গীতবিতান/গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য/মায়ার খেলা

উইকিসংকলন থেকে



মায়ার খেলা

প্রথম দৃশ্য

কানন

মায়াকুমারীগণ


সকলে।  মোরা  জলে স্থলে কত ছলে মায়াজাল গাঁথি। 
প্রথমা।  মোরা  স্বপন রচনা করি অলস নয়ন ভরি। 
দ্বিতীয়া।  গোপনে হৃদয়ে পশি কুহক-আসন পাতি। 
তৃতীয়া।  মোরা  মদিরতরঙ্গ তুলি বসন্তসমীরে। 
প্রথমা।  দুরাশা জাগায় প্রাণে প্রাণে 
আধো-তানে ভাঙা-গানে
ভ্রমরগুঞ্জরাকুল বকুলের পাঁতি।
সকলে।  মোরা মায়াজাল গাঁথি। 
দ্বিতীয়া।  নরনারী-হিয়া মোরা বাঁধি মায়াপাশে। 
তৃতীয়া। কত ভুল করে তারা, কত কাঁদে হাসে। 
প্রথমা।  মায়া করে ছায়া ফেলি মিলনের মাঝে 
আনি মান-অভিমান।
দ্বিতীয়া।  বিরহী স্বপনে পায় মিলনের সাথি। 
সকলে।  মোরা  মায়াজাল গাঁথি। 
প্রথমা।  চলো সখী, চলো। 
কুহকস্বপনখেলা খেলাবে চলো।
দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া।  নবীন হৃদয়ে রচি নব প্রেমছল 
প্রমোদে কাটাব নব বসন্তের রাতি।
সকলে।  মোরা  মায়াজাল গাঁথি। 

দ্বিতীয় দৃশ্য

গৃহ

গমনোন্মুখ অমর। শান্তার প্রবেশ


শান্তা।  পথহারা তুমি পথিক যেন গো সুখের কাননে, 
ওগো, যাও কোথা যাও।
সুখে ঢলঢল বিবশ বিভল পাগল নয়নে
তুমি চাও কারে চাও।
কোথা গেছে তব উদাস হৃদয়, কোথা পড়ে আছে ধরণী।
মায়ার তরণী বাহিয়া যেন গো মায়াপুরী-পানে ধাও।
কোন্  মায়াপুরী-পানে ধাও।
অমর।  জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত! 
নবীনবাসনাভরে  হৃদয় কেমন করে,
নবীন জীবনে হল জীবন্ত।
সুখভরা এ ধরায়  মন বাহিরিতে চায়,
কাহারে বসাতে চায় হৃদয়ে।
তাহারে খুঁজিব দিক-দিগন্ত।

মায়াকুমারীগণের প্রবেশ


সকলে।  কাছে আছে দেখিতে না পাও, 
তুমি  কাহার সন্ধানে দূরে যাও।

শান্তার প্রতি


অমর। যেমন দখিনে বায়ু ছুটেছে, 
কে জানে কোথায় ফুল ফুটেছে,,
তেমনি আমিও, সখী, যাব—
না জানি কোথায় দেখা পাব।

কার সুধাস্বরমাঝে  জগতের গীত বাজে,
প্রভাত জাগিছে কার নয়নে।
কাহার প্রাণের প্রেম অনন্ত।
তাহারে খুঁজিব দিক-দিগন্ত।

প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ।  মনের মতো করে খুঁজে মর— 
সে কি আছে ভুবনে,
সে যে রয়েছে মনে।
ওগো,  মনের মতো সেই তো হবে
তুমি  শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।

নেপথ্যে চাহিয়া


শান্তা।  আমার পরান যাহা চায়, 
তুমি তাই তুমি তাই গো।
তোমা, ছাড়া আর এ জগতে
মোর  কেহ নাই, কিছু নাই গো।
তুমি  সুখ যদি নাহি পাও,
যাও,  সুখের সন্ধানে যাও,
আমি  তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে—
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমি  তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস—
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি  আর-কারে ভালোবাস,
যদি  আর ফিরে নাহি আস,
তবে  তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও—
আমি যত দুখ পাই গো।

নেপথ্যে চাহিয়া


মায়াকুমারীগণ।  কাছে আছে দেখিতে না পাও, 
তুমি  কাহার সন্ধানে দূরে যাও।
প্রথমা।  মনের মতো কারে খুঁজে মর— 
দ্বিতীয়া।  সে কি আছে ভুবনে, 
সে যে রয়েছে মনে।
তৃতীয়া।  ওগো,  মনের মতো সেই তো হবে 
তুমি  শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।
প্রথমা।  তোমার আপনার যে জন দেখিলে না তারে 
দ্বিতীয়া।  তুমি যাবে কার দ্বারে। 
তৃতীয়া।  যারে চাবে তারে পাবে না, 
যে মন ভোমার আছে যাবে তাও।

তৃতীয় দৃশ্য


কানন


প্রমদার সখীগণ


প্রথমা।  সখী, সে গেল কোথায়, 
তারে ডেকে নিয়ে আয়।
সকলে।  দাঁড়াব ঘিরে তারে তরুতলায়। 
প্রথমা।  আজি এ মধুর সাঁঝে  কাননে ফুলের মাঝে 
হেসে হেসে বেড়াবে সে,  দেখিব তায়।
দ্বিতীয়া।  আকাশে তারা ফুটেছে,  দখিনে বাতাস ছুটেছে, 
পাখিটি ঘুমঘোরে গেয়ে উঠেছে।
প্রথমা।  আয় লো আনন্দময়ী, মধুর বসন্ত লয়ে— 
সকলে।  লাবণ্য ফুটাবি লো তরুলতায়। 

প্রমদার প্রবেশ


প্রমদা।  দে লো, সখী, দে পরাইয়ে গলে 
সাধের বকুলফুলহার।
আধফুট জুঁইগুলি  যতনে আনিয়ে তুলি
গাঁথি গাঁথি সাজায়ে দে মোরে
কবরী ভরিয়ে ফুলভার।
তুলে দে লো চঞ্চল কুন্তল,
কপোলে পড়িছে বারেবার।
প্রথমা।  আজি এত শোভা কেন, 
আনন্দে বিবশা যেন—
দ্বিতীয়া।  বিম্বাধরে হাসি নাহি ধরে, 
লাবণ্য ঝরিয়া পড়ে ধরাতলে!
প্রথমা।  সখী, তোরা দেখে যা, দেখে যা— 
তরুণ তনু এত রূপরাশি বহিতে পারে না বুঝি আর।
তৃতীয়া।  সখী,  বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা 
এ কি আর ভালো লাগে!
আকুল তিয়াষ প্রেমের পিয়াস
প্রাণে কেন নাহি জাগে।
কবে আর হবে থাকিতে জীবন
আঁখিতে আঁখিতে মদির মিলন—
মধুর হুতাশে মধুর দহন
নিত-নব অনুরাগে।
সখী,  তরল কোমল নয়নের জল
নয়নে উঠিবে ভাসি।
সখী,  সে বিষাদনীরে নিবে যাবে ধীরে
প্রখর চপল হাসি।
উদাস নিশ্বাস আকুলি উঠিবে,
আশা-নিরাশায় পরান টুটিবে,

মরমের আলো কপোলে ফুটিবে
শরম-অরুণ রাগে।
প্রমদা।  ওলো,  রেখে দে, সখী, রেখে দে— 
মিছে কথা ভালোবাসা।
সুখের বেদনা, সোহাগযাতনা—
বুঝিতে পারি না ভাষা।
ফুলের বাঁধন, সাধের কাঁদন,
পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন,
‘লহো লহো’ বলে পরে আরাধন—
পরের চরণে আশা।
তিলেক দরশ পরশ মাগিয়া
বরষ বরষ কাতরে জাগিয়া
পরের মুখের হাসির লাগিয়া
অশ্রুসাগরে ভাসা—
জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া
জীবনের সুখ নাশা।
মায়াকুমারীগণ।  প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে— 
কে কোথা ধরা পড়ে  কে জানে।
গরব সব হায়  কখন টুটে যায়,
সলিল বহে যায়  নয়নে।

কুমারের প্রবেশ


প্রমদার প্রতি


কুমার। যেয়ো না, যেয়ো না ফিরে— 
দাঁড়াও বারেক দাঁড়াও হৃদয়-আসনে।
চঞ্চলসমীরসম ফিরিছ কেন
কুসুমে কুসুমে কাননে কাননে।
তোমায়  ধরিতে চাহি, ধরিতে পারি নে—

তুমি  গঠিত যেন স্বপনে।
এসো হে, তোমারে বারেক দেখি  ভরিয়ে আঁখি,
ধরিয়ে রাখি যতনে।
প্রাণের মাঝে তোমারে ঢাকিব,
ফুলের পাশে বাঁধিয়ে রাখিব,
তুমি  দিবসনিশি রহিবে মিশি
কোমল প্রেমশয়নে।
প্রমদা।  কে ডাকে!  আমি কভু ফিরে নাহি চাই। 
কত ফুল ফুটে উঠে,  কত ফুল যায় টুটে,
আমি শুধু বহে চলে যাই।
পরশ পুলকরস-ভরা  রেখে যাই, নাহি দিই ধরা।
উড়ে আসে ফুলবাস,  লতাপাতা ফেলে শ্বাস,
বনে বনে উঠে হা-হুতাশ—
চকিতে শুনিতে শুধু পাই— চলে যাই।
আমি কভু ফিরে নাহি চাই।

অশোকের প্রবেশ


অশোক।  এসেছি গো এসেছি,  মন দিতে এসেছি— 
যারে ভালো বেসেছি!
ফুলদলে ঢাকি মন যাব রাখি চরণে
পাছে কঠিন ধরণী পায়ে বাজে—
রেখো রেখো চরণ হৃদিমাঝে—
নাহয় দলে যাবে, প্রাণ ব্যথা পাবে—
আমি তো ভেসেছি,  অকূলে ভেসেছি।
প্রমদা।  ওকে বলো, সখী, বলো,  কেন মিছে করে ছল— 
মিছে হাসি কেন সখী,  মিছে আঁখিজল!
জানি নে প্রেমের ধারা,  ভয়ে তাই হই সারা—
কে জানে কোথায় সুধা  কোথা হলাহল।

সখীগণ।  কাঁদিতে জানে না এরা,  কাঁদাইতে জানে কল— 
মুখের বচন শুনে  মিছে কী হইবে ফল।
প্রেম নিয়ে শুধু খেলা,  প্রাণ নিয়ে হেলাফেলা—
ফিরে যাই এই বেলা  চলো সখী, চলো।

প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ।  প্রেমের ফাঁদ পাতা  ভুবনে— 
কে কোথা ধরা পড়ে  কে জানে।
গরব সব হায়  কখন টুটে যায়,
সলিল বহে যায়  নয়নে।
এ সুখধরণীতে  কেবলই চাহ নিতে,
জান না হবে দিতে  আপনা—
সুখের ছায়া ফেলি  কখন যাবে চলি,
বরিবে সাধ করি  বেদনা।
কখন বাজে বাঁশি,  গরব যায় ভাসি—
পরান পড়ে আসি  বাঁধনে।

চতুর্থ দৃশ্য


কানন


অমর কুমার ও অশোক


অমর।  আমি মিছে ঘুরি এ জগতে কিসের পাকে, 
মনের বাসনা যত মনেই থাকে।
বুঝিয়াছি এ নিখিলে  চাহিলে কিছু না মিলে,
এরা  চাহিলে আপন মন গোপনে রাখে
এত লোক আছে, কেহ কাছে না ডাকে।
অশোক।  তারে দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ খুলে গো। 
কেন বুঝাতে পারি নে হৃদয়বেদনা।

কেমনে সে হেসে চলে যায়,
কোন্ প্রাণে ফিরেও না চায়,
এত সাধ এত প্রেম করে অপমান!
এত ব্যথাভরা ভালোবাসা কেহ দেখে না—
প্রাণে গোপনে রহিল।
এ প্রেম কুসুম যদি হত
প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম,
তার  চরণে করিতাম দান।
বুঝি সে তুলে নিত না, শুকাত অনাদরে—
তবু তার সংশয় হত অবসান
কুমার।  সখা,  আপন মন নিয়ে কাঁদিয়ে মরি, 
পরের মন নিয়ে কী হবে।
আপন মন যদি বুঝিতে নারি
পরের মন বুঝে কে কবে।
অমর।  অবোধ মন লয়ে ফিরি ভবে, 
বাসনা কাঁদে প্রাণে হা-হা রবে,
এ মন দিতে চাও দিয়ে ফেলো—
কেন গো নিতে চাও মন তবে।
স্বপনসম সব জানিয়ো মনে,
তোমার কেহ নাই এ ত্রিভুবনে—
যে জন ফিরিতেছে আপন আশে
তুমি ফিরিছ কেন তাহার পাশে।
নয়ন মেলি শুধু দেখে যাও,
হৃদয় দিয়ে শুধু শান্তি পাও।
কুমার।  তোমারে মুখ তুলে চাহে না যে 
থাক্ সে আপনার গরবে।
অশোক।  আমি  জেনে শুনে বিষ করেছি পান। 
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।

যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু  পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি—
লই গো বুক পেতে অনলবাণ।
যতই হাসি দিয়ে দহন করে
ততই বাড়ে তৃষা প্রেমের তরে,
প্রেম-অমৃতধারা যতই যাচি
ততই করে প্রাণে অশনি দান।
অমর।  ভালোবেসে যদি সুখ নাহি 
তবে কেন—
তবে কেন মিছে ভালোবাসা।
অশোক।  মন দিয়ে মন পেতে চাহি। 
অমর ও কুমার।  ওগো, কেন— 
ওগো, কেন মিছে এ দুরাশা।
অশোক।  হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা, 
নয়নে সাজায়ে মায়ামরীচিকা,
শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে।
অমর ও কুমার। ওগো, কেন— 
ওগো, কেন মিছে এ পিপাসা।
অমর।  আপনি যে আছে আপনার কাছে 
নিখিল জগতে কী অভাব আছে।
আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ,
কোকিলকূজিত কুঞ্জ।
অশোক।  বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়, 
একি ঘোর প্রেম অন্ধ রাহুপ্রায়
জীবন যৌবন গ্রাসে।
অমর ও কুমার। তবে কেন— 
তবে কেন মিছে এ কুয়াশা।

মায়াকুমারীগণ।  দেখো চেয়ে দেখো ওই কে আসিছে। 
চাঁদের আলোতে কার হাসি হাসিছে।
হৃদয়দুয়ার খুলিয়ে দাও,
প্রাণের মাঝারে তুলিয়ে লও,
ফুলগন্ধ-সাথে তার সুবাস ভাসিছে।

প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ


প্রমদা।  সুখে আছি সুখে আছি,  সখা, আপন-মনে। 
প্রমদা ও সখীগণ।  কিছু  চেয়ো না, দূরে যেয়ো না, 
শুধু  চেয়ে দেখো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি।
প্রমদা।  সখা,  নয়নে শুধু জানাবে প্রেম,  নীরবে দিবে প্রাণ, 
রচিয়া ললিত মধুর বাণী  আড়ালে গাবে গান।
গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি।
প্রমদা ও সখীগণ।  মন  চেয়ো না, শুধু চেয়ে থাকো, 
শুধু  ঘিরে থাকো কাছাকাছি।
প্রমদা।  মধুর জীবন, মধুর রজনী, মধুর মলয়বায়। 
এই  মাধুরীধারা বহিছে আপনি, কেহ নাহি চায়।
আমি  আপনার মাঝে আপনি হারা,
আপন সৌরভে সারা,
যেন  আপনার মন আপনার প্রাণ আপনারে সঁপিয়াছি।
অশোক।  ভালোবেসে দুখ সেও সুখ,  সুখ নাহি আপনাতে। 
প্রমদা ও সখীগণ।  না না না, সখা, মোরা  ভুলি নে ছলনাতে। 
কুমার।  মন দাও দাও, দাও সখী, দাও পরের হাতে। 
প্রমদা ও সখীগণ।  না না না, সখা, মোরা  ভুলি নে ছলনাতে। 
অশোক।  সুখের শিশির নিমেষে শুকায়, সুখ চেয়ে দুখ ভালো— 
আনো  সজল বিমল প্রেম ছলছল নলিননয়নপাতে।
প্রমদা ও সখীগণ। না না না, সখা, মোরা  ভুলি নে ছলনাতে। 
কুমার।  রবির কিরণে ফুটিয়া নলিনী আপনি টুটিয়া যায়, 

সুখ পায় তায় সে।
চির  কলিকাজনম কে করে বহন চিরশিশিররাতে।
প্রমদা ও সখীগণ।  না না না, সখা, মোরা  ভুলি নে ছলনাতে। 
অমর।  ওই কে গো হেসে চায়, চায় প্রাণের পানে। 
গোপন হৃদয়তলে  কী জানি কিসের ছলে
আলোক হানে।
এ প্রাণ নূতন ক’রে কে যেন দেখালে মোরে,
বাজিল মরমবীণা নূতন তানে।
এ পুলক কোথা ছিল,  প্রাণ ভরি বিকশিল—
তৃষাভরা তৃষাহরা এ অমৃত কোথা ছিল।
কোন্ চাঁদ হেসে চাহে,  কোন্ পাখি গান গাহে,
কোন্ সমীরণ বহে লতাবিতানে।
প্রমদা।  দূরে দাঁড়ায়ে আছে, 
কেন আসে না কাছে।
ওলো  যা, তোরা যা সখী, যা শুধা গে
ওই  আকুল অধর আঁখি কী ধন যাচে।
সখীগণ।  ছী, ওলো ছী, হল কী, ওলো সখী। 
প্রথমা।  লাজবাঁধ কে ভাঙিল,  এত দিনে শরম টুটিল। 
তৃতীয়া।  কেমনে যাব, কী শুধাব। 
প্রথমা।  লাজে মরি, কী মনে করে পাছে। 
প্রমদা।  ওলো  যা, তোরা যা সখী, যা শুধা’গে 
ওই  আকুল অধর আঁখি কী ধন যাচে।
মায়াকুমারীগণ।  প্রেমপাশে ধরা পড়েছে দুজনে 
দেখো দেখো, সখী, চাহিয়া।
দুটি ফুল খসে ভেসে গেল ওই প্রণয়ের স্রোত বাহিয়া

অমরের প্রতি


সখীগণ।  ওগো,  দেখি আঁখি তুলে চাও— 

তোমার  চোখে কেন ঘুমঘোর।
অমর।  আমি  কী যেন করেছি পান— 
কোন্  মদিরারসভোর।
আমার  চোখে তাই ঘুমঘোর।
সখীগণ।  ছি ছি ছী। 
অমর।  সখী, ক্ষতি কী। 
এ ভবে  কেহ জ্ঞানী অতি, কেহ ভোলামন—
কেহ সচেতন, কেহ অচেতন—
কাহারো নয়নে হাসির কিরণ,
কাহারো নয়নে লোর—
আমার  চোখে শুধু ঘুমঘোের।
সখীগণ। সখা,  কেন গো অচলপ্রায় 
হেথা  দাঁড়ায়ে তরুছায়।
অমর।  সখী,  অবশ হৃদয়ভারে চরণ 
চলিতে নাহি চায়,
তাই  দাঁড়ায়ে তরুছায়।
সখীগণ।  ছি ছি ছী। 
অমর।  সখী, ক্ষতি কী। 
এ ভবে  কেহ পড়ে থাকে, কেহ চলে যায়,
কেহ বা আলসে চলিতে না চায়,
কেহ বা আপনি স্বাধীন, কাহারো
চরণে পড়েছে ডোর।
কাহারো  নয়নে লেগেছে ঘোর।
সখীগণ।  ওকে  বোঝা গেল না— চলে আয়, চলে আয়। 
 কী কথা যে বলে সখী, কী চোখে যে চায়।
চলে আয়, চলে আয়।
লাজ টুটে শেষে মরি লাজে  মিছে কাজে।
ধরা দিবে না যে  বলো  কে পারে তায়।

আপনি সে জানে তার মন কোথায়!
চলে যায়, চলে আয়।

প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ। প্রেমপাশে ধরা পড়েছে দুজনে 
দেখো দেখো, সখী, চাহিয়া!
দুটি ফুল খসে ভেসে গেল ওই
প্রণয়ের স্রোত বাহিয়া।
চাঁদিনী যামিনী, মধু সমীরণ,
আধো ঘুমধোর, আধো জাগরণ,
চোখোচোখি হতে ঘটালে প্রমাদ
কুহুস্বরে পিক গাহিয়া—
দেখে দেখো, সখী, চাহিয়া।

পঞ্চম দৃশ্য


কানন


অমর।  দিবসরজনী আমি যেন কার 
আশায় আশায় থাকি।
তাই  চমকিত মন, চকিত শ্রবণ,
তৃষিত আকুল আঁখি।
চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই,
সদা মনে হয় যদি দেখা পাই,
‘কে আসিছে’ ব’লে চমকিয়ে চাই
কাননে ডাকিলে পাখি।
জাগরণে তারে না দেখিতে পাই,
থাকি স্বপনের আশে—
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়
বাঁধিব স্বপনপাশে।

এত ভালোবাসি এত যারে চাই
মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই,
যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে
তাহারে আনিবে ডাকি।

প্রমদা সখীগণ অশোক ও কুমারের প্রবেশ


কুমার।  সখী,  সাধ করে যাহা দিবে তাই লইব। 
সখীগণ। আহা, মরি মরি, সাধের ভিখারি, 
তুমি  মনে মনে চাহ প্রাণমন।
কুমার।  দাও যদি ফুল, শিরে তুলে রাখিব। 
সখী। দেয় যদি কাঁটা? 
কুমার। তাও সহিব। 
সখীগণ।  আহা, মরি মরি, সাধের ভিখারি, 
তুমি  মনে মনে চাহ প্রাণমন।
কুমার।  যদি একবার চাও, সখী, মধুর নয়ানে 
ওই আঁখি-সুধা-পানে চিরজীবন মাতি রহিব
সখীগণ।  যদি কঠিন কটাক্ষ মিলে? 
কুমার।  তাও  হৃদয়ে বিঁধায়ে চিরজীবন বহিব। 
সখীগণ।  আহা, মরি মরি, সাধের ভিখারি, 
তুমি  মনে মনে চাহ প্রাণমন।
প্রমদা।  আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, 
শুধাইল না কেহ।
সে তো এল না, যারে সঁপিলাম
এই প্রাণ মন দেহ।
সে কি  মোর তরে পথ চাহে—
সে কি  বিরহগীত গাহে
যার  বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে
আমি ত্যজিলাম গেহ।

মায়াকুমারীগণ।  নিমেষের তরে শরমে বাধিল, 
মরমের কথা হল না।
জনমের তরে তাহারি লাগিয়ে
রহিল মরমবেদনা।

প্রমদার প্রতি


অশোক।  ওগো সখী, দেখি দেখি মন কোথা আছে। 
সখীগণ। কত  কাতর হৃদয় ঘুরে ঘুরে হেরো কারে যাচে। 
অশোক।  কী মধু, কী সুধা, কী সৌরভ, 
কী রূপ রেখেছ লুকায়ে!
সখীগণ।  কোন্ প্রভাতে কোন্ রবির আলোকে 
দিবে খুলিয়ে কাহার কাছে!
অশোক।  সে যদি না আসে এ জীবনে,  এ কাননে পথ না পায়। 
সখীগণ।  যারা এসেছে তারা বসন্ত ফুরালে 
নিরাশ প্রাণে ফেরে পাছে।
প্রমদা।  এ তো  খেলা নয়, খেলা নয়। 
এ যে হৃদয়দহনজ্বালা সখী।
এ যে প্রাণভরা ব্যাকুলতা,  গোপন মর্মের ব্যথা,
এ যে {{gap|1em}কাহার চরণোদ্দেশে জীবন মরণ ঢালা।
কে যেন সতত মোরে  ডাকিয়ে বাকুল করে,
যাই-যাই করে প্রাণ— যেতে পারি নে।
যে কথা বলিতে চাহি তা বুঝি বলিতে নাহি—
কোথা যে নামায়ে রাখি,  সখী,  এ প্রেমের ডালা।
যতনে গাঁথিয়ে শেষে  পরাতে পারি নে মালা।
প্রথমা সখী।  সে জন কে, সখী, বোঝা গেছে 
আমাদের সখী যারে মনপ্রাণ সঁপেছে।
দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া।  ও সে  কে, কে, কে! 
প্রথমা।  ওই-যে তরুতলে  বিনোদমালা গলে 

না জানি কোন্ ছলে  বসে রয়েছে।
দ্বিতীয়া।  সখী, কী হবে— 
ও কি কাছে আসিবে কভু! কথা কবে!
তৃতীয়া। ও কি প্রেম জানে! ও কি বাঁধন মানে! 
 কী মায়াগুণে মন লয়েছে।
দ্বিতীয়া।  বিভল আঁখি তুলে আঁখিপানে চায়, 
যেন কোন্ পথ ভুলে এল কোথায়  ওগো!
তৃতীয়া।  যেন কোন্ গানের স্বরে  শ্রবণ আছে ভরে, 
যেন কোন্ চাঁদের আলোয় মগ্ন হয়েছে।
অমর।  ওই  মধুর মুখ জাগে মনে। 
ভুলিব না এ জীবনে কী স্বপনে কী জাগরণে।
তুমি জান বা না জান,
মনে সদা যেন মধুর বাঁশরি বাজে
হৃদয়ে সদা আছ ব’লে।
আমি  প্রকাশিতে পারি নে,
শুধু চাহি কাতর নয়নে।
সখীগণ।  তারে  কেমনে ধরিবে, সখী, যদি ধরা দিলে। 
প্রথমা।  তারে  কেমনে কাঁদাবে যদি আপনি কাঁদিলে। 
দ্বিতীয়া।  যদি মন পেতে চাও মন রাখো গোপনে। 
তৃতীয়া। কে তারে বাঁধিবে তুমি আপনায় বাঁধিলে। 
সকলে।  কাছে আসিলে তো কেহ কাছে রহে না। 
কথা  কহিলে তো কেহ কথা কহে না।
প্রথম।  হাতে পেলে ভূমিতলে ফেলে চলে যায়। 
দ্বিতীয়া।  হাসিয়ে ফিরায় মুখ কাঁদিয়ে সাধিলে। 

নিকটে আসিয়া প্রমদার প্রতি


অমর। সকল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছি যারে 
সে কি ফিরাতে পারে সখী!

সংসাবাহিরে থাকি জানি নে কী ঘটে সংসারে।
কে জানে হেথায়  প্রাণপণে প্রাণ যারে চায়
তারে পায় কি না পায়,  জানি নে—
ভয়ে ভয়ে তাই এসেছি গো অজানা-হৃদয়-দ্বারে।
তোমার সকলি ভালোবাসি— ওই রূপরাশি,
ওই খেলা, ওই গান, ওই মধুহাসি।
ওই দিয়ে আছ ছেয়ে জীবন আমারি—
কোথায় তোমার সীমা ভুবনমাঝারে।
সখীগণ।  তুমি কে গো, সখীরে কেন জানাও বাসনা। 
দ্বিতীয়া।  কে জানিতে চায় তুমি ভালোবাস কি ভালোবাস না। 
প্রথমা।  হাসে চন্দ্র, হাসে সন্ধ্যা, ফুল্ল কুঞ্জকানন, 
হাসে হৃদয়বসন্তে বিকচ যৌবন।
তুমি কেন ফেল শ্বাস, তুমি কেন হাস না।
সকলে।  এসেছ কি ভেঙে দিতে খেলা— 
সখীতে সখীতে এই হৃদয়ের মেলা—
দ্বিতীয়া।  আপন দুঃখ আপন ছায়া লয়ে যাও। 
প্রথমা।  জীবনের আনন্দপথ ছেড়ে দাঁড়াও। 
তৃতীয়া।  দূর হতে করো পূজা হৃদয়কমল-আসনা। 
অমর। তবে সুখে থাকো সুখে থাকো— আমি যাই— যাই। 
প্রমদা।  সখী, ওরে ডাকো, মিছে খেলায় কাজ নাই। 
সখীগণ।  অধীরা হয় না, সখী, 
আশ  মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।
অমর।  ছিলাম একেলা সেই আপন ভুবনে, 
এসেছি এ কোথায়।
হেথাকার পথ জানি নে— ফিরে যাই।
যদি সেই বিরামভবন ফিরে পাই।

প্রমদা।  সখী, ওরে ডাকো ফিরে। 
মিছে খেলা মিছে হেলা কাজ নাই।
সখীগণ।  অধীরা হোয়ো না, সখী, 
আশ  মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।

প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ।  নিমেষের তরে শরমে বাধিল, মরমের কথা হল না। 
জনমের তরে তাহারি লাগিয়ে রহিল মরমবেদনা।
চোখে চোখে সদা রাখিবারে সাধ—
পলক পড়িল, ঘটিল বিষাদ-
মেলিতে নয়ন মিলালো স্বপন, এমনি প্রেমের ছলনা।

ষষ্ঠ দৃশ্য


গৃহ


শান্তা। অমরের প্রবেশ


অমর।  সেই শান্তিভবন ভুবন কোথা গেল— 
সেই রবি শশী তারা, সেই শোকশান্ত সন্ধ্যাসমীরণ,
সেই শোভা, সেই ছায়া, সেই স্বপন।
সেই  আপন হৃদয়ে আপন বিরাম কোথা গেল,
গৃহহারা হৃদয় লবে কাহার শরণ।

শান্তার প্রতি


এসেছি ফিরিয়ে, জেনেছি তোমারে,
এনেছি হৃদয় তব পায়ে—
শীতল স্নেহসুধা করো দান,
দাও প্রেম, দাও শান্তি, দাও নূতন জীবন।
মায়াকুমারীগণ।  কাছে ছিলে দূরে গেলে,  দূর হতে এসো কাছে। 

ভুবন ভ্রমিলে তুমি,  সে এখনো বসে আছে।
ছিল না প্রেমের আলো,  চিনিতে পার নি ভালো,
এখন বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে।
শান্তা।  দেখো, সখা, ভুল করে  ভালোবেসো না। 
আমি ভালোবাসি ব’লে  কাছে এসো না।
তুমি যাহে সুখী হও  তাই করো সখা,
আমি সুখী হব ব’লে  যেন হেসো না।
আপন বিরহ লয়ে  আছি আমি ভালো—
কী হবে চির আঁধারে নিমেষের আলো!
আশা ছেড়ে ভেসে যাই,  যা হবার হবে তাই—
আমার অদৃষ্টস্রোতে  তুমি ভেসো না।
অমর। ভুল করেছিনু, ভুল ভেঙেছে। 
এবার  জেগেছি, জেনেছি—
এবার আর  ভুল নয়, ভুল নয়।
ফিরেছি মায়ার পিছে পিছে।
জেনেছি স্বপন সব মিছে।
বিঁধেছে বাসনা-কাঁটা প্রাণে—
এ তো  ফুল নয়, ফুল নয়!
পাই যদি ভালোবাসা হেলা করিব না,
খেলা করিব না লয়ে মন।
ওই প্রেমময় প্রাণে লইব আশ্রয় সখী,
অতল সাগর এ সংসার—
এ তো  কূল নয়, কূল নয়।

প্রমদার সখীগণের প্রবেশ


দূর হইতে


সখীগণ।  অলি  বার বার ফিরে যায়, 
অলি  বার বার ফিরে আসে—

তবে তো ফুল বিকাশে।
প্রথমা।  কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না, মরে লাজে, মরে ত্রাসে। 
ভুলি মান অপমান  দাও মন প্রাণ,
নিশি দিন রহো পাশে।
দ্বিতীয়া।  ওগো  আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও 
হৃদয়রতন-আশে।
সকলে।  ফিরে এসো ফিরে এসো, বন মোদিত ফুলবাসে। 
আজি  বিরহরজনী, ফুল্ল কুসুম শিশিরসলিলে ভাসে।
অমর।  ওই কে আমায় ফিরে ডাকে। 
ফিরে যে এসেছে তারে কে মনে রাখে।
মায়াকুমারীগণ।  বিদায় করেছ যারে  নয়নজলে 
এখন ফিরবে তারে  কিসের ছলে  গো।
আজি মধু সমীরণে  নিশীথে কুসুমবনে
তারে কি পড়েছে মনে  বকুলতলে?
এখন ফিরাবে তারে  কিসের ছলে  গো।
অমর।  আমি চলে এনু বলে কার বাজে ব্যথা। 
কাহার মনের কথা মনেই থাকে।
আমি শুধু বুঝি, সখী, সরল ভাষা—
সরল হৃদয় আর সরল ভালোবাসা।
তোমাদের কত আছে, কত মন প্রাণ,
আমার হৃদয় নিয়ে ফেলো না বিপাকে।
মায়াকুমারীগণ।  সেদিন তো মধুনিশি  প্রাণে গিয়েছিল মিশি, 
মুকুলিত দশ দিশি  কুসুমদলে।
দুটি সোহাগের বাণী  যদি হত কানাকানি,
যদি ঐ মালাখানি  পরাতে গলে!
এখন ফিরাবে তারে  কিসের ছলে  গো।

অমরের প্রতি


শান্তা।  না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে! 

ওগো, কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে,
কাহার জীবনে নাহি সুখ,  কাহার পরান জ্বলে!
পড় নি কাহার নয়নের ভাষা,
বোঝ নি কাহার মরমের আশা,
দেখ নি ফিরে—
কার  ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দ’লে।
অমর।  আমি  কারেও বুঝি নে, শুধু বুঝেছি তোমারে। 
তোমাতে পেয়েছি আলো সংশয়-আঁধারে।
ফিরিয়াছি এ ভুবন,  পাই নি তো কারো মন,
গিয়েছি তোমারি শুধু মনের মাঝারে।
এ সংসারে কে ফিরাবে— কে লইবে ডাকি
আজিও বুঝিতে নারি, ভয়ে ভয়ে থাকি।
কেবলই তোমারে জানি,  বুঝেছি তোমার বাণী,
তোমাতে পেয়েছি কূল অকূল পাথারে।

প্রস্থান


সখীগণ। প্রভাত হইল নিশি  কানন ঘুরে, 
বিরহবিধুর হিয়া  মরিল ঝুরে।
ম্লান শশী অস্তে গেল,  ম্লান হাসি মিলাইল—
কাঁদিয়া উঠিল প্রাণ  কাতর সুরে।

প্রমদার প্রবেশ


প্রমদা।  চল্ সখী, চল্ তবে  ঘরেতে ফিরে— 
যাক ভেসে ম্লান আঁখি  নয়ননীরে।
যাক ফেটে শূন্য প্রাণ,  হোক আশা অবসান—
হৃদয় যাহারে ডাকে  থাক্ সে দূরে।

প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ।  মধুরাতি পূর্ণিমার  ফিরে আসে বার বার, 
সে জন ফেরে না আর  যে গেছে চলে।

ছিল তিথি অনুকুল,  শুধু নিমেষের ভুল—
চিরদিন তৃষাকুল  পরান জ্বলে।
এখন ফিরাবে তারে  কিসের ছলে গো।

সপ্তম দৃশ্য


কানন


অমর শান্তা অন্যান্য পুরনারী ও পৌরজন


স্ত্রীগণ।  এস’ এস’, বসন্ত, ধরাতলে। 
আন’ কুহুকুহু কুহুতান, প্রেমগান,
আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।
আন’ নবযৌবনহিল্লোল, নব প্রাণ,
প্রফুল্ল নবীন বাসনা ধরাতলে।
পুরুষগণ।  এস’ থরথরকম্পিত মর্মরমুখরিত 
নবপল্লবপুলকিত
ফুল-আকুল-মালতিবল্লি-বিতানে-
সুখছায়ে মধুর এস’ এস’।
এস’ অরুণচরণ কমলবরণ
তরুণ উষার কোলে।
এস জ্যোৎস্নাবিবস নিশীথে,
কলকল্লোল-তটিনী-তীরে—
সুখসুপ্ত সরসীনীরে এস’ এস’।
স্ত্রীগণ। এস’ যৌবনকাতর হৃদয়ে, 
এস’ মিলনসুখালস নয়নে,
এস’ মধুর শরমমাঝারে,
দাও বাহুতে বাহ বাঁধি,
নবীন কুসুমপাশে রচি দাও নবীন মিলনবাঁধন।

শান্তার প্রতি


অমর।  মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে। 
মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে।
কুহকলেখনী ছুটায়ে  কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়কাহিনী বিবিধ বরনছটাতে।
হেরো  পুরানো প্রাচীন ধরণী  হয়েছে শ্যামলবরনী,
যেন  যৌবনপ্রবাহ ছুটেছে কালের শাসন টুটাতে।
পুরানো বিরহ হানিছে, নবীন মিলন আনিছে,
নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে।
স্ত্রীগণ।  আজি  আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে 
মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগল মুরতি।
পুরুষগণ।  ফুলগন্ধে পাগল করে,  বাজে বাঁশরি উদাস স্বরে, 
নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে—
স্ত্রীগণ।  তারি মাঝে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগল মুরতি। 
আনো আনো ফুলমালা, দাও দোঁহে বাঁধিয়ে।
পুরুষগণ।  হৃদয়ে পশিবে ফুলপাশ, অক্ষয় হবে প্রেমবন্ধন। 
স্ত্রীগণ। চিরদিন হেরিব হে 
মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগল মুরতি।

প্রমদা ও সখীগণের প্রবেশ


অমর। এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া! 
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া!

প্রমদার প্রতি


শান্তা।  আহা, কে গো তুমি মলিনবয়নে 
আধোনিমীলিত নলিননয়নে
যেন আপনারি হৃদয়শনে
আপনি রয়েছ লীন।

পুরুষগণ। তোমা তরে সবে রয়েছে চাহিয়া, 
তোমা লাগি পিক উঠিছে গাহিয়া,
ভিখারি সমীর কানন বাহিয়া
ফিরিতেছে সারা দিন।
অমর।  এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া! 
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া।
শান্তা। যেন শরতের মেঘখানি ভেসে 
চাঁদের সভাতে দাঁড়ায়েছ এসে,
এখনি মিলাবে ম্লান হাসি হেসে—
কাঁদিয়া পড়িবে ঝরি।
পুরুষগণ।  জাগিছে পূর্ণিমা পূর্ণ নীলাম্বরে, 
কাননে চামেলি ফুটে থরে থরে,
হাসিটি কখন ফুটিবে অধরে
রয়েছি তিয়াষ ধরি।
অমর।  এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া! 
এ কি প্রমদা! এ কি প্রমদার ছায়া।
সখীগণ। আহা,  আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, 
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,
সখীর হৃদয় কুসুমকোমল—
কার অনাদরে আজি ঝরে যায়!
কেন কাছে আস’,  কেন মিছে হাস’,
কাছে যে আসিত সে তো  আসিতে না চায়।
সুখে আছে যারা  সুখে থাক্ তারা,
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা—
দুখিনী নারীর নয়নের নীর
সুখীজনে যেন দেখিতে না পায়।
তারা  দেখেও দেখে না,
তারা  বুঝেও বুঝে না,

তারা ফিরেও না চায়।
শান্তা।  আমি তো বুঝেছি সব, যে বোঝে না-বোঝে, 
গোপনে হৃদয় দুটি কে কাহারে খোঁজে।
আপনি বিরহ গড়ি  আপনি রয়েছে পড়ি,
বাসনা কাঁদিছে বসি হৃদয়সরোজে।
আমি কেন মাঝে থেকে  দুজনারে রাখি ঢেকে,
এমন ভ্রমের তলে কেন থাকি মজে।

প্রমদার প্রতি


অশোক।  এতদিন বুঝি নাই, বুঝেছি ধীরে— 
ভালো যারে বাস তারে আনিব ফিরে।
হৃদয়ে হৃদয় বাঁধা, দেখিতে না পায় আঁধা—
নয়ন রয়েছে ঢাকা নয়ননীরে।
শান্তা ও স্ত্রীগণ।  চাঁদ হাসো, হাসো— 
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।
পুরুষগণ। কত দুখে কত দূরে আঁধারসাগর ঘুরে 
সোনার তরণী দুটি তীরে এসেছে।
মিলন দেখিবে বলে  ফিরে বায়ু কুতুহলে,
চারি ধারে ফুলগুলি ঘিরে এসেছে।
সকলে।  চাঁদ হাসে, হাসো— 
হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে।
প্রমদা।  আর কেন, আর কেন 
দলিত কুসুমে বহে বসন্তসমীরণ।
ফুরায়ে গিয়েছে বেলা— এখন এ মিছে খেলা—
নিশান্তে মলিন দীপ কেন জ্বলে অকারণ।
সখীগণ।  অশ্রু যবে ফুরায়েছে তখন মুছাতে এলে 
অশ্রুভরা হাসিভরা নবীন নয়ন ফেলে!
প্রমদা।  এই লও, এই ধরো— এ মালা তোমরা পরো— 
এ খেলা তোমরা খেলো, সুখে থাকো অনুক্ষণ।

অমর।  এ ভাঙা সুখের মাঝে নয়নজলে 
এ মলিন মালা কে লইবে।
স্নান আলো গান আশা হৃদয়তলে,
এ চিরবিষাদ কে বহিবে।
সুখনিশি অবসান—  গেছে হাসি, গেছে গান—
এখন এ ভাঙা প্রাণ লইয়া গলে
নীরব নিরাশা কে সহিবে।
শান্তা।  যদি কেহ নাহি চায় আমি লইব, 
তোমার সকল দুখ আমি সহিব।
আমার হৃদয় মন সব দিব বিসর্জন,
তোমার হৃদয়ভার আমি বহিব।
ভুল-ভাঙা দিবালোকে  চাহিব তোমার চোখে—
প্রশান্ত সুখের কথা আমি কহিব।

অমর ও শান্তার প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ।  দুখের মিলন টুটিবার নয়— 
নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়।
নয়নসলিলে যে হাসি ফুটে গো,
রয় তাহ রয় চিরদিন রয়।
প্রমদা।  কেন এলি রে, ভালোবাসিলি,  ভালোবাসা পেলি নে। 
কেন সংসারেতে উঁকি মেরে চলে গেলি নে।
সখীগণ।  সংসার কঠিন বড়ো— কারেও সে ডাকে না, 
কারেও সে ধরে রাখে না।
যে থাকে সে থাকে আর যে যায় সে যায়—
কারো তরে ফিরেও না চায়।
প্রমদা।  হায় হায়, এ সংসারে যদি না পূরিল 
আজন্মের প্রাণের বাসনা,
চলে যাও ম্লানমুখে, ধীরে ধীরে ফিরে যাও—

থেকে যেতে কেহ বলিবে না।
তোমার ব্যথা তোমার অশ্রু তুমি নিয়ে যাবে—
আর তো কেহ অশ্রু ফেলিবে না।

প্রস্থান


মায়াকুমারীগণ


সকলে।  এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না। 
প্রথমা।  শুধু  সুখ চলে যায়। 
দ্বিতীয়া।  এমনি মায়ার ছলনা। 
তৃতীয়া। এরা  ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়। 
সকলে।  তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ, 
তাই মান অভিমান।
প্রথমা।  তাই এত হায়-হায়। 
দ্বিতীয়া।  প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়। 
সকলে।  সখী, চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরালো, 
মিছে আর কেন বলো।
প্রথমা।  শশী  ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল। 
সকলে। সখী, চলো। 
প্রথমা।  প্রেমের কাহিনী গান  হয়ে গেল অবসান। 
দ্বিতীয়া।  এখন  কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।