কুরু পাণ্ডব/৬

উইকিসংকলন থেকে

 পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের বৎসর সমাগত হইলে রাজা দুর্য্যোধন তাঁহাদের অনুসন্ধানার্থে দেশবিদেশে চর প্রেরণ করিলেন। তাহারা নানা গ্রাম নগর ও রাষ্ট্রে বিফল পরিভ্রমণ করিয়া অবশেষে বৎসরের অল্পমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে হস্তিনাপুরে প্রত্যাগত হইল। রাজা দুর্য্যোধনের সভায় দ্রোণ কর্ণ কৃপ ভীষ্ম ও মহারথ ত্রিগর্ত্তরাজ সমাসীন আছেন, এমন সময়ে চরগণ উপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলি-পুটে নিবেদন করিল—

 মহারাজ! আমরা অপ্রতিহত-যত্নসহকারে দুরবগাহ অরণ্যানী ও গিরিশিখর, জনাকীর্ণ প্রদেশ ও অরাতিগণের রাজধানী তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু পাণ্ডবগণের কোন সংবাদ পাইলাম না।

 মহারাজ! আর এক সংবাদ প্রদান করি শ্রবণ করুন। মৎস্য রাজ্যের এক প্রবল পরাক্রাপ্ত সেনাপতি কীচক এবং তাঁহার মহাবল আত্মীয়বর্গ রাত্রিযােগে গন্ধর্ব্বকর্তৃক নিহত হইয়াছেন।

 তখন কর্ণ কহিলেন—

 মহারাজ! যাহারা পাণ্ডবগণকে বিশেষরূপে অবগত আছে, এমন কতিপয় ছদ্মবেশী ধূর্ত্ত লােককে প্রত্যেক জনপদ গােষ্ঠী তীর্থ ও আকরে প্রেরণ কর। তাহারা পুনরায় নদী কুঞ্জ গ্রাম নগর আশ্রম ও গিরিগুহায় অনুসন্ধান করুক।

 কর্ণের বাক্য সমর্থন করিয়া দুঃশাসন ভ্রাতাকে কহিলেন―

 মহারাজ! আপনি অবিচলিত উৎসাহে পাণ্ডবগণের অনুসন্ধান করিতে থাকুন। তাঁহারা হয় অত্যন্ত গোপনভাবে অবস্থিতি করিতেছেন, নয় একান্ত দুরবস্থায় পতিত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন।

 কৃপাচার্য্য কহিলেন—পাণ্ডবগণের প্রতিজ্ঞাত ত্রয়োদশ বৎসর পূর্ণ হইবার আর অতি অল্প দিবস অবশিষ্ট আছে, অতএব উহাদের অভ্যুদয়ের পূর্ব্বেই তুমি এই বেলা কোষশুব্ধি বলবৃদ্ধি ও নীতিবিধান কর এবং বল মিত্র ও সৈন্য সামন্তের সামর্থ্য বিবেচনা কর।

 ইতিপূর্ব্বে ত্রিগর্ত্তরাজ বিরাটরাজকর্ত্তৃক বারবার পরাজিত হইয়াছিলেন; এক্ষণে উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া কর্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন―

 হে দুর্য্যোধন! আমরা সকলে মিলিয়া মৎস্যদেশ আক্রমণ করিলে জয়লাভ করিতে সমর্থ হইব এবং তত্রত্য বহুসংখ্যক গো, ধন ও রত্ন আমরা বিভাগ করিয়া লইতে পারিব। তদ্ব্যতীত মৎস্যরাজ্য হস্তগত হইলে তোমারও বলবৃদ্ধি হইবে সন্দেহ নাই।

 কর্ণ সুশর্ম্মার বাক্য অনুমোদনপূর্ব্বক দুর্য্যোধনকে কহিলেন―

 মহারাজ! অর্থহীন ভ্রষ্টবল পাণ্ডবগণের অনুসন্ধানে বৃথা সময়ক্ষেপ করা অপেক্ষা নিজবল বৃদ্ধি করাই শ্রেয়।

 দুর্য্যোধন কর্ণের কথায় হৃষ্ট হইয়া দুঃশাসনকে আজ্ঞা করিলেন—

 ভ্রাতঃ! তুমি শীঘ্র বৃদ্ধগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া বাহিনী যােজনা কর।

 অনন্তর ত্রিগর্ত্তরাজ স্বীয় সৈন্য সজ্জিত করিয়া কৃষ্ণপক্ষীয় সপ্তমীতে মৎস্যদেশাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কৌরবগণও পরদিন অপরদিক্‌ হইতে বিরাটরাজকে আক্রমণ করিবার মানসে ভিন্ন পথ অবলম্বন করিলেন।

 এদিকে পাণ্ডবগণ ছদ্মবেশে বিরাটরাজের কার্য্যানুষ্ঠান করিয়া এবং কীচকের পরিবর্ত্তে সকল বিষয়ে তাঁহার সহায়স্বরূপ হইয়া তাঁহাদের প্রতিজ্ঞাত অজ্ঞাতবাসের কাল অতিবাহিত করিয়াছেন, এমন সময়ে ত্রিগর্ত্তাধিপতি মৎস্যদেশে উপস্থিত হইয়া বিরাটনগরের এক প্রান্ত হইতে বহুতর গােধন অপহরণ করিলেন।

 তখন সেই গোরক্ষক গােপ সত্বরে রথারােহণ করিয়া মহাবেগে পুরী প্রবেশপূর্ব্বক যে স্থানে পাণ্ডবগণবেষ্টিত হইয়া বিরাটরাজ আসীন আছেন, সেখানে উপস্থিত হইল এবং সত্বর রথ হইতে অবতরণ করিয়া রাজসমীপে অগ্রসর হইয়া প্রণতিপূর্ব্বক নিবেদন করিল―

 মহারাজ! ত্রিগর্ত্তগণ সসৈন্যে আমাদিগকে আক্রমণ করিয়া আপনার সহস্র সহস্র গোধন অপহরণ করিতেছেন। আপনি রক্ষা করুন।

 বিরাটরাজ এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র রথ-মাতঙ্গ-অশ্বপদাতিসমন্বিত স্বীয় সেনাদিগকে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইতে আদেশ করিলেন ও কহিলেন, বোধ হইতেছে মহাবীর কঙ্ক, বল্লভ, তন্ত্রিপাল, ও গ্রন্থিক ইঁহারাও যুদ্ধ করিবেন; অতএব ইঁহাদিগকে উপযুক্ত রথ, সুদৃঢ় বর্ম্ম ও বিবিধ আয়ুধ প্রদান কর।

 রাজাজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া যুধিষ্ঠির ভীমসেন নকুল ও সহদেব হৃষ্টচিতে নির্দ্দিষ্ট অস্ত্র গ্রহণ ও রথারোহণপূর্ব্বক মৎস্যরাজের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। মহাবল মৎস্যসেনা অপরাহ্ণকালে নগর হইতে বহির্গত হইয়া গোধনাপহারী ত্রিগর্ত্তদিগকে আক্রমণ করিল।

 এই অবস্থায় সূর্য্য অস্তমিত হইল। সমরক্ষেত্র তিমিরাচ্ছন্ন হইলে যুদ্ধ ক্ষণকাল স্তব্ধ রহিল। অনন্তর চন্দ্রমা অন্ধকার নিরাকৃত করিয়া নভোমণ্ডলে উদিত হইলে ক্ষত্রিয়গণ আলোকপ্রাপ্ত হইয়া পুনরায় পরস্পরের প্রতি ধাবিত হইলেন।

 ইত্যবসরে ত্রিগর্ত্তাধিপতি সুশর্ম্মা কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে রথে লইয়া বিরাটরাজকে আক্রমণ করিলেন এবং সমীপস্থ হইয়া সত্বর রথ হইতে গদাহস্তে অবতরণ করিলেন। মহাবেগে বিরাটের রথের নিকট অগ্রসর হইয়া তিনি মৎস্য রাজের সারথি-সংহারপূর্ব্বক তাঁহাকে স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন। ইহাতে সৈন্যগণ সাতিশয় ভীত হইয়া চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল। তখন যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে বলিলেন―

 হে বৃকোদর! ঐ দেখ সুশর্ম্মা বিরাটরাজকে লইয়া প্রস্থান করিতেছেন। আমরা এতদিন ইঁহারই আশ্রয়ে সুখস্বচ্ছন্দে কালযাপন করিয়াছি; অতএব তাহার প্রতিদানস্বরূপ তোমার উহাকে সত্বর অরাতিহস্ত হইতে মোচন করা উচিত।

 তখন মহাবল ভীমসেন শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক বারিধারার ন্যায় অনবরত বর্ষণ করিতে করিতে সুশর্ম্মার রথের পশ্চাতে ধাবিত হইলেন। ত্রিগর্ত্তরাজ পশ্চাদ্ভাগে দৃষ্টি করিয়া কালান্তক যমের ন্যায় ভীমসেনকে আসিত দেখিয়া রথ প্রত্যাবর্তনপূর্ব্বক সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। ভীমসেন ক্রোধভরে নিমেষমধ্যে বহুসংখ্যক সৈন্য় নিহত করিয়া সুশর্ম্মার সমীপস্থ হইলেন। ইত্যবসরে অন্যান্য পাণ্ডবগণও উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহায়তা করিলেন। একত্র সকলের বিক্রমপ্রকাশে তত্রত্য সৈন্যগণ নিহত হইলে ভীমসেন অবসর বুঝিয়া সুশর্ম্মার সারথিকে বিনষ্ট করিয়া তাঁহার রথারােহণপুর্ব্বক বিরাটকে মোচন ও সুশর্শ্মাকে রথচ্যুত করিয়া গ্রহণ করিলেন। যুধিষ্ঠির ইহা দেখিয়া সহাস্যবদনে বলিলেন―

 এইবার ত ত্রিগর্ত্তরাজ পরাজিত হইলেন, এক্ষণে উঁহাকে পরিত্যাগ কর।

 পরে তিনি সুশর্ম্মাকে কহিলেন—

 এক্ষণে তুমি মুক্ত হইলে, আর কখনও পরের ধন লুব্ধ হইয়া এরূপ সাহসিক কর্ম্ম করিও না।

 ত্রিগর্ত্তরাজ যুধিষ্ঠিরের অনুগ্রহে মুক্তিলাভ করিয়া লজ্জাবনতবদনে বিরাটকে অভিবাদনপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন।

 মৎস্যরাজ সে রাত্রি সমরক্ষেত্রেই অতিবাহিত করিলেন। পরদিন প্রাতে মৎস্যরাজ পাণ্ডবদিগকে প্রভূত ধন প্রদান করিবার আদেশ দিয়া বলিতে লাগিলেন―

 আমি তোমাদেরই বিক্রমে মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করিলাম। অদ্য হইতে আমার সমুদয় ধনরত্নে তোমাদেরই আমারই ন্যায় প্রভুতা রহিল। তোমরা আমাকে অরাতিহস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছ; অতএব তোমরাই এ রাজ্য শাসন কর।

 পাণ্ডবগণ কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া রাজার কৃতজ্ঞ বচন অভিনন্দন করিলে যুধিষ্ঠির প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন―

 মহারাজ। আপনি যে শত্রুহস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছেন, ইহাই আমাদের পরম পরিতোষের বিষয়। এক্ষণে দূতগণ নগরে গমন করিয়া সুহৃদ্গণকে প্রিয়সংবাদ প্রদান ও আপনার বিজয় ঘোষণা করুক।

 এদিকে রাজা নগরে প্রত্যাগত হইবার পুর্ব্বেই দুর্য্যোধন, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ প্রভৃতি কৌরবসেনা-সমভিব্যাহারে উপস্থিত হইয়া বিরাটনগরী পরিবৃত করিলেন এবং গোপগণকে প্রহার করিয়া ষষ্টিসহস্র গোধন অধিকার করিলেন। গো লইয়া ইঁহাদিগকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া গোপাধ্যক্ষ ভয়ব্যাকুলচিত্তে রাজভবনে উপস্থিত হইয়া রাজপুত্র উত্তরকে নিবেদন করিল―

 কৌরবগণ বলপূর্ব্বক আপনাদের ষষ্টিসহস্র গো অপহরণ করিতেছেন; অতএব সে সম্বন্ধে যাহা কর্ত্তব্য হয়, অনুষ্ঠান করুন। মহারাজ আপনার উপর সমুদয় ভার সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন; অতএব আপনি স্বয়ং শত্রু পরাজয়ে যত্নবান্ হউন।

 উত্তর স্ত্রী-সমাজের মধ্যে এরূপে অভিহিত হইয়া আত্মশ্লাঘা সহকারে কহিতে লাগিলেন—

 আমি যদি একজন উপযুক্ত সারথি প্রাপ্ত হই, তবে অনায়াসে সংগ্রামে গমনপূর্ব্বক শত্রুসংহারে প্রবৃত্ত হইতে পারি এবং কৌরবগণও অদ্যই আমার বলবীর্য্য প্রত্যক্ষ করিতে পারে।

 অর্জ্জুন রাজপুত্রের এই কথা শুনিয়া নির্জনে দ্রৌপদীকে কহিলেন―

 প্রিয়ে! তুমি রাজপুত্র উত্তরকে বল যে, বৃহন্নলা এক সময়ে পাণ্ডবগণের সারথ্য গ্রহণ করিয়া মহাযুদ্ধে কৃতকার্য্য হইয়াছিল; অতএব উহাকে সারথি করিয়া আপনি অনায়াসে যুদ্ধে গমন করিতে পারেন।

 অর্জ্জুনের বাক্য অনুসারে দ্রৌপদী রাজপুত্রের নিকট গমনপূর্ব্বক সলজ্জভাবে ধীরে ধীরে কহিতে লাগিলেন—

 এই মহাকায় বৃহন্নলা এক সময়ে মহাবীর ধনঞ্জয়ের সারথি ছিলেন। উনি অর্জ্জুনেরই শিষ্য এবং ধনুর্বিদ্যায় সেই মহাত্মা অপেক্ষা ন্যূন নহেন; আমি পাণ্ডবগৃহে বাসকালে এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছিলাম।

 আপনার ভগিনী উত্তরা বৃহন্নলাকে বলিলে তিনি নিশ্চয়ই রাজকুমারীর কথা রক্ষা করিবেন।

 অনন্তর উত্তরের আদেশক্রমে তাঁহার ভগিনী অর্জ্জুনকে লইয়া রাজকুমারের সমীপে উপস্থিত হইলেন।

 উত্তর তাঁহাকে দেখিবামাত্র দূর হইতে বলিতে লাগিলেন―

 শুনিলাম তুমি পুর্ব্বে অর্জ্জুনের সারথ্য করিয়াছ; অতএব এক্ষণে আমার সারথি হইয়া আমাকে কৌরবদের নিকট লইয়া চল।

 অর্জ্জুন পরিহাসচ্ছলে বলিলেন—

 সারথ্য কর্ম্ম কি আমার সাজে? আমাকে বরং গীত বাদ্য বা নৃত্য করিতে বলিলে তাহা অনায়াসে সম্পাদন করিতে পারি।

 অনন্তর কবচ বিপর্য্যস্তভাবে অঙ্গে ধারণ করিয়া এবং অনভ্যস্তের ন্যায় নানাবিধ অঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া তিনি মহিলাগণের কৌতুক উৎপাদন করিতে লাগিলেন। রাজকুমার স্বয়ং তাঁহাকে বর্ম্ম কবচাদিদ্বারা সুসজ্জিত করিয়া সারথ্যপদে বরণ করিলেন। উত্তরা প্রভৃতি কন্যাগণ বলিলেন―

 হে বৃহন্নলে! ভীষ্ম-দ্রোণাদিকে পরাজয় করিয়া তাঁহাদের রুচির বসন আমাদের পুত্তলিকার নিমিত্ত আনয়ন করিও।

 অর্জ্জুন সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন—

 রাজকুমার যদি কৌরবগণকে পরাজয় করেন, অমি অবশ্য তাঁহাদের বিচিত্র উত্তরীয়সকল আনয়ন করিব।

 এই কথা বলিয়া অর্জ্জুন রথারােহণপূর্ব্বক রাজকুমারকে কোরবসৈন্যাভিমুখে লইয়া চলিলেন। উত্তর অকুতােভয়ে বলিতে লাগিলেন—

 হে বৃহন্নলে! সত্বর কৌরবগণের সমীপে রথ উপনীত কর। আমি সেই দুরাত্মাদিগকে উপযুক্ত শাস্তি দিব।

 এই কথা শ্রবণে অর্জ্জুন অতি দ্রুতবেগে অশ্বচালনা করিয়া শ্মশান সমীপস্থ সেই সমীবৃক্ষের নিকট উপস্থিত হইলেন। সেস্থান হইতে সাগরোপম কৌরববল দৃষ্ট হইতে লাগিল। তখন রাজকুমার শ্রেষ্ঠ মহারথ-রক্ষিত সেই বিপুল কুরুসৈন্য অবলােকন করিয়া রােমাঞ্চিত কলেবরে ভয়াদ্বিগ্নচিত্তে বলিতে লাগিলেন—

 হে সারথে! ইহাদের সহিত আমি একাকী কি প্রকারে যুদ্ধ করিব? এই বীর-পরিরক্ষিত সৈন্যদল স্বয়ং দেবগণেরও অজেয় বলিয়া বোধ হয়। যুদ্ধ করা দূরে থাক্‌, ইহাদিগকে দেখিয়াই আমার অন্তঃকরণ নিরুৎসাহ ও শরীর অবসন্ন হইতেছে। পিতা আমাকে শূন্য গৃহে রাখিয়া সমগ্র সৈন্যসামন্ত লইয়া প্রস্থান করিয়াছেন, আমি একাকী এক্ষণে কি করিব?

 অর্জ্জুন তাঁহাকে সাহসপ্রদানার্থে কহিলেন—

 হে কুমার! এক্ষণে কাতর হইয়া শত্রুগণের হর্ষবর্দ্ধন করিও না। উহারা কি করিয়াছে যে, তুমি ইতিমধ্যেই ভীত হইতেছ! তুমি যাত্রাকালে সকলের সমক্ষে যেরূপ গর্ব্ব করিলে তাহার পর গো লইয়া না ফিরিলে স্ত্রী পুরুষ সকলেই উপহাস করিবে। সৈরিন্ধ্রী সকলের সমক্ষে আমার সারথ্যের প্রশংসা করিলেন, আমাকেও উপহাসাস্পদ হইতে হইবে; অতএব কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ না করিয়া কিরূপে ক্ষান্ত হইব?

 উত্তর কহিলেন―কৌরবগণ আমাদের যথাসর্ব্বস্ব হরণই করুক, লােকে উপহাসই করুক, কিম্বা পিতা তিরস্কারই করুন, আমি কিছুতেই যুদ্ধ করিতে পারিব না।

 এই কথা বলিয়া রাজকুমার ধনুর্ব্বাণ ত্যাগ করিয়া রথ হইতে লক্ষপ্রদানপূর্ব্বক পলায়নে উদ্যত হইলেন।

 অর্জ্জুন তখন বলিলেন—

 হে রাজকুমার! যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হওয়া ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম নহে। ভীত হইয়া পলায়ন অপেক্ষা সমরে মরণও শ্রেয়স্কর।

 বাক্য বিফল দেখিয়া ধনঞ্জয় রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক উত্তরের পশ্চাতে ধাবমান হইলেন। তাঁহার গতিবেগে সুদীর্ঘ বেণী আলুলায়িত এবং বসন শিথিল ও বিধুয়মান হইতে লাগিল।

 এই অদ্ভুত দৃশ্য অবলােকনে অরস্থিত কুরুসেনাগণ হাস্য করিতে লাগিল। অর্জ্জুনের অঙ্গসৌষ্ঠব কেহ কেহ পরিচিতবৎ বােধ করিয়া এই স্ত্রী-বেশধারী ব্যক্তি কে হইতে পারে ইহা লইয়া নানাপ্রকার বিতর্ক করিতে লাগিল।

 এদিকে অর্জ্জুন শতপদমাত্র গমন করিয়া পলায়মান রাজপুত্রের কেশধারণপূর্ব্বক তাঁহাকে সবলে রথে আরােপিত করিলেন। উত্তর কাতরস্বরে অনুনয় করিলেন―

 হে বৃহন্নলে! তুমি শীঘ্র রথ প্রতিনিবৃত্ত কর। আমি তােমাকে বহু ধন প্রদান করিব।

 তখন রাজকুমারকে ভয়ে মূর্ছিতপ্রায় দেখিয়া অর্জ্জুন তাহাকে সহাস্যবদনে কহিলেন—

 হে বীর! তােমার যদি যুদ্ধ করিতে উৎসাহ না হয়, তবে তুমি সারথি হইয়া রথ-চালনা কর। তােমার কিছুমাত্র শঙ্কা নাই, আমি স্বীয় বাহুবলে তােমাকে রক্ষা করিব।

 উত্তর এই কথায় কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া রথ-চালনায় প্রবৃত্ত হইলেন। ছদ্মবেশী অর্জ্জুনকে রথারােহণ করিতে দেখিয়া ভীষ্ম-দ্রোণাদি মহারথিগণের তাঁহার প্রকৃতপরিচয়সম্বন্ধে আর সংশয় রহিল না। এদিকে নানাবিধ দুর্নিমিত্তও দৃষ্ট হইতে লাগিল। তখন ভীষ্মকে দ্রোণ বলিতে লাগিলেন―

 আজ দেখিতেছি পার্থের হস্তে আমাদিগকে পরাজিত হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে এমন কেহই নাই, যে তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে পারে। তাহাতে কর্ণ কহিলেন—

 হে আচার্য্য। আপনি সর্ব্বদাই অর্জ্জুনের প্রশংসা এবং আমাদের নিন্দা করিয়া থাকেন, কিন্তু আমি ও দুর্য্যোধন একত্র হইলে অর্জ্জুনের কি সাধ্য আমাদের পরাজয় করে!

 দুর্য্যোধন এই কথায় প্রীত হইয়া কহিলেন—

 হে কর্ণ! যদি এই স্ত্রীবেশধারী বাস্তবিকই অর্জ্জুন হয়, তবে তাে বিনা যুদ্ধেই আমাদের মনােরথ পূর্ণ হইবে; কারণ প্রতিজ্ঞাত ত্রয়ােদশ বর্ষ শেষ হইবার পূর্ব্বে আমরা তাঁহার পরিচয় পাইলে পাণ্ডবগণকে পুনরায় দ্বাদশ বৎসর বনবাসে গমন করিতে হইবে। আর অন্যকেহ যদি এই অদ্ভুত বেশ ধারণ করিয়া আসিয়া থাকে, তবে আমি নিশ্চয়ই উহাকে সংহার করিব।

 এদিকে অর্জ্জুন উত্তরকে সেই সমীবৃক্ষের নিকট গমন করিতে বলিয়া কহিলেন―

 হে রাজকুমার! তোমার এই ধনুঃশর অতি অসার, যুদ্ধকালে আমার বাহুবেগ সহ্য করিতে পারিবে না। এই বৃক্ষে পাণ্ডবগণ তাঁহাদের অস্ত্রসকল রক্ষা করিয়াছেন, তুমি ইহাতে আরােহণপূর্ব্বক সেগুলি আমাকে প্রদান কর। সকল অস্ত্র আমার উপযুক্ত হইবে।

 অর্জ্জুনের নির্দ্দেশক্রমে উত্তর সমীবৃক্ষে আরোহণ করিলেন এবং অস্ত্রশস্ত্র ভূতলে অবতারিত করিয়া বন্ধন ও আচ্ছাদন মােচনপূর্ব্বক একে একে কার্ম্মুকাদি বাহির করিতে লাগিলেন।

 তখন অর্জ্জুন উত্তরকে নিজের এবং অন্য পাণ্ডবগণের প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিলেন। বিরাটতনয় চমৎকৃত হইয়া অর্জ্জুনকে সবিনয়ে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে মহাবাহো! আজ আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনার দর্শন লাভ করিলাম। আমি যদি অজ্ঞতাপ্রযুক্ত ইতিপূর্ব্বে কোন অযথা কথা বলিয়া থাকি, তবে আমাকে মার্জ্জনা করিবেন। আজ্ঞা করুন, কোনদিকে গমন করিতে হইবে।

 অর্জ্জুন কহিলেন―হে রাজকুমার! অমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি। তুমি অবিচলিতচিত্তে শত্রুমধ্যে অশ্বচালনা করিও।

 এই বলিয়া অর্জ্জুন স্ত্রীবেশ পরিহারপূর্ব্বক সেই আয়ুধের সঙ্গে রক্ষিত বর্ম্ম ধারণ ও শুক্লবসনে কেশ আচ্ছাদন করিলেন; পরে অস্ত্রসমুদয় ও গাণ্ডীব গ্রহণ করিয়া অতি ভীষণ ধনুষ্টঙ্কার ও লােমহর্ষণ শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে কৌরবদের দিকে রথচালনা করিতে বলিলেন। তখন দ্রোণাচার্য্য কহিতে লাগিলেন—

 হে কৌরবগণ! যখন ইঁহার রথনির্ঘোষে বসুমতী বিকম্পিত হইতেছে, তখন ইনি নিশ্চয়ই অর্জ্জুন হইবেন।

 দুর্য্যোধনও কিঞ্চিৎ শঙ্কিত হইয়া কহিতে লাগিলেন—

 পাণ্ডবগণ নির্দ্ধারিত ত্রয়ােদশ বৎসর উত্তীর্ণ হইয়াছেন কি না, তা নিঃসংশয়রূপে জ্ঞাত হওয়া কর্ত্তব্য। কিয়দ্দিন অবশিষ্ট আছে বলিয়া সকলের ধারণা ছিল, কিন্তু আমার এক্ষণে সন্দেহ হইতেছে। স্বার্থচিন্তার সময়ে লোকের ভ্রমে পতিত হওয়া বিচিত্র নহে। তবে পিতামহ গণনাদ্বারা প্রকৃত অবস্থা জ্ঞাত হইতে পারেন। কিন্তু সে যাহাহউক আমি ত ভীত হইবার কোনো কারণ দেখিতেছি না। এ ব্যক্তি কোন মৎস্যবীরই হউক বা মৎস্যরাজই হউক বা স্বয়ং ধনঞ্জয়ই হউক যুদ্ধ করিতেই হইবে, ইহা আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম।

 সকলে সজ্জিত হইয়া অর্জ্জুনের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন, এমন সময়ে দ্রোণাচার্য্য বহু কাল পরে প্রিয় শিষ্যের দর্শনলাভে সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিতে লাগিলেন—

 ঐ শুন মহাস্বন গাণ্ডীব-টঙ্কার শ্রুত হইতেছে। এই দেখ দুইটি শর আমার পদতলে পতিত হইল এবং অপর দুইটি আমার কর্ণ স্পর্শ করিয়া অতিক্রান্ত হইল। ইহাদ্বারা মহাবীর অর্জ্জুন আমার পাদবন্দন ও কুশল প্রশ্ন করিতেছেন।

 অনন্তর নিকটবর্ত্তী হইয়া অর্জ্জুন রাজকুমার উত্তরকে কহিলেন—

 হে সারথে! তুমি অশ্বের রশ্মি সংযত কর! এই সৈন্যমণ্ডলীর মধ্যে কুরুকুলাধম দুর্য্যোধন কোথায় আছে দেখি। অন্য কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিবার কোনো প্রয়োজন নাই, দুর্য্যোধন পরাজিত হইলেই সকলে পরাজিত হইবে। কিন্তু তাহাকে ত ইহার মধ্যে কোথাও দেখতে পাইতেছি না। ঐ যে দূরে সৈন্যপদধূলি উড্ডীন হইতেছে, সে দুরাত্মা নিশ্চয়ই উহাদের সহিত পলায়ন করিতেছে; অতএব এই সকল মহারথকে পরিত্যাগ করিয়া ঐ দিকে সত্বর রথ চালনা কর।

 উত্তর পরম যত্ন সহকারে রশ্মিসংযমদ্বারা যে দিকে রাজা দুর্য্যোধন গমন করিতেছিলেন, সেই দিকে অশ্বচালনা করিলেন। কৌরবগণ তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া অর্জ্জুনকে নিবারণ করিবার উদ্দেশ্যে ধাবমান হইলেন। তখন অর্জ্জুন শরজালে সৈন্যগণকে অত্যন্ত ব্যথিত করিয়া প্রথমত ধেনু—সকলকে গৃহাভিমুখে প্রতিনিবৃত্ত করইলেন। পরে পুনরায় দুর্য্যোধনকে আক্রমণ করিবার অবসর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। সময় বুঝিয়া উত্তরকে সম্বোধনপূর্ব্বক তিনি কহিলেন—

 হে রাজপুত্র! সত্বর এই পথে রথ চালনা কর, তাহা হইলে ব্যূহ-মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে পারিবে। ঐ দেখ, সূতপুত্র মত্তমাতঙ্গের ন্যায় আমার সহিত যুদ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছে; অতএব উহার প্রতি প্রথমে অগ্রসর হও।

 ধিরতনয় তাহাই করিলে কর্ণ অর্জ্জুনের উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। অর্জ্জুন রুষ্ট হইয়া প্রথমত বিকর্ণকে রথ হইতে পাতিত করিলেন, পরে অধিরথপুত্র কর্ণের ভ্রাতাকে সংহার করিলেন। তখন ক্রোধভরে কর্ণ সম্মুখীন হইয়া দ্বৈরথ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। অন্যান্য কৌরবগণ স্তম্ভিত হইয়া এই ভীষণ ব্যাপার অবলোকন করিতে লাগিলেন।

 প্রথমে যখন কর্ণ অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত বাণসমূহ মধ্যপথেই সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত করিয়া তাঁহার অশ্বগণকে বিদ্ধ করিলেন, তখন তাঁহারা মহা আনন্দে করতালি প্রদান ও শঙ্খ ভেরী প্রভৃতি বাদনদ্বারা কর্ণের প্রশংসা আরম্ভ করিলেন। তাহাতে মহাবীর ধনঞ্জয় সুপ্তোত্থিত সিংহের ন্যায় ক্রোধান্বিত হইয়া শরনিকরদ্বারা কর্ণের রথ আচ্ছাদন করিয়া নিশিত ভল্ল নিক্ষেপপুর্ব্বক তাঁহার গাত্র বিদ্ধ করিলেন। পরে বিবিধ সুশাণিত অস্ত্রদ্বারা সূতপুত্রের বাহু শির উরু ললাট ও গ্রীবাদেশ ভেদ করিলে কর্ণ মূর্চ্ছিত প্রায় হইয়া রণক্ষেত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিলেন।

 অনন্তর বিরাটনন্দন পার্থের আদেশানুসারে দ্রোণাচার্য্যের প্রতি রথচালনা করিলেন। তুল্যবীর গুরুশিষ্যের সঙ্ঘটনে সকলে বিস্মিত হইয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিল এবং সৈন্যদল হইতে মহা শঙ্খধ্বনি উত্থিত হইল। অর্জ্জুন প্রথম গুরুদর্শনে মহানন্দসহকারে তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক বিনয় বাক্যে কহিলেন—

 হে সমরদুর্জ্জয়! আমরা বনবাসজনিত বহুকষ্ট ভােগ করিয়া এক্ষণে কৌরবগণের শত্রুপক্ষের মধ্যে গণ্য হইয়াছি; অতএব আমাদের প্রতি রুষ্ট হইবেন না। আপনি প্রথমে প্রহার না করিলে আমি আপনার সহিত যুদ্ধ করিতে পারিব না, অতএব আপনি প্রথমে বাণত্যাগ করুন।

 অনন্তর দ্রোণ অর্জ্জুনের প্রতি বাণত্যাগ করিলে অর্জ্জুন পথেই তাহা খণ্ডখণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন দ্রোণার্জ্জুনের সমরকৃত্য আরম্ভ হইল। উভয়েই মহারথী, উভয়েই দিব্যাস্ত্রবিশারদ, সকলে স্তম্ভিত হইয়া তাঁহাদের অদ্ভুত কর্ম্ম দর্শন করিতে লাগিল।

 কৌরবগণ বলিলেন—অর্জ্জুনব্যতীত কেহই আচার্য্যের সমকক্ষ হইতে পারিত না, ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম কি ভয়ানক যে, পার্থকে গুরুর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইল।

 এদিকে বীরদ্বয় সম্মুখবর্ত্তী হইয়া পরস্পরকে শরজালে সমাবৃত ও ক্ষত বিক্ষত করিতে লাগিলেন। দ্রোণাচার্য্য অর্জ্জুনের অভ্রান্ততা লঘুহস্ততা ও দূরপাতিতা অবলােকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। অনন্তর সব্যসাচী ক্রমেই উত্তপ্ত হইয়া দুই হস্তে এতবেগে বাণবর্ষণ আরম্ভ করিলেন যে, কখন্ শরগ্রহণ করিতেছেন, কখন্ নিক্ষেপ করিতেছেন, তাহা কাহারও দৃষ্টিগোচর হইল না। সৈন্যগণ আচার্য্যকে অর্জ্জুন-বাণে একান্ত সমাচ্ছন্ন দেখিয়া হাহাকার করিতে লাগিল। তখন অশ্বত্থামা সহসা অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহার মনােযোগ বিক্ষিপ্ত করিয়া দ্রোণাচার্যকে প্রস্থান করিবার অবসর প্রদান করিলেন।

 ইতিমধ্যে কর্ণ কথঞ্চিৎ বিশ্রান্ত হইয়া পুনরায় সমরক্ষেত্রে আগত হইলেন।

 জয়শীল অর্জ্জুন তাঁহার প্রতি বর্ম্মভেদী বাণবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। তিনি প্রথমত শরাঘাতে কর্ণের তূণীররজ্জু ছেদন করিলেন। তখন কর্ণ অপর তূণ হইতে বাণগ্রহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের হস্তবিদ্ধ করিলে ক্ষণকালের নিমিত্ত তাঁহার মুষ্টি শিথিল হইল। পরে ক্রুদ্ধ হইয়া তিনি কর্ণের শরাসন ছেদন করিলেন এবং তৎক্ষিপ্ত অন্যান্য অস্ত্রসমুদায় নিবারণ করিলেন। কর্ণকে এইরূপে অস্ত্রহীন করিয়া সৈন্যদল আগত হইবার পূর্ব্বেই অর্জ্জুন তাঁহার অশ্ব বিনষ্ট করিয়া বক্ষঃস্থলে সুতীক্ষ্ণ বাণ বিদ্ধ করিলেন। তাহাতে কর্ণ পুনরায় বিকলেন্দ্রিয় হইয়া ধরাতলে পতিত ও বিচেতন হইলেন এবং ক্ষণকালপরে সংজ্ঞালাভপুর্ব্বক বেদনায় অধীর হইয়া রণক্ষেত্র ত্যাগ করিলেন।

 অনন্তর পুর্ব্বপরাজিত যোদ্ধৃগণ বারবার সমরক্ষেত্রে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া কখনও পৃথক্ পৃথক্‌, কখনও ধর্ম্মযুদ্ধ পরিত্যাগপূর্ব্বক দলবদ্ধ হইয়া অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন এক সম্মােহন বাণ গাণ্ডীবে সংযােগ করিয়া প্রচণ্ড নির্ঘোষে তাহা পরিত্যাগ করিবামাত্র কৌরবগণ সকলে সংজ্ঞাশূন্য হইয়া ধরাতলশায়ী হইলেন।

 এই সময়ে রাজকুমারী উত্তরার বাক্য অর্জ্জুনের স্মৃতিপথে উদয় হওয়ায় তিনি বিরাটনন্দনকে বলিলেন—

 হে উত্তর! কৌরবগণ এখন চেতনাশূন্য হইয়া পড়িয়া রহিয়াছেন, এই অবসরে তুমি রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক উহাদের উত্তরীয় বসনসকল রাজকুমারীর নিমিত্ত আহরণ কর। তবে সাবধান! ভীষ্ম এই সম্মোহন অস্ত্রের প্রতিঘাত-কৌশল অবগত আছেন; অতএব তাঁহার অশ্বগণের অন্তরালে সতর্কতার সহিত গমন করিও।

 অনন্তর উত্তর নিশ্চেষ্ট বীরগণের মধ্যে বিচরণ করিয়া দ্রোণ ও কৃপের শুক্ল বসনদ্বয় কর্ণের পীতবস্ত্র অশ্বত্থামা ও দুর্য্যোধনের নীল উত্তরীয়দ্বয় গ্রহণ করিয়া পুনরায় রথারোহণ ও বল্গাধারণ করিয়া ধেনুগণের পশ্চাতে নগরাভিমুখে চলিলেন। ইতিমধ্যে কুরুবীরগণ ক্রমে ক্রমে সংজ্ঞালাভ করিলেন। অর্জ্জুনকে গো ধন লইয়া ধীর নিশ্চিন্ত গতিতে প্রস্থান করিতে দেখিয়া দুর্য্যোধন অতিমাত্র ব্যগ্রতা সহকারে কহিলেন—

 হে যোদ্ধৃগণ! তোমরা কি নিমিত অর্জ্জুনকে পরিত্যাগ করিয়াছ? উহাকে এরূপ আহত কর যে, আর স্বস্থানে না ফিরিতে পারে!

 তখন ভীষ্ম হাস্যবদনে কহিলেন—

 হে দুর্য্যোধন! এতক্ষণ তােমার বলবুদ্ধি কোথায় প্রস্থান করিয়াছিল? তোমরা যখন সকলে হতচেতন হইয়া পড়িয়াছিলে, তখন মহাবীর পার্থ কোন নৃশংস কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন নাই। ত্রৈলােক্যলাভার্থেও তিনি ধর্ম্ম পরিত্যাগ করেন না। এই নিমিত্তই এই সমরে তোমরা সকলে নিহত হও নাই। এক্ষণে আর আস্ফালন শোভা পায় না। অর্জ্জুন গােধন লইয়া প্রস্থান করুন। তোমরা এক্ষণে প্রাণ লইয়া হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছ, তাহাই পরম সৌভাগ্য।

 পিতামহের এই যথার্থ কথা শ্রবণ দুর্য্যোধন দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক আর দ্বিরুক্তি করলেন না।

 অর্জ্জুন বিরাটনগরে গমনকালে উত্তরকে কহিলেন—

 হে তাত! পাণ্ডবণ যে তোমার পিতার আশ্রয়ে বাস করিতেছেন, একথা তুমিই অবগত হইলে। কিন্তু উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে উহা প্রকাশ হওয়া বিধেয় নহে; অতএব তুমি স্বয়ং যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া গােধন প্রত্যানয়ন করিয়াছ, এইরূপ সকলকে জানাইবে।

 উত্তর কহিলেন—হে বীর! আপনি যে কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছেন, তাহা আমাদ্বারা হইতে পারে বলিয়া কেহ বিশ্বাস করিবে না। যাহা-হৌক আপনার অনুমতি না পাইলে আমি একথা পিতার নিকটও প্রকাশ করিব না।

 অর্জ্জুন কহিলেন—এক্ষণে গোপগণ নগরপ্রবেশ করিয়া তোমার জয়ঘোষণা করুক। আমরা অপরাহ্ণে গমন করিব, কারণ আমাকে পুনরায় বৃহন্নলার বেশ ধারণ করিতে হইবে।

 এদিকে বিরাটরাজ ত্রিগর্ত্তগণকে পরাজয় করিয়া পাণ্ডবদের সহিত হৃষ্টচিত্তে স্বনগরে প্রবেশ করিলেন এবং অনতিবিলম্বে অন্তঃপুরে উপনীত হইলেন। তথায় একাকী উত্তরের কোরবসৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার সংবাদ শ্রবণে সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া তিনি যোদ্ধৃবর্গকে সমগ্র সৈন্যবল লইয়া রাজকুমারের সাহায্যার্থে গমন করিতে আদেশ করিয়া কহিলেন—

 হে সৈন্যগণ! কুমার জীবিত আছে কি না এই সংবাদ ত্বরায় আমার নিকট প্রেরণ করিও। সে স্ত্রীবেশধারী নর্ত্তককে সারথি ও একমাত্র সহায় করিয়া কি আর উদ্ধার পাইয়াছে?

 তখন যুধিষ্ঠির ঈষৎ হাস্যসহকারে কহিলেন—  মহারাজ! বৃহন্নলা যখন রাজকুমারের সারথ্যগ্রহণ করিয়াছেন, তখন আপনার আর চিন্তা নাই। কৌরবগণ গোধন হরণ করিতে সক্ষম হইবেন না।

 এই কথা বলিতে বলিতেই দূতগণ আসিয়া উত্তরের বিজল্প-সংবাদ প্রদান করিল। বিরাটরাজ সাতিশয় হৃষ্টান্তঃকরণে তাহাদিগকে পারিতোষিক প্রদান করিয়া মন্ত্রীকে কহিলেন—

 এক্ষণে রাজপথে পতাকা উড্ডীন কর এবং পুষ্পোপহার দ্বারা দেবগণের অর্চ্চনা করা হৌক। সকলে মত্তবারণে আরােহণ করিয়া চতুর্দ্দিকে সংবাদ প্রচার করুক। উত্তরা কুমারীগণের সহিত উজ্জ্বল বেশ ধারণ করিয়া ভ্রাতার অভ্যর্থনার্থে প্রস্তুত থাকুক।

 এই সকল উৎসবের আয়োজন অনুষ্ঠিত হইতে থাকিলে, মৎস্যরাজ প্রফুল্লমনে দ্রৌপদীকে কহিলেন—

 হে সৈরিন্ধ্রি! এক্ষণে অক্ষ আনয়ন কর, অমি কঙ্কের সহিত দ্যূতক্রীড়া করিব।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন— আনন্দে বা অন্য কোনাে কারণে প্রমত্ত ব্যক্তির সহিত দ্যূতক্রীড়া অনুচিত; অতএব আপনি আমাকে অন্য কোন অভিলষিত বিষয়ে আদেশ করুন।

 বিরাট কহিলেন—হে কঙ্ক! যদি আমার অভিলষিত দ্যূতক্রীড়াই না হইল, তবে অন্য আমোদে আমার প্রয়োজন নাই। দ্যূতক্রীড়ায় সর্ব্বস্ব প্রদান করিয়াও আমার কিছুমাত্র ক্লেশ বােধ হয় না, অতএব তোমার সঙ্কোচের কোন কারণ নাই।

 কঙ্ক কহিলেন—মহারাজ! আপনি শুনিয়া থাকিবেন যে, মহারাজ যুধিষ্ঠির দ্যূতাসক্ত হইয়া রাজ্য হারাইয়াছিলেন। সেই অবধি দ্যূতক্রীড়া আমার নিতান্ত অপ্রীতিকর। যাহাহৌক আপনার যদি একান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, তবে আসুন আমরা ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হই।

 দ্যূতারম্ভ হইলে বিরাট বলিতে লাগিলেন—

 আজ কি সৌভাগ্যের বিষয় যে আমার আত্মজ সমরে সমগ্র কৌরবগণকে পরাজয় করিয়াছে।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—মহারাজ! বৃহন্নলা যাহার সারথি, সংগ্রামে তাহার অবশ্যই জয়লাভ হইবে।

 রাজা এই কথায় কিঞ্চিৎ রুষ্ট হইয়া কহিলেন—

 দেখ কঙ্ক! আমার পুত্র কি নিমিত্ত কৌরবদিগকে পরাস্ত করিতে অসমর্থ হইবে? তুমি কেন বার বার তাহাকে উপেক্ষা করিয়া সামান্য নর্ত্তককে প্রশংসা করিতেছ?

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—মহারাজ! ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ যেখানে সমবেত হইয়াছেন, সেখানে বৃহন্নলা ব্যতীত কেহই জয়লাভে সমর্থ হইতে পারে না। মৎস্যরাজ তখন রোষে অধীর হইয়া কহিলেন—

 অহে কঙ্ক! আমার বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও তুমি বাক্য সংযম করিতেছ না। তুমি বয়স্য বলিয়া তোমাকে এতক্ষণ মার্জ্জনা করিয়াছিলাম, কিন্তু যদি জীবিত থাকিতে অভিলাষ থাকে, তবে আর কদাচ এরূপ কহিও না।

 যুধিষ্ঠিরকে এরূপ ভর্ৎসনা করিতে করিতে বিরাট তাঁহার মুখমণ্ডলে অক্ষনিক্ষেপ করিয়া কঠিন আঘাত করিলেন। তাহাতে ধর্ম্মরাজের নাসিকা হইতে রুধিরধারা নির্গত হইতে লাগিল। সৈরিন্ধ্রী তাহা দেখিয়া বারিপূর্ণ সুবর্ণপাত্র অনিয়া তাঁহার শুশ্রূষা করিলেন।

 ইত্যবসর রাজকুমার ভবনের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলে দ্বারী আসিয়া তাঁহার আগমনসংবাদ প্রদান করিল। মৎস্যরাজ অতিশয় প্রীতমনে কহিলেন—

 হে দ্বারপাল! সত্বর উত্তর ও বৃহন্নলাকে আনয়ন কর। উহাদিগকে অবলোকন করিতে আমি অত্যন্ত ব্যগ্র রহিয়াছি।

 তখন যুধিষ্ঠির একান্তে দ্বারপালের কর্ণকুহরে কহিলেন—

 বৃহন্নলা যেন কিয়ৎক্ষণ পরে আগমন করেন, তিনি আমার অঙ্গে অকারণপাতিত শােণিত সন্দর্শন করিলে মহারাজের আর রক্ষা থাকিবে না।

 অনন্তর উত্তর সভাস্থলে প্রবেশপূর্ব্বক পিতার চরণবন্দন ও কঙ্ককে প্রণাম করিয়া সহসা তাঁহার রক্তাক্ত মুখশ্রী দেখিয়া ব্যগ্রচিত্তে পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—

 হে পিতঃ! কে ইহাকে প্রহার করিল? কোন্ দুঃসাহস এই পাপানুষ্ঠানে সমর্থ হইল?

 বিরাট কহিলেন—বৎস! আমি তােমার বিজয়বার্ত্তা শ্রবণে পরম আহ্লাদিত হইয়া তোমার প্রশংসা করিতেছিলাম, কিন্তু এই ব্রাহ্মণ আমার কথায় অনুমােদন না করিয়া বারংবার বৃহন্নলারই প্রশংসা করিতে লাগিল, এই নিমিত্ত আমিই উহাকে প্রহার করিয়াছি।

 উত্তর কহিলেন—মহারাজ! আপনি অতিশয় অন্যায় কার্য্য করিয়াছেন। শীঘ্র উহাকে প্রসন্ন করুন, নচেৎ ব্রহ্মশাপে বিনষ্ট হইবেন, সন্দেহ নাই।

 তখন বিরাট ধর্ম্মরাজের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলে তিনি কহিলেন—

 মহারাজ! উদ্বিগ্ন হইবেন না। আমি বহুক্ষণ ক্ষমা করিয়াছি। বলবান ব্যক্তি অধীনের প্রতি মাঝে মাঝে অকারণ ক্রোধপরবশ হইয়াই থাকেন

 ইতিমধ্যে যুধিষ্ঠিরের নাসিকানিঃসৃত শোণিত অপনীত হইলে বৃহন্নলআ তথায় প্রবেশ করিয়া সকলকে অভিবাদন করিলেন। রাজা তাঁহকে অভিনন্দন করিয়া তাঁহার সমক্ষেই পুত্রকে প্রশংসা করিয়া কহিতে লাগিলেন—

 বৎস! তােমাদ্বারাই আমি যথার্থ পুত্রবান্ হইলাম। যিনি অহোরাত্র যুদ্ধ করিয়াও ক্লান্ত হন না, তুমি কি প্রকারে সেই মহাবীর কর্ণকে পরাজয় করিলে? যাঁহার সমান যােদ্ধা মনুষ্যলােকে বিদ্যমান নাই, তুমি কি করিয়া সেই কুরুকুলাগ্রগণ্য ভীষ্মের সহিত সংগ্রাম করিলে? সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ যাদব ও কৌরবগুরু আচার্য্য দ্রোণের অস্ত্রকৌশল বা তুমি কি প্রকারে সহ্য করিলে? কি আর বলিব, তুমি হৃত-গােধন প্রত্যাহরণ করিয়া অতি মহৎ কার্য্য সম্পাদন করিয়াছ।

 উত্তর বিনয়নম্র বচনে কহিলেন—

 হে তাত! আমি স্বয়ং এই সকল ভীষণ কর্ম্ম করি, আমার কি সাধ্য? আমি প্রথমত ভীত হইয়া পলায়ন করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম, এমন সময় এক দেবকুমার আসিয়া আমাকে অভয়প্রদানপূর্ব্বক কুরুগণকে পরাজয় ও গােধন উদ্ধার করিলেন।

 পুত্রের বাক্য শ্রবণান্তর বিরাট বিস্মিত হইয়া কহিলেন—

 বৎস! যে মহাপুরুষ আমাদের এই মহান্ উপকার সাধন করিলেন, তিনি এক্ষণে কোথায়?

 উত্তর কহিলেন—হে পিতঃ। তিনি সেই সময়েই অন্তর্হিত হইয়াছেন, কল্য কি পরশ্ব আবির্ভূত হইবেন।

 অনন্তর মহারাজের অনুমতিক্রমে অর্জ্জুন অন্তঃপুরে গমনপূর্ব্বক স্বয়ং রাজকুমারীকে অপহৃত উত্তরীয় বস্ত্রসমুদয় প্রদান করিলেন। উত্তরা পুত্তলিকার নিমিত্ত মহামূল্য বসন লাভ করিয়া অতিশয় প্রীত হইলেন।

 অনন্তর পাণ্ডবগণ বিরাটপুত্রের সহিত নির্জ্জনে মিলিত হইয়া আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত সময়সম্বন্ধে মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন।