খুন না চুরি?/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 পরদিন প্রাতঃকালে সমস্ত কার্য্য ত্যাগ করিয়া অগ্রে সেই সন্ন্যাসীত্রয়কে দেখিতে গেলাম। যে ঘরে তাহাদিগকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে বলিয়াছিলাম, তাহার দ্বারে দুইজন প্রহরী ছিল। সন্ন্যাসীদিগের কার্য্য লক্ষ্য করিতে এবং তাহাদের কথোপকথন শুনিবার জন্য আমি তাহাদিগকে পূর্ব্ব রাত্রে নিযুক্ত করিয়াছিলাম।

 প্রহরীদ্বয়ের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে তাহাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ করা যায় না। তাহারা বলিল, সন্ন্যাসীগণ কোন কথা কহে নাই, যেখানে বসিতে বলা হইয়াছিল সমস্ত রাত্রি সেইস্থানে চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিল। ঘরে এক সামান্য আলোক দেওয়া হইয়াছিল কিন্তু একমুহূর্ত্তের জন্যও চক্ষু উন্মীলন করে নাই, কথা কহা দুরে থাক, কেহ একটা শব্দও করে নাই। অথচ গৌরীর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে ত তাহাদিগের উপরই ভয়ানক সন্দেহ হয়। একি রহস্য!

 একজন সন্ন্যাসীর মুখে শুনিলাম,শোভন সিং তাহার পরিচিত। শোভন সিং বলিয়াছিলেন, ঐ সন্ন্যাসী তাহার পরম শত্রু। এত দিন সুবিধা পায় নাই বলিয়া কোন অপকার করিতে পারে নাই। সন্ন্যাসী কিন্তু সে কথা স্বীকার করিল না। তবে কি সন্ন্যাসীত্রয় নির্দ্দোষী? আমি কি অন্যায় সন্দেহ করিয়া তাহাদিগকে অবরুদ্ধ করিয়াছি। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে আমার যথেষ্ট পাপ সঞ্চয় হইল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু গৌরীর কথাই বা কেমন করিয়া মিথ্যা বলি। গোরীর বয়স চৌদ্দ-পনের বৎসরের অধিক হইবে না। এ বয়সে সে যদি এত মিথ্যা কথা সাজাইয়া বলিতে পারে, তাহা হইলে বড় হইলে সে কি করিবে বলা যায় না।

 এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি সন্ন্যাসীদিগের নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম তখনও তাহাদের চক্ষু মুদিত। একবার তাহাদের জিনিষপত্রগুলি দেখিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু সন্ন্যাসীদিগের আবার কি জিনিষ থাকিবে? যাহারা সংসার ত্যাগ করিয়াছে, যাহারা মন হইতে বাসনা দূর করিয়াছে, তাহারা আবার সঞ্চয় করিবে কি? তবে যদি ভণ্ড হয়, তাহা হইলে কিছু পাইলেও পাইতে পারি। এই ভাবিয়া আমি তাহাদের পরিচ্ছদ, কমণ্ডলু প্রভৃতি দ্রব্যগুলি অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম।

 যে দুইজন কনষ্টেবল প্রহরী ছিল, তাহারা তখনই আমার আদেশ পালন করিল, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হইল না। ভাবিয়াছিলাম, যদি দুই একখানা গহনা বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই রূপসীকে খুন করিয়াছে। কিন্তু সেরূপ কোন নিদর্শন পাওয়া গেল না।

 এইরূপ গোলযোগে সন্ন্যাসীগণের ধ্যান ভঙ্গ হইল। আমি তখন অপর সকলকে সেখান হইতে দূর করিয়া গত রাত্রে যাহার সহিত কথা কহিয়াছিলাম, তাহাকে বলিলাম, “শোভন সিং তোমার নামে যে দোষারোপ করিয়াছেন, তাহাতে তোমাকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। যদি নিজের মঙ্গল চাও, তাহা হইলে যাহা জান সত্য করিয়া প্রকাশ কর।” শোভন সিং বলেন যে, তুমি তাহার পরম শত্রু এবং আর কোন উপায়ে প্রতিশোধ লইতে না পারিয়া অবশেষে তাহার একমাত্র কন্যাকে হত্যা করতঃ তাহার গাত্রের প্রায় দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছ। শোভন সিংএর মুখে শুনিয়াছিলাম, সেই সন্ন্যাসীর নাম ভজন সিং। সত্য মিথ্যা জানিবার জন্য আমি সন্ন্যাসীকে নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। সন্ন্যাসী উত্তর করিল, সত্যই তাহার নাম ভজন সিং।

 আমার কথা শুনিয়া ভজন সিং হাসিয়া উঠিল। বলিল, “আমি তাহার শত্রু? না মহাশয়, সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী কাহারও শত্রুতাচরণ করে না। এ জগতে আমারও শত্রু কেহ নাই, আমিও কাহার শত্রু নয়। যেরূপ করিলে আপনার খিশ্বাস হয়, আপনি স্বচ্ছন্দে তাহাই করুন, আমার তাহাতে কোন প্রকার ক্ষতি বৃদ্ধি হইবে না। জীবন ক্ষণস্থায়ী, আজ হউক বা দুদিন পরেই হউক, কোন না কোন দিন আমাকে মরিতেই হইবে।”

 আ। আমি শুনিয়াছি, তুমি অতি অল্পদিনই বিরাগী হইয়াছ, এখনকার কথা বলিতেছি না, পুর্ব্বে যখন তুমি সংসারাশ্রমে ছিলে, তখনকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। শোভন সিংএর সহিত তোমার কিরূপ সম্পর্ক আছে? কেনই বা তুমি সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইলে?

 স। সমস্তই বলিতেছি—যদি একান্তই শুনিতে চান, শুনুন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমার নাম ভজন সিং, আমি পিতার একমাত্র পুত্র। অল্প বয়সেই মাতৃহীন হওয়ায় আমি পিতার বড় আদরের সামগ্রী ছিলাম। আমার এক জ্ঞাতি ভগ্নী ছিল, পিতৃমাতৃহীন হওয়ায় সে আমাদের বাড়ীতেই প্রতিপালিতা। তাহার সহিত শোভন সিংহের বিবাহ হয়। শোভন সিং সম্পর্কে ভগ্নীপতি। ভগ্নীপতি হইলেও শোভন সিং আমাকে দেখিতে পারিত না। আমিও তাহার সহিত মিশিতাম না। ক্রমে এই মনোবিবাদের বৃদ্ধি হইতে লাগিল, আমি তাহার ছায়াও স্পর্শ করিতাম না। শোভন সিং কিন্তু আমার অপকারের চেষ্টা করিতে লাগিল। সুবিধা পাইলেই আমার অনিষ্ট করিতে লগিল। এই সময়ে হঠাৎ হৃদরোগে আমার পিতার মৃত্যু হয়। যখন আমি তাঁহার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হইলাম, তখন হইতে শোভন সিংহের মতিগতি ফিরিতে লাগিল। উপযাচক হইয়া আমার সহিত দেখা করিল, কত মিষ্ট কথায় আমাকে সান্ত্বনা করিল, আপনার অসদাচরণের জন্য বারম্বার ক্ষমা প্রার্থনা করিল। শোভন সিংহের তৎকালীন অবস্থা ও কথাবার্ত্তা শুনিয়া আমার মনে কেমন বিশ্বাস হইল। আমি তাহার বশীভূত হইলাম। ক্রমে ঘনিষ্টতা হইল। উভয়ে মিলিয়া জুয়ার দলে মিশিলাম। তাহার পর যাহা ঘটিল তাহা আর বলিবার নয়। অল্প দিনের মধ্যে আমি নিঃসম্বল হইয়া পড়িলাম। পিতার বহু কষ্টে সঞ্চিত প্রায় লক্ষাধিক টাকা জুয়া খেলিয়া জলে ফেলিয়া দিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার অধিকাংশই শোভন সিংএর উদর পূর্ণ করিয়াছিল। আমাকে নিঃস্ব করিয়াও শোভন সিংএর তৃপ্তি হইল না, সে আমাকে চোর বলিয়া ধরাইয়া দিল। সৌভাগাক্রমে দুইজন ভদ্রলোক সাক্ষী ছিলেন বলিয়াই সে যাত্রা অব্যাহিত পাই। এইরূপে নানা কারণে মনে কেমন বৈরাগ্য উপস্থিত হইল, আমি সংসার ছাড়িয়া গুরুর নিকট যাইলাম। সেখানে দীক্ষা লইয়া সেই নির্জ্জন বনে সাধনা করিতে থাকি। কিছুদিন হইল, এই দুইজনের ইচ্ছায় আমাকে এখানে আসিতে হইয়াছে। কিন্তু এখানেও নিস্তার নাই—শোভন সিং আমাকে প্রাণে মারিবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু তাহাতে সন্ন্যাসীর কি করিবে?

 এই বলিয়া সন্ন্যাসী স্থির হইল। সে যেভাবে কথাগুলি বলিল, তাহাতে তাহার কথা অবিশ্বাস করিতে পারিলাম না। তাহার কথাবার্ত্তায় তাহাকে বিদ্বান ও মহাশয় ব্যক্তি বলিয়া বোধ হইল এবং এতক্ষণ যে তাহার প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হয় নাই, তজ্জন্য অনুতপ্ত হইলাম। আমি তখন অতি বিনীতভাবে বলিলাম,—“শোভন সিং আপনাকেই তাঁহার কন্যার হত্যা কারী বলিয়া সন্দেহ করিয়াছে এবং তাঁহারই কথামত আমি আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়াছি। এখন আপনার মুখে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহাতে আমার অবিশ্বাস নাই। কিন্তু তাহা হইলেও আমি এখন আপনাকে মুক্তি দিতে পারিব না। যতদিন না আপনার বিচার হয়, ততদিন এরূপে থাকিতে হইবে। শোভন সিংয়ের ভাগীনেয়ী আপনাকে দেখিয়াছিল। আমি এখনই তাহাকে এখানে ডাকিয়া আনাইতেছি। যদি সে সনাক্ত করে, তাহা হইলে বিচারে কি হয় বলা যায় না।”

 সন্ন্যাসী ভজন সিং ঈষৎ হাসিয়া বলিল,—“মৃত্যুর জন্য ভয় করি না—যদি অদৃষ্টে থাকে তবে আমার এই অপধাত মৃত্যুও কেহ রোধ করিতে পারিবে না। কিন্ত দেখিতেছি, আপনি ব্রাহ্মণ সন্তান। দেখিবেন, যেন ভ্রমক্রমে একজন নিরীহ ব্রাহ্মণের মৃত্যুর উপলক্ষ না হন।”

 আমি সাগ্রহে উত্তর করিলাম,—“আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। যাহাতে প্রকৃত দোষীকে গ্রেপ্তার করিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে পারি, তজ্জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব। তবে ভবিতব্যের কথা বলিতে পারি, এমন ক্ষমতা আমার নাই।”