খুন না চুরি?/নবম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

নবম পরিচ্ছেদ।

 থানায় আসিয়া রূপসীকে একটা ঘরে রাখিলাম। পরে তখনই একজন কনষ্টেবলকে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম। বলিয়া দিলাম, সে যেন অবিলম্বে তাহাকে ডাকিয়া আনে।

 এক ঘণ্টার মধ্যেই কনষ্টেবল শোভনকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। আমি কোন কথা না বলিয়া তখনই তাহাকে বন্দী করিতে আদেশ করিলাম।

 শোভন সিং আমার আদেশ শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “এ কিরূপ বিচার হইল? একেত আমি ধনে প্রাণে মারা পড়িয়াছি, তাহার উপর আবার আমাকেই বন্দী করিলেন? আমার অপরাধ কি?”

 আমি গম্ভীরভাবে উত্তর করিলাম, “আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে, সকল কথা কালই জানিতে পারিবেন।”

 শো। আমার অপরাধ?

 আ। যথেষ্ট—আপনি লালসিংএর নিকট হইতে আটশত টাকা প্রবঞ্চনা করিয়া লইয়াছেন; একজন নিরীহ সন্ন্যাসীর উপর আপনার কন্যার হত্যাপরাধ চাপাইবার মানস করিয়াছেন।

 শো। সেকি আমার কন্যা কোথায়?

 আ। আপনি কি বিবেচনা করেন?

 শো। সেই সন্ন্যাসী—আমার ঘোর শত্রু ভজন সিং তাহাকে হত্যা করিয়াছে, আমি এই জানি।

 আ। এই দেখুন—আপনি এখনও মিথ্যা বলিতেছেন। রূপসীকে যে কেহ খুন করে নাই, এ কথা আপনিও অবগত আছেন। কিন্তু বলুন দেখি, পরশ্ব রাত্রি হইতে আপনি কি কাণ্ড করিয়াছেন? আপনার রোদন দেখিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম, আপনার কন্যা সত্য সত্যই খুন হইয়াছে, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় এখন সমস্ত রহস্য ভেদ করিয়াছি। আপনি যে কি ভয়ানক লোক, একজন নিরীহ লোকের প্রাণবিনাশ করিবার জন্য কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছেন, তাহা কাল প্রাতেই জানিতে পারিবেন। আজ অনেক রাত্রি হইয়া পড়িয়াছে, বিশেষতঃ সমস্ত দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি, আজ এই রাত্রে আর সে সকল কথার প্রয়োজন নাই।”

 এই বলিয়া আমি একজন কনষ্টেবলকে ইঙ্গিত করিলাম। সে আমার সঙ্কেত বুঝিতে পারিল এবং তখনই শোভন সিংকে আমার সম্মুখ হইতে স্থানান্তরিত করিল। শোভন সিং অতি বিমর্ষভাবে হাজতে গেল।

 পরদিন প্রাতঃকালে লালসিং থানায় আসিলে আমি তখন তাহাকে কোন কথ। না বলিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিলাম। তিনি আমার মুখ দেখিয়া কি বুঝিয়াছিলেন বলিতে পারি না, কিন্ত তাঁহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা যেন অধিক আনন্দিত বলিয়া বোধ হইল।

 অন্যান্য কাজ শেষ করিয়া আমি শোভন সিং, লাল সিং, কামিনী ও সন্ন্যাসী তিনজনকে একটা ঘরের মধ্যে আনয়ন করিতে বলিলাম। মুহূর্ত্ত মধ্যে আমার আদেশমত কার্য্য হইল। আমি তখন সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া শোভন সিংএর দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আপনার সমস্ত চাতুরী ধরা পড়িয়াছে। রূপসীকে কেহ হত্যা করে নাই, তাহাকে আপনিই কৌশলে আপনার ভগ্নীর বাড়ীতে সরাইয়াছিলেন। রূপসী যখন গৌরীর সহিত পদ্মপুকুরের নিকট দিয়া যাইতেছিল, তখন কামিনী কৌশলে উহাদের উভয়কে ভুলাইয়া গাড়ীতে তুলিয়াছিল এবং অনতিবিলম্বে সন্ন্য়াসীগণের নির্জ্জন আশ্রম—সেই ভগ্ন অট্রালিকায় লইয়া গিয়াছিল। সন্ন্যাসীগণ নিশ্চয়ই ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁহারা এ বিষয়ের কিছুই জানিতেন না—এমন কি, সন্দেহও করেন নাই। এই স্থান হইতে রূপসীকে কৌশলে বাহির করিয়া দেওয়া হইয়াছিল; এবং গৌরীকে নানা প্রকার ভয় দেখাইয়া কামিনী স্বয়ং বাহির করিয়া আনিয়াছিল। গৌরী স্বচক্ষে রূপসীকে হত্যা করিতে দেখে নাই। সে কামিনীর মুখে শুনিয়াছিল মাত্র এবং সেই শোনা কথা এমন ভাবে রাষ্ট্র করিয়াছিল, যেন সে উহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে। আপনি লোক নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহারাই রূপসীকে অন্য পথ দিয়া বাহির করিয়া আপনার ভগ্নীর বাড়ীতে লইয়া যায়। এদিকে আপনার ভগ্নীও সেইদিন প্রাতঃকালে আপনার বাড়ী ছাড়িয়া নিজ বাড়ীতে গিয়াছিলেন। বিবাহোপলক্ষে তাঁহার আগমন। অথচ বিবাহের দিনে প্রাতঃকাল নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া যাওয়া বড়ই আশ্চর্য্যের কথা! এখন বলুন, আপনি কি জন্য কন্যার মিথ্যা মৃত্যুর সংবাদ রাষ্ট্র করিতেছেন? কেনই বা নিরপরাধী এই সন্ন্যাসীগণের উপর খুনের দাবী দিয়াছিলেন? আর কেনই বা এই লাল সিংকে প্রবঞ্চনা করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন? আমার প্রত্যেক কথার প্রমাণ আছে। বলেন ত সমক্ষেই তাহারা সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। আমার কথায় অস্বীকার করা বাতুলের কার্য্য।

 আমার কথায় শোভন সিংএর মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি আমার কথার ভাবেই বুঝিয়াছিলেন যে, আমি মুখে যাহা বলিতেছি, কাজেও তাহা করিব। এই ভাবিয়া তিনি বলিলেন,—“না—যাহা করিয়াছি এবং যখন ধরা পড়িয়াছি, তখন অস্বীকার করিব কেন? আপনার সমস্ত কথাই ঠিক। আপনি সব করিতে পারেন। নিতান্ত কষ্টে পড়িয়াই লাল সিংএর টাকা নষ্ট করিয়া ফেলিলাম।”

 আমি বলিলাম, “আর আপনার টাকার দরকার নাই। যখন আপনার কন্যা রূপসী জীবিত, তখন তাহার সহিত লাল সিংএর বিবাহ দিন। যে প্রতিজ্ঞা করিয়া টাকা লইয়াছেন, সেই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ ককুন। আপনার কন্যা এখানেই আছে, আর সে লাল সিংকে বিবাহ করিতে সম্পূর্ণ ইচ্ছুক। আপনি অন্যায় করিয়া মিথ্যা এই বিপদ ঘটাইয়াছেন। কেন না, নিরীহ সন্ন্যাসীগণের উপর মিথ্যা কন্যার খুনের দাবী দিয়া আপনাকে বিষম বিপদে ফেলিয়াছেন। যথেষ্ট অর্থদণ্ড না দিলে নিষ্কৃতি নাই।

 শোভন সিং বিবাহের কথা শুনিয়া আন্তরিক রাগান্বিত হইলেন। কিন্তু সাহস করিয়া সে সন্ধে কোন কথা বলিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কেমন করিরা জানিলেন, রূপসী এ বিবাহে ইচ্ছুক? সে আমার দুধের মেয়ে, এই বুড়ো বরকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিবে কেন?”

 আ। কেন তাহা জানি না। কিন্তু আপনার কন্যা আমার বাড়ীতে ঐরূপই বলিয়াছে।

 শো। আমার মেয়ে—বালিকা নয়, সে এখন যুবতী। বিশেষ তাহার কোন অপরাধ নাই, কেবল, সাক্ষ্য স্বরূপ তাহাকে এখানে আনা হইয়াছে। সেইজন্য তাহাকে বাহিরে পুলিসের অন্যান্য কর্ম্মচারিদিগের সহিত একত্র রাখিলাম না;—আমার অন্দরেই স্থান দিয়াছি। রূপসী বড় ভাল মেয়ে। তাহার মন বড় সরল।

 শোভন সিং আর কোন কথা কহিলেন না। সন্ন্যাসীগণকে তখনই মুক্ত করিয়া দেওয়া হইল। তাঁহারা, বিশেষতঃ ভজন লাল আমায় আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন।

 লাল সিং আমার কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। আপাততঃ রূপসী তাঁহারই বাড়ীতে গেল। শোভন সিং বিবাহে সম্মতি দিয়াছিলেন। সুতরাং রূপসীকে লাল সিংএর সহিত যাইতে নিষেধ করিলেন না।

 কামিনী হাজতেই রহিল। কোন লোক তাহার জামিন হইল না। সৌভাগ্য বশতঃ অধিককাল তাহাকে হাজতে থাকিতে হইল না। শীঘ্রই বিচার হইয়া গেল। বিচারে শোভন সিংহের পাঁচ শত মুদ্রা এবং কামিনীর দুইশত মুদ্রা অর্থদণ্ড হইল। অর্থ দিতে না পারিলে শোভন সিংকে ছয় মাস এবং কামিনীকে একমাস কাল সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইবে।

 রূপসীকে লাভ করিয়া লাল সিং এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, বিশেষ রূপসী তাঁহাকে বিবাহ করিতে অভিলাষিণী শুনিয়া তিনি এত আনন্দিত হইয়াছিলেন যে, শোভন সিংএর মুক্তির সমস্ত টাকা নিজেই প্রদান করিলেন। শোভন মুক্ত হইলেন। কামিনীও দুই শত টাকা দিয়া মুক্তি লাভ করিল।

 বাড়ী ফিরিয়াই শোভন সিং কন্যার বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। বিনা বাক্যব্যয়ে লাল সিংকে পাঁচ শত মুদ্রা দিতে দেখিয়া তিনি লাল সিংএর পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। রূপসীকে নিজ বাড়ীতে আনিয়া মহা সমারোহে বিবাহ দিলেন। নব দম্পতীকে শোভন প্রাণ খুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন।

সমাপ্ত।


জ্যৈষ্ঠ মাসের সংখ্যা

“গুম খুন”

যন্ত্রস্থ।