কুরু পাণ্ডব/৭

উইকিসংকলন থেকে

 প্রতিজ্ঞামুক্ত পাণ্ডবগণ বিরাট রাজের নিকট আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত সময় স্থির করিয়া নিদ্দিষ্ট দিবসে স্নানানন্তর শুক্লবসন ও নানাবিধ আভরণে ভূষিত হইয়া রাজসভায় প্রবেশপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজকে বিরাটের সিংহাসনে উপবেশন করাইয়া তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া রহিলেন। দ্রৌপদীও সৈরিন্ধ্রীবেশ পরিত্যাগ করিয়া তথায় উপস্থিত রহিলেন।

 অনন্তর রাজকার্য্যারম্ভের সময় উপস্থিত হইলে বিরাট- রাজ সভায় সমাগত হইলেন এবং পাণ্ডবগণের অভিনব আচরণে প্রথমত বিস্মিত ও ক্রোধাবিষ্ট হইলেন, কিন্তু তৎপরে ইহার মধ্যে কোন নিগূঢ় রহস্য আছে বিবেচনা করিয়া মুহূর্ত্তকাল চিন্তার পর বলিলেন—

 হে কঙ্ক! আমি তােমাকে দ্যূত সভাসদ্‌রূপে বরণ করিয়াছিলাম, তুমি এক্ষণে কি নিমিত্ত রাজবৎ অলঙ্কৃত হইয়া আমার সিংহাসন অধিকার করিলে?

 অর্জ্জুন সহাস্যবদনে তাঁহাকে উত্তর করিলেন—

 হে রাজন! এই মহাতেজা দেবগণের অর্দ্ধাসনে আরোহণ করিবার উপযুক্ত। ইহাঁর কীর্ত্তি সমূদিত সূর্য্যপ্রভার ন্যায় চতুর্দ্দিক উদ্ভাসিত করিয়াছে। ইনি কুরুবংশাবতংস ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, অতএব কি নিমিত্ত ইনি আপনার সিংহাসনের যোগ্য নহেন?

 মৎস্যরাজ পরম আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া কহিলেন—

 যদি ইনিই রাজা যুধিষ্ঠির হন, তবে ইহাঁর অবশিষ্ট ভ্রাতৃগণ এবং সহধর্ম্মিণী দ্রোপদী কোথায়?

 অর্জ্জুন কহিলেন—হে নরাধিপ! যিনি আপনার সুপকারের কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া বল্লভ নামে পরিচয় দিয়াছেন, তিনিই ভীমপরাক্রম ভীমসেন। আপনার অশ্বপাল গােপাল দুইজনে কান্তিমান্ মাদ্রীপুত্র নকুল-সহদেব। এই অলোকসামান্য-রূপসম্পন্না পতিপরায়ণা সৈরিন্ধ্রীই দ্রুপদনন্দিনী। আর আমি ভীমসেনের অনুজ অর্জ্জুন। আমার সবিশেষ বৃত্তান্ত আপনি শ্রুভ হইয়া থাকিবেন। হে রাজন্। আমরা পরম সুখে সম্বৎসরকাল আপনার রাজ্যে গর্ভস্থিতের ন্যায় অজ্ঞাতবাস করিয়াছি।

 বিরাট-তনয় এই অবসর এত দিনের রুদ্ধ কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করিয়া কহিলেন—

 হে তাত! এই মহাবাহু ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য অর্জ্জুনই মৃগকুলসংহারকারী কেশরীর ন্যায় অরাতিগণকে নিপাতিত করিয়াছিলেন।

 বিরাটরাজ এই কথা শুনিয়া প্রফুল্লবদনে প্রথমে রাজা যুধিষ্ঠিরের সমীপবর্ত্তী হইয়া তাঁহাকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনার্থে যথাবিধি দণ্ড কোষ ও নগরসমেত সমস্ত রাজ্য প্রদানপূর্ব্বক অর্চ্চনা করিলেন এবং—কি সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য!—বলিয়া অন্য পাণ্ডবগণের মস্তকাঘ্রাণপুর্ব্বক তাঁহাদিগকে আলিঙ্গন করলেন। পরে তিনি পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন—

 হে মহাভাগ! ভাগ্যক্রমে তোমরা অরণ্য হইতে নিষ্ক্রমণ ও দুরাত্মাদের অজ্ঞাতসারে বাস করিয়া প্রতিজ্ঞামুক্ত হইয়াছ। এক্ষণে আমার রাজ্যের যাহা কিছু সম্পত্তি তাহা তোমাদেরই অধিকারে রহিল। মহাবীর ধনঞ্জয় আমার কন্যার উপযুক্ত পাত্র, অতএব তিনি উত্তরার পাণিগ্রহণ করুন।

 অর্জ্জুনের অভিপ্রায় জানিবার নিমিত্ত যুধিষ্ঠির তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র তিনি বিরাটরাজকে কহিলেন—

 হে রাজন! আমি আপনার অন্তঃপুরে বাসকালে রাজকুমারীর গুরুস্বরূপ ছিলাম। তিনিও আমাকে পিতার ন্যায় মান্য করিতেন, অতএব যদি অনুমতি করেন, তবে আমি উত্তরাকে আমার পুত্র অভিমন্যুর নিমিত্ত বধূরূপে গ্রহণ করি।

 অর্জ্জুনের বাক্যে প্রীত হইয়া বিরাটরাজ কহিলেন—

 হে কৌন্তেয়! তুমি একান্ত ধর্ম্মপরায়ণ। স্বয়ং উত্তরার পাণিগ্রহণ করতে অস্বীকার করা তােমার উপযুক্তই হইয়াছে। এক্ষণে কালবিলম্ব না করিয়া অভিমন্যুর সহিত বিবাহের উদ্যোগসম্বন্ধে যাহা কর্ত্তব্য, তাহার অনুষ্ঠান করা যাক।

 অনন্তর এ বিষয়ের সংবাদ দিয়া এবং নিমন্ত্রণ জ্ঞাপন করিয়া প্রথমত বাসুদেবের নিকট পরে অন্যান্য মিত্রণের রাজ্যে দূতপ্রেরণ করা হইল। পাণ্ডবগণ সময়পালনান্তে মুক্তিলাভ করিয়াছেন এই সংবাদ প্রচার হওয়ায় মিত্র ভূপতিগণ সসৈন্যে দলে দলে আগমন করিতে লাগিলেন।

 প্রথমে যুধিষ্ঠিরের পরম প্রিয়পাত্র কাশীরাজ ও শিবিরাজ এক এক অক্ষৌহিণী সেনা লইয়া বিরাটনগরে সমাগত হইলেন। পরে মহাবল দ্রুপদ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র-সমভিব্যাহারে এক অক্ষৌহিণী সেনা লইয়া উপস্থিত হইলেন।

 বিরাটরাজ অর্জ্জুনপুত্র অভিমন্যুর ন্যায় সৎপাত্রলাভে পরম আহ্লাদিত হইয়া দিগ্দেশাগত নৃপতিগণকে পরম সমাদর অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন।

 বিবাহ-উৎসবের আমোদ-প্রমোদ সকল পরিসমাপ্ত হইলে পাণ্ডবগণ বন্ধু বান্ধবগণের সহিত মন্ত্রণা করিবার উদ্যোগ করিলেন। অবস্থা পর্য্যালােচনাপুর্ব্বক কিংকর্ত্তব্য অবধারণার্থে সকলে বিরাটরাজের সভাগৃহে সমবেত হইলেন।

 অনন্তর বিরাট ও দ্রুপদরাজ উপবিষ্ট হইলে সকলেই নির্দ্দিষ্ট আসন পরিগ্রহ করিলেন।

 প্রথমত পাঞ্চালরাজ স্বীয় প্রজ্ঞাশালী পুরােহিতকে কৌরবগণের নিকট দূতরূপে প্রেরণ করিবার উদ্দেশ্যে আহানপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে দ্বিজসত্তম! ধৃতরাষ্ট্রের জ্ঞাতসারেই দুর্য্যোধনাদি শত্রুগণ সরল হৃদয় পাণ্ডবদিগকে প্রতারণা করিয়াছিল। ধর্ম্মবৎসল বিদুর সে সময়ে বারম্বার অনুনয় করিলেও কেহ তাঁহার কথায় কর্ণপাত করে নাই। সুতরাং উহারা যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ধর্ম্মরাজকে রাজ্যার্দ্ধ প্রত্যর্পণ করিবে, তাহার বড় আশা নাই। তথাপি আপনি ধৃতরাষ্ট্রকে প্রসন্ন করিয়া কুরুপ্রধানগণের মন আবর্ত্তিত করিবার চেষ্টা করিবেন। বিদুর এবিষয়ে নিশ্চয়ই বাক্যদ্বারা আপনার সাহায্য করিবেন। ভীষ্ম দ্রোণাদিকে বিমুখ করিতে পারিলে একাকী দুর্য্যোধন যুদ্ধের অভিলাষ করিবে না। অন্তত তাহা হইলে স্বীয় পক্ষীয় প্রধান যােদ্ধাদিগকে পুনরায় স্ববশে আনিতে দুর্য্যোধনের যে সময় লাগিবে, তাহার মধ্যে আমরা সহায়সংগ্রহের অবসর লাভ করিব।

 নীতিশাস্ত্রবিশারদ পুরোহিত দ্রুপদের নিকট এই উপদেশ প্রাপ্ত হইয়া পাথেয় গ্রহণপূর্ব্বক হস্তিনাপুরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 পুরােহিত গমন করিলে নরপতিগণের সাহায্য প্রার্থনার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে দূত প্রেরিত হইল। অর্জ্জুন কৃষ্ণকে প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত স্বয়ং দ্বারকায় চলিলেন। দুর্য্যোধন গুপ্তচর দ্বারা এই সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইতেছিলেন এবং প্রত্যেক স্থানে তিনিও দূত প্রেরণ করিতেছিলেন; অর্জ্জুনের দ্বারকাযাত্রার সংবাদ পাইবামাত্র তিনিও বায়ুবেগগামী তুরঙ্গম আরােহণে অল্পমাত্র অনুচর লইয়া অতি ত্বরায় তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিত হইলেন।

 দুই জনেই একসঙ্গে দ্বারকানগর সমাগত ও সমকালে রাজভবনে উপস্থিত হইলেন। কৃষ্ণ সে সময়ে নিদ্রিত ছিলেন। দুর্য্যোধন প্রথমে শয়নাগারে প্রবিষ্ট হইয়া বাসুদেবের শিয়রে বসিলেন, পরে অর্জ্জুন গিয়া পদতলের নিকট অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর জনার্দ্দন জাগ্রত হইয়া প্রথমে অর্জ্জুনকে এবং পরে দুর্য্যোধনকে নয়নগােচর করিলেন এবং স্বাগতপ্রশ্নপুর্ব্বক তাঁহাদের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। দুর্য্যোধন সহাস্যবদনে কহিলেন—

 হে যাদবশ্রেষ্ঠ! উপস্থিত যুদ্ধে তােমাকে আমাদের পক্ষ অবলম্বন করিতে হইবে। যদিও আমরা উভয়ই তােমার সহিত তুল্যসম্বন্ধ ও সমান সৌহার্দ্দ্যযুক্ত, তথাপি আমি অগ্রে আগমন করিয়াছি, প্রথমাগতের প্রার্থনা সফল করাই সদাচারসঙ্গত।

 কৃষ্ণ কহিলেন-হে কুরুবীর! তুমি যে অগ্রে আগমন করিয়াছ সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই, কিন্তু পার্থই প্রথমে আমার নয়নপথে পতিত হইয়াছেন, এই নিমিত্ত আমি উভয় পক্ষকেই সাহায্য করিব। আমার সুবিখ্যাত এক অর্ব্বুদ নারায়ণী সেনা আছে, ইহারা একপক্ষের সৈনিকপদ গ্রহণ করুক। অপর পক্ষে আমি একাকী নিরস্ত্র এবং সমপরাঙ্মুখ হইয়া অবস্থান করিব। অর্জ্জুন কনিষ্ঠ, অতএব তিনি প্রথমে এতদুভয়ের মধ্যে একপক্ষ বরণ করুন।

 কৃষ্ণ যুদ্ধে যােগদান করিবেন না শুনিয়াও ধনঞ্জয় হৃষ্টমনে তাঁহাকেই বরণ করিলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন এক অর্ব্বুদ নারায়ণী সেনা প্রাপ্ত হইয়া এবং কৃষ্ণকে সমরপরাঙ্মুখ জানিয়া প্রীতির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন।

 অনন্তর উভয়ে মহাবলশালী বলদেবের নিকট সাহায্য প্রার্থনার জন্য গমন করিলে তিনি বলিলেন―এরূপ কুলক্ষয়কর যুদ্ধে আমি কোন পক্ষেরই সাহায্য করিব না, তােমরা প্রস্থান কর।

 দুর্য্যোধন প্রস্থিত হইলে বাসুদেব অর্জ্জুনকে জিজ্ঞাসা করিলেন—

 হে পার্থ! তুমি আমাকে সমপরাঙ্মুখ জানিয়াও কি নিমিত্ত বরণ করিলে?

 অর্জ্জুন কহিলেন—হে সখে! আমি বলের নিমিত্ত তোমার নিকট আসি নাই, আমি একাকীই ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে বিনষ্ট করিতে সক্ষম। কিন্তু তোমার অদ্বিতীয় নীতি জ্ঞানের সাহায্য এবং চিরসখ্যজনিত মঙ্গলকামনা প্রাপ্ত হইলে আমরা কৃতার্থ হইব। হে বাসুদেব! চিরপ্ররূঢ় এক মনােরথ আছে, তাহাও তােমাকে পূর্ণ করিতে হইবে। এ যুদ্ধে তুমি আমার সারথ্য গ্রহণ কর।

 কৃষ্ণ প্রীত হইয়া তাঁহার অনুরােধ স্বীকার করিয়া কহিলেন—

 হে অর্জ্জুন! তুমি আমার নিকট সকলই যাঞ্চা করিতে পার, তােমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই।

 এদিকে নানা দেশ হইতে ভূপালবৃন্দ প্রভূত সেনাদলসমভিব্যাহারে যুধিষ্ঠিরের পক্ষ অবলম্বন করিবার নিমিত্ত আগত হইতে লাগিলেন। বিবাহ উপলক্ষেই অনেকে উপস্থিত ছিলেন, তদুপরি চেদিপতি ধৃষ্টকেতু এবং বৃষ্ণিপ্রবীর সাত্যকি ও বিরাটরাজের অনুগত রাজগণ বহুতর চতুরঙ্গিণী সেনা লইয়া উপস্থিত হইলে পাণ্ডবপক্ষে সপ্তঅক্ষৌহিণী সৈন্য সংগৃহীত হইল। বিরাটরাজ্যান্তর্গত উপপ্লব্য নগরে বিস্তৃত সেনানিবেশ স্থাপনপূর্ব্বক এই বৃহৎ সৈন্যমণ্ডলী লইয়া পাণ্ডবগণসহ সমবেত রাজন্যবর্গ সুখে সময় প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন

 দুর্য্যোধনের পক্ষে ভগদত্ত, ভূরিশ্রবা ও শল্য, যাদবগণের মধ্যে ভােজরাজ কৃতবর্ম্মা, সিন্ধুদেশাধিপতি জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বিবিধ নরপতিগণ সমাগত হইলে কৌরবগণের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা সংগ্রহ হইল।

 এই সকল বলসঞ্চয় চলিতেছে, এমন সময় পাঞ্চালরাজপুরােহিত ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে উপনীত হইলেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম বিদুরাদি তাহার যথোচিত অর্চ্চনা করিলে সেই ব্রাহ্মণ উপস্থিত কৌরবপ্রধান ও রাজপুরুষগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন—

 হে সভ্যগণ! আপনারা সকলেই সনাতম রাজধর্ম্ম অবগত আছেন, তথাপি উপস্থিত প্রসঙ্গে তার বিশেষ উপযােগিতা আছে বলিয়া আমি সে সম্বন্ধে দুই এক কথা বলিতেছি। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু উভয়ই একজনের সন্তান, সুতরাং পৈতৃক ধনে উভয়েরই সমান অধিকার। তবে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ পাণ্ডবগণকে বঞ্চিত করিয়া সমগ্র সাম্রাজ্য ভােগ করিবেন ইহার অর্থ কি? আপনারা ধর্ম্মের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া পাণ্ডবগণকে স্বীয় অংশ প্রত্যর্পণের বিধান করুন। এখনও শান্তিস্থাপনের কাল অতীত হয় নাই।

 প্রজ্ঞাসম্পন্ন ভীষ্ম ব্রাহ্মণের এই কথা শুনিয়া কহিলেন—

 হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! ভাগ্যবল পাণ্ডবগণ কুশলে আছেন, এবং ভাগ্যবলে তাঁহারা প্রভূত পরিমাণ সৈন্য সংগ্রহ করিয়াও ধর্ম্মপথে নিরত থাকিয়া বান্ধবগণের সহিত সংগ্রামাভিলাষ পরিহারপুর্ব্বক সন্ধির প্রার্থনা করিতেছেন। আপনি যে সমস্ত কথা বলিলেন, তাহা কঠোর হইলেও যথার্থ বটে। পাণ্ডবগণ নির্দ্ধারিত বনবাসন্তে স্বীয় পুর্ব্বাধিকৃত রাজ্যের অধিকারী হইয়াছেন সন্দেহ নাই। অর্জ্জুনের অনুরূপ যোদ্ধাও ত্রিলোকমধ্যে প্রাপ্ত হওয়া যায় না।

 ধৃতরাষ্ট্র তাঁহার বাক্য অনুমােদন করিয়া কহিতে লাগিলেন—

 ভীষ্ম যাহা কহিলেন, তাহা আমাদের শুভকর, পাণ্ডবদের হিতকর এবং সমগ্র ক্ষত্রিয়মণ্ডলীর শ্রেয়স্কর; অতএব আমি তদনুসারে সঞ্জয়কে সন্ধিস্থাপন নিমিত্ত পাণ্ডবদের নিকট প্রেরণ করিব।

 এই বলিয়া ধৃতরাষ্ট্র দ্রুপদ-পুরােহিতকে যথােচিত সৎকারপূর্ব্বক বিদায় করলেন। অনন্তর সঞ্জয়কে সভাস্থলে আহ্বান করিয়া তিনি কহিতে লাগিলেন—

 হে সঞ্জয়। তুমি এক্ষণে উপপ্লব্যনগরে গমনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সমীপে উপস্থিত হইয়া প্রথমত তাঁহাদের কুশল জিজ্ঞাসা করিবে। পাণ্ডবগণ অকপট ও সাধু; তাঁহারা এত দুঃখ সহ্য করিয়াও আমাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হন নাই; তাঁহারা সর্ব্বদাই আত্মমুখ অপেক্ষা ধর্ম্মকে অগ্রে স্থাপন করিয়া থাকেন; এ নিমিত্ত মন্দ বুদ্ধি দুর্য্যোধন এবং ক্ষুদ্রাশয় কর্ণ ব্যতীত তাঁহারা আমাদের সকলেরই প্রীতিভাজন হইয়াছেন; অতএব তুমি এই সকল বুঝিয়া উপযুক্ত বাক্যে যুধিষ্ঠিরের নিকট আমার সন্ধির ইচ্ছা জ্ঞাপন করিবে। হে সঞ্জয়! উভয় পক্ষের যেরূপ বল সংগ্রহ হইয়াছে, তাহাতে আমি বিশেষ ভীত হইয়াছি, সুতরাং তুমি বিবেচনাপূর্ব্বক এমন প্রস্তাব করিবে, যাহাতে আমরা এ ঘাের বিপদাশঙ্কা হইতে উদ্ধার পাইতে পারি।

 সঞ্জয় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায় জ্ঞাত হইয়া তাঁহার আদেশানুসারে মৎস্যদেশাভিমুখে যাত্রা করিলেন।