকে আনয়ন কর, পাণ্ডবগণ হইতে তোমা কোন ভয় নাই।
প্রাতিকামী এই আদেশ প্রাপ্ত হইয়া সত্বর গমনে পাণ্ডবগণের ভবনে প্রবেশপূর্ব্বক দ্রৌপদীকে নিবেদন করিল—
হে পাঞ্চালি! যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়ায় নিতান্ত আসক্ত হইয়া তোমাকে পণ রাখিয়াছিলেন, দুর্য্যোধন তোমাকে জয় করিয়াছেন। তিনি তোমায় সভায় আহ্বান করিতেছেন।
দ্রৌপদী কহিলেন―হে প্রাতিকামিন্! তুমি কি প্রলাপ বকিতেছ? কোন্ রাজপুত্র পত্নীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া করে! যুধিষ্ঠিরের কি আর সম্পওি ছিল না?
প্রাতিকামী কহিল—হে দ্রুপদনন্দিনি! মহারাজ যুধিষ্ঠির পূর্ব্বে অন্য সমস্ত ধন এবং পরে ভ্রাতৃগণসমেত আপনাকে হারাইয়া পরিশেষে তােমাকে দ্যূতমুখে সমর্পণ করিয়াছেন।
দ্রোপদী কহিলেন―হে সূতনন্দন! তুমি সভায় গমন করিয়া যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা কর যে, তিনি অগ্রে আমাকে কি আপনাকে পণ রাখিয়াছিলেন।
প্রাতিকামী কৃষ্ণার আদেশানুসারে সভাস্থ সকলের সমক্ষে অধােমুখােপবিষ্ট যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদীর প্রশ্ন নিবেদন করিল, কিন্তু সেই বিচেতনপ্রায় পাণ্ডবের নিকট কোনো উত্তর পইল না।
দুর্য্যোধন কহিলেন―তে প্রাতিকামিন্! পাঞ্চালী এই স্থানে আসিয়া তাহার যাহা কিছু প্রশ্ন থাকে, নিজে করুক।
তখন প্রাতিকামী পুনরায় দ্রৌপদীর নিকট উপস্থিত হইয়া শােকাকুল বচনে বলিল―
হে রাজপুত্রি! পাপাত্মা দুর্য্যোধন মত্ত হইয়া তোমায় বারম্বার আহ্বান করিতেছেন।
দ্রৌপদী কহিলেন― হে সূতনন্দন! ইহা বিধাতারই বিধান। পৃথ্বীতলে ধর্ম্মই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, অতএব সভ্যগণকে জিজ্ঞাসা করিয়া আইস, ধর্ম্মত আমার এক্ষণে কি করা কর্ত্তব্য, তাঁহারা সকলে যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব।
প্রাতিকামী প্রত্যাগত হইয়া পূর্ব্ববৎ সভাস্থ সুকলকে দ্রৌপদীর বাক্য নিবেদন করিল। সভ্যগণ দুর্য্যোধনের আগ্রহ দেখিয়া তাঁহার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সাহস করিলেন না, অথচ দ্রৌপদীকে কোন অধর্ম্মযুক্ত কথা বলিতেও তাঁহাদের প্রবৃত্তি হইল না, সুতরাং তাঁহারা অধোবদনে নিরুত্তর রহিলেন।
যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে সভায় আনয়নসম্বন্ধে দুর্য্যোধনকে কৃতসংকল্প দেখিয়া গােপনে দূতদ্বারা তাঁহাকে শশুরের সমক্ষে আসিয়া রোদন করিতে উপদেশ প্রেরণ করিলেন।
প্রাতিকামী সমূহ বিপদ অনুভব করিয়া দুর্য্যোধনের ভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় সভাসগণকে উত্তেজিত করিবার নিমিত্ত কহিতে লাগিল—
আমি দ্রৌপদীকে আপনাদের কী উত্তর প্রদান করিব? তখন দুর্য্যোধন প্রাতিকামীর প্রতি রোষ প্রকাশপূর্ব্বক কহিল―
হে দুঃশাসন! সূতপুত্র নিতান্ত অল্পচেতা, এ দেখিতেছি বৃকোদরকে ভয় করে, তুমি স্বয়ং গিয়া কৃষ্ণাকে আনয়ন কর। অবশ শত্রুগণ তোমার কি করতে পারিবে?
দুরাত্মা দুঃশাসন আজ্ঞা পাইবামাত্র ত্বরায় দ্রৌপদীর গৃহে প্রবেশ করিয়া বলিল—
হে পাঞ্চালি! তুমি দ্যূতে পরাজিত হইয়াছ, অতএব লজ্জা পরিত্যাগপূর্ব্বক সভায় আগমন কর।
দ্রৌপদী দুঃশাসনের আরক্ত নেত্র অবলােকনে সাতিশয় ভীত হইয়া স্ত্রীগণবেষ্টিত গান্ধারীর আশ্রয় লইবার উদ্দ্যেশ্যে দ্রুতবেগে গমন করিলেন।
নির্লজ্জ দুঃশাসন ক্রোধভরে তর্জ্জন গর্জ্জন করিতে করিতে তাঁহার অনুধাবন করিয়া কেশ গ্রহণ করিল। দীর্ঘকেশী দ্রৌপদী বাতান্দোলিত কদলীপত্রের ন্যায় কম্পিত হইয়া বিনীতভাবে বলিলেন―
হে দুঃশাসন! আমি একবস্ত্রা রহিয়াছি, এ অবস্থায় আমাকে সভায় লইয়া যাওয়া উচিত হয় না।
কিন্তু দুঃশাসন তাঁহার বাক্য উপেক্ষা করিয়া বলিল—
একবস্ত্রাই হও, আর বিবস্ত্রাই হও, তুমি পরাজিত হইয়া আমাদের দাসী হইয়াছ, অতএব আমাদের আজ্ঞা পালন করিতেই হইবে।
এই বলিয়া দুর্ম্মতি কৃষ্ণার কেশ সবলে আকর্ষণপূর্ব্বক অনাথার ন্যায় তাঁহাকে সভা সমীপে আনয়ন করিল।
যে কুন্তলদাম রাজসূয়যজ্ঞের অবভৃথস্নানসময়ে মন্ত্রপূত জলদ্বারা সিক্ত হইয়াছিল, তাহা পাষণ্ডের হস্তস্পর্শে কলুষিত দেখিয়া সভাস্থ সকলে অসহ্য শোকে অভিভূত হইলেন।
দারুণ আকর্ষণে প্রকীর্ণকেশা ও স্খলিতার্দ্ধবসনা কৃষ্ণা এককালে লজ্জা ও ক্রোধে দগ্ধ হইয়া বলিতে লাগিলেন―
রে দুরাত্মন্! এই সভামধ্যে আমার ইন্দ্রতুল্য গুরুজনগণ উপবিষ্ট আছেন, তাঁহাদের সমক্ষে তুই কোন্ সাহসে আমাকে এই অবস্থায় আনিলি? স্বয়ং ইন্দ্র তোর সহায় থাকিলেও রাজপুত্রগণ তোকে ক্ষমা করিবেন না।
কিন্তু দুঃশাসনকে কেহই নিবারণ করিতেছেন না দেখিয়া অভিমানিনী পাঞ্চালী পুনরায় বলিলেন—
হায়! ভারতবংশীয়গণের ধর্ম্মে ধিক্। অদ্য বুঝিলাম ক্ষত্রচরিত্র নষ্ট হইয়াছে, যেহেতু সভাস্থ সকলে বিনা প্রতিবাদে কুলধর্ম্মের ব্যতিক্রম নিরীক্ষণ করিতেছেন।
এই বলিয়া রোরুদ্যমানা কৃষ্ণা স্বীয় পতিগণের প্রতি কটাক্ষপাত করিলেন। রাজ্য ধন মান সম্ভ্রম সমস্ত যাওয়ায় তাঁহাদের যাহা না হইয়াছিল, দ্রৌপদীর এই সকরুণ কটাক্ষে তাঁহাদের মনে দুর্নিবার অন্তর্দাহ উপস্থিত হইল।
কর্ণ পূর্ব্ব অপমান স্মরণ করিয়া অতীব হৃষ্ট হইলেন, শকুনিও দ্রৌপদীর অবমাননায় যোগদান করিলেন, দুঃশাসন দাসী! দাসী! বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিল।
ভীমসেন প্রিয়তমার এ অবমাননায় উন্মত্ত প্রায় হইয়া বলিয়া উঠিলেন―
হে যুধিষ্ঠির! দ্যূতপ্রিয় ব্যক্তিগণ গৃহস্থিত দাসীকে পণ রাখিয়াও কখনও ক্রীড়া করে না, তাহাদের প্রতিও কিঞ্চিৎ দয়া প্রকাশ করিয়া থাকে। দেখ, তুমি বহুকষ্টলব্ধ ধনসকল এবং তোমার অধীনস্থ আমাদিগকে একে একে পরবশে বিসর্জ্জন দিলে, আমি তাহাতেও ক্রোধ প্রকাশ করি নাই। কিন্তু তোমার এই শেষ কার্য্য যৎপরোনাপ্তি গর্হিত হইয়াছে। তোমারই অপরাধে ক্ষুদ্রাশয় কৌরবগণ এই অসহায় বালাকে ক্লেশ দিতে সাহসী হইল। তোমার দ্যূতাসক্ত হস্তদ্বয় ভস্মসাৎ করিলে তোমার এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইবে। সহদেব! ত্বরায় অগ্নি আনয়ন কর।
অর্জ্জুন এই কথার অগ্রজকে তিরস্কারপূর্বক কহিলেন—
হে আর্য্য! তুমি পূর্ব্বে ত কখনও ঈদৃশ দুর্ব্বাক্য প্রয়ােগ কর নাই। মনের আবেগে শত্রুগণের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিও না। দেখ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ক্ষত্রধর্ম্মানুসাৱেই ক্রীড়া করিয়াছেন, ক্ষত্রধর্ম্মানুসারেই অবনত মস্তকে পরাজয় স্বীকার করিয়াছেন।
এদিকে যখন দুঃশাসন সভামধ্যে একবস্ত্রা দ্রৌপদীর বসন আকর্ষণ করিবার উপক্রম করিল, তখন দ্রৌপদী একান্ত বিপন্ন হইয়া আর্ত্তনাদ করিতে লাগিলেন। সেই বিপদে স্বয়ং ধর্ম্ম অন্তরিত হইয়া দ্রোপদীকে নানাবিধ বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া রক্ষা করিলেন।
তদ্দর্শনে সভামধ্যে ঘোরতর কলরব আরম্ভ হইল। মহীপালগণ দুঃশাসনকে ভর্ৎসনা করিয়া নিবারণ করিলেন। ভীমসেন আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। তাঁহার ওষ্ঠাধর ক্রোধভরে বিস্ফুরিত হইতে লাগিল। তিনি করে কর নিষ্পেষণ করিয়া শপথপূর্ব্বক কহিলেন—
হে ক্ষত্রিয়গণ, শ্রবণ কর! যদি আমি যুদ্ধে এই ভারতাধম কুলাঙ্গার দুঃশাসনের বক্ষোবিদীর্ণ করিয়া রুধির পান না করি, তবে আমি যেন পূর্ব্বপুরুষের গতি প্রাপ্ত না হই।
দুঃশাসন দ্রৌপদীর বসন আকর্ষণে কৃতকার্য্য না হইয়া লজ্জিতভাবে সভামধ্যে উপবিষ্ট হইলেন। সভ্যগণ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে ধিক্কার প্রদান করিতে লাগিলেন এবং সজ্জনগণ ধৃতরাষ্ট্রকে নিন্দা করিয়া পরিতাপ করিতে লাগিলেন। সভাস্থ সকলকে পাণ্ডবপক্ষে কথঞ্চিৎ উত্তেজিত দেখিয়া বিদুর উৎক্ষিপ্ত হস্তদ্বারা কোলাহল নিবারণপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন—
হে সভ্যগণ। এই নিরপরাধা পাঞ্চালীর প্রতি আর অধিক অত্যাচার হইবার পূর্ব্বে আপনারা তৎকৃত প্রশ্নের উত্তর প্রদানে বর্ত্তমান সমস্যার মীমাংসা করুন। যে স্থানে অধর্ম্ম আচরিত হইতেছে, সেখানে মৌন থাকিলেও পাপ স্পর্শ করে, অতএব দ্রোপদীকে পণ রাখিবার ক্ষমতা যুধিষ্ঠিরের ছিল কি না― ইহা সত্বর নির্দ্ধারণ করুন।
কিন্তু বাষ্পাকুললোচনা কৃষ্ণাকে নিরীক্ষণ করিয়াও ধৃতরাষ্ট্রের ভয়ে কেহ বাঙ্নিষ্পত্তি করিলেন না।
তখন দুর্য্যোধন দ্রৌপদীকে বলিতে লাগিলেন—
হে দ্রৌপদি! তুমি পতিগণকে তোমার প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা কর। তাঁহারা যাহা বলিবেন, আমরা তাহাতে সম্মত আছি। যদি ভীম অর্জ্জুন নকুল সহদেব যুধিষ্ঠিরের প্রভুত্ব প্রকাশ্যে অস্বীকার করেন, তবে তুমি দাসীত্ব-শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইতে পারিবে।
পাণ্ডবভ্রাতাদিগকে নিরুত্তর দেখিয়া বিজয়ােৎফুল্ল দুর্য্যোধন দ্রৌপদীর প্রতি সহাস্যে দৃষ্টিপাত করিয়া রাম উরুতে হস্তস্থাপনপূর্ব্বক অপমানসূচক ইঙ্গিত করিলেন।
ইহাতে মহাক্রোধন ভীমসেন মদমত্ত কুঞ্জরের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া পুনরায় প্রতিজ্ঞা করিলেন―
হে ভুপতিগণ! যদি আমি যুদ্ধে গদাঘাতে ঐ উরু ভগ্ন না করি, তবে অন্তে আমার যেন পিতৃসমান গতি না হয়।
এরূপ বাদ প্রতিবাদ হইতেছে, এমন সময় ঘোর দুর্নিমিত্তসকল দৃষ্ট হইতেছে এরূপ সংবাদ আসিল। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত ভীত হইয়া অমঙ্গল শান্ত করিবার নিমিত্ত পুত্রকৃত দুষ্কর্ম্ম খণ্ডনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। দুর্য্যোধনকে ভর্ৎসনা করিয়া তিনি কহিলেন―
ওহে দুর্ব্বিনীত দুর্য্যোধন! তুমি কিরূপ বিবেচনায় কুরুকুল-কামিনীকে সভামধ্যে সম্ভাষণ করিতেছ?
পরে তিনি সান্ত্বনাবাক্যে দ্রোপদীকে কহিলেন―
হে কল্যাণি! তুমি আমার বধূগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তুমি অভিলষিত বর গ্রহণ কর।
দ্রৌপদী কহিলেন—যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আমার পতিগণকে দাসত্ব হইতে মুক্তি দিতে আজ্ঞা হউক।
ধৃতরাষ্ট্র―তথাস্তু!―বলিয়া পাণ্ডবগণকে স্বাধীনতা প্রদান করিলেন।
কর্ণ উপহাসপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন—
স্ত্রীলোকের অনেক অদ্ভুত কর্ম্মের কথা শ্রবণ করিয়াছি, কিন্তু পতিগণকে তরণীস্বরূপ হইয়া বিপদ্সাগর হইতে উদ্ধার একমাত্র পাঞ্চালীই করিলেন।
ভীম তাহাতে বলিলেন―
হাঁ! পাণ্ডবগণ স্ত্রীর দ্বারাই রক্ষিত হইলেন!
এই বলিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলিতে লাগিলেন―
মহারাজ! আজ্ঞা কর, আমি এই সভাতেই তােমার শত্রুবর্গকে সমূলে উন্মূলিত করি! তুমি তাহা হইলে নিশ্চিন্তচিত্তে পৃথিবী প্রশাসন করতে পারিবে।
যুধিষ্ঠির ভীমকে নিবারণ করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন―
হে রাজন! এক্ষণে আমরা আপনারই অধীন, অতএক কি করিব অনুমতি করুন।
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন―হে অজাতশত্রু! তুমি তােমার সমস্ত পরাজিত ধনসম্পত্তি প্রতিগ্রহ করিয়া স্বরাজ্য শাসন কর। হে তাত! তুমি দুর্য্যোধনের দুর্ব্বাক্য এবং নিষ্ঠুর ব্যবহার নিজগুণে ক্ষমা করিও, ইহাই আমার একমাত্র অনুরোধ।
পরাজিত ধনরত্ন পুনঃপ্রাপ্ত হইয়া পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞাক্রমে স্বরাজ্যে প্রতিগমনে উদ্যত হইয়াছেন অবগত হইবামাত্র দুঃশাসন ব্যতিব্যস্ত হইয়া মন্ত্রিসহিত দুর্য্যোধনের নিকট দ্রুতগমনে উপস্থিত হইয়া আকুলস্বরে বলিতে লাগিলেন—
হে আর্য্য! আমরা অতীব ক্লেশে যাহা কিছু সঞ্চয় করিয়াছিলাম, বৃদ্ধ রাজা তাহা সকলই নষ্ট করিলেন, ধনাদি সমস্তই শত্রুগণের হস্তগত হইল। এক্ষণে যাহা বিবেচনা হয় কর।
এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র একান্ত অভিমানপরতন্ত্র হইয়া দুর্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনি তৎক্ষণাৎ ধৃতরাষ্ট্র-সমীপে উপস্থিত হইয়া কহিলেন―
মহারাজ! আপনি এ কি সর্ব্বনাশ করিলেন? চতুর্দ্দিকে ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গমের মধ্যে বাস করিয়া কি কেই পরিত্রাণ পাইতে পারে? আপনি কি অবগত নহেন যে, ক্রোধান্ধ পাণ্ডবগণ রথারোহণপূর্ব্বক যুদ্ধের আয়োজন করিতেছেন? আমরা তাঁহাদের যেরূপ অপকার করিয়াছি, তাঁহারা কি কখনও ক্ষমা করিবেন? দ্রৌপদীর প্রতি দাসীবৎ ব্যবহার তাঁহারা কি কখনও সহ্য করিতে পারিবেন?
এ কথায় ধৃতরাষ্ট্রকে ভীতিবিহ্বল দেখিয়া দুর্য্যোধন পুনরায় বলিতে লাগিলেন―
অতএব এবার পাণ্ডবদিগের প্রতিশোধের পথ একবারেই অবরুদ্ধ করিয়া কার্য্য করা হইবে। পুনরায় উহাদিগকে অক্ষে পরাজিত করিতে হইবে, কিন্তু ক্রোধের কারণ যাহাতে থাকে, এমন কোন পণ রাখা হইবে না। এইবার পণ থাক্ যে নির্জ্জিতপক্ষকে বহুবৎসর বনবাসে যাপন করিতে হইবে। শকুনি স্বীয় শ্রেষ্ঠ কৌশলের দ্বারা নিশ্চয়ই জয়লাভ করিবেন, কিন্তু তাহাতে উপস্থিত কলহেরও কোন সম্ভাবনা থাকিবে না, ভবিষ্যৎ ভাবনারও কোন কারণ থাকিবে না।
ধৃতরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন—
বৎস! তুমি অবিলম্বে পাণ্ডবগণকে আবার দ্যূতে আহ্বান কর। এ কথা শ্রবণমাত্র ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর অশ্বত্থামা এবং ধৃতরাষ্ট্রের কোন কোন পুত্র প্রভৃতি উপস্থিত অনেকে ধৃতরাষ্ট্রকে নিষেধ করিয়া কহিলেন―
মহারাজ! বহু কষ্টে শান্তিসঞ্চার হইয়াছে, বারবার কুলক্ষয়কর বিবাদের সূত্রপাত করিবেন না।
কিন্তু ভীরুস্বভাব পুত্রবৎসল মােহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র সে কথায় কর্ণপাত করিলেন না। পুত্রদের ক্রূর অভদ্রোচিত ব্যবহারে একান্ত শোকনিমগ্না ধর্মপরায়ণা রাজমহিষী গান্ধারীও এ সংবাদে উদ্বিগ্ন হইয়া কহিলেন―
মহারাজ! দুর্য্যোধনের জন্ম মুহুর্ত্তেই সকলে তাহাকে পরিত্যাগ করিতে বলিয়াছিল, তুমি তাহা কর নাই। তাহার বিষম ফল একবার দেখিলে; আবার তুমি কোন্ সাহসে এই কুলপাংশুল দুর্ব্বিনীত বালকের কথায় অনুমােদন করিতেছ? উহাকে তোমার আজ্ঞানুবর্ত্তী না করিতে পার, তবে পরিত্যাগ কর। সেতুবন্ধ হইলে তাহা ইচ্ছাপূর্ব্বক কে ভগ্ন করে? হে মহারাজ! পুত্রস্নেহবশত নির্ব্বাপিতপ্রায় অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিয়া কুলনাশের হেতু হইও না।
ধৃতরাষ্ট্র বিষণ্ণবদনে উত্তর করিলেন―
প্রিয়ে! যদি একান্ত বংশনাশ হয়, তবে আমি নিরুপায়। কিন্তু প্রাণপ্রিয় পুত্রের বিরুদ্ধাচরণে আমি সক্ষম নহি।
পিতার অনুমতি প্রাপ্তিমাত্র দুর্য্যোধন যুধিষ্ঠিরের নিকটে উপস্থিত হইয়া কহিলেন—
হে পার্থ। সভায় এখনও বহুসংখ্যক লােক উপস্থিত আছে। পিতার অনুমতি হইয়াছে যে, তোমরা বিদায় হইবার পূর্ব্বে আমরা আর একবার সকলে মিলিয়া ক্রীড়া করি।
যুধিষ্ঠির বলিলেন—জ্যেষ্ঠতাতের যদি সেরূপ আদেশ হইয়া থাকে, তবে অক্ষ ক্ষয়কর জানিয়াও আমি ক্রীড়া হইতে নিবৃত্ত হইব না।
এইমাত্র বলিয়া যুধিষ্ঠির মোনাবলম্বনপূর্ব্বক ভ্রাতাদের সহিত ক্রীড়াগৃহে প্রবেশ করিলেন।
শকুনি বলিলেন—মহারাজ! বৃদ্ধ রাজা তােমাদিগকে যাহা কিছু প্রত্যর্পণ করিয়াছেন, তাতে আমরা আর হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না; এবার অন্য প্রকার পণ নির্ধারণ করা যাক্। আমাদের বা তােমাদের যে পক্ষেরই পরাজয় হইবে, তাহাদের দ্বাদশ বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিতে হইবে; অজ্ঞাতবাসকালে জ্ঞাত হইলে পুনরায় দ্বাদশবর্ষের জন্য বনগমন করিতে হইবে;—এই পণে যদি তুমি ভীত না হও, তবে আইস দ্যূতারম্ভ করি।
সভাস্থ লােকে ইহাতে উদ্বিগ্ন হইয়া ব্যস্তচিত্তে হস্তপ্রসারণপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন—
হে বান্ধবগণ! তোমাদিগকে ধিক্! যুধিষ্ঠির বােধ হয় এই ভয়ঙ্কর পণের পরিণাম না বিবেচনা করিয়াই দ্যূতে হস্তক্ষেপ করিতেছেন,—কিন্তু ক্রীড়া-ভীরু-অপবাদের লজ্জায় যুধিষ্ঠির আসন্নকালীন মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তির ন্যায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া পণে অঙ্গীকারপুর্ব্বক অক্ষনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। কিন্তু সিদ্ধহস্ত শকুনি অনায়াসে জয়লাভ করিয়া পাণ্ডবগণকে বনবাস-প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিলেন।
অনন্তর ধর্মাত্মা পাণ্ডবগণ পূর্ব্ববৎ শান্তভাবে পরাজয় স্বীকার করিয়া বনবাসের আয়ােজন করিলেন। দীনভাবে বল্কলাজিন ধারণপূর্ব্বক তাঁহারা যখন ক্রীড়াসভা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতেছেন, তখন উৎফুল্ল দুর্ম্মতি ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ পাণ্ডবদিগকে নানাপ্রকারে অবমাননা না করিয়া থাকিতে পারিল না।
দুর্য্যোধন পশ্চাদ্ভাগ হইতে ভ্রাতাদের কৌতুক উৎপাদনপূর্ব্বক সিংহগতি ভীমসেন এবং অন্যান্য পাণ্ডবগণের গতির অনুকরণ করিতে লাগিলেন। অভিমানী ভীমসেন বহু কষ্টে ক্রোধসম্বরণপূর্ব্বক তৎপ্রতি অর্দ্ধকায়ামাত্র পরিবর্ত্তিত করিয়া কহিলেন—
আমি তোমাদিগকে সবংশে নিহত জানিয়া ইহার উপযুক্ত প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি না। তােমরা এক্ষণে নিঃশঙ্কচিত্তে যাহা অভিরুচি তাহাই কর। রণস্থলে আমি ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে নিহত করিব, এবং অর্জ্জুন রাধেয়কে, সহদেব শকুনিকে নিহত করিবেন।
অর্জ্জুন কহিলেন—হে ভীম! কুতসঙ্কল্প ব্যক্তির বাক্যব্যয়ে প্রয়ােজন কি? ত্রয়ােদশ বর্ষ অতীত হইল যাহা ঘটিবে, তাহা সকলেই দেখিতে পাইবে। যাহা হউক তােমারই নিয়োগানুসারে আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে আমি নিশিত বাণদ্বারা পৃথিবীকে এই উপহাস-রসিক সূতপুত্রের রক্ত পান করাইব। হিমাচল বিচলিত হইতে পারে, সূর্য্য নিষ্প্রভ হইতে পারেন, কিন্তু আমার এই বাক্য মিথ্যা হইবে না।
অর্জ্জুনের বাক্যাবসানে মাদ্রীতনয় কঠিন কটাক্ষপাতপূর্ব্বক বলিলেন―
হে ধূর্ত্ত সৌবল? তুমি যে গুলিকে অক্ষ বিবেচনায় সেবা করিয়াছ সেগুলিকে রণস্থলে বাণাকারে মস্তকে বরণ করিতে হইবে।
নকুলও কহিলেন—যে-সকল দুর্ব্বৃত্তগণ ক্রীড়াপ্রসঙ্গে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় আনন্দ অনুভব করিয়াছে, তাহাদের সকলকে আমি যমালয়ে প্রেরণ করিব।
অনন্তর যুধিষ্ঠির রাজসভায় উপস্থিত হইয়া কহিলেন—
এক্ষণে আমি পিতামহ, কুরুবৃদ্ধগণ, দ্রোণপ্রভৃতি গুরুগণ, ধৃতরাষ্ট্র ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ এবং বিদুরের নিকট বিদায় হইলাম। যদি বনবাসান্তে প্রত্যাগত হই, তবে আবার সাক্ষাৎ হইবে।
সকলেই মৌন থাকিয়া মনে মনে পাণ্ডবগণকে বিবিধ প্রকার আশীর্ব্বাদ করিলেন।
বিদুর কহিলেন―হে পাণ্ডবগণ! মােদের সর্ব্বত্র মঙ্গল হউক, তােমাদের মাতা সুকুমারী এবং সুখলালিতা, এক্ষণে বৃদ্ধাও হইয়াছেন। তাঁহার বনগমন কোনাে ক্রমেই উচিত হয় না; অতএব তিনি সৎকৃত হইয়া আমার ভবনে বাস করুন।
পাণ্ডবগণ নিবেদন করিলেন―
হে প্রাজ্ঞপ্রধীর! তুমি আমাদের পিতৃতুল্য এবং পরম গুরু, তোমার আজ্ঞা আমরা অবশ্য প্রতিপালন করিব। আর যাহা অভিলাষ থাকে বল।
বিদুর বলিলেন―হে ধর্ম্মরাজ! যে ধর্ম্মবুদ্ধি বলে তুমি এই সমস্ত লাঞ্ছনা ও অবমাননা উপেক্ষা করিলে, তাহা যেন তোমার চিরকালই থাকে। আশীর্ব্বাদ করি নির্ব্বিঘ্নে প্রত্যাগত হও।
তদনন্তর যুধিষ্ঠির সকলকে যথােচিত অভিবাদনপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন।