কুরু পাণ্ডব/৮

উইকিসংকলন থেকে

 মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে পাণ্ডবদিগকে নিরস্ত করিয়া শান্তিস্থাপনের প্রস্তাব করিবার জন্য উপপ্লব্য নগরে উপস্থিত হইয়া সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরকে প্রীতমনে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন—

 আপনার পিতৃব্য রাজা ধৃতরাষ্ট্র আমাকে যে কথা বলিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করুন। বৃদ্ধ রাজার সন্ধিস্থাপনের নিতান্ত ইচ্ছা, অতএব আপনারা সে বিষয়ে অনুমােদন করুন। আপনারা সর্ব্বদাই ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের অপরাধ ক্ষমা করিয়া ক্রোধ পরিহারপূর্ব্বক সুখ অপেক্ষা ধর্ম্মকেই প্রধান করিয়াছেন, অতএব এস্থলে অতি ভীষণ লােকহিংসা নিবারণের উপায় একমাত্র আপনাদেরই আয়ত্তে রহিয়াছে।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—হে সঞ্জয়! আমি কি যুদ্ধাভিলাষসুচক কোন কথা বলিয়াছি যে, তুমি সংগ্রাময়ে এত ভীত হইতেছ? আমরা পূর্ব্বনিগ্রহ ও তজ্জনিত ক্লেশ সমুদয় বিস্মৃত হইয়া আমাদের পুর্ব্বাধিকৃত ইন্দ্রপ্রস্থ গ্রহণ করিয়া শান্তিস্থাপন করিতে প্রস্তুত আছি, একথা ত পুর্ব্বেই বলা হইয়াছে।

 সঞ্জয় কহিলেন—হে ধর্ম্মরাজ। আপনার কল্যাণ হৌক! আমি এক্ষণে চলিলাম। যদি স্বপক্ষসমর্থন করিতে গিয়া কোন অযথাবাক্য প্রয়ােগ করিয়া থাকি, তবে তজ্জন্য আমাকে মার্জ্জনা করিবেন।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন, হে সঞ্জয়! আমার শেষ কথা এই যে, আমাদের পঞ্চভ্রাতাকে পঞ্চগ্রামমাত্র প্রদত্ত হইলেও আমরা রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক সন্ধিস্থাপনে সম্মত আছি।

 অনন্তর সঞ্জয় হস্তিনাপুরে উপস্থিত হইলেন।

 ভীষ্ম দ্রোণ ও সমবেত মিত্র-ভূপতিগণকে অগ্রে করিয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এবং কর্ণ শকুনি ও ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে দুর্য্যোধন বিস্তীর্ণ কনক-চত্বর-শােভিত ও চন্দন-রস-সিক্ত সভাগৃহে প্রবেশ করিলেন। তথায় সকলে দারুময়, প্রস্তরসারময়, দন্তময় ও কাঞ্চনময় বিবিধ নির্দ্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হইলেন।

 অনন্তর কুণ্ডলধারী সঞ্জয় সেই পরিপুর্ণ রাজসভায় প্রবেশ করিয়া সকলকে অভিবাদনান্তে কহিলেন—  হে কৌরবগণ ও রাজন্যবর্গ! আমি পাণ্ডবগণের নিকট হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়াছি, আপনারা তত্রত্য বৃত্তান্ত সমুদয় শ্রবণ করুন। আমি ধর্ম্মরাজসমীপে উপস্থিত হইয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকর্ত্তৃক উপদিষ্ট বাক্য তাঁহকে যথাযথরূপে বিজ্ঞাপিত করিলে পাণ্ডবগণ প্রথমত উপস্থিত সকলকে সাদরসম্ভাষণসহকারে যথােপযুক্ত অভিবাদনাদি জানাইলেন।

 এই বলিয়া সঞ্জয় ক্রমে ক্রমে যুধিষ্ঠিরের মতামত ও যুদ্ধার্থে যেরূপ বলসংগ্রহ ও আয়ােজন হইয়াছে তৎসমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া বর্ণনা করিলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র মনের আবেগে আর কাহাকেও বলিবার অবসর না দিয়া স্বয়ং পাণ্ডবপ্রস্তাব সমর্থন করিতে উদ্যত হইলেন। তিনি বলিলেন—

 পাণ্ডবগণ যেরূপ বল সংগ্রহ করিয়াছেন, অর্জ্জুনের যেরূপ দিব্যাস্ত্র-শিক্ষা লাভ হইয়াছে এবং ভীমসেন যেরূপ অলৌকিক বলসম্পন্ন, তাহাতে দুর্য্যোধন উহাদের সহিত কলহ করিয়া অতি অবিবেচকের কার্য্য করিয়াছেন। এ যুদ্ধ ঘটিলে কৌরবকুলের নিস্তার নাই, তাহা আমার স্পষ্টই উপলব্ধি হইতেছে। আমার ইচ্ছ। পাণ্ডবদের ধর্ম্মানুগত প্রস্তাব অনুসারে সন্ধিস্থাপনপূর্ব্বক আমরা চিরকল্যাণ লাভ করি।

 এই কথা শ্রবণে ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি সকলেই ধৃতরাষ্ট্রের উপদেশের প্রশংসা করিয়া তাঁহার প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। কিন্তু দুর্য্যোধন এই অপ্রিয় মন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া বলিতে লাগিলেন—  হে পিতঃ! আপনি কেন বৃথা ভীত হইয়া আমাদের নিমিত্ত শােক করিতেছেন? আমাদের শত্রু অপেক্ষা আমরা কিসে হীনবল যে, পরাজয় আশঙ্কায় কাতর হইব? তদ্ব্যতীত এক্ষণে সমগ্র সাম্রাজ্য আমারই হস্তগত এবং এই সকল মহারথ ভূপালবৃন্দ আমারই অনুগত, অতএব পাণ্ডবদের নিস্তার কোথায়?

 ধৃতরাষ্ট্র পুত্রকে নিতান্তই মোহাবিষ্ট দেখিয়া কাতরস্বরে কহিতে লাগিলেন—

 হে কৌরবগণ! আমি বারবার বিলাপ করিতেছি, তথাপি আমার মন্দমতি পুত্রগণ যুদ্ধসঙ্কল্প পরিত্যাগ করিতেছে না। বৎস দুর্য্যোধন! তুমি কি নিমিত্ত সমগ্র পৃথিবী অধিকার করিবার দুরভিলাষ পোষণ করিতেছ? তদপেক্ষা পাণ্ডবদিগকে তাহাদের প্রাপ্যাংশ প্রত্যর্পণ করিয়া সুখে আপন রাজ্য পালন কর। পাপযুদ্ধে লিপ্ত হইলে কুরুকুল সমূলে ধ্বংস হইবে। আমি অহোরাত্র এইরূপ চিন্তায় বিহ্বল হইয়া নিদ্রাসুখে বঞ্চিত হইতেছি, এই নিমিত্তই আমি সন্ধিস্থাপনে সমুৎসুক।

 মহাবীর কর্ণ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের হর্ষোৎপাদন করিয়া কহিলেন—

 হে মহারাজ! আমি দিব্যাস্ত্রবেত্তা মহাত্মা পরশুরামের নিকট অস্ত্রশিক্ষা করিয়াছি। আমিই এই যুদ্ধে পাণ্ডবপ্রধানগণকে বিনাশ করিবার ভার গ্রহণ করিলাম।

 কর্ণের এই আত্মশ্লাঘাই দুর্য্যোধনের দুঃসাহস এবং তজ্জনিত সমস্ত অনর্থের মূল বিবেচনা করিয়া মহামতি ভীষ্ম অনিবার্য্য ক্রোধে কর্ণকে তীব্র ভৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন—

 হে কাল-হত-বুদ্ধি কর্ণ। পাণ্ডবদিগকে সংহার করিবে বলিয়া তুমি সর্ব্বদাই অহঙ্কার করিয়া থাক। বিরাটনগরে যখন ধনঞ্জয় তোমার প্রিয় ভ্রাতাকে সংহার করিলেন, তখন তুমি কি করিতেছিলে? যখন অর্জ্জুন সমস্ত কৌরবগণকে অচেতন করিয়া তাঁহাদের উত্তরীয় সকল হরণ করিলেন, তখন কি তুমি সে স্থানে ছিলে না? এখন তুমি বৃষের ন্যায় আস্ফালন করিতেছ, তােমার ন্যায় ধর্ম্মভ্রষ্ট ব্যক্তির আশ্রয়ের প্রতি নির্ভর করিয়াই এ ঘাের যুদ্ধে ইহারা কালকবলে পতিত হইবে।

 ভীষ্মের বাক্যশল্যে অতিশয় সন্তপ্ত হইয়া কর্ণ তৎক্ষণাৎ অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে পিতামহ! আপনি পাণ্ডবদের যেরূপ গুণ কীর্ত্তন করিয়া থাকেন, তাহা সেইরূপই বা ততােধিক হইতে পারে; কিন্তু আপনি আমাকে সভাস্থলে যে সকল পরুষবাক্য প্রয়ােগ করিলেন, তাহার ফল শ্রবণ করুন। আমি এই অস্ত্র ত্যাগ করিলাম, আপনি জীবিত থাকিতে আর ইহা গ্রহণ করিব না।

 মহাধনুর্দ্ধর কর্ণ এই কথা বলিয়া তৎক্ষণাৎ সভাগৃহ পরিত্যাগ করিয়া স্বভবনে চলিয়া গেলেন। অনস্তর অতি বিষণ্ণমনে ধৃতরাষ্ট্র সেদিনকার সভা ভঙ্গ করিলেন।

 এই সভার বিবরণ যুধিষ্ঠিরের নিকট উপস্থিত হইলে তিনি কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন—

 হে মিত্রবৎসল। এক্ষণে আমাদের এরূপ সময় আসিয়াছে, যখন তােমার পরামর্শ ভিন্ন আর গতি নাই। আপৎকাল উপস্থিত হইলে তুমি যাদবগণকে যেরূপ রক্ষা করিয়া থাক, এক্ষণে আমাদেরও সম্বন্ধে তাহাই করিতে হইবে।

 কৃষ্ণ কহিলেন—মহারাজ! আমি ত এই উপস্থিত রহিয়াছি, যে বিষয়ে আজ্ঞা করিবে আমি তাহাই সম্পাদন করিব।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন—সঞ্জয়ের নিকট যাহা শুনা গেল, তাহাতে ধৃতরাষ্ট্রের প্রকৃত মনােভাব স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে। বিনা রাজ্য প্রদানে আমাদিগকে ক্ষান্ত করিতে চাহেন। আমি কুলক্ষয় নিবারণার্থে অবশেষে পঞ্চগ্রাম মাত্র লইয়া বিবাদ-ভঞ্জনের প্রস্তাব করিয়াছি; কিন্তু সমগ্র সাম্রাজ্য অধিকারে স্ফীত হইয়া উহারা তাহাতেও সম্মত হইল না।

 কৃষ্ণ কহিলেন, হে ধর্ম্মরাজ! যুদ্ধ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে আমি মনে করিতেছি আমি নিজে হস্তিনাপুরে গমনপূর্ব্বক উভয় পক্ষের হিতার্থে শেষচেষ্টা করিব। যদি আমি তোমাদের স্বার্থের অব্যাঘাতে শান্তি স্থাপন করিতে পারি, তাহা হইলে কুরুকুলকে মৃত্যুপাশ হইতে মুক্ত করিয়া আমি মহা পুণ্যফল লাভ করিব।

 দ্রৌপদী এতক্ষণ পতিগণের মৃদুভাব অবলােকনে নিতান্ত ম্রিয়মাণা হইয়া বসিয়াছিলেন। তিনি আর মৌন থাকিতে পারিলেন না। রােদন করিতে করিতে কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন—

 হে মধুসূদন! তুমি কৌরব-সভায় গিয়া আমাদের সমগ্র রাজ্য প্রদান ব্যতিরেকে কোন সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হইও না। তুমি এই পাপিষ্ঠ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের উপযুক্ত দণ্ড বিধান কর।

 অনন্তর রােরুদ্যমানা কৃষ্ণা স্বীয় রমণীয় কুটিলাগ্র কুন্তলদাম হস্তে ধারণপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে কেশব! যখন কৌরব-সভায় শান্তির প্রস্তাব হইবে, তখন পাষণ্ড দুঃশাসনের হস্ত-কলুষিত এই কেশের কথা স্মরণ রাখিও।

 কৃষ্ণ তখন দ্রোপদীকে সান্ত্বনা দিয়া কহিলেন—

 হে কল্যাণি! তুমি এখন যেরূপ রোদন করিতেছ, অতি অল্পদিনের মধ্যেই কৌরব-মহিলাগণকে সেইরূপ রোদন করিতে দেখিবে। হে কৃষ্ণে! বাষ্প সম্বরণ কর। তোমার পতিগণ অচিরেই শত্রু-সংহারপূর্ব্বক রাজ্যলাভ করিবেন।

 এইরূপ কথােপকথনে সে রাত্রি অতিবাহিত হইল। পরদিন প্রভাতে যদুবংশাবতংস কৃষ্ণ হস্তিনাপুর যাত্রার আয়োজন করিতে আরম্ভ করিলেন। ব্রাহ্মণগণের মাঙ্গল্যপুণ্য নির্ঘোষ শ্রবণান্তে স্নান করিয়া বসন-ভূষণ পরিধানপূর্ব্বক তিনি সূর্য্য ও বহ্নির উপাসনা করিলেন। তদনন্তর সাত্যকিকে কহিলেন—

 হে যুযুধান! আমার রথমধ্যে শঙ্খ চক্র গদা ও অন্যান্য অস্ত্রসকল সুসজ্জিত কর। দুর্য্যোধন শকুনি ও কর্ণ অতি দুরাত্মা, অতএব তাহাদের পাপাভিসন্ধির নিমিত্ত প্রস্তুত থাকা কর্ত্তব্য।

 কৃষ্ণের অভিপ্রায় জ্ঞাত হইয়া সাত্যকি রথসকল উপযুক্ত রূপে অস্ত্রসজ্জিত করিলেন। অনন্তর সকালের নিকট বিদায় লইয়া সাত্যকিসহ কৃষ্ণ স্বীয় রথে আরােহণ করিলে দশ শস্ত্রপাণি মহারথী, সহস্র অশ্বারােহী ও সহস্র পদাতি এবং ভক্ষ্য দ্রব্য লইয়া বহুসংখ্যক কিঙ্কর তাঁহার অনুগমন করিল। তখন দারুকসারথি-চালিত বায়ুবেগগামী অশ্বসকল হস্তিনপুরাভিমুখে ধাবিত হইল।

 এদিকে ধৃতরাষ্ট্র দূতমুখে কৃষ্ণের আগমন-বার্ত্তা শ্রুত হইয়া রােমাঞ্চিত-কলেবরে ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদির সমক্ষে দুর্য্যোধনকে কহিলেন—

 হে কুরুনন্দন! এই অত্যাশ্চর্য সংবাদ শুনিতেছি যে মহাত্মা বাসুদেব স্বয়ং পাণ্ডবদূত হইয়া এখানে আগমন করিতেছেন। কৃষ্ণ আমাদের পরম আত্মীয় ও মাননীয়, তাঁহার অভ্যর্থনার্থে উপযুক্ত আয়ােজন করা কর্ত্তব্য।

 ভীষ্ম এই বাক্যের সম্পূর্ণ অনুমােদন করিলে দুর্য্যোধন তদনুসারে বিবিধ আসন, উৎকৃষ্ট গন্ধদ্রব্য ও সুস্বাদু অন্নপানাদিশোভিত পরমরমণীয় সভাসকল স্থানে স্থানে সংস্থাপন করিলেন।

 এদিকে কৃষ্ণ বৃকস্থলে রাত্রিযাপনপুর্ব্বক প্রভাতে আহ্নিককার্য্য সমাধা করিয়া হস্তিনাপুরাভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন। বৃকস্থল-নিবাসিগণ তাঁহাকে চতুর্দিকে বেষ্টন করিয়া সঙ্গে চলিতে লাগিল। ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি মহাত্মারা এবং দুর্যোধন ব্যতীত ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রসমুদয় কৃষ্ণের প্রত্যুদ্গমনের নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। পুরবাসিগণ কৃষ্ণ-দর্শনার্থে কেহ কেহ বিবিধ যানে, ও অনেকে পদব্রজে যাত্রা করিল।

 যথাক্রমে রাজপ্রাসাদের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কৃষ্ণ রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রের ভবনে প্রবেশ করিলেন। একে একে তিন কক্ষ অতিক্রম করিয়া অবশেষে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সমীপস্থ হইলেন। উপস্থিত রাজগণসহ ধৃতরাষ্ট্র আসন হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক কৃষ্ণকে সমাদর প্রদর্শন করিলে কৃষ্ণ বিনীতভাবে সকলকে প্রতিপূজা করিয়া বয়ঃক্রম অনুসারে সকলের সহিত মিলিত হইলেন। অনন্তর তিনি নির্দ্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হইলে গাে মধুপর্ক ও উদকপ্রদানে তাঁহার অর্চ্চনা করা হইল। বাসুদেব আতিথ্য গ্রহণপূর্ব্বক সকলের সহিত সম্বন্ধোচিত হাস্যপরিহাস ও বাক্যালাপে তথায় কিছুকাল অতিবাহিত করিলেন।

 সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া কৃষ্ণ বিদুরের ভবনে আশ্রয়গ্রহণ করিলেন।

 প্রভাতে সুমধুর-স্বরসম্পন্ন বৈলিকের দ্বারা প্রবােধিত হইয়া মহাত্মা কৃষ্ণ জপ ও হোমান্তে বসনপরিধানপূর্ব্বক নবোদিত আদিত্যের উপাসনা করিলেন। ইত্যবসরে দুর্য্যোধন ও শকুনি তাঁহার সমীপে আগমন করিয়া সংবাদ দিলেন—

 হে কেশব! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম প্রভৃতি কৌরবগণ এবং অন্যান্য ভূপালবৃন্দ সভায় সমুপস্থিত হইয়া তােমার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন।

 বাসুদেব তাহাদিগকে অভিনন্দনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে সৎকার করিয়া দারুক-সারথি-সমানীত রথে আরােহণ করিয়া অনুচরবর্গ পরিবৃত হইয়া রাজসভায় গমন করিলেন।

 যদুবংশাবতংস কৃষ্ণ প্রবিষ্ট হইবামাত্র কুরুবৃদ্ধগণ আসন পরিত্যাগপূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইলেন। ধৃতরাষ্ট্র উত্থিত হইলে তগ্রস্থ সহস্র সহস্র ভূপতি গাত্রোত্থান করিলেন। কৃষ্ণ হাস্যমুখে সকলকে প্রত্যাভিনন্দন করিলেন।

 তখন সভাস্থ সকলে নির্দ্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হইলেন। কর্ণ এবং দুর্য্যোধন অনতিদূরে একাসনে অবস্থিত হইলেন এবং বিদুর কৃষ্ণের পার্শে আসন পরিগ্রহ করিলেন। অনন্তর সকলে কৃষ্ণের প্রস্তাবের প্রতীক্ষায় তাঁহার প্রতি চাহিয়া নীরব রহিলেন। তখন ধীমান্ বাসুদেব জলদ গম্ভীরস্বরে সভাগৃহ প্রতিধ্বনিত করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন—

 এই ভরতবংশাবতংস। আমার বিবেচনায় কৌরব ও পাণ্ডবগণের মধ্যে সন্ধি স্থাপনপূর্ব্বক বীবগণের বিনাশ নিবারণ করা কর্ত্তব্য! এই প্রার্থনা করিতেই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। হে কুরুপ্রবীর! পাণ্ডবদিগকে রাজ্যার্দ্ধ প্রদানপূর্ব্বক তাঁহাদের সহিত সন্ধিস্থাপন ভিন্ন আমার আর অন্য প্রস্তাব করিবার নাই। উপস্থিত সভাসদের মধ্যে কাহারও যদি অন্য কোন সঙ্গত প্রস্তাব থাকে, তবে তাহা শ্রবণ করা যাক্।

 ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন—

 তােমার বাক্য ধর্ম্মানুমােদিত তাহার সন্দেহ নাই; কিন্তু দেখিতেছ যে, আমি স্বাধীন নহি। আমার প্রিয়কার্য্য অনুষ্ঠিত হয় না; অতএব তুমি দুর্য্যোধনকে বুঝাইবার নিমিত্ত যত্ন কর, সে আমাদের কাহারও বাক্য গ্রাহ্য করে না। তুমি তাহাকে শান্ত করিতে পারিলে যথার্থ বন্ধু জনােচিত কার্য্য হইবে।

 রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বাক্যানুসারে বাসুদেব দুর্য্যোধনের অভিমুখে প্রত্যাবৃত হইয়া মৃদুবচনে কহিতে লাগিলেন—

 ভ্রাতঃ! তুমি যে রূপ ব্যবহার করিতেছ, তাহা তোমার বংশের উপযুক্ত হইতেছে না। সেই বিপরীত ব্যবহারজনিত অনর্থ পরিহারপূর্ব্বক নিজের ভ্রাতৃগণের ও মিত্রসকলের শ্রেয় সাধন কর। হে দুর্য্যোধন! পাণ্ডবদের সহিত সন্ধিস্থাপন করা তোমার গুরুজন সকলেই অভিপ্রেত; অতএব তাহা তােমারও অনুমােদিত হউক।

 কৃষ্ণের বাক্যাবসানে ভীষ্ম তাঁহার কথা সমর্থন করিয়া দুর্য্যোধনকে বুঝাইতে লাগিলেন—

 হে দুর্য্যোধন! মহাত্মা কেশব তোমাকে ধর্ম্মসঙ্গত উপদেশ প্রদান করিলেন, তুমি তাহার অনুবর্ত্তী হও, প্রজাগণকে বিনষ্ট করিও না, পিতামাতাকে শােকসাগরে নিমগ্ন করিও না।

 কিন্তু দুর্য্যোধন ভীষ্ম-বাক্যের সমাদর না করিয়া— ক্রোধে ঘন ঘন শ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন বিদুর কহিলেন—

 আমি তােমার নিমিত্ত শােক করিতেছি না, কিন্তু তোমার বৃদ্ধ পিতামাতা যে তােমাকে উৎপাদন করিয়া হতপুত্র ও হতমিত্র হইয়া ছিন্নপক্ষ পক্ষীর ন্যায় অনাথ হইবেন, তজ্জন্যই আমি শােকাকুল হইতেছি।

 তখন ধৃতরাষ্ট্র পুনরায় অনুনয় বাক্যে কহিলেন—

 বৎস! বাসুদেবের কল্যাণকর বাক্য গ্রহণ কর, তাতে তােমার ঐশ্বর্য্য অক্ষুণ্ণ থাকিবে। যে রাজ্যার্দ্ধ তুমি দান করিবে, মহামতি কেশবের সাহায্যে তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে রাজ্যবৃদ্ধি করিতে পারিবে। কিন্তু ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিলে পরাজয় অনিবার্য্য, তাহার সন্দেহ কি?

 রাজা দুর্য্যোধন আর কাহারও কথায় কিছুমাত্র মনােযােগ না করিয়া কৃষ্ণকে উষ্ণভাবে প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন―

 হে বাসুদেব! আমরা ক্ষত্রধর্ম্মাবলম্বী, শত্রুর নিকট নত হওয়া অপেক্ষা আমরা সমরক্ষেত্রে বীরশয্যা শ্রেয়স্কর জ্ঞান করি। আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকিতে পিতা আমার অনভিমতে পাণ্ডবদিগকে আমার রাজ্যের অংশ প্রদান করিয়াছিলেন। আমি জীবিত থাকিতে তাহা পুনরায় প্রত্যর্পিত হইবে না। অধিক কি, সূচির অগ্রভাগে যে পরিমাণ ভূমি বিদ্ধ হতে পারে, তাহাও পাণ্ডবদিগকে প্রদান করিব না।

 দুর্য্যোধনের উগ্রবাক্যে রুষ্ট হইয়া কৃষ্ণ উপহাস-সহকারে প্রত্যুত্তর করিলেন—

 হে দুর্য্যোধন! তুমি যে বীর-শয্যালাভের বাসনা করিতেছ, তাহা যথাকালে অবশ্যই প্রাপ্ত হইবে। তুমি পিতা মাতা ও সমগ্র গুরুজনের বাক্য অবহেলা করিতেছ, অথচ চিন্তা করিয়াও স্বীয় দোষ দেখিতে পাইতেছ না। কিন্তু বােধ করি উপস্থিত নৃপতিবর্গ অন্যরূপ বিচার করিবেন।

 কৃষ্ণ এইরূপ কহিতেছেন এমন সময়ে দুঃশাসন উত্থানপুর্ব্বক দুর্য্যোধনের নিকট সমাগত হইয়া কহিলেন—

 হে রাজন্! সভাস্থ সকলের মন ক্রমেই তোমার বিপক্ষে আবর্ত্তিত হইতেছে; অতএব তােমার আর এখানে অবস্থান করা শ্রেয় নহে।

 দুর্য্যোধন এই কথায় শঙ্কিত হইয়া অশিষ্টভাবে কর্ণ শকুনি ও দুঃশাসনকে লইয়া সভাগৃহ পরিত্যাগ করিলেন।

 ধৃতরাষ্ট্র ব্যগ্রভাবে বিদুরকে কহিলেন—

 বৎস! দূরদর্শিনী গান্ধারীর সমীপে সত্বর গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে এই সভায় আনয়ন কর, যদি মাতার বাক্যে দুর্য্যোধনের সুবুদ্ধির উদয় হয়, একবার শেষচষ্টা দেখা যাক্। হায়! দুর্য্যোধনকৃত এই ঘোর ব্যসন কোথায় প্রশমিত হইবে!

 বিদুর রাজাজ্ঞা পাইবামাত্র নিষ্ক্রান্ত হইয়া অবিলম্বে যশস্বিনী গান্ধারীকে তথায় উপস্থিত করিলেন। তিনি আগত হইলে ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন—

 হে গান্ধারি! তোমার দুর্বিনীত পুত্র দুর্য্যোধন ঐশ্বর্য্যলােভে মুগ্ধ হইয়া গুরুজন-বাক্য অবহেলা করিয়া অতি ভয়ঙ্কর বিপদের সূত্রপাত করিতেছে। এক্ষণে সে সুহৃদ্বাক্য উল্লঙ্ঘনপূর্ব্বক অশিষ্টের ন্যায় সভা ত্যাগ করিয়াছে।

 গান্ধারী কহিলেন—মহারাজ! এই যে ব্যসন সমুপস্থিত, ইহাতে তোমারই দুর্ব্বলতা প্রকাশ পাইতেছে। তুমি দুর্য্যোধনের পাপ-পরায়ণতা অবগত হইয়াও চিরকাল তাহার মতের অনুসরণ করিয়া আসিয়াছ, এক্ষণে উহাকে বলপূর্ব্বক নিবারণ করিবার তোমার আর সাধ্য নাই।

 অনন্তর মাতৃ আজ্ঞা জ্ঞাত হইয়া দুর্য্যোধন পুনরায় সভায় প্রবিষ্ট হইলে গান্ধারী তাঁহাকে ভর্ৎসনাপূর্ব্বক কহিলেন―

 বৎস দুর্য্যোধন! কাম ও ক্রোধের বশীভূত হইয়া তোমার প্রজ্ঞা বিলুপ্ত হওয়াতেই তুমি গুরুজনের সদুপদেশ বাক্য লঙ্ঘন করিতেছ; কিন্তু, হে পুত্র! যদি নিজের অধর্ম্মবুদ্ধিকেই না জয় করিতে পারিলে তবে রাজ্যজয় বা রাজ্য রক্ষা করিবার আশা কিরূপে করিতেছ? বৎস! শান্তিমার্গ অবলম্বন করিয়া সকলকে রক্ষা কর, পাণ্ডবদের সহিত মিলিত হইয়া পরম সুখে সাম্রাজ্য ভোগ কর।

 মাতৃবাক্যের অবসানে দুর্য্যোধন প্রত্যুত্তর প্রদান না করিয়া পুনরায় সভাগৃহ ত্যাগ করিলেন এবং কর্ণ শকুনি ও দুঃশাসনের সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন।

 বাসুদেব তখন সকলের সমক্ষে ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন―

 মহারাজ! আমি এক্ষণে সমস্ত অবস্থা অবগত হইলাম। স্পষ্টই বুঝিলাম যে আপনি স্বাধীন নহেন এবং দুর্য্যোধন রূঢ়ভাবে সন্ধির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিতেছেন; অতএব এই সকল বৃত্তান্ত ধর্ম্মরাজের নিকট নিবেদন করিলেই আমার কার্য্য শেষ হয়। এক্ষণে আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ করিতেছি, আমি চলিলাম।

 এই বলিয়া মহামতি বাসুদেব বহির্গত হইয়া রথারােহণ পূর্ব্বক পিতৃস্বসার নিকট বিদায় লইতে চলিলেন। তথায় তাঁহাকে সমস্ত বৃত্তান্ত জ্ঞাত করাইয়া কৃষ্ণ কহিলেন―

 দেবি! দুর্য্যোধনের ত শেষদশা উপস্থিত হইয়াছে; এক্ষণে আপনার পুত্রদিগকে যদি কিছু বক্তব্য থাকে, তাহা আমি শ্রবণ করিতে অভিলাষী।

 কুন্তী কহিলেন—বৎস! যুধিষ্ঠিরকে আমার বচনে কহিবে—

 ―হে পুত্র! তোমার রাজ্য-পালন-জনিত প্রচুর ধর্ম্ম বিনষ্ট হইতেছে; অতএব আর ক্ষত্রধর্মে অবহেলা করি না। তোমার বুদ্ধি সতত ধর্ম্মচিন্তায় অভিভূত হইয়া কর্ম্মপথের বাধা ঘটায়; অতএব সাবধান হও।

 ―হে কেশব! ভীমসেন ও ধনঞ্জয়কে কহিবে—

 বৎসগণ! ক্ষত্রিয় কন্যা যে নিমিত্ত গর্ভধারণ করেন, তাহা স্মরণ রাখিও, এক্ষণে তাহা সফল করিবার সময় আগত হইয়াছে।

 ―এবং কল্যাণী দ্রুপদনন্দিনীকে কহিবে―

 —“হে কৃষ্ণে! হে মহাভাগে! হে যশস্বিনি! তুমি আমার পুত্রগণের প্রতি এত ক্লেশ সহ্য করিয়াও যথােচিত আচরণ করিয়াছ, ইহা তােমার উপযুক্তই হইয়াছে।

 হে মাধব! সকলকে আমার স্নেহাশীর্ব্বাদ ও কুশলসংবাদ জ্ঞাপন করিবে। এক্ষণে তুমি নির্ব্বিঘ্নে গমন কর।

 অনন্তর কুন্তীকে অভিবাদন করিয়া কৃষ্ণ তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া কর্ণকে বিশেষ প্রয়োজন জানাইয়া স্বীয় রথে আরোহণ করাইলেন এবং সাত্যকি ও অনুচরবর্গ সমভিব্যাহারে নগর হইতে প্রস্থান করিলেন। নগরের বহির্দ্দেশে নির্জ্জনস্থানে উপস্থিত হইয়া কৃষ্ণ কর্ণকে একান্তে কহিতে লাগিলেন—

 হে কর্ণ! তুমি সর্বদাই বেদপারগ ব্রাহ্মণগণের সহিত মিলিত হইয়া বহু তত্ত্ব আলেচনা করিয়াছ, অতএব তুমি নিশ্চয়ই জান যে, কোন রমণীকে যে বিবাহ করে, সে তাহার কন্যাবস্থায় জাত পুত্রের শাস্ত্রোক্ত পিতা হয়। তুমি স্বীয় জন্মবৃত্তান্ত অবগত আছ। তুমি কুন্তীর বিবাহের পূর্ব্বপ্রসূত সূর্য্যদত্ত পুত্র, সুতরাং মহাত্মা পাণ্ডুই তোমার পিতা, তুমিই প্রকৃতপক্ষে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব; অতএব অদ্য আমার সহিত গমন কর, পাণ্ডবগণকে এই বৃত্তান্ত বিজ্ঞাপিত করা যাক্। তাঁহারা তোমাকে জ্যেষ্ঠ বলিয়া জানিতে পারিলে সমস্ত আধিপত্য তোমার হস্তে সমর্পণ করিবেন। অতএব হে মহাবাহো! অদ্যই আমার সহিত আইস, ভ্রাতৃগণ-পরিবৃত হইয়া রাজ্যশাসনপুর্ব্বক কুন্তীর আনন্দবর্দ্ধন কর।

 কর্ণ প্রত্যুত্তর করিলেন―

 হে বৃষ্ণিপ্রবীর বাসুদেব! আমি অবগত আছি যে, কুন্তীর কন্যাবস্থায় জন্মগ্রহণ করায় আমি শাস্ত্রানুসারে পাণ্ডুপুত্ররূপেই গণ্য। কিন্তু হে জনার্দ্দন! আমি জন্মিবামাত্র আমার কিছুমাত্র কুশল চিন্তা না করিয়া কুন্তী আমাকে পরিত্যাগ করিলেন। তৎকালে সূতজাতীয় অধিরথ দয়াপরবশ হইয়া আমাকে তাঁহার পত্নী রাধার নিকট পালনার্থে সমর্পণ করিলেন। হে কৃষ্ণ! স্নেহবশত তৎক্ষণাৎ আমার মাতৃরূপিণী রাধার স্তনযুগলে ক্ষীর সঞ্চার হইয়াছিল। তদবধি উভয়ে আমাকে পুত্রনির্বিশেষে লালন করিলেন। যৌবন প্রাপ্ত হইলে আমি সূতজাতীয় কন্যা বিবাহ করিলাম এবং তাঁহা হইতে আমার পুত্র পৌত্রাদি জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহাদের উপরই আমার সমস্ত প্রণয় আবদ্ধ হইয়াছে, অপরিমেয় ধনরত্ন বা অখণ্ড ভূমণ্ডল প্রাপ্ত হইলেও আমার ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিবার অভিলাষ হয় না। তাহা ছাড়া, হে বাসুদেব! আমি এতকাল দুর্য্যোধনের প্রদত্ত রাজ্য অকণ্টকে ভোগ করিয়া আসিয়াছি, আমাকে তিনি সর্ব্বদাই প্রীতি প্রদর্শন করিয়াছেন এবং আমার উপর নির্ভর করিয়াই পাণ্ডবদের সহিত বিরোধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। অতএব এক্ষণে লোভ বা ভয়ে বিচলিত হইয়া আমি তাঁহার প্রতি মিথ্যাচরণপূর্ব্বক তাঁহাকে নিরাশ করিতে পারিব না। তদ্ব্যতীত, যদি এই যুদ্ধে আমি সব্যসাচীর সম্মুখীন না হই, তবে আমাদের উভয়েরই ভূয়সী অকীর্ত্তি থাকিয়া যাইবে। হে যাদব নন্দন! তুমি আমার হিতার্থে এই সকল প্রস্তাব করিয়াছ, সন্দেহ নাই, কিন্তু আমার অনুরােধ এই যে, তুমি আমার জন্মবৃত্তান্ত পাণ্ডবদের নিকট প্রকাশ না কর। অরিন্দম! ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির আমাকে কুন্তীপুত্র বলিয়া জানিতে পারিলে তৎক্ষণাৎ রাজ্য পরিত্যাগ করিবেন। সে রাজ্য আমি প্রাপ্ত হইলে দুর্য্যোধনকে না প্রদান করিয়া থাকিতে পারিব না। কিন্তু এরূপে দুর্য্যোধনের রাজ্যপ্রাপ্তি উচিত হইবে না; অতএব যুধিষ্ঠিরই চিরকাল রাজ্যশাসন করুন।

 কর্ণের কথা শেষ হইলে বাসুদেব মৃদুহাস্য-সহকারে কহিলেন—

 হে কর্ণ! আমি তােমাকে সাম্রাজ্য প্রদান করিলাম, তাহা তোমার গ্রহণের অভিলাষ হইল না, অতএব আর যুদ্ধ বিনা গতি নাই। তুমি এখান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া ভীষ্ম দ্রোণাদিকে বলিও যে, বর্ত্তমান মাস সর্ব্বতােভাবে যুদ্ধের উপযােগী। খাদ্যদ্রব্য ও কাষ্ঠাদি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, জল সুরস ও পথ কর্দ্দমশূন্য। অদ্য হইতে সপ্তম দিবসে অমাবস্যা হইবে, ঐ তিথি যুদ্ধারম্ভের পক্ষে উপযুক্ত। তোমরা সকলেই যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তিমশয্যা প্রার্থনা করিতেছ, তখন তাহাই হইবে। দুর্য্যোধনের অনুগত রাজগণ সমরক্ষেত্রে নিধন প্রাপ্ত হইয়া সদ্গতি লাভ করিবেন।

 কর্ণ কহিলেন―হে কৃষ্ণ! আমি এক্ষণে বিদায় গ্রহণ করি। সম্প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে পুনরায় তােমার দর্শন পাইব এবং পরে হয় এই ক্ষত্রান্তকারী মহারণ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, নতুবা স্বর্গে, যথাকালে তোমার সহিত পুনরায় মিলিত হইব।

 এই বলিয়া কর্ণ কেশবকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক বিষণ্ণমনে স্বীয় রথারােহণ করিয়া হস্তিনাপুরে প্রত্যাগত হইলেন। কৃষ্ণ শান্তির নিমিত্ত শেষচেষ্টায়ও অকৃতকার্য্য হইয়া সারথিকে রথ-চালনার আদেশ প্রদান করিলে রথ উপপ্লব্য অভিমুখে প্রধাবিত হইল।

 কুরু-সভা ভঙ্গ হইলে শান্তির আশা সম্পূর্ণ পরাহত জানিয়া বিদুর অতিশয় চিন্তাকুলিত চিত্তে ইতস্তত পরিভ্রমণ করিতে করিতে অবশেষে কুন্তীর ভবনে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট মনােবেদনা নিবেদন করিতে লাগিলেন―

 হে কুন্তি! তুমি ত জান, আমি যুদ্ধের কি পর্য্যন্ত বিরােধী ছিলাম, আমি কায়মনোবাক্যে শান্তির নিমিত্ত চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুই ফল হইল না। ধর্ম্মাত্মা পাণ্ডবগণ সহায়সম্পন্ন হইয়াও দীনের ন্যায় সন্ধি প্রার্থনা করিলেন, তথাপি দুর্য্যোধনের তাহাতে অভিরুচি হইল না। যে ঘোরযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িয়াছে, তাহার ফল যে কি পর্য্যন্ত শােচনীয় হইতে পারে, তাহা ভাবিয়া আমি দিবানিশি নিদ্রাসুখে বঞ্চিত হইতেছি।

 মনস্বিনী কুন্তী বিদুরের বাক্য শ্রবণে একান্ত দুঃখিত হইলেন এবং দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক চিন্তা করিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি কর্ণকে দুর্য্যোধনের প্রধান নির্ভর স্থল জানিয়া জন্মবৃত্তান্ত জ্ঞাপনপূর্ব্বক তাঁহাকে পাণ্ডবদের প্রতি প্রসন্ন করিবার সঙ্কল্প করিলেন। কর্ণ পুত্র হইয়া কি নিমিত্ত তাঁহার হিতকর বাক্য উপেক্ষা করিবে?― এই কল্পনায় আশ্বস্ত হইয়া তিনি এই উদ্দেশ্যে ভাগীরথীতীরে গমন করিলেন।

 তথায় দেখিলেন স্বীয় আত্মজ সত্যপরায়ণ মহাতেজা কর্ণ পূর্ব্বমুখে বসিয়া বেদ পাঠ করিতেছেন। পৃথা কর্ণের পশ্চাতে দণ্ডায়মান থাকিয়া তাঁহার জপাবসান প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। অপরাহ্ণ পর্য্যন্ত কর্ণ পূর্ব্বমুখে অবস্থান করিয়া পরিশেষে সূর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাভিমুখে আবর্ত্তিত হইবামাত্র কুন্তী তাঁহার নয়নপথে পতিত হইলেন। তখন তিনি বিস্মিত হইয়া অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিলেন —

 ভদ্রে! অধিরথ ও রাধার পুত্র আপনাকে অভিবাদন করিতেছে। আপনি কি নিমিত্ত এ স্থানে আগমন করিয়াছেন? আজ্ঞা করুন কি করিতে হইবে।

 কুন্তী কহিলেন—বৎস! তুমি অধিরথ বা রাধার পুত্র নহ; সূতকুলে তোমার জন্ম হয় নাই। তুমি আমাই সূর্য্যদত্ত পুত্র, কন্যাবস্থায় আমি তোমাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। তুমি শাস্ত্রানুসারে মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্র হইয়া মােহবশত স্বীয় ভ্রাতৃগণের সহিত সৌহার্দ্দ না করিয়া দুর্য্যোধনের সেবা করিতেছ, ইহা কি ভাল হইতেছে? তুমি সর্ব্বগুণসম্পন্ন এবং আমার পুত্রগণের অগ্রজ, অতএব তােমার সূতপুত্র-সংজ্ঞা তিরোহিত হওয়া কর্ত্তব্য।

 কুন্তীর বাক্যাবসানে কর্ণ কহিলেন—

 হে ক্ষত্রিয়ে! আমি আপনার বাক্যে আস্থা করি না, উহাতে আমার ধর্ম্মহানি হইবে। আপনার কর্ম্মদোষেই আমি সূতজাতি মধ্যে গণ্য হইয়াছি, আপনি জন্মমাত্র আমাকে পরিত্যাগ করিয়া আমার ক্ষত্রিয়জন্ম বৃথা করিয়াছেন, কোন্ শত্রু ইহা অপেক্ষা আমার অধিক অপকার করিতে পারিত? ধৃতরাষ্ট্র-তনয়গণ আমার সর্ব্বপ্রকার সৎকার করিয়া আসিতেছেন, আপনার অনুরোধে তাঁহাদের প্রতি কি প্রকারে কৃতঘ্ন হইব? অতএব দুর্য্যোধনের হিতার্থে আপনার পুত্রগণের সহিত যুদ্ধ করিব, ইহা অনিবার্য্য। তবে, হে পুত্রবৎসলে! আপনার প্রীতির নিমিত্ত আমি সত্য করিয়া বলিতেছি যে, যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব আপনার এই চারিপুত্রের সহিত আমার কোন বৈর নাই, ইহাদিগকে আমি সংহার করিব না। সুতরাং আপনার পঞ্চপুত্র কদাপি বিনষ্ট হইবে না—হয় অর্জ্জুন নয় আমি জীবিত থাকিব।

 কুন্তী কর্ণের যথার্থ কথাসকল শ্রবণে দুঃখে, কম্পিত হইলেন, কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর করিতে পারিলেন না। পরিশেষে তিনি কর্ণকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন―

 তুমি যে যুধিষ্ঠিরাদি ভ্রাতৃচতুষ্টয়কে অভয় প্রদান করিলে ইহা যেন যুদ্ধকালে তােমায় স্মরণ থাকে।

 অনন্তর উভয়ে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।