বিষয়বস্তুতে চলুন

গল্পের বই/ব্যাঙ্‌ রাজা

উইকিসংকলন থেকে

গল্পের বই।


ব্যাঙ্ রাজা।

 অনেকদিন আগে এক রাজা ছিলেন, তাঁর তিনটি মেয়ে ছিল। তিনটি মেয়েই দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু ছােট মেয়েটি তাদের মধ্যে তিনটি সকলের চেয়ে সুন্দর।

 রাজার বাড়ীর কাছে বন ছিল, সেই বনের ভিতর একটি ঝরণা ছিল। গরমের সময় রাজার ছােট মেয়ে সেই ঝরণার ধারে গাছের ছায়ায় ব’সে সােনার গােলা নিয়ে খেলা কর্‌ত।

 একদিন সে এমনি করে সেই ঝরণার ধারে ব’সে সােনার গােলা নিয়ে খেলা কর্‌ছিল। খেল্‌তে খেল্‌তে গােলাটি তার হাত থেকে প’ড়ে গেল, আর গড়াতে গড়াতে টুপ্‌ করে সেই ঝরণার জলে ডুবে গেল। সেখানে ঢের জল, তা’তে মানুষ ডুবে যায়।

 রাজার মেয়ে আর কি কর্‌বে? সে তার গােলা হারিয়ে কাঁদ্‌তে লাগ্‌ল। সে অনেকক্ষণ ধরে খুব চেঁচিয়ে কাঁদল। কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে তার মনে হল, কে যেন তাকে কি বলছে।

 রাজার মেয়ে চারদিকে আর কাউকে দেখ্‌তে পেল না, খালি দেখ্‌ল, একটা মস্ত ব্যাঙ্‌ জলের ভিতর থেকে মাথা বার ক’রে ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে চেয়ে আছে!

 ব্যাঙ্ বল্‌ল, “রাজার মেয়ে, রাজার মেয়ে, অত কাঁদছ কেন?”

 রাজার মেয়ে বল্‌ল, “আমার সােনার গােলা জলে পড়ে গিয়েছে, তাই আমি কাঁদছি।”

 ব্যাঙ্ বল্‌ল, “আমি যদি তােমার গােলা তুলে দিতে পারি তবে আমাকে কি দেবে?”

 রাজার মেয়ে বল্‌ল “আমার চক্‌চকে পােষাক, ঝক্‌ঝকে মুকুট, আমার হীরার বালা মতির মালা, যা চাও আমি তাই দেব।”

 ব্যাঙ্ বল্‌ল, “আমি তােমার পােযাক টোষাক কিছুই চাই না। তুমি যদি আমাকে তােমার সঙ্গে খেলা করতে দাও, তােমার সােনার থালাখানাতে তােমার সঙ্গে খেতে দাও, আর তােমার ছােট্ট বিছানাটিতে ঘুমুতে দাও, তবে আমি তােমার গোলা এনে দিতে পারি।”

 রাজার মেয়ে বল্‌ল, “আচ্ছা তাই হবে। তুমি যদি আমার গােলাটি এনে দিতে পার, তবে তুমি যা বল্‌বে আমি তাই কর্‌ব।” সে মনে মনে ভাব্‌ল “কি বােকা! ব্যাঙ্‌ বুঝি আবার মানুষের সঙ্গে খেলা কর্‌তে পারে। সে ত খালি জলের ভিতর ব’সে গ্যাঙোর গ্যাঙোর ক’রে ডাকে।”

 কিন্তু ব্যাঙ্ তখনি জলে ডুব দিয়ে সেই সােনার গােলাটি তুলে আন্‌ল। সে ভেবেছিল যে না জানি রাজার মেয়ে তার সঙ্গে কত খেলাই কর্‌বে। রাজার মেয়ে তার কিছুই করল না। সে গােলা পেয়ে খুসী হয়ে অমনি দে বাড়ীর পানে ছুট!

 ব্যাঙ্ তার নাম ধরে কত ডাকল আর বল্‌ল, “রাজার মেয়ে, থাম, থাম! আমাকে ফেলে যেয়াে না। আমি অত ছুটতে পারি না।” রাজার মেয়ে কি তা’ শােনে? সে আরাে বেশী করে ছুটতে লাগল, একটিবার ফিরেও তাকাল না। শেষে ব্যাঙ বেচারী আর চ্যাঁচাতে না পেরে মনের দুঃখে ঝরণায় ফিরে গেল।

 তার পরের দিন রাজার মেয়ে রাজার সঙ্গে বসে সােনার থালায় ভাত খাচ্ছে। এমন সময় কে যেন থপ্ থপ্ থপ্ থপ্ করে সিঁড়ী দিয়ে উঠে এল, আর দরজার কাছে এসে ডাক্‌তে লাগ্‌ল, “রাজার ছােট মেয়ে, দরজা খুলে দাও।”

 রাজার মেয়ে তা শুনে দরজা খুলতে গেল। কিন্তু খুলেই দেখে, সর্ব্বনাশ! সেই ব্যাঙ্ এসেছে। তা’ দেখে সে তখনি দড়াম্ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছুট্টে এসে তার জায়গায় বসে পড় ল।

 রাজা বলেন, “কি মা, এত ভয় পেলে কেন? কোন রাক্ষস টাক্ষস তােমাকে ধরে নিতে এসেছে নাকি?”

 সে বল ল, “না বাবা, রাক্ষস নয়, একটা ব্যাঙ্।”

 রাজা বল্লেন, “ব্যাঙ, তােমার কাছে কি করতে এসেছে?”

 রাজার মেয়ে বল ল, “কাল বনের ভিতর খেলা করতে গিয়ে আমার সােনার গােলাটা জলে পড়ে গিয়েছিল। তাই আমি কাঁদছিলাম। তখন ব্যাঙ্‌টা এসে সেই গোলা তুলে দিল আর বল্‌ল যে তাকে নিয়ে আমার খেলা কর্‌তে হবে আর একথালায় ভাত খেতে হবে। আমি বল্লাম, “হাঁ, তাই কর্‌ব।” আমি কি জানি যে সে সেই বন থেকে এতদূর চলে আস্‌তে পারবে?”

 ব্যাঙ আবার ডাক্‌তে লাগল, “ও ছােট রাজকন্যা, আমাকে ঢুক্‌তে দাও। কাল যে সেই ঝরণার ধারে কি বলেছিলে মনে নেই? শীঘ্র দরজা খােল।”

 তখন রাজা বল্‌লেন, “তুমি যখন বলেছ, তখন দরজা খুলে দিতেই হয়। কাজেই সে দরজা না খুলে দিয়ে আর কি করে?

 দরজা খুলতেই ত অমনি সেই সর্ব্বনেশে ব্যাঙ, থপাস্ থপাস্ করে ঘরের ভিতর চলে এল। তারপর গিয়ে বস্‌বিত বস্ একেবারে রাজার মেয়ের সােনার থালাখানির পাশে! বলে, “তােমার। সঙ্গে ভাত খাবাে!” তা দেখে রাজার মেয়ে চোখ বুঁজে না সিঁটকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বল্‌ল “ওয়াক!” কিন্তু রাজা বল্লেন, “তা হবে না। ও তােমার কত উপকার করেছে। ও যা বল্‌বে, তােমাকে তাই কর্‌তে হবে।” তাতে রাজার মেয়ে অনেক কষ্টে ঠোট মুখ চেপে চুপ করে রইল, কিন্তু কিচ্ছু খেতে পারল না।

 ততক্ষণে ব্যাঙ্ হাপুত্ হুপুত্ করে ভাতটাত সব খেয়ে তারপর বল্‌ল, “বাপরে, বড্ড পেট ভরে গিয়েছে। এখন আমাকে নিয়ে তােমার ছােট্ট বিছানায় শুইয়ে দাও।”

 তা শুনেই ত রাজার মেয়ের কান্না আস্‌তে লাগ্‌ল। ঘেন্নায় তার গা সির্ সির্ কর্‌ছে, কিন্তু রাজা মশাইয়ের ভয়ে সে কিছু বল্‌তে পারছে না। ব্যাঙের কথা না শুন্‌লে তিনি এখনি বড্ড
ব্যাঙ্‌ আর রাজার মেয়ে
রাগ কর্‌বেন। কাজেই সে অনেক কষ্টে বাঁ হাতের দু’আঙুলে ব্যাঙের ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে তাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। তাপর তাকে এক কোণে ফেলে দিয়ে, নিজে গিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল।

 ব্যাঙ্ সেই কোণ থেকে থপাস্ থপাস্ করে এসে তাকে বল্ল, “খাটে উঠিয়ে দাও; ঘুমাব।” তখন রাজার মেয়ে যারপরনাই রেগে বিছানাথেকে উঠে বল্ল, “দাঁড়াও তোমাকে ভাল করে শোয়াচ্ছি।” এই বলে, সে ব্যাঙ্‌টাকে ধরে ধাঁই করে দেওয়ালের উপর এমনি এক আছাড় মার্‌ল যে কি বল্‌ব! অন্য ব্যাঙ্ হলে নিশ্চয়ই তাতে ভট্ করে ফেটে মরে যেত। কিন্তু সে ব্যাঙ্‌টা তার কিছু না ক’রে, অমনি ভারি সুন্দর একটি রাজার ছেলে হয়ে গেল। তা ত হবেই। আসলে ত সে ব্যাঙ্ ছিল না, সে রাজার ছেলেই ছিল। কোথাকার এক দুষ্টু বেঁটে কালো কুঁজো ডাইনী বুড়ী নাকি তাকে ব্যাঙ্ বানিয়ে দিয়েছিল।

 পরদিন সকালবেলা সেই রাজার ছেলের দেশ থেকে মস্ত আট ঘোড়ার গাড়ী এলো। ঘোড়াগুলো সব শাদা, আর তাদের মাথায় শাদা পালকের ঝুটী। সেই গাড়ী করে রাজার ছেলে রাজার মেয়েকে দেশে নিয়ে গিয়ে, তার রাণী কর্‌ল।