গল্পগুচ্ছ/পণরক্ষা
পণরক্ষা
বংশীবদন তাহার ভাই রসিককে যেমন ভালোবাসিত এমন করিয়া সচরাচর মাও
ছেলেকে ভালোবাসিতে পারে না। পাঠশালা হইতে রসিকের আসিতে যদি কিছু বিলম্ব
হইত তবে সকল কাজ ফেলিয়া সে তাহার সন্ধানে ছুটিত। তাহাকে না খাওয়াইয়া সে
নিজে খাইতে পারিত না। রসিকের অল্প-কিছু অসুখবিসুখ হইলেই বংশীর দুই
চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল ঝরিতে থাকিত।
রসিক বংশীর চেয়ে যোলো বছরের ছোটো। মাঝে যে কয়টি ভাইবোন জন্মিয়াছিল
সবগুলিই মারা গিয়াছে। কেবল এই সব-শেষেরটিকে রাখিয়া যখন রসিকের এক
বছর বয়স তখন তাহার মা মারা গেল এবং রসিক যখন তিন বছরের ছেলে তখন সে
পিতৃহীন হইল। এখন রসিককে মানুষ করিবার ভার একা এই বংশীর উপর।
তাঁতে কাপড় বোনাই বংশীর পৈতৃক ব্যবসায়। এই ব্যাবসা করিয়াই বংশীর বৃদ্ধ-প্রপিতামহ অভিরাম বসাক গ্রামে যে দেবালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছে আজও সেখানে
রাধানাথের বিগ্রহ স্থাপিত আছে। কিন্তু, সমুদ্রপার হইতে এক কল-দৈত্য আসিয়া
বেচারা তাঁতের উপর অগ্নিবাণ হানিল এবং তাঁতির ঘরে ক্ষুধাসুরকে বসাইয়া দিয়া
বাষ্পফুৎকারে মুহুর্মুহু জয়শৃঙ্গ বাজাইতে লাগিল।
তবু তাঁতের কঠিন প্রাণ মরিতে চায় না—ঠুকঠাক ঠুকঠাক করিয়া সুতা দাঁতে
লইয়া মাকু এখনও চলাচল করিতেছে—কিন্তু তাহার সাবেক চালচলন চঞ্চলা লক্ষ্মীর
মনঃপূত হইতেছে না, লোহার দৈত্যটা কলে বলে কৌশলে তাঁহাকে একেবারে বশ
করিয়া লইয়াছে।
বংশীর একটু সুবিধা ছিল। থানাগড়ের বাবুরা তাহার মুরুব্বি ছিলেন। তাঁহাদের
বৃৃহৎ পরিবারের সমুদয় শৌখিন কাপড় বংশীই বুনিয়া দিত। একলা সব পারিয়া
উঠিত না, সেজন্য তাহাকে লোক রাখিতে হইয়াছিল।
যদিচ তাহাদের সমাজে মেয়ের দর বড়ো বেশি, তবু চেষ্টা করিলে বংশী এতদিনে
যেমন-তেমন একটা বউ ঘরে আনিতে পারিত। রসিকের জন্যই সে আর ঘটিয়া উঠিল
না। পূজার সময় কলিকাতা হইতে রসিকের যে সাজ আমদানি হইত তাহা যাত্রার
দলের রাজপুত্রকেও লজ্জা দিতে পারিত। এইরূপ আর-আর সকল বিষয়েই রসিকের
যাহা-কিছু প্রয়োজন ছিল না তাহা জোগাইতে গিয়া বংশীকে নিজের সকল প্রয়োজনই
খর্ব করিতে হইল।
তবু বংশরক্ষা করিতে তো হইবে। তাহাদের বিবাহযোগ্য ঘরের একটি মেয়েকে
মনে মনে ঠিক করিয়া বংশী টাকা জমাইতে লাগিল। তিন-শো টাকা পণ এবং অলংকার
বাবদ আর এক-শো টাকা হইলেই মেয়েটিকে পাওয়া যাইবে স্থির করিয়া অল্প-অল্প
কিছু-কিছু সে খরচ বাঁচাইয়া চলিল। হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না বটে, কিন্তু যথেষ্ট
সময় ছিল। কারণ, মেয়েটির বয়স সবে চার—এখনো অন্তত চার-পাঁচ বছর মেয়াদ
পাওয়া যাইতে পারে।
কিন্তু, কোষ্ঠীতে তাহার সঞ্চয়ের স্থানে দৃষ্টি ছিল রসিকের। সে দৃষ্টি শুভ-গ্রহের দৃষ্টি নহে।
৪০ রসিক ছিল তাহাদের পাড়ার ছোটো ছেলে এবং সমবয়সীদের দলের সর্দার।
যে লোক সুখে মানুষ হয় এবং যাহা চায় তাহাই পাইয়া থাকে ভাগ্যদেবতা কর্তৃক
বঞ্চিত হতভাগাদের পক্ষে তাহার ভারি একটা আকর্ষণ আছে। তাহার কাছে ঘেঁষিতে
পাওয়াই যেন কতকটা পরিমাণে প্রার্থিত বস্তুকে পাওয়ার সামিল। যাহার অনেক আছে
সে যে অনেক দেয় বলিয়াই লোকে তাহার কাছে আনাগোনা করে তাহা নহে—সে কিছু না
দিলেও মানুষের লুব্ধ কল্পনাকে তৃপ্ত করে।
শুধু যে রসিকের শৌখিনতাই পাড়ার ছেলেদের মন মুগ্ধ করিয়াছে এ কথা
বলিলে তাহার প্রতি অবিচার করা হইবে। সকল বিষয়েই রসিকের এমন একটি আশ্চর্য
নৈপুণ্য ছিল যে তাহার চেয়ে উচ্চবংশের ছেলেরাও তাহাকে খাতির না করিয়া থাকিতে
পারিত না। সে যাহাতে হাত দেয় তাহাই অতি সুকৌশলে করিতে পারে। তাহার
মনের উপর যেন কোনো পূর্বসংস্কারের মূঢ়তা চাপিয়া নাই, সেইজন্য সে যাহা দেখে
তাহাই গ্রহণ করিতে পারে।
রসিকের এই কারুনৈপুণ্যের জন্য তাহার কাছে ছেলেমেয়েরা, এমন-কি, তাহাদের
অভিভাবকেরা পর্যন্ত উমেদারি করিত। কিন্তু, তাহার দোষ ছিল কি, কোনো একটা-কিছুতে সে বেশিদিন মন দিতে পারিত না। একটা-কোনো বিদ্যা আয়ত্ত করিলেই
আর সেটা তাহার ভালো লাগিত না—তখন তাহাকে সে বিষয়ে সাধ্যসাধনা করিতে
গেলে সে বিরক্ত হইয়া উঠিত। বাবুদের বাড়িতে দেওয়ালির উৎসবে কলিকাতা হইতে
আতসবাজিওয়ালা আসিয়াছিল—তাহাদের কাছ হইতে সে বাজি তৈরি শিখিয়া কেবল
দুটো বৎসর পাড়ায় কালীপূজার উৎসবকে জ্যোতির্ময় করিয়া তুলিয়াছিল; তৃতীয়
বৎসরে কিছুতেই আর তুবড়ির ফোয়ারা ছুটিল না। রসিক তখন চাপকান-জোব্বা-পরা
মেডেল-ঝোলানো এক নব্য যাত্রাওয়ালার দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া বাক্স হার্মোনিয়ম
লইয়া লক্ষ্মৌ ঠুংরি সাধিতেছিল।
তাহার ক্ষমতার এই খামখেয়ালি লীলায় কখনো সুলভ কখনো দুর্লভ হইয়া সে
লোককে আরও বেশি মুগ্ধ করিত, তাহার নিজের দাদার তো কথাই নাই। দাদা
কেবলই ভাবিত, ‘এমন আশ্চর্য ছেলে আমাদের ঘরে আসিয়া জন্মিয়াছে, এখন কোনো-মতে বাঁচিয়া থাকিলে হয়!’ এই ভাবিয়া নিতান্ত অকারণেই তাহার চোখে জল আসিত
এবং মনে মনে রাধানাথের কাছে ইহাই প্রার্থনা করিত যে, ‘আমি যেন উহার আগে
মরিতে পারি।’
এমনতরো ক্ষমতাশালী ভাইয়ের নিত্যনূতন শখ মিটাইতে গেলে ভাবী বধূ
কেবলই দূরতর ভবিষ্যতে অন্তর্ধান করিতে থাকে, অথচ বয়স চলিয়া যায় অতীতের
দিকেই। বংশীর বয়স যখন ত্রিশ পার হইল, টাকা যখন একশতও পুরিল না, এবং
সেই মেয়েটি অন্যত্র শ্বশুরঘর করিতে গেল, তখন বংশী মনে মনে কহিল, ‘আমার
আর বড়ো আশা দেখি না, এখন বংশরক্ষার ভার রসিককেই লইতে হইবে।’
পাড়ায় যদি স্বয়ম্বরপ্রথা চলিত থাকিত তবে রসিকের বিবাহের জন্য কাহাকেও
ভাবিতে হইত না। বিধু, তারা, ননী, শশী, সুধা—এমন কত নাম করিব—সবাই
রসিককে ভালোবাসিত। রসিক যখন কাদা লইয়া মাটির মূর্তি গড়িবার মেজাজে
থাকিত তখন তাহার তৈরি পুতুলের অধিকার লইয়া মেয়েদের মধ্যে বন্ধুবিচ্ছেদের
উপক্রম হইত। ইহাদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল সৌরভী, সে বড়ো শান্ত—সে চুপ করিয়া বসিয়া পুতুল-গড়া দেখিতে ভালোবাসিত এবং প্রয়োজনমতো রসিককে কাদা
কাঠি প্রভৃতি অগ্রসর করিয়া দিত। তাহার ভারি ইচ্ছা রসিক তাহাকে একটা-কিছু
ফরমাশ করে। কাজ করিতে করিতে রসিক পান চাহিবে জানিয়া সৌরভী তাহা
জোগাইয়া দিবার জন্য প্রতিদিন প্রস্তুত হইয়া আসিত। রসিক স্বহস্তের কীর্তিগুলি
তাহার সামনে সাজাইয়া ধরিয়া যখন বলিত “সৈরি, তুই এর কোনটা নিবি বল্”,
তখন সে ইচ্ছা করিলে যেটা খুশি লইতে পারিত, কিন্তু সংকোচে কোনোটাই লইত না;
রসিক নিজের পছন্দমতো জিনিসটি তাহাকে তুলিয়া দিত। পুতুল-গড়ার পর্ব শেষ
হইলে যখন হার্মোনিয়ম বাজাইবার দিন আসিল তখন পাড়ার ছেলেমেয়েরা সকলেই
এই যন্ত্রটা টেপাটুপি করিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িত, রসিক তাহাদের সকলকেই হুংকার
দিয়া খেদাইয়া রাখিত। সৌরভী কোনো উৎপাত করিত না; সে তাহার ডুরে শাড়ি
পরিয়া, বড়ো বড়ো চোখ মেলিয়া, বাম হাতের উপর শরীরটার ভার দিয়া হেলিয়া
বসিয়া, চুপ করিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিত। রসিক ডাকিত, “আয় সৈরি, একবার
টিপিয়া দেখ্।” সে মৃদু মৃদু হাসিত, অগ্রসর হইতে চাহিত না। রসিক অসম্মতি-সত্ত্বেও নিজের হাতে তাহার আঙুল ধরিয়া তাহাকে দিয়া বাজাইয়া লইত।
সৌরভীর দাদা গোপালও রসিকের ভক্তবৃন্দের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ছিল।
সৌরভীর সঙ্গে তাহার প্রভেদ এই যে, ভালো জিনিস লইবার জন্য তাহাকে কোনো-দিন সাধিতে হইত না। সে আপনি ফরমাশ করিত এবং না পাইলে অস্থির করিয়া
তুলিত। নূতনগোছের যাহা-কিছু দেখিত তাহাই সে সংগ্রহ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া
উঠিত। রসিক কাহারও আবদার বড়ো সহিতে পারিত না, তবুু গোপাল যেন অন্য
ছেলেদের চেয়ে রসিকের কাছে কিছু বেশি প্রশ্রয় পাইত।
বংশী মনে মনে ঠিক করিল, এই সৌরভীর সঙ্গেই রসিকের বিবাহ দিতে হইবে।
কিন্তু সৌরভীর ঘর তাহাদের চেয়ে বড়ো—পাঁচ-শো টাকার কমে কাজ হইবার আশা
নাই।
২
এতদিন বংশী কখনো রসিককে তাহার তাঁত-বোনায় সাহায্য করিতে অনুরোধ করে
নাই। খাটুনি সমস্তই সে নিজের ঘাড়ে লইয়াছিল। রসিক নানাপ্রকার বাজে কাজ
লইয়া লোকের মনোরঞ্জন করিত, ইহা তাহার দেখিতে ভালোই লাগত। রসিক ভাবিত,
‘দাদা কেমন করিয়া যে রোজই এই এক তাঁতের কাজ লইয়া পড়িয়া থাকে কে জানে।
আমি হইলে তো মরিয়া গেলেও পারি না।’ তাহার দাদা নিজের সম্বন্ধে নিতান্তই
টানাটানি করিয়া চালাইত, ইহাতে সে দাদাকে কৃপণ বলিয়া জানিত। তাহার দাদার
সম্বন্ধে রসিকের মনে যথেষ্ট একটা লজ্জা ছিল। শিশুকাল হইতেই সে নিজেকে
তাহার দাদা হইতে সকল বিষয়ে ভিন্ন শ্রেণীর লোক বলিয়াই জানিত। তাহার দাদাই
তাহার এই ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়া আসিয়াছে।
এমন সময়ে বংশী নিজের বিবাহের আশা বিসর্জন দিয়া রসিকেরই বধূ অনিবার
জন্য যখন উৎসুক হইল তখন বংশীর মন আর ধৈর্য মানিতে চাহিল না। প্রত্যেক
মাসের বিলম্ব তাহার কাছে অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। বাজনা বাজিতেছে, আলো জ্বালা হইয়াছে। বরসজ্জা করিয়া রসিকের বিবাহ হইতেছে, এই আনন্দের ছবি বংশীর
মনে তৃষ্ণার্তের সম্মুখে মৃগতৃষ্ণিকার মতো কেবলই জাগিয়া আছে।
তবু যথেষ্ট দ্রুত বেগে টাকা জমিতে চায় না। যত বেশি চেষ্টা করে ততই যেন
সফলতাকে আরও বেশি দূরবর্তী বলিয়া মনে হয়। বিশেষত মনের ইচ্ছার সঙ্গে
শরীরটা সমান বেগে চলিতে চায় না, বারবার ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। পরিশ্রমের মাত্রা
দেহের শক্তিকে ছাড়াইয়া যাইবার জো করিয়াছে।
যখন সমস্ত গ্রাম নিষুপ্ত, কেবল নিশা-নিশাচরীর চৌকিদারের মতো প্রহরে
প্রহরে শৃগালের দল হাঁক দিয়া যাইতেছে, তখনো মিটমিটে প্রদীপে বংশী কাজ
করিতেছে, এমন কত রাত ঘটিয়াছে। বাড়িতে তাহার এমন কেহই ছিল না যে তাহাকে
নিষেধ করে। এ দিকে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর আহার হইতেও বংশী নিজেকে
বঞ্চিত করিয়াছে। গায়ের শীতবস্ত্রখানা জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে, তাহা নানা ছিদ্রের
খিড়কির পথ দিয়া গোপনে শীতকে ডাকিয়া-ডাকিয়াই আনে। গত দুই বৎসর হইতে
প্রত্যেক শীতের সময়ই বংশী মনে করে, ‘এইবারটা একরকম করিয়া চালাইয়া দিই,
আর-একটু হাতে টাকা জমুক, আসছে বছরে যখন কাবুলিওয়ালা তাহার শীতবস্ত্রের
বোঝা লইয়া গ্রামে আসিবে তখন একটা কাপড় ধারে কিনিয়া তাহার পরের বৎসরে
শোধ করিব, ততদিনে তহবিল ভরিয়া উঠিবে।’ সুবিধামতো বৎসর আসিল না।
ইতিমধ্যে তাহার শরীর টেঁকে না এমন হইয়া আসিল।
এতদিন পরে বংশী তাহার ভাইকে বলিল, “তাঁতের কাজ আমি একলা চালাইয়া
উঠিতে পারি না, তুমি আমার কাজে যোগ দাও।” রসিক কোনো জবাব না করিয়া
মুখ বাঁকাইল। শরীরের অসুখে বংশীর মেজাজ খারাপ ছিল, সে রসিককে ভর্ৎসনা
করিল; কহিল, “বাপ-পিতামহের ব্যাবসা পরিত্যাগ করিয়া তুমি যদি দিনরাত হো-হো
করিয়া বেড়াইবে তবে তোমার দশা হইবে কী।”
কথাটা অসংগত নহে এবং ইহাকে কটূক্তিও বলা যায় না। কিন্তু রসিকের মনে
হইল, এত বড়ো অন্যায় তাহার জীবনে সে কোনোদিন সহ্য করে নাই। সেদিন
বাড়িতে সে বড়ো একটা কিছু খাইল না; ছিপ হাতে করিয়া চন্দনীদহে মাছ ধরিতে
বসিল। শীতের মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ, ভাঙা উঁচু পাড়ির উপর শালিক নাচিতেছে,
পশ্চাতের আমবাগানে ঘুঘু ডাকিতেছে, এবং জলের কিনারায় শৈবালের উপর একটি
পতঙ্গ তাহার স্বচ্ছ দীর্ঘ দুই পাখা মেলিয়া দিয়া স্থিরভাবে রৌদ্র পোহাইতেছে। কথা
ছিল, রসিক আজ গোপালকে লাঠিখেলা শিখাইবে—গোপাল তাহার আশু কোনো
সম্ভাবনা না দেখিয়া রসিকের ভাঁড়ের মধ্যেকার মাছ ধরিবার কেঁচোগুলাকে লইয়া
অস্থিরভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করিতে লাগিল—রসিক তাহার গালে ঠাস্ করিয়া এক চড়
বসাইয়া দিল। কখন তাহার কাছে রসিক পান চাহিবে বলিয়া সৌরভী যখন ঘাটের
পাশে ঘাসের উপর দুই পা মেলিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে এমন সময়ে রসিক হঠাৎ
তাহাকে বলিল, “সৈরি, বড়ো ক্ষুধা পাইয়াছে, কিছু খাবার আনিয়া দিতে পারিস?”
সৌরভী খুশি হইয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়া গিয়া বাড়ি হইতে আঁচল ভরিয়া মুড়িমুড়কি
আনিয়া উপস্থিত করিল। রসিক সেদিন তাহার দাদার কাছেও ঘেঁষিল না।
বংশীর শরীর মন খারাপ ছিল, রাত্রে সে তাহার বাপকে স্বপ্ন দেখিল। স্বপ্ন
হইতে উঠিয়া তাহার মন আরও বিকল হইয়া উঠিল। তাহার নিশ্চয় মনে হইল, বংশলোপের আশঙ্কায় তাহার বাপের পরলোকেও ঘুম হইতেছে না।
পরদিন বংশী কিছু জোর করিয়াই রসিককে কাজে বসাইয়া দিল। কেননা, ইহা
তো ব্যক্তিগত সুখদুঃখের কথা নহে, এ যে বংশের প্রতি কর্তব্য। রসিক কাজে বসিল
বটে, কিন্তু তাহাতে কাজের সুবিধা হইল না; তাহার হাত আর চলেই না, পদে পদে
সুতা ছিঁড়িয়া যায়, সুতা সারিয়া তুলিতে তাহার বেলা কাটিতে থাকে। বংশী মনে
করিল, ভালোরূপ অভ্যাস নাই বলিয়াই এমনটা ঘটিতেছে, কিছুদিন গেলেই হাত
দুরস্ত হইয়া যাইবে।
কিন্তু, স্বভাবপটু রসিকের হাত দুরস্ত হইবার দরকার ছিল না বলিয়াই
তাহার হাত দুরস্ত হইতে চাহিল না। বিশেষত তাহার অনুগতবর্গ তাহার সন্ধানে
আসিয়া যখন দেখিত সে নিতান্ত ভালোমানুষটির মতো তাহাদের বাপ-পিতামহের
চিরকালীন ব্যবসায়ে লাগিয়া গেছে, তখন রসিকের মনে ভারি লজ্জা এবং রাগ হইতে
লাগিল।
দাদা তাহাকে তাহার এক বন্ধুর মুখ দিয়া খবর দিল যে, সৌরভীর সঙ্গেই
রসিকের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করা যাইতেছে। বংশী মনে করিয়াছিল, এই
সুখবরটায় নিশ্চয়ই রসিকের মন নরম হইবে। কিন্তু, সেরূপ ফল তো দেখা গেল না।
‘দাদা মনে করিয়াছেন, সৌরভীর সঙ্গে বিবাহ হইলেই আমার মোক্ষলাভ হইবে!’
সৌরভীর প্রতি হঠাৎ তাহার ব্যবহারের এমনি পরিবর্তন হইল যে, সে বেচারা আঁচলের
প্রান্তে পান বাঁধিয়া তাহার কাছে আসিতে আর সাহসই করিত না–সমস্ত রকম-সকম দেখিয়া কী জানি এই ছোটো শান্ত মেয়েটির ভারি কান্না পাইতে লাগিল।
হার্মোনিয়ম বাজনা সম্বন্ধে অন্য মেয়েদের চেয়ে তাহার যে একটু বিশেষ অধিকার
ঘটিয়াছিল সে তো ঘুচিয়াই গেল—তার পর সর্বদাই রসিকের যে ফাইফরমাশ
খাটিবার ভার তাহার উপর ছিল সেটাও রহিল না। হঠাৎ জীবনটা ফাঁকা এবং
সংসারটা নিতান্তই ফাঁকি বলিয়া তাহার কাছে মনে হইতে লাগিল।
এতদিন রসিক এই গ্রামের বনবাদাড়, রথতলা, রাধানাথের মন্দির, নদী, খেয়াঘাট,
বিল, দিঘি, কামারপাড়া, ছুতারপাড়া, হাটবাজার সমস্তই আপনার আনন্দে ও
প্রয়োজনে বিচিত্রভাবে অধিকার করিয়া লইয়াছিল। সব জায়গাতেই তাহার একটা একটা
আড্ডা ছিল, যেদিন যেখানে খুশি কখনো বা একলা কখনো বা দলবলে কিছু-না-কিছু
লইয়া থাকিত। এই গ্রাম এবং থানাগড়ের বাবুদের বাড়ি ছাড়া জগতের আর-যে কোনো
অংশ তাহার জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় তাহা সে কোনোদিন মনেও করে নাই।
আজ এই গ্রামে তাহার মন আর কুলাইল না। দূর দূর বহুদূরের জন্য তাহার চিত্ত
ছটফট করিতে লাগিল। তাহার অবসর যথেষ্ট ছিল—বংশী তাহাকে খুব বেশিক্ষণ
কাজ করাইত না। কিন্তু, ঐ একটুক্ষণ কাজ করিয়াই তাহার সমস্ত অবসর পর্যন্ত
যেন বিস্বাদ হইয়া গেল; এরূপ খণ্ডিত অবসরকে কোনো ব্যবহারে লাগাইতে তাহার
৩
এই সময়ে থানাগড়ের বাবুদের এক ছেলে এক বাইসিকল কিনিয়া আনিয়া চড়া
অভ্যাস করিতেছিল। রসিক সেটাকে লইয়া অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন আয়ত্ত
করিয়া লইল যেন সে তাহার নিজেরই পায়ের তলাকার একটা ডানা। কিন্তু, কী
চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন
তীক্ষ্ণ সুদর্শনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের
বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের মতো মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া
ছোটে। রামায়ণ-মহাভারতের সময় মানুষে কখনো কখনো দেবতার অস্ত্র লইয়া যেমন
ব্যবহার করিতে পাইত এ যেন সেইরকম।
রসিকের মনে হইল, এই বাইসিকল নহিলে তাহার জীবন বৃথা। দাম এমনই
কী বেশি। এক-শো পঁচিশ টাকা মাত্র! এই এক-শো পঁচিশ টাকা দিয়া মানুষ একটা
নূতন শক্তি লাভ করিতে পারে—ইহা তো সস্তা। বিষ্ণুর গরুড়বাহন এবং সূর্যের
অরুণসারথি তো সৃষ্টিকর্তাকে কম ভোগ ভোগায় নাই, আর ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবার জন্য
সমুদ্রমন্থন করিতে হইয়াছিল—কিন্তু এই বাইসিকলটি তাহার পৃথিবীজয়ী গতি-বেগ স্তব্ধ করিয়া কেবল এক-শো পঁচিশ টাকার জন্য দোকানের এক কোণে দেয়াল
ঠেস দিয়া প্রতীক্ষা করিয়া আছে।
দাদার কাছে রসিক আর-কিছু চাহিবে না পণ করিয়াছিল, কিন্তু সে পণ রক্ষা
হইল না। তবে চাওয়াটার কিছু বেশ পরিবর্তন করিয়া দিল। কহিল, “আমাকে
এক-শো পঁচিশ টাকা ধার দিতে হইবে।”
বংশীর কাছে রসিক কিছুদিন হইতে কোনো আবদার করে নাই, ইহাতে
শরীরের অসুখের উপর আর-একটা গভীরতর বেদনা বংশীকে দিনরাত্রি পীড়া
দিতেছিল। তাই রসিক তাহার কাছে দরবার উপস্থিত করিবামাত্রই মুহূর্তের জন্য
বংশীর মন নাচিয়া উঠিল; মনে হইল, ‘দূর হোকগে ছাই, এমন করিয়া আর টানা-টানি করা যায় না—দিয়া ফেলি।’ কিন্তু বংশ? সে যে একেবারেই ডোবে! এক-শো
পঁচিশ টাকা দিলে আর বাকি থাকে কী। ধার! রসিক এক-শো পঁচিশ টাকা ধার
শুধিবে! তাই যদি সম্ভব হইত তবে তো বংশী নিশ্চিন্ত হইয়া মরিতে পারিত।
বংশী মনটাকে একেবারে পাথরের মতো শক্ত করিয়া বলিল, “সে কি হয়। এক-শো
পঁচিশ টাকা আমি কোথায় পাইব।”
রসিক বন্ধুদের কাছে বলিল, “এ টাকা যদি না পাই তবে আমি বিবাহ
করিবই না।”
বংশীর কানে যখন সে কথা গেল তখন সে বলিল, “এও তো মজা মন্দ নয়।
পাত্রীকে টাকা দিতে হইবে, আবার পাত্রকে না দিলেও চলিবে না। এমন দায় তো
আমাদের সাত পুরুষের মধ্যে কখনো ঘটে নাই।”
রসিক সুস্পষ্ট বিদ্রোহ করিয়া তাঁতের কাজ হইতে অবসর লইল। জিজ্ঞাসা
করিলে বলে, “আমার অসুখ করিয়াছে।” তাঁতের কাজ না করা ছাড়া তাহার আহার-বিহারে অসুখের অন্য কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। বংশী মনে মনে একটু
অভিমান করিয়া বলিল, “থাক্, উহাকে আমি আর কখনো কাজ করিতে বলিব না।” বলিয়া রাগ করিয়া নিজেকে আরও বেশি কষ্ট দিতে লাগিল। বিশেষত সেই বছরেই
বয়কটের কল্যাণে হঠাৎ তাঁতের কাপড়ের দর এবং আদর অত্যন্ত বাড়িয়া গেল।
তাঁতিদের মধ্যে যাহারা অন্য কাজে ছিল তাহারাও প্রায় সকলে তাঁতে ফিরিল।
নিয়তচঞ্চল মাকুগুলা ইঁদুর-বাহনের মতো সিদ্ধিদাতা গণনায়ককে বাংলাদেশের
তাঁতির ঘরে দিনরাত কাঁধে করিয়া দৌড়াইতে লাগিল। এখন এক মুহূর্ত তাঁত
কামাই পড়িলে বংশীর মন অস্থির হইয়া উঠে; এই সময়ে রসিক যদি তাহার সাহায্য
করে তবে দুই বৎসরের কাজ ছয় মাসে আদায় হইতে পারে, কিন্তু সে আর ঘটিল
না। কাজেই ভাঙা শরীর লইয়া বংশী একেবারে সাধ্যের অতিরিক্ত পরিশ্রম করিতে
লাগিল।
রসিক প্রায় বাড়ির বাহিরে বাহিরেই কাটায়। কিন্তু, হঠাৎ একদিন যখন সন্ধ্যার
সময় বংশীর হাত আর চলে না, পিঠের দাঁড়া যেন ফাটিয়া পড়িতেছে, কেবলই
কাজের গোলমাল হইয়া যাইতেছে এবং তাহা সারিয়া লইতে বৃথা সময় কাটিতেছে,
এমন সময় শুনিতে পাইল, সেই কিছুকালের উপেক্ষিত হার্মোনিয়ম যন্ত্রে আবার
লক্ষ্মৌ ঠুংরি বাজিতেছে। এমন দিন ছিল যখন কাজ করিতে করিতে রসিকের
এই হার্মোনিয়ম বাজনা শুনিলে গর্বে ও আনন্দে বংশীর মন পুলকিত হইয়া
উঠিত; আজ একেবারেই সেরূপ হইল না। সে তাঁত ফেলিয়া ঘরের আঙিনার কাছে
আসিয়া দেখিল একজন কোথাকার অপরিচিত লোককে রসিক বাজনা শুনাইতেছে।
ইহাতে তাহার জ্বরতপ্ত ক্লান্ত দেহ আরও জ্বলিয়া উঠিল। মুখে তাহার যাহা
আসিল তাহাই বলিল। রসিক উদ্ধত হইয়া জবাব করিল, “তোমার অন্নে যদি আমি
ভাগ বসাই তবে আমি” ইত্যাদি ইত্যাদি। বংশী কহিল, “আর মিথ্যা বড়াই করিয়া
কাজ নাই, তোমার সামর্থ্য যতদূর ঢের দেখিয়াছি! শুধু বাবুদের নকলে বাজনা
বাজাইয়া নবাবি করিলেই তো হয় না।” বলিয়া সে চলিয়া গেল—আর তাঁতে বসিতে
পারিল না; ঘরে মাদুরে গিয়া শুইয়া পড়িল।
রসিক যে হার্মোনিয়ম বাজাইয়া চিত্তবিনোদন করিবার জন্য সঙ্গী জুটাইয়া
আনিয়াছিল তাহা নহে। থানাগড়ে যে সার্কাসের দল আসিয়াছিল রসিক সেই দলে
চাকরির উমেদারি করিতে গিয়াছিল। সেই দলেরই একজনের কাছে নিজের ক্ষমতার
পরিচয় দিবার জন্য তাহাকে যতগুলি গৎ জানে একে একে শুনাইতে প্রবৃত্ত
হইয়াছিল—এমন সময় সংগীতের মাঝখানে নিতান্ত অন্যরকম সুর আসিয়া
পৌঁছিল।
আজ পর্যন্ত বংশীর মুখ দিয়া এমন কঠিন কথা কখনো বাহির হয় নাই। নিজের
বাক্যে সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। তাহার মনে হইল, যেন তাহাকে অবলম্বন
করিয়া আর-একজন কে এই নিষ্ঠুর কথাগুলো বলিয়া গেল। এমনতরো মর্মান্তিক
ভর্ৎসনার পরে বংশীর পক্ষে আর তাহার সঞ্চয়ের টাকা রক্ষা করা সম্ভবপর নহে।
যে টাকার জন্য হঠাৎ এমন অভাবনীয় কাণ্ডটা ঘটিতে পারিল সেই টাকার উপর
বংশীর ভারি একটা রাগ হইল—তাহাতে আর তাহার কোনো সুখ রহিল না। রসিক যে
তাহার কত আদরের সামগ্রী, এই কথা কেবলই তাহার মনের মধ্যে তোলপাড় করিতে
লাগিল। যখন সে ‘দাদা’ শব্দ উচ্চারণ করিতে পারিত না, যখন তাহার দুরন্ত হস্ত
হইতে তাঁতের সুতাগুলোকে রক্ষা করা এক বিষম ব্যাপার ছিল, যখন তাহার দাদা হাত বাড়াইবামাত্র সে অন্য সকলের কোল হইতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া সবেগে তাহার
বুকের উপর আসিয়া পড়িত, এবং তাহার ঝাঁকড়া চুল ধরিয়া টানাটানি করিত,
তাহার নাক ধরিয়া দন্তহীন মুখের মধ্যে পুরিবার চেষ্টা করিত, সে-সমস্তই
সুস্পষ্ট মনে পড়িয়া বংশীর প্রাণের ভিতরটাতে হাহা করিতে লাগিল। সে আর
শুইয়া থাকিতে পারিল না। রসিকের নাম ধরিয়া বার-কয়েক করুণকণ্ঠে ডাকিল।
সাড়া না পাইয়া তাহার জ্বর লইয়াই সে উঠিল। গিয়া দেখিল, সেই হার্মোনিয়মটা
পাশে পড়িয়া আছে, অন্ধকারে দাওয়ায় রসিক চুপ করিয়া একলা বসিয়া। তখন
বংশী কোমর হইতে সাপের মতো সরু লম্বা এক থলি খুলিয়া ফেলিল, রুদ্ধপ্রায়-কণ্ঠে কহিল, “এই নে, ভাই—আমার এ টাকা সমস্ত তোরই জন্য। তোরই বউ ঘরে
আনিব বলিয়া আমি এ জমাইতেছিলাম। কিন্তু, তোকে কাঁদাইয়া আমি জমাইতে
পারিব না, ভাই আমার, গোপাল আমার—আমার সে শক্তি নাই—তুই চাকার গাড়ি
কিনিস, তোর যা খুশি তাই করিস।”
রসিক দাঁড়াইয়া উঠিয়া শপথ করিয়া কঠোরস্বরে কহিল, “চাকার গাড়ি কিনিতে
হয়, বউ আনিতে হয়, আমার নিজের টাকায় করিব—তোমার ও টাকা আমি ছুঁইব
না।” বলিয়া বংশীর উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। উভয়ের মধ্যে
আর এই টাকার কথা বলার পথ রহিল না—কোনো কথা বলাই অসম্ভব হইয়া
উঠিল।
৪
রসিকের ভক্তশ্রেষ্ঠ গোপাল আজকাল অভিমান করিয়া দূরে দূরে থাকে। রসিকের
সামনে দিয়া তাহাকে দেখাইয়া দেখাইয়া একাই মাছ ধরিতে যায়, আগেকার মতো
তাহাকে ডাকাডাকি করে না। আর, সৌরভীর তো কথাই নাই। রসিকদাদার সঙ্গে
তাহার আড়ি, একেবারে জন্মের মতো আড়ি—অথচ সে যে এত বড়ো একটা ভয়ংকর
আড়ি করিয়াছে, সেটা রসিককে স্পষ্ট করিয়া জানাইবার সুযোগ না পাইয়া, আপন-মনে
ঘরের কোণে অভিমানে ক্ষণে ক্ষণে কেবলই তাহার দুই চোখ ভরিয়া উঠিতে লাগিল।
এমন সময় একদিন রসিক মধ্যাহ্নে গোপালদের বাড়িতে গিয়া তাহাকে ডাক দিল।
আদর করিয়া তাহার কান মলিয়া দিল, তাহাকে কাতুকুতু দিতে লাগিল। গোপাল
প্রথমটা প্রবল আপত্তি প্রকাশ করিয়া লড়াইয়ের ভাব দেখাইল, কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা
রাখিতে পারিল না; দুইজনে বেশ হাস্যালাপ জমিয়া উঠিল। রসিক কহিল,
“গোপাল, আমার হার্মোনিয়মটি নিবি?”
হার্মোনিয়ম! এত বড়ো দান! কলির সংসারে এও কি কখনো সম্ভব। কিন্তু,
যে জিনিসটা তাহার ভালো লাগে বাধা না পাইলে সেটা অসংকোচে গ্রহণ করিবার
শক্তি গোপালের যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। অতএব হার্মোনিয়মটি সে অবিলম্বে অধিকার
করিয়া লইল; বলিয়া রাখিল, ফিরিয়া চাহিলে আর কিন্তু পাইবে না।
গোপালকে যখন রসিক ডাক দিয়াছিল তখন নিশ্চয় জানিয়াছিল, সে ডাক
অন্তত আরও একজনের কানে গিয়া পৌঁছিয়াছে। কিন্তু, বাহিরে আজ তাহার
কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। তখন রসিক গোপালকে বলিল, “সৈরি কোথায় আছে একবার ডাকিয়া আন্ তো।”
গোপাল ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “সৈরি বলিল, তাহাকে এখন বড়ি শুকাইতে
দিতে হইবে, তাহার সময় নাই।” রসিক মনে মনে হাসিয়া কহিল, “চল্ দেখি, সে
কোথায় বড়ি শুকাইতেছে।” রসিক আঙিনার মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল, কোথাও
বড়ির নামগন্ধ নাই। সৌরভী তাহাদের পায়ের শব্দ পাইয়া আর-কোথাও লুকাইবার
উপায় না দেখিয়া তাহাদের দিকে পিঠ করিয়া মাটির প্রাচীরের কোণ ঠেসিয়া
দাঁড়াইল। রসিক তাহার কাছে গিয়া তাহাকে ফিরাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “রাগ
করেছিস সৈরি?” সে আঁকিয়া-বাঁকিয়া রসিকের চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া দেয়ালের
দিকেই মুখ করিয়া রহিল।
একদা রসিক আপন খেয়ালে নানা রঙের সুতা মিলাইয়া নানা চিত্রবিচিত্র করিয়া
একটা কাঁথা শেলাই করিতেছিল। মেয়েরা যে কাঁথা শেলাই করিত তাহার কতকগুলা
বাঁধা নকশা ছিল, কিন্তু রসিকের সমস্তই নিজের মনের রচনা। যখন এই শেলাইয়ের
ব্যাপার চলিতেছিল তখন সৌরভী আশ্চর্য হইয়া একমনে তাহা দেখিত; সে মনে
করিত, জগতে কোথাও এমন আশ্চর্য কাঁথা আজ পর্যন্ত রচিত হয় নাই। প্রায়
যখন কাঁথা শেষ হইয়া আসিয়াছে এমন সময়ে রসিকের বিরক্তি বোধ হইল, সে আর
শেষ করিল না। ইহাতে সৌরভী মনে ভারি পীড়া বোধ করিয়াছিল; এইটে শেষ
করিয়া ফেলিবার জন্য সে রসিককে কতবার যে কত সানুনয় অনুরোধ করিয়াছে
তাহার ঠিক নাই। আর ঘণ্টা দুই-তিন বসিলেই শেষ হইয়া যায়, কিন্তু রসিকের
যাহাতে গা লাগে না তাহাতে তাহাকে প্রবৃত্ত করাইতে কে পারে। হঠাৎ এতদিন
পরে রসিক কাল রাত্রি জাগিয়া সেই কাঁথাটি শেষ করিয়াছে।
রসিক বলিল, “সৈরি, সেই কাঁথাটা শেষ করিয়াছি, একবার দেখবি না?”
অনেক কষ্টে সৌরভী মুখ ফিরাইতেই সে আঁচল দিয়া মুখ ঝাঁপিয়া ফেলিল।
তখন যে তাহার দুই কপোল বাহিয়া জল পড়িতেছিল, সে জল সে দেখাইবে কেমন
করিয়া।
সৌরভীর সঙ্গে তাহার পূূর্বের সহজ সম্বন্ধ স্থাপন করিতে রসিকের যথেষ্ট
সময় লাগিল। অবশেষে উভয় পক্ষে সন্ধি যখন এতদূর অগ্রসর হইল যে সৌরভী
রসিককে পান আনিয়া দিল তখন রসিক সেই কাঁথার আবরণ খুলিয়া সেটা আঙিনার
উপর মেলিয়া দিল—সৌরভীর হৃদয়টি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেল। অবশেষে
যখন রসিক বলিল, “সৈরি, এ কাঁথা তোর জন্যই তৈরি করিয়াছি, এটা আমি তোকেই
দিলাম”, তখন এতবড়ো অভাবনীয় দান কোনোমতেই সৌরভী স্বীকার করিয়া
লইতে পারিল না। পৃথিবীতে সৌরভী কোনো দুর্লভ জিনিস দাবি করিতে শেখে
নাই। গোপাল তাহাকে খুব ধমক দিল। মানুষের মনস্তত্ত্বের সুক্ষ্মতা সম্বন্ধে তাহার
কোনো বোধ ছিল না; সে মনে করিল, লোভনীয় জিনিস লইতে লজ্জা একটা
নিরবচ্ছিন্ন কপটতামাত্র। গোপাল ব্যর্থ কালব্যয়-নিবারণের জন্য নিজেই কাঁথাটা ভাঁজ
করিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে রাখিয়া আসিল। বিচ্ছেদ মিটমাট হইয়া গেল। এখন
হইতে আবার পূর্বতন প্রণালীতে তাহাদের বন্ধুত্বের ইতিহাসের দৈনিক অনুবৃত্তি
চলিতে থাকিবে, দুটি বালক-বালিকার মন এই আশায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিল।
সেদিন পাড়ায় তাহার দলের সকল ছেলেমেয়ের সঙ্গেই রসিক আগেকার মতোই ভাব করিয়া লইল; কেবল তাহার দাদার ঘরে একবারও প্রবেশ করিল না। যে প্রৌঢ়া
বিধবা তাহাদের বাড়িতে আসিয়া রাঁধিয়া দিয়া যায় সে আসিয়া যখন সকালে বংশীকে
জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইবে”, বংশী তখন বিছানায় শুইয়া। সে বলিল,
“আমার শরীর ভালো নাই, আজ আমি কিছু খাইব না—রসিককে ডাকিয়া তুমি
খাওয়াইয়া দিয়ো।” স্ত্ৰীলোকটি বলিল, রসিক তাহাকে বলিয়াছে সে আজ বাড়িতে
খাইবে না—অন্যত্র বোধ করি তাহার নিমন্ত্রণ আছে। শুনিয়া বংশী দীর্ঘনিশ্বাস
ফেলিয়া গায়ের কাপড়টায় মাথা পর্যন্ত মুড়িয়া পাশ ফিরিয়া শুইল।
রসিক যেদিন সন্ধ্যার পর গ্রাম ছাড়িয়া সার্কাসের দলের সঙ্গে চলিয়া গেল
সেদিন এমনি করিয়াই কাটিল। শীতের রাত্রি; আকাশে আধখানি চাঁদ উঠিয়াছে।
সেদিন হাট সারিয়া সকলেই চলিয়া গিয়াছে—কেবল যাহাদের দূর পাড়ায় বাড়ি
এখনো তাহারা মাঠের পথে কথা কহিতে কহিতে চলিয়াছে। একখানি বোঝাইশূন্য
গোরুর গাড়িতে গাড়োয়ান র্যাপার মুড়ি দিয়া নিদ্রামগ্ন; গোরু দুটি আপন-মনে
ধীরে ধীরে বিশ্রামশালার দিকে গাড়ি টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। গ্রামের গোয়ালঘর
হইতে খড়-জ্বালানো ধোঁয়া বায়ুহীন শীতরাত্রে হিমভারাক্রান্ত হইয়া স্তরে স্তরে
বাঁশঝাড়ের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া আছে। রসিক যখন প্রান্তরের প্রান্তে গিয়া পৌঁছিল,
যখন অস্ফুট চন্দ্রালোকে তাহাদের গ্রামের ঘন গাছগুলির নীলিমাও আর দেখা যায়
না, তখন রসিকের মনটা কেমন করিয়া উঠিল। তখনো ফিরিয়া আসার পথ কঠিন
ছিল না, কিন্তু তখনো তাহার হৃদয়ের কঠিনতা যায় নাই। ‘উপার্জন করি না অথচ
দাদার অন্ন খাই’ যেমন করিয়া হউক এ লাঞ্ছনা না মুছিয়া, নিজের টাকায় কেনা
বাইসিকলে না চড়িয়া আজন্মকালের এই গ্রামে আর ফিরিয়া আসা চলিবে না—রহিল এখানকার চন্দনীদহের ঘাট, এখানকার সুখসাগর দিঘি, এখানকার ফাল্গুন
মাসে সর্ষেখেতের গন্ধ, চৈত্র মাসে আমবাগানে মৌমাছির গুঞ্জনধ্বনি; রহিল এখান-কার বন্ধুত্ব, এখানকার আমোদ-উৎসব—এখন সম্মুখে অপরিচিত পৃথিবী, অনাত্মীয়
সংসার এবং ললাটে অদৃষ্টের লিখন।
৫
রসিক একমাত্র তাঁতের কাজেই যত অসুবিধা দেখিয়াছিল; তাহার মনে হইত,
আর-সকল কাজই ইহার চেয়ে ভালো। সে মনে করিয়াছিল, একবার তাহার সংকীর্ণ
ঘরের বন্ধন ছেদন করিয়া বাহির হইতে পারিলেই তাহার কোনো ভাবনা নাই। তাই
সে ভারি আনন্দে পথে বাহির হইয়াছিল। মাঝখানে যে কোনো বাধা, কোনো কষ্ট,
কোনো দীর্ঘকালব্যয় আছে, তাহা তাহার মনেও হইল না। বাহিরে দাঁড়াইয়া দূরের
পাহাড়কেও যেমন মনে হয় অনতিদূরে—যেমন মনে হয়, আধ ঘণ্টার পথ পার
হইলেই বুঝি তাহার শিখরে গিয়া পৌঁছিতে পারা যায়—তাহার গ্রামের বেষ্টন
হইতে বাহির হইবার সময় নিজের ইচ্ছার দুর্লভ সার্থকতাকে রসিকের তেমনি
সহজগম্য এবং অত্যন্ত নিকটবর্তী বলিয়া বোধ হইল। কোথায় যাইতেছে, রসিক
কাহাকেও তাহার কোনো খবর দিল না। একদিন স্বয়ং সে খবর বহন করিয়া আসিবে,
এই তাহার পণ রহিল। কাজ করিতে গিয়া দেখিল, বেগারের কাজে আদর পাওয়া যায় এবং সেই আদর
সে বরাবর পাইয়াছে, কিন্তু যেখানে গরজের কাজ সেখানে দয়ামায়া নাই। বেগারের
কাজে নিজের ইচ্ছা-নামক পদার্থটাকে খুব কষিয়া দৌড় করানো যায়; সেই ইচ্ছার
জোরেই সে কাজে এমন অভাবনীয় নৈপুণ্য জাগিয়া উঠিয়া মনকে এত উৎসাহিত
করিয়া তোলে। কিন্তু, বেতনের কাজে এই ইচ্ছা একটা বাধা; এই কাজের তরণীতে
অনিশ্চিত ইচ্ছার হাওয়া লাগাইবার জন্য পালের কোনো বন্দোবস্ত নাই, দিনরাত
কেবল মজুরের মতো দাঁড় টানা এবং লগি ঠেলা। যখন দর্শকের মতো দেখিয়াছিল
তখন রসিক মনে করিয়াছিল, সার্কাসে ভারি মজা। কিন্তু, ভিতরে যখন প্রবেশ করিল
মজা তখন সম্পূর্ণ বাহির হইয়া গিয়াছে। যাহা আমোদের জিনিস যখন তাহা
আমোদ দেয় না, যখন তাহার প্রতিদিনের পুনরাবৃত্তি বন্ধ হইলে প্রাণ বাঁচে অথচ
তাহা কিছুতেই বন্ধ হইতে চায় না, তখন তাহার মতো অরুচিকর জিনিস আর-কিছুই
হইতে পারে না। এই সার্কাসের দলের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া রসিকের প্রত্যেক দিনই
তাহার পক্ষে একান্ত বিস্বাদ হইয়া উঠিল। সে প্রায়ই বাড়ির স্বপ্ন দেখে। রাত্রে
ঘুম হইতে জাগিয়া অন্ধকারে প্রথমটা রসিক মনে করে, সে তাহার দাদার বিছানার
কাছে শুইয়া আছে; মুহূর্তকাল পরেই চমক ভাঙিয়া দেখে, দাদা কাছে নাই। বাড়িতে
থাকিতে এক-একদিন শীতের রাত্রে ঘুমের ঘোরে সে অনুভব করিত, দাদা তাহার শীত
করিতেছে মনে করিয়া তাহার গাত্রবস্ত্রের উপর নিজের কাপড়খানা ধীরে ধীরে চাপাইয়া
দিতেছে। এখানে পৌষের রাত্রে যখন ঘুমের ঘোরে তাহার শীত-শীত করে তখন
দাদা তাহার গায়ে ঢাকা দিতে আসিবে মনে করিয়া সে যেন অপেক্ষা করিতে থাকে—দেরি হইতেছে দেখিয়া রাগ হয়। এমন সময় জাগিয়া উঠিয়া মনে পড়ে, দাদা কাছে
নাই এবং সেই সঙ্গে ইহাও মনে হয় যে, এই শীতের সময় তাহার গায়ে আপন
কাপড়টি টানিয়া দিতে না পারিয়া আজ রাত্রে শূন্যশয্যার প্রান্তে তাহার দাদার মনে
শান্তি নাই। তখনই সেই অর্ধরাত্রে সে মনে করে, ‘কাল সকালে উঠিয়াই আমি ঘরে
ফিরিয়া যাইব।’ কিন্তু, ভালো করিয়া জাগিয়া উঠিয়া, আবার সে শক্ত করিয়া প্রতিজ্ঞা
করে, মনে মনে আপনাকে বারবার করিয়া জপাইতে থাকে যে, ‘আমি পণের টাকা
ভর্তি করিয়া বাইসিকলে চড়িয়া বাড়ি ফিরিব, তবে আমি পুরুষমানুষ, তবে আমার
নাম রসিক।’
একদিন দলের কর্তা তাহাকে তাঁতি বলিয়া বিশ্রী করিয়া গালি দিল। সেইদিন
রসিক তাহার সামান্য কয়েকটি কাপড় ঘটি ও থালাবাটি, নিজের যে-কিছু ঋণ ছিল
তাহার পরিবর্তে ফেলিয়া রাখিয়া সম্পূর্ণ রিক্তহস্তে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
সমস্তদিন কিছু খাওয়া হয় নাই। সন্ধ্যার সময় যখন নদীর ধারে দেখিল গোরুগুলা
আরামে চরিয়া খাইতেছে তখন একপ্রকার ঈর্ষার সহিত তাহার মনে হইতে লাগিল,
পৃথিবী যথার্থ এই পশুপক্ষীদের মা—নিজের হাতে তাহাদের মুখে আহারের গ্রাস
তুলিয়া দেন—আর, মানুষ বুঝি তাঁর কোন্ সতিনের ছেলে, তাই চারি দিকে এত
বড়ো মাঠ ধূ ধূ করিতেছে, কোথাও রসিকের জন্য একমুষ্টি অন্ন নাই। নদীর
কিনারায় গিয়া রসিক অঞ্জলি ভরিয়া খুব খানিকটা জল খাইল। এই নদীটির ক্ষুধা
নাই, তৃষ্ণা নাই, কোনো ভাবনা নাই, কোনো চেষ্টা নাই, ঘর নাই তবু ঘরের অভাব
নাই, সম্মুখে অন্ধকার রাত্রি আসিতেছে তবু সে নিরুদ্বেগে নিরুদ্দেশের অভিমুখে ছুটিয়া চলিয়াছে—এই কথা ভাবিতে ভাবিতে রসিক একদৃষ্টে জলের স্রোতের দিকে
চাহিয়া বসিয়া রহিল; বোধ করি তাহার মনে হইতেছিল, দুর্বহ মানবজন্মটাকে এই
বন্ধনহীন নিশ্চিন্ত জলধারার সঙ্গে মিশাইয়া ফেলিতে পারিলেই একমাত্র শান্তি।
এমন সময় একজন তরুণ যুবক মাথা হইতে একটা বস্তা নামাইয়া তাহার পাশে
বসিয়া কোঁচার প্রান্ত হইতে চিঁড়া খুলিয়া লইয়া ভিজাইয়া খাইবার উদ্যোগ করিল।
এই লোকটিকে দেখিয়া রসিকের কিছু নূতন রকমের ঠেকিল। পায়ে জুতা নাই,
ধুতির উপর একটা জামা, মাথায় পাগড়ি পরা—দেখিবামাত্র স্পষ্ট মনে হয়, ভদ্র-লোকের ছেলে—কিন্তু মুটে-মজুরের মতো কেন যে সে এমন করিয়া বস্তা বহিয়া
বেড়াইতেছে ইহা সে বুঝিতে পারিল না। দুইজনের আলাপ হইতে দেরি হইল না
এবং রসিক ভিজা চিঁড়ার যথোচিত পরিমাণে ভাগ লইল। এ ছেলেটি কলিকাতার
কলেজের ছাত্র। ছাত্রেরা যে স্বদেশী কাপড়ের দোকান খুলিয়াছে তাহারই জন্য দেশি
কাপড় সংগ্রহ করিতে সে এই গ্রামের হাটে আসিয়াছে। নাম সুবোধ, জাতিতে
ব্রাহ্মণ। তাহার কোনো সংকোচ নাই, বাধা নাই—সমস্তদিন হাটে ঘুরিয়া সন্ধ্যাবেলায়
চিঁড়া ভিজাইয়া খাইতেছে।
দেখিয়া নিজের সম্বন্ধে রসিকের ভারি একটা লজ্জা বোধ হইল। শুধু তাই নয়,
তাহার মনে হইল ‘যেন মুক্তি পাইলাম’। এমন করিয়া খালি পায়ে মজুরের মতো
যে মাথায় মোট বহিতে পারা যায় ইহা উপলব্ধি করিয়া জীবনযাত্রার ক্ষেত্র এক
মুহূর্তে তাহার সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল। সে ভাবিতে লাগিল, ‘আজ তো
আমার উপবাস করিবার কোনো দরকারই ছিল না—আমি তো ইচ্ছা করিলেই মোট
বহিতে পারিতাম।’
সুবোধ যখন মোট মাথায় লইতে গেল রসিক বাধা দিয়া বলিল, “মোট আমি
বহিব।” সুবোধ তাহাতে নারাজ হইলে রসিক কহিল, “আমি তাঁতির ছেলে, আমি
আপনার মোট বহিব, আমাকে কলিকাতায় লইয়া যান।” ‘আমি তাঁতি’, আগে হইলে
রসিক এ কথা কখনোই মুখে উচ্চারণ করিতে পারিত না—তাহার বাধা কাটিয়া
গেছে।
সুবোধ তো লাফাইয়া উঠিল; বলিল, “তুমি তাঁতি! আমি তো তাঁতি খুঁজিতেই
বাহির হইয়াছি। আজকাল তাহাদের দর এত বাড়িয়াছে যে, কেহই আমাদের তাঁতের
স্কুলে শিক্ষকতা করিতে যাইতে রাজি হয় না।”
রসিক তাঁতের স্কুলের শিক্ষক হইয়া কলিকাতায় আসিল। এত দিন পরে
বাসা-খরচ বাদে সে সামান্য কিছু জমাইতে পারি, কিন্তু বাইসিকলচক্রের লক্ষ্য
ভেদ করিতে এখনো অনেক বিলম্ব আছে। আর, বধূর বরমাল্যের তো কথাই নাই!—ইতিমধ্যে তাঁতের স্কুলটা গোড়ায় যেমন হঠাৎ জ্বলিয়া উঠিয়াছিল তেমনি হঠাৎ
নিবিয়া যাইবার উপক্রম হইল। কমিটির বাবুরা যতক্ষণ কমিটি করিতে থাকেন অতি
চমৎকার হয়, কিন্তু কাজ করিতে নামিলেই গণ্ডগোল বাধে; তাঁহারা নানা দিগ্দেশ
হইতে নানা প্রকারের তাঁত আনাইয়া শেষকালে এমন একটা অপরূপ জঞ্জাল বুনিয়া
তুলিলেন যে, সমস্ত ব্যাপারটা লইয়া যে কোন্ আবর্জনাকুণ্ডে ফেলা যাইতে পারে
তাহা কমিটির পর কমিটি করিয়াও স্থির করিতে পারিলেন না।
রসিকের আর সহ্য হয় না। ঘরে ফিরিবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। চোখের সামনে সে কেবলই আপনার গ্রামের নানা ছবি দেখিতেছে। অতি
তুচ্ছ খুঁটিনাটিও উজ্জ্বল হইয়া তাহার মনের সামনে দেখা দিয়া যাইতেছে।
পুরোহিতের আধ-পাগলা ছেলেটা; তাহাদের প্রতিবেশীর কপিলবর্ণের বাছুরটা;
নদীর পথে যাইতে রাস্তার দক্ষিণধারে একটা তাল গাছকে শিকড় দিয়া আঁটিয়া
জড়াইয়া একটা অশথ গাছ দুই কুস্তিগির পালোয়ানের মতো প্যাঁচ কষিয়া দাঁড়াইয়া
আছে, তাহারই তলায় একটা অনেক দিনের পরিত্যক্ত ভিটা; তাহাদের বিলের তিন
দিকে আমন ধান, এক পাশে গভীর জলের প্রান্তে মাছ-ধরা জাল বাঁধিবার জন্য বাঁশের
খোঁটা পোঁতা, তাহারই উপরে একটি মাছরাঙা চুপ করিয়া বসিয়া; কৈবর্তপাড়া হইতে
সন্ধ্যার পরে মাঠ পার হইয়া কীর্তনের শব্দ আসিতেছে; ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নানা-প্রকার মিশ্রিত গন্ধে গ্রামের ছায়াময় পথে স্তব্ধ হাওয়া ভরিয়া রহিয়াছে; আর তারই
সঙ্গে মিলিয়া তাহার সেই ভক্তবন্ধুর দল, সেই চঞ্চল গোপাল, সেই আঁচলের-খুঁটে-পান-বাঁধা বড়ো-বড়ো-স্নিগ্ধ-চোখ-মেলা সৌরভী—এই-সমস্ত স্মৃতি, ছবিতে গন্ধে
শব্দে, স্নেহে প্রীতিতে বেদনায়, তাহার মনকে প্রতিদিন গভীরতর আবিষ্ট করিয়া
ধরিতে লাগিল। গ্রামে থাকিতে রসিকের যে নানাপ্রকার কারুনৈপুণ্য প্রকাশ পাইত
এখানে তাহা একেবারে বন্ধ হইয়া গেছে, এখানে তাহার কোনো মূল্য নাই; এখানকার
দোকান-বাজারের কলের তৈরি জিনিস হাতের চেষ্টাকে লজ্জা দিয়া নিরস্ত করে।
তাঁতের ইস্কুলে কাজ কাজের বিড়ম্বনামাত্র, তাহাতে মন ভরে না। থিয়েটারের দীপ-শিখা তাহার চিত্তকে পতঙ্গের মতো মরণের পথে টানিয়াছিল—কেবল টাকা
জমাইবার কঠোর নিষ্ঠা তাহাকে বাঁচাইয়াছে। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে কেবলমাত্র তাহার
গ্রামটিতে যাইবার পথই তাহার কাছে একেবারে রুদ্ধ। এইজন্যই গ্রামে যাইবার টান
প্রতি মুহূর্তে তাহাকে এমন করিয়া পীড়া দিতেছে। তাঁতের ইস্কুলে সে প্রথমটা
ভারি ভরসা পাইয়াছিল, কিন্তু আজ যখন সে আশা আর টেঁকে না, যখন তাহার
দুই মাসের বেতনই সে আদায় করিতে পারিল না, তখন সে আপনাকে আর ধরিয়া
রাখিতে পারে না এমন হইল। সমস্ত লজ্জা স্বীকার করিয়া, মাথা হেঁট করিয়া, এই
এক বৎসর প্রবাসবাসের বৃহৎ ব্যর্থতা বহিয়া দাদার আশ্রয়ে যাইবার জন্য তাহার
মনের মধ্যে কেবলই তাগিদ আসিতে লাগিল।
যখন মনটা অত্যন্ত যাই-যাই করিতেছে এমন সময় তাহার বাসার কাছে খুব
ধুম করিয়া একটা বিবাহ হইল। সন্ধ্যাবেলায় বাজনা বাজাইয়া বর আসিল। সেইদিন
রাত্রে রসিক স্বপ্ন দেখিল, তাহার মাথায় টোপর, গায়ে লাল চেলি; কিন্তু সে গ্রামের
বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়াইয়া আছে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ‘তোর বর আসিয়াছে’
বলিয়া সৌরভীকে খেপাইতেছে, সৌরভী বিরক্ত হইয়া কাঁদিয়া ফেলিয়াছে—রসিক
তাহাদিগকে শাসন করিতে ছুটিয়া আসিতে চায়, কিন্তু কেমন করিয়া কেবলই বাঁশের
কঞ্চিতে তাহার কাপড় জড়াইয়া যায়, ডালে তাহার টোপর আটকায়, কোনোমতেই পথ
করিয়া বাহির হইতে পারে না। জাগিয়া উঠিয়া রসিকের মনের মধ্যে ভারি লজ্জা
বোধ হইতে লাগিল। বধূ তাহার জন্য ঠিক করা আছে অথচ সেই বধূকে ঘরে
আনিবার যোগ্যতা তাহার নাই, এইটেই তাহার কাপুরুষতার সব চেয়ে চূড়ান্ত পরিচয়
৬
অনাবৃষ্টি যখন চলিতে থাকে তখন দিনের পর দিন কাটিয়া যায় মেঘের আর দেখা
নাই, যদি বা মেঘ দেখা দেয় বৃষ্টি পড়ে না, যদি বা বৃষ্টি পড়ে তাহাতে মাটি ভেজে
না। কিন্তু বৃষ্টি যখন নামে তখন দিগন্তের এক কোণে যেমনি মেঘ দেখা দেয় অমনি
দেখিতে দেখিতে আকাশ ছাইয়া ফেলে এবং অবিরল বর্ষণে পৃথিবী ভাসিয়া যাইতে
থাকে। রসিকের ভাগ্যে হঠাৎ সেইরকমটা ঘটিল।
জানকী নন্দী মস্ত ধনী লোক। সে একদিন কাহার কাছ হইতে কী একটা খবর
পাইল; তাঁতের ইস্কুলের সামনে তাহার জুড়ি আসিয়া থামিল, তাঁতের ইস্কুলের
মাস্টারের সঙ্গে তাহার দুই-চারটে কথা হইল এবং তাহার পরদিনই রসিক আপনার
মেসের বাসা পরিত্যাগ করিয়া নন্দীবাবুদের মস্ত তেতালা বাড়ির এক ঘরে আশ্রয়
গ্রহণ করিল।
নন্দীবাবুদের বিলাতের সঙ্গে কমিশন এজেন্সির মস্ত কারবার—সেই কারবারে
কেন যে জানকীবাবু অযাচিতভাবে রসিককে একটা নিতান্ত সামান্য কাজে নিযুক্ত
করিয়া যথেষ্ট পরিমাণে বেতন দিতে লাগিলেন তাহা রসিক বুঝিতেই পারিল না।
সেরকম কাজের জন্য লোক সন্ধান করিবার দরকারই হয় না, এবং যদি বা লোক
জোটে তাহার তো এত আদর নহে। বাজারে নিজের মূল্য কত এত দিনে রসিক
তাহা বুঝিয়া লইয়াছে; অতএব জানকীবাবু যখন তাহাকে ঘরে রাখিয়া যত্ন করিয়া
খাওয়াইতে লাগিলেন তখন রসিক তাহার এত আদরের মূল কারণ সুদূর আকাশের
গ্রহনক্ষত্র ছাড়া আর-কোথাও খুঁজিয়া পাইল না।
কিন্তু, তাহার শুভগ্রহটি অত্যন্ত দূরে ছিল না। তাহার একটু সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বলা আবশ্যক।
একদিন জানকীবাবুর অবস্থা এমন ছিল না। তিনি যখন কষ্ট করিয়া কলেজে
পড়িতেন তখন তাঁহার সতীর্থ হরমোহন বসু ছিলেন তাঁহার পরম বন্ধু। হরমোহন
ব্রাহ্ম সমাজের লোক। এই কমিশন এজেন্সি হরমোহনদেরই পৈতৃক বাণিজ্য—তাঁহাদের একজন মুরুব্বি ইংরেজ সদাগর তাঁহার পিতাকে অত্যন্ত ভালোবাসিতেন।
তিনি তাঁহাকে এই কাজে জুড়িয়া দিয়াছিলেন। হরমোহন তাঁহার নিঃস্ব বন্ধু
জানকীকে এই কাজে টানিয়া লইয়াছিলেন।
সেই দরিদ্র অবস্থায় নূতন যৌবনে সমাজসংস্কার সম্বন্ধে জানকীর উৎসাহ
হরমোহনের চেয়ে কিছুমাত্র কম ছিল না। তাই তিনি পিতার মৃত্যুর পরে তাঁহার
ভগিনীর বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙিয়া দিয়া তাহাকে বড়ো বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া
শিখাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। ইহাতে তাঁহাদের তন্তুবায়সমাজে যখন তাঁহার ভগিনীর
বিবাহ অসম্ভব হইয়া উঠিল তখন কায়স্থ হরমোহন নিজে তাঁহাকে এই সংকট
হইতে উদ্ধার করিয়া এই মেয়েটিকে বিবাহ করিলেন।
তাহার পরে অনেক দিন চলিয়া গিয়াছে। হরমোহনেরও মত্যু হইয়াছে, তাঁহার
ভগিনীও মারা গেছে। ব্যাবসাটিও প্রায় সম্পূর্ণ জানকীর হাতে আসিয়াছে। ক্রমে
বাসাবাড়ি হইতে তাহার তেতালা বাড়ি হইল, চিরকালের নিকেলের ঘড়িটিকে অপমান
করিয়া তাড়াইয়া দিয়া সোনার ঘড়ি সুয়োরানীর মতো তাঁহার বক্ষের পার্শ্বে টিকটিক করিতে লাগিল।
এইরূপে তাঁহার তহবিল যতই স্ফীত হইয়া উঠিল, অল্পবয়সের অকিঞ্চন
অবস্থার সমস্ত উৎসাহ ততই তাঁহার কাছে নিতান্ত ছেলেমানুষি বলিয়া বােধ হইতে
লাগিল। কোনােমতে পারিবারিক পূর্ব-ইতিহাসের এই অধ্যায়টাকে বিলুপ্ত করিয়া
দিয়া সমাজে উঠিবার জন্য তাঁহার রােখ চাপিয়া উঠিল। নিজের মেয়েটিকে সমাজে
বিবাহ দিবেন, এই তাঁর জেদ। টাকার লােভ দেখাইয়া দুই-একটি পাত্রকে রাজি
করিয়াছিলেন, কিন্তু যখনই তাহাদের আত্মীয়েরা খবর পাইল তখনই তাহারা
গােলমাল করিয়া বিবাহ ভাঙিয়া দিল। শিক্ষিত সৎপাত্র না হইলেও তাঁহার চলে—কন্যার চিরজীবনের সুখে বলিদান দিয়াও তিনি সমাজদেবতার প্রসাদলাভের জন্য
উৎসুক হইয়া উঠিলেন।
এমন সময় তিনি তাঁতের ইস্কুলের মাস্টারের খবর পাইলেন। সে থানাগড়ের
বসাক-বংশের ছেলে—তাহার পূর্বপুরুষ অভিরাম বসাকের নাম সকলেই জানে—এখন তাহাদের অবস্থা হীন, কিন্তু কুলে তাহারা তাঁহাদের চেয়ে বড়াে।
দূর হইতে দেখিয়া গৃহিণীর ছেলেটিকে পছন্দ হইল। স্বামীকে জিজ্ঞাসা
করিলেন, “ছেলেটির পড়াশুনা কিরকম।”
জানকীবাবু বলিলেন, “সে বালাই নাই। আজকাল যাহার পড়াশুনা বেশি,
তাহাকে হিন্দুয়ানিতে আঁটিয়া ওঠা শক্ত।”
গৃহিণী প্রশ্ন করিলেন, “টাকাকড়ি?”
জানকীবাবু বলিলেন, “যথেষ্ট অভাব আছে। আমার পক্ষে সেইটেই লাভ।”
গৃহিণী কহিলেন, “আত্মীয়স্বজনদের তো ডাকিতে হইবে।”
জানকীবাবু কহিলেন, “পূর্বে অনেকবার সে পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে; তাহাতে
আত্মীয়স্বজনেরা দ্রুতবেগে ছুটিয়া আসিয়াছে, কিন্তু বিবাহ হয় নাই। এবারে স্থির
করিয়াছি, আগে বিবাহ দিব, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিষ্টালাপ পরে সময়মতাে করা
যাইবে।”
রসিক যখন দিনে রাত্রে তাহার গ্রামে ফিরিবার কথা চিন্তা করিতেছে, এবং
হঠাৎ অভাবনীয়রূপে অতি সত্বর টাকা জমাইবার কী উপায় হইতে পারে তাহা
ভাবিয়া কোনাে কূলকিনারা পাইতেছে না, এমন সময় আহার ঔষধ দুইই তাহার
মুখের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। হাঁ করিতে সে আর এক মুহূর্ত বিলম্ব
করিতে চাহিল না।
জানকীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার দাদাকে খবর দিতে চাও?”
রসিক কহিল, “না, তাহার কোনাে দরকার নাই।” সমস্ত কাজ নিঃশেষে সারিয়া
তাহার পরে সে দাদাকে চমৎকৃত করিয়া দিবে; অকর্মণ্য রসিকের যে সামর্থ্য কিরকম
তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণে কোনাে ত্রুটি থাকিবে না।
শুভলগ্নে বিবাহ হইয়া গেল। অন্যান্য সকলপ্রকার দানসামগ্রীর আগে রসিক
৭
তখন মাঘের শেষ। সর্ষে এবং তিসির ফুলে খেত ভরিয়া আছে। আখের গুড় জ্বাল
দেওয়া আরম্ভ হইয়াছে, তাহারই গন্ধে বাতাস যেন ঘন হইয়া উঠিয়াছে। ঘরে ঘরে
গোলাভরা ধান এবং কলাই; গোয়ালের প্রাঙ্গণে খড়ের গাদা স্তূপাকার হইয়া রহিয়াছে।
ও পারে নদীর চরে বাথানে রাখালেরা গোরু-মহিষের দল লইয়া কুটির বাঁধিয়া বাস
করিতেছে। খেয়াঘাটের কাজ প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে—নদীর জল কমিয়া গিয়া,
লোকেরা কাপড় গুটাইয়া হাঁটিয়া পার হইতে আরম্ভ করিয়াছে।
রসিক কলার-পরানো শার্টের উপর মালকোঁচা মারিয়া ঢাকাই ধুতি পরিয়াছে;
শার্টের উপরে বোতাম-খোলা কালো বনাতের কোট; পায়ে রঙিন ফুল্-মোজা ও
চকচকে কালো চামড়ার শৌখিন বিলাতি জুতা। ডিস্ট্রিক্ট্-বোর্ডের পাকা রাস্তা বাহিয়া
দ্রুতবেগে সে বাইসিকল চালাইয়া আসিল; গ্রামের কাঁচা রাস্তায় আসিয়া তাহাকে
বেগ কমাইতে হইল। গ্রামের লোকে হঠাৎ তাহার বেশভূষা দেখিয়া তাহাকে চিনিতেই
পারিল না। সেও কাহাকেও কোনো সম্ভাষণ করিল না; তাহার ইচ্ছা, অন্য লোকে
তাহাকে চিনিবার আগেই সর্বাগ্রে সে তাহার দাদার সঙ্গে দেখা করিবে। বাড়ির
কাছাকাছি যখন সে আসিয়াছে তখন ছেলেদের চোখ সে এড়াইতে পারিল না। তাহারা
এক মুহূর্তেই তাহাকে চিনিতে পারিল। সৌরভীদের বাড়ি কাছেই ছিল—ছেলেরা
সেই দিকে ছুটিয়া চেঁচাইতে লাগিল, “সৈরিদিদির বর এসেছে, সৈরিদিদির বর।”
গোপাল বাড়িতেই ছিল, সে ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিবার পূর্বেই বাইসিকল
রসিকদের বাড়ির সামনে আসিয়া থামিল।
তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে; ঘর অন্ধকার, বাহিরে তালা লাগানো। জনহীন
পরিত্যক্ত বাড়ির যেন নীরব একটা কান্না উঠিতেছে, ‘কেহ নাই, কেহ নাই।’ এক
নিমেষেই রসিকের বুকের ভিতরটা কেমন করিয়া উঠিয়া চোখের সামনে সমস্ত অস্পষ্ট
হইয়া উঠিল। তাহার পা কাঁপিতে লাগিল, বন্ধ দরজা ধরিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল,
তাহার গলা শুকাইয়া গেল, কাহাকেও ডাক দিতে সাহস হইল না। দূরে মন্দিরে
সন্ধ্যারতির যে কাঁসরঘন্টা বাজিতেছিল তাহা যেন কোন্ একটি গতজীবনের পরপ্রান্ত
হইতে সুগভীর একটা বিদায়ের বার্তা বাহিয়া তাহার কানের কাছে আসিয়া পৌঁছিতে
লাগিল। সামনে যাহা কিছু দেখিতেছে, এই মাটির প্রাচীর, এই চালাঘর, এই রুদ্ধ
কপাট, এই জিগর গাছের বেড়া, এই হেলিয়া-পড়া খেজুর গাছ—সমস্তই যেন একটা
হারানো সংসারের ছবিমাত্র, কিছুই যেন সত্য নহে।
গোপাল আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। রসিক পাংশুমুখে গোপালের মুখের দিকে
চাহিল; গোপাল কিছু না বলিয়া চোখ নিচু করিল। রসিক বলিয়া উঠিল, “বুঝেছি,
বুঝেছি,—দাদা নাই!” অমনি সেইখানেই দরজার কাছে সে বসিয়া পড়িল। গোপাল
তাহার পাশে বসিয়া কহিল, “ভাই রসিকদাদা, চলো আমাদের বাড়ি চলো।” রসিক
তাহার দুই হাত ছাড়াইয়া দিয়া সেই দরজার সামনে উপুড় হইয়া মাটিতে লুটাইয়া
পড়িল। “দাদা! দাদা! দাদা!”
যে দাদা তাহার পায়ের শব্দটি পাইলে আপনিই ছুটিয়া আসিত কোথাও তাহার
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। গোপালের বাপ আসিয়া অনেক বলিয়া-কহিয়া রসিককে বাড়িতে লইয়া আসিল।
রসিক সেখানে প্রবেশ করিয়াই মুহূর্তকালের জন্য দেখিতে পাইল, সৌরভী সেই
তাহার চিত্রিত কাঁথায় মোড়া কী-একটা জিনিস অতি যত্নে রোয়াকের দেয়ালে ঠেসান
দিয়া রাখিতেছে। প্রাঙ্গণে লোকসমাগমের শব্দ পাইবামাত্রই সে ছুটিয়া ঘরের মধ্যে
অন্তর্হিত হইল। রসিক কাছে আসিয়াই বুঝিতে পারিল, এই কাঁথায় মোড়া পদার্থটি
একটি নূতন বাইসিকল। তৎক্ষণাৎ তাহার অর্থ বুঝিতে আর বিলম্ব হইল না।
একটা বুক-ফাটা কান্না বক্ষ ঠেলিয়া তাহার কণ্ঠের কাছে পাকাইয়া পাকাইয়া উঠিতে
লাগিল এবং চোখের জলের সমস্ত রাস্তা যেন ঠাসিয়া বন্ধ করিয়া ধরিল।
রসিক চলিয়া গেলে বংশী দিনরাত্রি অবিশ্রাম খাটিয়া সৌরভীর পণ এবং এই
বাইসিকল কিনিবার টাকা সঞ্চয় করিয়াছিল। তাহার এক মুহূর্ত আর-কোনো চিন্তা
ছিল না। ক্লান্ত ঘোড়া যেমন প্রাণপণে ছুটিয়া গম্য স্থানে পৌঁছিয়াই পড়িয়া মরিয়া
যায়, তেমনি যেদিন পণের টাকা পূর্ণ করিয়া বংশী বাইসিকলটি ভি. পি. ডাকে
পাইল সেইদিনই আর তাহার হাত চলিল না, তাহার তাঁত বন্ধ হইয়া গেল; গোপালের
পিতাকে ডাকিয়া তাহার হাতে ধরিয়া সে বলিল, “আর-একটি বছর রসিকের জন্য
অপেক্ষা করিয়ো—এই তোমার হাতে পণের টাকা দিয়া গেলাম। আর যেদিন রসিক
আসিবে তাহাকে এই চাকার গাড়িটি দিয়া বলিয়ো, দাদার কাছে চাহিয়াছিল, তখন
হতভাগ্য দাদা দিতে পারে নাই, কিন্তু তাই বলিয়া মনে যেন সে রাগ না রাখে।”
দাদার টাকার উপহার গ্রহণ করিবে না, একদিন এই শপথ করিয়া রসিক চলিয়া
গিয়াছিল। বিধাতা তাহার সেই কঠোর শপথ শুনিয়াছিলেন। আজ যখন রসিক ফিরিয়া
আসিল তখন দেখিল, দাদার উপহার তাহার জন্য এতদিন পথ চাহিয়া বসিয়া আছে,
কিন্তু তাহা গ্রহণ করিবার দ্বার একেবারে রুদ্ধ। তাহার দাদা যে-তাঁতে আপনার
জীবনটি বুনিয়া আপনার ভাইকে দান করিয়াছে, রসিকের ভারি ইচ্ছা করিল, সব
ছাড়িয়া সেই তাঁতের কাছেই আপনার জীবন উৎসর্গ করে। কিন্তু হায়, কলিকাতা
শহরে টাকার হাড়কাঠে চিরকালের মতো সে আপনার জীবন বলি দিয়া আসিয়াছে।
পৌষ ১৩১৮