খুন না চুরি?/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

খুন না চুরি।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। হাতের কাজ শেষ করিয়া অফিস-ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে পশ্চিমদেশীয় একজন ভদ্রলোক আমার সম্মুখে আসিয়া নমস্কার করতঃ একখানি পত্র দিলেন। পত্রখানি গ্রহণ করিয়া দেখিলাম, উহা আমারই উপরিতন কর্ম্মচারীর লেখা। খুলিয়া পাঠ করিলাম। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে খুন হইয়াছে, আমাকে তখনই পত্রবাহকের সহিত তাহার তদ্বির করিতে যাইতে হইবে।

 কোন কথা জিজ্ঞানা না করিয়া আমি দাঁড়াইয়া উঠিলাম। আগন্তুক আমার অভিপ্রায় বুঝতে পারিয়া পরম আপ্যায়িত হইয়া বলিলেন, “আসুন মহাশয়! আমি ধনে প্রাণে মারা গেলাম। সকল কথা গাড়ীতেই শুনিতে পাইবেন।”

 দ্বিরুক্তি না করিয়া আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইলাম। ফটকের সম্মুখেই তাঁহার গাড়ী ছিল, উভয়েই সে গাড়ীতে উঠিলাম। কোচমান শকট চালনা করিল।

 লোকটীর বয়স প্রায় পয়ত্রিশ বৎসর, দেখিতে অতি সুপুরুষ। বেশ হষ্টপুষ্ট দেহ। তাঁহার পরিধানে একখানি পাতলা দেশী কালাপেড়ে ধুতি, একটা আদ্ধির পিরাণ, একখানি মান্দ্রাজী জরিপেড়ে উড়ানি, মস্তকে একটা ফিরোজা রঙের পাগ,ড়ী, গলায় গিনি সোণার মোটা হার, কর্ণে হীরাবসান ফুল, হস্তে হীরার আংটী, পায়ে বার্ণিশ করা জুতা।

 কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি অতি বিমর্ষভাবে বলিলেন, “মহাশয়, আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। আমার ভাবী-পত্নীকে কে খুন করিয়াছে।”

 ভাবী পত্নীর কথা শুনিয়া আমি বিস্মিত হইলাম, তাঁহার মুখের দিকে একৃষ্টে চাহিয়া রহিলাম। তিনি আমার মনোগত ভাব বুঝিয়া বলিলেন, “দুই বৎসর হইল আমার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাঁহার মৃত্যুর দুই মাস পরে আমার একমাত্র পুত্ত্রও মারা পড়ে। মনে করিয়াছিলাম, আর সংসারে লিপ্ত হইব না; কিন্ত বিধিলিপি অখণ্ডনীয়। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে শোভন সিং নামে আমার একবন্ধু বাস করিতেন। আমি প্রায়ই তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত করিতাম। শোভন সিংএর অবস্থা বড় ভাল ছিল না। তাঁহার একটী কন্যা ছিল। মেয়েটীর বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হইলেও অর্থ-অভাবে তিনি বিবাহ দিতে পারেন নাই। কন্যার নাম রূপসী। তাহার বয়স প্রায় চৌদ্দবৎসর, দেখিতে বেশ সুন্দরী। একদিন কথায় কথায় শোভন সিং কন্যার বিবাহের কথা উত্থাপন করেন এবং আমাকে বিবাহ করিবার জন্য অত্যন্ত অনুরোধ করেন। রূপসী সুন্দরী যুবতী, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার, দু-পয়সার সঙ্গতিও আছে। আমিও পিতার একমাত্র সন্তান, বিবাহ না করিলে বংশ লোপ হইবে, এই আশঙ্কায় বিবাহে সম্মত হইলাম। কিন্তু তাহার পর হইতে শোভন সিং আর বিবাহের কথা উত্থাপন করেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে বিবাহের দিন স্থির করিতে বলি। শোভন সিং আমার কথায় যেন বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, “পাঁচশত টাকা না দিলে আমি রূপসীকে দান করিতে পারিব না।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “শোভন সিং কি পুর্ব্বে টাকার কথা বলেন নাই?”

 তিনি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “না, টাকার নামও করেন নাই। টাকা দিতে হইবে শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, হয় ত তিনি আর কোথাও পাত্র ঠিক করিয়াছেন। এখন টাকা চাহিয়া আমাকে তাড়াইবার চেষ্টায় আছেন। আমার তখন বিবাহে ইচ্ছা হইয়াছে। রূপসীও জানিতে পারিয়াছে যে, তাহার সহিত আমার বিবাহ হইবে। পূর্ব্বের মত সেও আর আমার কাছে আসিত না। কাজেই আমি সম্মত হইলাম। বলিলাম, আমি টাকা দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি বিবাহের দিন স্থির করুন। তখনই একজন দৈবজ্ঞকে ডাকা হইল। তিনি আসিয়া আমাদের বিবাহের দিন ধার্য্য করিয়া দিলেন। কিন্তু দুরদৃষ্ট বশতঃ সে লগ্নে আমাদের বিবাহ হইল না।

 আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া আমি লিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন?”

 তিনি বলিলেন, “বিবাহের দুই দিন পুর্ব্বে শোভন সিংএর এক জ্ঞাতি বিয়োগ হয়। কালাশৌচ, কাজেই বিবাহ হইল না। অশৌচান্তে আবার দিন স্থির হইল। কিন্তু সেবারও বিবাহ হইল না। রূপসীর সাংঘাতিক জ্বর হইল। প্রায় তিন মাস ভুগিয়া রূপসী আরোগ্যলাভ করিল। এইরূপে আরও তিন চারিবার দিন ধার্য্য হইল, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তখনও বিবাহ হইল না। কোন না। কোন অছিলা করিয়া শোভন সিং বিবাহের দিন ক্রমাগত পিছাইয়া দিতে লাগিলেন। প্রায় আট মাস কাল এইরূপে অতিবাহিত হইল। পরে একদিন শোভন সিং বলিলেন যে, রূপসী ও বাড়ীর অন্যান্য লোকের চিকিৎসায় তাঁহার অনেক অর্থব্যয় হইয়া গিয়াছে। যদি আমি আরও তিন শত টাকা দিই, তাহা হইলে আমাদের শীঘ্রই বিবাহ হইতে পারে। আমি তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি। কাজেই শোভন সিংএর প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। বোধ হয় তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি আর অধিক টাকা দিতে স্বীকৃত হইব না। কিন্তু যখন আমি তাহাতেও সম্মত হইলাম, তখন তিনি আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। মুখে বলিলেন, সমস্ত টাকা অগ্রিম দিলেই বিবাহ হইবে। আমিও নাছোড় বন্দা, পরদিনই আটশত টাকা আনিয়া শোভন সিংএর হস্তে দিলাম। তিনি আনন্দিত মনে উহা গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কোন রসিদ দিলেন না, আমিও চক্ষু লজ্জায় পড়িয়া কোন রসিদ চাহিলাম না তবে যখন টাকা দিই, সেই সময়ে সেখানে তিন চারিজন লোক ছিলেন। তাঁহারাই সাক্ষী স্বরূপ ছিলেন। সে যাহা হউক, টাকা পাইয়া শোভন সিং আবার বিবাহের দিন স্থির করিলেন। আজই সেই দিন। বেলা পাঁচটার সময় আমি কয়েকজন মাত্র বরযাত্র লইয়া কন্যার গৃহে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র একটা ভয়ানক গোলযোগ আমার কর্ণগোচর হইল। ক্রমে চীৎকার, ক্রন্দনধ্বনিও শুনিতে পাইলাম। মনে একটা কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হইল। আমার সঙ্গীগণ দেখিয়া শুনিয়া অবাক হইলেন। বর বা বরযাত্র বসিবার স্থান পর্য্যন্ত করা হয় নাই। কি করিব, কোথায় বসিব ভাবিতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমাদের নিকটে আসিলেন। বলিলেন, রূপসীকে কে খুন করিয়াছে। ক্রন্দনের শব্দ শুনিয়া গ্রতিবেশিগণ ছুটিয়া আসিল, বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য হইল। রূপসীর মৃত্যু-সংবাদে দুঃখ হওয়া দুরে থাক, আমার অত্যন্ত ক্রোধ হইল। আমি অতি কর্কশ স্বরে বলিলাম, “চলুন—আমি মৃতদেহ দেখিতে চাই। কেমন করিয়া কেই বা রূপসীকে খুন করিল, আপনিই বা এখনও থানায় এ সংবাদ দেন নাই কেন? আমি বড় ভাল বুঝিতেছি না। ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনরূপ ষড়যন্ত্র আছে। রূপসী যদি সত্য সত্যই খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না। এই দণ্ডে আমার আটশত টাকা চাই।”

 আমার কথায় শোভন সিং কাতর হইলেন। বলিলেন, “আমার কন্যার মৃতদেহ পর্য্যন্ত পাইতেছি না। অগ্রে তাহার সন্ধান না করিয়া কেমন করিয়া থানায় সংবাদ দিব। যদি আপনার ইচ্ছা হয়, আপনি এখনই সংবাদ দিতে পারেন। আমি একা কোন্‌ দিক দেখিব”?

 “কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইল। আমি তখনই সেখান হইতে বিদায় লইলাম এবং তৎক্ষণাৎ বরবেশ ত্যাগ করিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। রূপসীকে পাই ভালই, নচেৎ আমার আটশত টকা ফিরাইয়া চাই। আপনাকে এ টাকা আদায় করিয়া দিতে হইবে।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার নিবাস কোথায়? নামই বা কি?”

 তিনি বলিলেন, “আমার নাম লালসিং, বাড়ী শিয়ালদহের নিকট।”

 লালাসিংএর টাকার কথায় আমি কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া, তিনি পুনরায় ঐ কথা তুলিলেন। আমি বলিলাম, “টাকা আদায় করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমি কেবল খুনের তদ্বির করিতে পারিব।”

 এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীখানি একটী ক্ষুদ্র অট্টালিকার সম্মুখে থামিল। লালসিং অগ্রে গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন। আমিও নামিয়আ তাঁহার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

 কিছুদূর অগ্রসর হইয়া আমরা একটী ক্ষুদ্র প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বিবাহোৎসব সম্পন্ন করিবার জন্য বাড়ীখানি বেশ সাজানো হইয়াছে। চারিদিকে বেলোয়ারি ঝাড় ঝুলিতেছে। একখানি চাঁদোয়া দ্বারা সমস্ত প্রাঙ্গণ আচ্ছাদিত রহিয়াছে। তাহারই নিম্নে একটা ঢালা বিছানা পাড়া ছিল। সেই বিছানার এক পার্শ্বে পাত্রের বসিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু একজন লোককেও সেই শয্যার উপর দেখিতে পাইলাম না। অন্দর হইতে রমনীদিগের রোদনশব্দ আমার কর্ণগোচর হইতে লাগিল। কিন্ত শোভনসিংকে দেখিতে পাইলাম না।

 কিছুক্ষণ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় লালসিং অঙ্গুলি নির্দ্দেশ দ্বারা একজনকে দেখাইয়া বলিলেন, “ইনিই শোভনসিং—আমার ভাবী শ্বশুর।”

 শোভন সিং আমাকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনিই কি আমার কন্যার মৃতদেহ দেখিতে আসিয়াছেন?”

 আমি লালসিংকে দেখাইয়া বলিলাম, “ইনি বলেন আপনার কন্যা খুন হইয়াছে। কিন্ত আপনি ইঁহাকে তাহার মৃতদেহ দেখাইতেছেন না। আমি ইঁহার মুখে সমস্তই শুনিয়াছি। এখন লাস কোথায় বলুন?”