গুচ্ছ/টমি

উইকিসংকলন থেকে

টমি

 টমি দেখিতে ছোট, কিন্তু আমাদের সংসারে সে একজন কর্ত্তাব্যক্তি। আমার এখন একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তাহারা কখনও টমির গায়ে হাত দিতে সাহস করে না। সে গম্ভীরভাবে একখানা পাপোসের উপর বসিয়া থাকে; কেবল আমি এবং আমার স্ত্রী তাহার নিকটে আসিলে লেজটি নাড়িতে থাকে; আর কাহাকেও সে বড় একটা গ্রাহ্য করে না। সুশী (আমার কণ্ঠ, তাহার ভাল নাম সুশীলা) মাঝে মাঝে তাহার মাতার নিকট নালিস করে যে, টমি কেবল বসিয়া থাকে, খেলা করে না, পথ দিয়া লোক গেলে ডাকে না। তাহার মা তাহাকে বলে যে, টমি অনেক কাজ করিয়াছে, এখন আর পারে না; সে পেন্সন পাইতেছে। টমি কি কাজ করিয়াছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কেবল মন্দ মন্দ হাস্য করেন।

 যখন আমার পিতা পঞ্চসহস্র রজত মুদ্রার বিনিময়ে আমাকে মিনির পিতার নিকটে বিক্রয় করিয়াছিলেন, তখন আমি ওকালতী পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। যথাসময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া কলিকাতা হইতে দেশে ফিরিয়া গেলাম। ইচ্ছা ছিল যে কলিকাতায় থাকিয়া হাইকোর্টে প্রাক্টিস্‌ করি, কিন্তু তাহা হইল না। পাশ করিয়া পিতাকে যখন হাইকোর্টে ওকালতি করিবার বাসনা জানাইলাম, তখন গুনিতে পাইলাম যে তাঁহার অবস্থা ভাল নহে, আমাকে সুশিক্ষিত করিতে গিয়া তিনি সর্ব্বস্বাস্ত হইয়াছেন। বরাবর শুনিয়া আসিয়াছি যে, পিতা বিত্তশালী কিন্তু কৃপণ, গ্রামে তাঁহার যে একটু অখ্যাতি আছে তাহাও জানিতাম। আমার বিবাহের পরে যখন বধূ লইয়া বাড়ী আসিলাম তখন আমার পিতা বরবধূ বরণের পূর্ব্বে বন্ধুর অঙ্গের অলঙ্কারগুলি খুলিয়া ওজন করিয়া লইয়াছিলেন, তাহাও শুনিয়াছিলাম। কি করিব, উপায় নাই, দেশে ফিরিলাম।

 নিত্য শামলা মাথায় দিয়া কাছারি যাই; শূন্য পকেট ও শূন্য উদর লইয়া ফিরিয়া আসি। পিতার হৃদয়ে দয়ামায়ার স্থান ছিল না। তিনি প্রায়ই আমার উপার্জ্জনের অভাব দেখিয়া জানাইতেন যে তিনি আর আমাদিগের (অর্থাৎ আমার ও আমার স্ত্রীর) ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করিতে পারবেন না। তখন মনে বড়ই ঘৃণা হইত, ভাবিতাম যেমন করিয়া পারি উপার্জ্জন করিব। তাহার পরদিন শামলাটা মাথায় জোর করিয়া টিপিয়া বসাইয়া আদালতে যাইতাম, দুই এক জন বড় উকীলের মুহুরীর ও দালালের তাড়া খাইয়া স্থির করিতাম এ জঘন্য বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়া মোট বহির, ওকালতী করিয়া অর্থ উপার্জ্জন করা আর হইবে না।

 বলা বাহুল্য এ পর্যন্ত আমি নিঃসন্তান। মাতা মধ্যে মধ্যে দুঃখ করিতেন, তাহা শুনিয়া আমি মনে মনে হাসিতাম, ভাবিতাম পিতা ত পুত্রের ব্যয়ভার বহনেই অসমর্থ; পৌত্র-পৌত্রীর আবির্ভাব হইলেই তিনি হয় ত আমাদিগকে বিদায় করিয়া দিবেন। কিন্তু মাতার দুঃখ ক্রমে অভিযোগে পরিণত হইল। পিতা বুঝিলেন তাঁহার পৌত্রী ভাবের জন্য বধুই দোষী এবং মাতাও ক্রমশঃ বধূর পক্ষ পরিত্যাগ করিলেন। বিশেষতঃ পিতা যখন স্পষ্ট বুঝাইয়া দিলেন, যে তাঁহার পৌত্রহীনতা ভগবানের বিশেষ দয়ার লক্ষণ, কারণ পাঁচটা পাশ-কর ছেলে কোন্‌ না এখন আর দশ হাজার টাকা আনিবে, তখন আমি বড় বিপদে পড়িলাম।

 আমার স্ত্রী যখন পিতার অভিপ্রায় জ্ঞাত হইলেন তখন তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল, মুখখানি ভারও হইল! দুই জনে নীরবে বসিয়া রাত্রি কাটাইয়া দিতাম, প্রবোধ দিতেও ভরসা হইত না। কি বলিয়া প্রবোধ দিব? মাতা যে বধূকে একেবারে ভালবাসিতেন না, তাহা নহে; তবে দশ হাজার টাকার লোভ সম্বরণ করাও তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। তবুও গোপনে গোপনে তিনি বধূকে অনেক ঔষধ সেবন করাইয়াছিলেন ও অনেক দেবতার পূজা মানিয়াছিলেন। তাহার পর দেবতা বোধ হয় মুখ তুলিয়া চাহিলেন। মাতা একদিন সানন্দে পিতাকে আগু পৌত্রমুখ দর্শনের সম্ভাবনার কথা জানাইলেনু। আমিও আশু বিপদের হাত হইতে রক্ষা পাইলাম মনে করিয়া একটু নিশ্চিন্ত হইলাম। পিতা কিন্তু ক্ষুণ্ণ হইলেন।

 বিধিলিপি কে খণ্ডন করে। যথাসময়ে তিনি মাতার বাঞ্ছা পূর্ণ করিলেন, মাতা পৌত্রমুখও দর্শন করিলেন; কিন্তু পৌত্র দিবালোক দর্শন করিবার পূর্ব্বেই দেহত্যাগ করিয়াছিল—তিনি মৃতপুত্র প্রসব করিয়াছিলেন। মাতার শোকের ও দুঃখের অবধি রহিল না। কিন্তু পিতা যেন আশ্বস্ত হইলেন। এবং আমার বিনিময়ে (দ্বিতীয়বার) দশ সহস্র রজতখণ্ড অর্জ্জনে এইবার কৃতসঙ্কল্প হইলেন। অযত্নে ও দুঃখে তিনিও এই সময়ে মৃতপুত্রের অনুসরণ করিবার বিশেষ

চেষ্টা করিতেছিলেন। এই সময়ে আমাদিগের জীবনে টমির প্রথম আবির্ভাব।

 টমি ডিপুটি সাহেবের প্রিয় কুকুরীর পুত্র এবং তাহার মাতার মনিবের ন্যায় খাস বিলাতী। তাহাকে চারি আনা মূল্য দিয়া মেথরের নিকট হইতে ক্রয় করিয়া কোটের পকেটের মধ্যে লুকাইয়া শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিলাম। ভয়ে ভয়ে তাহাকে বাহির করিলাম। তিনি তখনও রোগ-শয্যায় কিন্তু সে তখনই লেজ নাড়িয়া হাত মুখ চাটিয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া লইল, তাহার পর তাঁহার কোলেই ঘুমাইয়া পড়িল।

 ছয় মাস কাটিয়া গেল। টমি বড় হইয়া উঠিল। পিতার দশ। হাজার টাকা পাইবার আশা যত বলবতী হইয়া উঠিতেছিল, মিনির শরীর ততই অধিকতর দুর্ব্বল হইতেছিল। অবশেষে তাঁহার পিতা কাসিয়া তাঁহাকে লইয়া গেলেন। মিনির পিতা জীবনের শেষ কয়ট দিন দূর পশ্চিমাঞ্চলে কাটাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।

 আমি আর টমি শূন্যগৃহ পড়িয়া রহিলাম। বিপদজাল আমাকে এমনিভাবে ঘিরিয়া ফেলিল যে উদ্ধারের বড় উপরে রহিল না। শুনিতে পাইতেছি যে মিনির রোগ বাড়িয়াছে, কিন্তু তাহাকে দেখিতে যাইতে পারিতেছি না, ভরসায় কুলায় না। দশ হাজার টাকাও বড়ই নিকট হইয়া আসিতেছিল। তখন সমস্ত সঙ্কোচ ও ভয় দূরে ঠেলিয়া আমি মিনিকে দেখিবার জন্য সেই দূর পশ্চিমে রওনা হইরা পড়িলাম কিন্তু সেখানে পৌঁছিয়া শুনিলাম কন্যার মৃত্যু হওয়ায় মিনির পিতা সপরিবারে অন্যত্র চলিয়া গিয়াছেন। বুঝিলাম মিনি মায়া কাটাইয়াছে। আমি উন্মাদের মত শূন্যহৃদয়ে বাড়ী ফিরিলাম। চোখে এক ফোঁট জলও ছিল না।

 মনটা কেমন হইরা গেল। সকলেরই শুনিয়াছি এমনি হয়। মিনি নাই, বিশ্বাস হয় না। সে যেন কোথায় গিয়াছে, আবার আসিবে। কখনও ভাবিতাম, যদি অর্থ উপার্জ্জনের ক্ষমতা থাকিত, যদি পিতার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে না হইত, তাহা হইলে হয় ত মিনিকে বাঁচাইতে পারিতাম। মাথার তেল পড়িত না, মলিন বসনে উদাসীনের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম। মা ভয় পাইয়া পিতাকে বলিতেন, পিতা আশ্বাস দিতেন, ঘরে আবার বৌ আসিলেই সব সারিয়া যাইবে,—অমন হইয়া থাকে।

 এক দিন মিনির কথা ভাবিতে ভাবিতে পাগলের মত হইয়াছি, নদীর ধারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, এমন সময়ে কে আসিয়া বলিল পিতা ডাকিতেছেন। বাড়ী ফিরিয়া দেখিলাম পিতা বড়ই প্রসন্ন, কে যেন আসিয়া কাণে কাণে বলিয়া গেল, দশ হাজার প্রায় তাঁহার হস্তগত। শুনিলাম কন্যার পিতা আশীর্ব্বাদ করিতে আসিয়াছেন।

 পিতা বলিলেন, “ভিতরে যাও।” আমি কিন্তু তেমনি দাঁড়াইয়া রহিলাম।

 দেখিয়া পিতা রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “দাঁড়িয়ে রটলে যে? ভিতৱে যাও।”

 আমি তবুও নড়িলাম না। কোন কথা কহিলাম না।

 পিতা তখন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, বলিলেন, “কি যাবে না?”

 পিতাকে দেবতার দ্যায় ভক্তি করিতাম। যাঁহার প্রসাদে এই নশ্বর দেহ লাভ করিয়াছি, কখনও তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কথা কহি নাই, যখন তিনি তিরস্কার করিতেন, তখন ভাবিতাম তিনি আমার ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্যই বলিতেছেন। তথাপি দশ সহস্রের জন্য তিনি যখন ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন, যখন মনে পড়িল তাঁহারই অযত্নে মিনি আমার মরিয়াছে, তখন ভক্তির স্রোত আর হৃদয়ের আবেগ রোধ করিতে পারিল না।

 আমার মাথার মধ্যে তখন আগুন জ্বলিতেছিল, আমিও উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর করিলাম “ন, যাব না।”

 পিতা অগ্নিশর্ম্ম হইয়া উঠিলেন, “আমাকে অপমান করবে, তবু স্বাবে না?”

 আমিও উত্তরোত্তর অধিক উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিলাম, দৃঢ়কণ্ঠে কহিলাম “না, কিছুতেই যাব না।”

 “যাবে না, তবে দূর হও।”

 গৃহ হইতে তখনি বাহির হইলাম। অল্প দূর গিয়া বোধ হইল যেন কে আমার পিছনে আসিতেছে। ফিরিয়া দেখিলাম,—টমি— তাহার টমি। টমিকে কোলে করিয়া চলিতে লাগিলাম।

 কপর্দ্দকশূন্য হইয়া যখন গৃহত্যাগ করিলাম তখন ভবিষ্যতের চিন্তা মনে প্রবেশ করে নাই। আমার কেহ নাই, কিছু নাই, বাঁচিবার আবশ্যক নাই, উদ্দেশ্যবিহীন হইয়া গৃহ পরিত্যাগ করিলাম— আমি আর টমি। আমাদের আপনার বলিতে কেহই নাই, আমাদের জন্য চিন্তা করিবার কেহ নাই, একদিনের জন্য আশ্রয় দিবার কেহ নাই; তথাপি গৃহ ত্যাগ করিয়া একটা অপূর্ব্ব শান্তি পাইলাম।  যখন অর্থের জন্য লালায়িত হইয়া বেড়াইয়াছি, তখন অর্থের মুখ দেখিতে পাই নাই, যখন অর্থের অভাবে সংসার মরুময় হইয়া গিয়াছে তখন অর্থ পাই নাই; কিন্তু যখন অর্থাভাব বোধ করিবার অবস্থা অতীত হইয়াছে তখন ভগবান অর্থ ঢালিয়া দিলেন। গৃহত্যাগ করিয়া অন্নাভাবে প্রথম উপার্জ্জন করিলাম। একজন কয়লার দালালের কেরাণী হইলাম। দেশে যখন কয়লার দুর্ভিক্ষ হইল তখন আমার মনিব চতুর্গুণ মূল্যে তাঁহার সঞ্চিত কয়লা ছাড়িতে আরম্ভ করিলেন। মনিব ক্রোরপতি হইলেন। তাঁহার প্রসাদে আমার অভাব ঘুচিল। ধনী হইয়া ভাবিলাম অর্থ লইয়া কি করিব? কে ভোগ করিবে? কাহার জন্য উপার্জ্জন করিলাম? ভোগ করিতে কেবল আমি আর টমি।

 চাকরী ছাড়িয়া দেশ ভ্রমণে বাহির হইলাম, আমি আর টমি। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। এইরূপে দিনের পর দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। গৃহের সংবাদ আমি মাঝে মাঝে পাইতাম। কিন্তু পিতা কখনও আমার সংবাদ লন নাই, একদিনও আমার সন্ধান করেন নাই। আমার আরও দুইটি ভাই ছিল, তাহারা বড় হইয়া উঠিল, তাহাদের বিবাহ হইল, পিতা বোধ হয় আমাকে বিস্তৃত হইলেন। তাহাতে এক দিনের তরেও মনে কোন কষ্ট অনুভব করি নাই। আমি ত মরিয়াছি—আমার আবার অভিমান কি?

 পিতা দেহত্যাগ করিলেন, ভাই দুইটি লক্ষ লক্ষ মুদ্রার অধীশ্বর হইল। যে পিতা আমার শিক্ষার জন্য সর্ব্বস্বাস্ত হইয়াছিলেন, যাঁহার এমন অর্থ ছিল না যে পুত্রকে কিছুদিন কলিকাতায় রাখিয়া দেন, যাহার পুত্রবধু অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মরিয়াছে, তাঁহার মৃত্যুর পরে তাঁহারই পরিত্যক্ত সম্পত্তি, লইয়া তাহার পুত্রগণ দেশের প্রধান ধনী হইয়া পড়িল, ইহাই দেখিয়া মনে একটু দুঃখ হইয়াছিল। ভাই দুইটি প্রথমে ভাবিয়ছিল যে আমি তাহাদের বিষয়-বিভবের ভাগ লইতে আসিব, কিন্তু দুই এক মাস কাটিয়া গেল, ক্রমে দুই এক বৎসর অতীত হইল, তখন তাহারা নিশ্চিন্তমনে বিষয় ভোগ করিতে লাগিল।

 কত দেশ ঘুরিয়া বেড়াইলাম, কোথাও শান্তি পাইলাম না। আমার মনেই যখন শান্তি নাই তখন কোথায় শান্তি পাইব। টমি আর বেশী বড় হয় নাই, সে যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে।

দেশ ছাড়িয়া আসিবার দশ বৎসর পরে শুনিতে পাইলাম মাতাও পিতার অনুসরণ করিয়াছেন। প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম নে আর কখনও জন্মভূমিতে ফিরিব না, কিন্তু তথাপি সময়ে সময়ে মাতার জন্য মন ব্যাকুল ইয়া উঠিত। ভাবিতাম একবার, কেবল একবার ফিরিব, মাতার পদধূলি লইয়া আসিব, সেই গৃহখানি একবার দেখিয়া আসিব। যে গৃহে জন্মিয়াছি, এ পর্য্যন্ত বাস করিয়াছি, মিনির সঙ্গে কত সুখদুঃখে যে গৃহখানিতে কাটাইয়াছি, সে গৃহখানি দেখিবার জন্য মন বড় ব্যাকুল হইয় উঠিত। মাকে দেখিবার জন্য একদিন মন সত্যই অস্থির হইয়া উঠিল, কিছুতেই মনকে বাঁধিতে পারিতেছিলাম না। একদিনের জন্যও বাড়ী ফিরিব স্থির করিলাম কিন্তু সংবাদ পাইলাম, মা আর নাই, তিনি পিতার অনুসরণ করিয়াছেন, তাঁহার স্নেহময়ী মূর্ত্তি আর দেখিতে পাইব না। তখন মনটা যেন কেমনতর হইয়া গেল। যদি কিছুদিন পূর্ব্বে একবার যাইতাম, তাহা হইলেও মাকে দেখিতে পাইতাম!  বাঙ্গালা দেশ ত্যাগ করিয়া তখন আমি বহুদূরে বাস করিতেছিলাম। কিন্তু সে দেশ আর ভাল লাগিল না। অনেক দিন বাঙ্গলা দেশ দেখি নাই! তিন দিন রেলে চড়িয়া একদিন সন্ধ্যার সময় মোগলসরাই ষ্টেসনে নামিয়া কাশী আসিয়া পৌঁছিলাম। বাঙ্গালী-টোলার, একটী ক্ষুদ্র অপরিচ্ছন্ন গৃহে আমরা দুইজন—টমি আর আমি—বাসা লইলাম। তখন পূজার ছুটি, বাঙ্গালীতে কাশী ভরিয়া গিয়াছে। কত দিন পূজার ছুটির কথা শুনি নাই। যখন দেশে ছিলাম পূজার সময় কত উৎসাহ হইত, কত আমোদ করিতান। কতদিন বাঙ্গালা দেশের দশভূজা দুর্গা প্রতিমা দেখি নাই। শেষ যেবার পূজা দেখিয়াছিলাম, মিনি তখনও বাঁচিয়া ছিল। পিতা বলিয়াছিলেন—থাক্ সে কথা।

 কাশীতে আসিয়া মনে হইল যেন দেশে আসিয়াছি। বাঙ্গালী-টোলায় সকলেই বাঙ্গালী। কাশীর হিন্দুস্থানী অধিবাসীরাও সুন্দর বাঙ্গাল ভাষায় কথা কহিয়া থাকেন। বছর বছর পূজার ছুটির সময় শত, শত বাঙ্গালী ভদ্রলোক সপরিবারে কাশীতে আসিয়া থাকেন। কত বাড়ীতে শারদ-পূজা হইতেছে, ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলি নূতন কাপড়জামা পরিয়া ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে। তাহা দেখিলে যে কত আনন্দ হয়, প্রবাসী ব্যতীত কেহ তাহা বুঝিতে পারে না। যে বহুকাল স্বজাতির মুখ দশন করে নাই, বহুকাল মাতৃভাষা শ্রবণ করে নাই, তাহার নিকট এজন্য—স্বর্গ। আমরা দুইজনে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াই, পূজা বাড়ীতে গিয়া প্রতিমা দেখিয়া আসি, সন্ধ্যার সময় ঘাটে বসিয়া থাকি, ইহাই আমাদিগের কার্য্য।

 আজ মহাষ্টমী। দলে দলে নরনারী অন্নপূর্ণার মন্দিরে চলিয়াছে। কত লোক আবার অন্নপূর্ণার মন্দির হইয়া দুর্গাবাড়ী যাইতেছে। দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়ির উপরে আমরা দুটিতে বসিয়া তাহাই দেখিতেছি। কত লোক আসিতেছে, স্নান করিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। আমাদের দিকে কেহ ফিরিয়াও চাহে না, একবার জিজ্ঞাসাও করে না। ভাবিতেছিলাম যে, আমি যদি মরি, তাহা হইলে কেবল কাঁদিবে টমি, আর কেহ দেখিয়াও দেখিবে না। এমন কেহ নাই যে, একদিন আর শুশ্রুষা করিবে,— মরণের সময়ে মুখে জল দিবে। টমিও যেন চুপ করিয়া বসিয়া কি ভাবিতেছিল কিন্তু হঠাৎ সে অস্থির হইয়া উঠিল, একটু পরেই উঠিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল, কত ডাকিলাম আমার কথা কিন্তু শুনিল না। সে ত পূর্ব্বে কখনও এমন অবাধ্য হয় নাই। মনে করিলাম টমি—আমার একমাত্র সঙ্গী সেও আজ আমাকে পরিত্যাগ করিয়া গেল।

 দূরে ঘাটের অপর দিকে কতকগুলি বাঙ্গালী রমণী স্নানান্তে কথা কহিতেছেন। দেখিলাম টমি সেই দিকে ছুটয়াছে। একটি মহিলার নিকটে গিয়া সে দুই তিনবার ডাকিয়া উঠিল, তাহার পর দুই পা তাঁহার গায়ের উপর তুলিয়া দিল, লেজ নাড়িয়া হাত চাটিয়া সদ্ভাব জানাইল, তাহার পর পাগলের মত ছুটতে আরম্ভ করিল। ছুটিয়া আবার তাঁহার নিকট ফিরিয়া গেল, আবার দুই পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইল। তখন তিনি আদর করিয়া তাহার মাথায় হাত দিলেন, টমি আনন্দে অধীর হইয়া লেজ নাড়িতে লাগিল। তিনি তাহাকে আদর করিয়া কোলে তুলিয়া লইলেন, আমি তখন দূর হইতে চীৎকার করিয়া টমিকে ডাকিতেছি। তিনি বোধ হয় তাহা শুনিতে পাইলেন, কারণ তখনই তাড়াতাড়ি টমিকে নামাইয়া দিলেন। টমি ছোট্টটি বটে, কিন্তু দেখিতে বড় সুন্দর। আমার কুকুর বলিয়া বলিতেছি না, সকলেই এই কথা বলে। তাহাকে আদর করিতে দেখিয়া আমি বিস্মিত হই নাই—কত লোকই তাহাকে আদর করে; কিন্তু সে ত কখনও আমার নিকট হইতে পলায় নাই। তাহার পর সেই মহিলাটিকে আর দেখিতে পাইলাম না, তিনি জনতার মধ্যে কোথায় মিশিয়া গেলেন তাহা ঠিক করিতে পারিলাম না।

 অনেকক্ষণ পরে টমি ফিরিয়া আসিল। আমি এদিকে চৌষটি ঘাট হইতে মানমন্দির পর্যন্ত তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। সে যখন আসিল, তখন তাহার জিহবা বাহির হইয়া পড়িয়াছে এবং সে বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু তখনও সে বাড়ী ফিরিতে প্রস্তুত নহে। সে আমাকে কোথায় লইয়া যাইতে চায়। বারবার দৌড়াইয়া যাইতেছে, আবার ফিরিয়া আসিয়া আমার কাপড় ধরিয়া টানিতেছে। ধমক দিয়া উঠিলে পা চাটিয়া আদর করিতেছে। আমি ভাবিলাম, কে হয় ত তাহাকে মারিয়াছে, না হয় তাড়াইয়া দিয়াছে; সেই জন্য সে নালিশ করিতে আসিয়াছে। সে সময়ে সময়ে এমন নালিশ করিত। তখন বেলা বাড়িয়া উঠিয়াছে, ক্ষুধার উদ্রেক হইতেছে, তাহার আব্দার আর ভাল লাগিতেছিল না।

 সে মুক। সে যাহা খুঁজিয়া পাইয়াছিল তাহা দেখাইবার জন্য আমাকে আহ্বান করিতে আসিয়াছিল। আমি ত তাহা বুঝিতে পারি নাই। সে তাহার ভাষায় আমাকে জানাইতে আসিয়াছিল যে, এ জগতে তাহাকে ভালবাসে এবং ভালবাসিত এমন একজনের সন্ধান পাইয়া, সে আমাকে জানাইতে আসিয়াছিল। তাহার সুদূর শৈশবে যে তাহাকে মাতার ন্যায় পালন করিয়াছিল, সে তাহার অপূর্ব্ব ঘ্রাণশক্তিবলে তাহাকে আবিষ্কার করিয়া আমাকে জানাইতে আসিয়াছিল। সে বুঝিত যে এ বিশাল জগতে তাহার আমি, এবং আমার সে ব্যতীত আর কেহই নাই। আর এক জন ছিল, কিন্তু আজ পঞ্চদশ বর্ষ সে কোথায় চলিয়া গিয়াছে সে তাহা বুঝিতে পারে নাই। সে তাহার অভাব বোধ করিত, বেদন অনুভব করিত, কিন্তু প্রকাশ করিতে পারিত না।

 টমিকে কোলে করিয়া গৃহে ফিরিলাম। সে কিছুতেই ফিরিবে না, কেবল পলাইয়া যাইবে। অগত্যা তাহাকে বহিয়া লইয়া আসিলাম। আহার শেষ হইয়াছে, এমন সময় ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল, টমি পলাইয়াছে। তখনই তাহাকে সন্ধান করিতে বাহির হইলাম। কেদারঘাট হইতে মনিকণিকা পর্য্যন্ত সমস্ত বাড়ী ও গলি খুঁজিয়া বেড়াইলাম, কিন্তু কোথাও তাহার সন্ধান পাইলাম না। বেলা যখন তৃতীয় প্রহর তখন তাহাকে পাইলাম। সে যেন কাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। আমি তখনও বুঝিতে পারি নাই যে, সে পলাইয়া আসিয়া ভ্রাণশক্তির বলে তাঁহাঁকে খুজিয়া বাহির করিয়াছে। তাহার পর সংবাদ দিবার জন্য আমার সন্ধান করিয়া বেড়াইতেছে। টমি আমাকে দেখিয়া লাফাইয়া উঠিল, আবার আমার কাপড় ধরিয়া টানিতে লাগিল, আমাকে ছাড়িয়া দিয়া আবার খানিক দূর দৌড়িয়া গেল। তখন আমি কতকটা বিস্ময়ে কতকটা কৌতুহলে তাহার অনুসরণ করিলাম।

 গলির ভিতরে একখানি নূতন বাড়ী। তাহার সম্মুখে পাথরের একটি ক্ষুদ্র মন্দির। টমি তাহার ভিতর প্রবেশ করিল। আবার তখনই বাহির হইয়া আমার নিকট আসিল। আমি তাহাকে ধরিতে গেলাম, সে পলাইয়া গেল। আমি স্তম্ভিত হইয়া মন্দিরদ্ধারে দাঁড়াইয়া রহিলাম। মন্দির মধ্যে একটি শ্বেত প্রস্তরের শিবলিঙ্গ, তাহার সম্মুখে পুজা-নিরতা বিধবাবেশ-ধারিণী রমণী। টমি ঝাঁপাইয়া রমণীর ক্রোড়ে উঠিয়াছে। তাঁহার হস্তের অর্ঘ্য পড়িয়া গিয়াছে, টমির পদাঘাতে পুষ্পপাত্রের পুষ্পরাশি ছড়াইয়া পড়িয়াছে, নৈবেদ্য ভূমিতে গড়াইতেছে। রমণী টমিকে কোলে করিয়া পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় স্থির হইয়া বসিয়া আছেন।

 পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া তিনি ফিরিয়া চাহিলেন। স্তস্তিত হইয়া আমার পানে চাহিয়া রহিলেন। আমার যেন মনে হইল, তাঁহাকে কোথায় দেখিয়াছি, কিন্তু কিছুতেই মনে করিতে পারিতেছি না। দূরে, বহুদূরে তাঁহার মত কাহার অস্পষ্টমূর্ত্তি আমার স্মৃতিপটে ফুটিয়া উঠিতেছে। কে সে রমণী? তাঁহাকে কোথায় দেখিয়াছি? তাঁহাকে দেখিয়া আমার শিরার রক্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে যেন বিজলী থেলিয়া যাইতেছে, কিন্তু কোথায় তাহাকে দেখিয়াছি মনে করিতে পারিতেছি না। এইরূপ মুখশ্রী আর একবার যেন তাহার মত কাহাকেও দেখিয়াছি।

 বাসর সজ্জায় নিশীথ রাত্রিতে উৎসব-কোলাহল-মুখরিত গৃহে চন্দনচর্চ্চিত একখানি মুখের মতন। কিন্তু সে ত নাই, বহুদিন পূর্ব্বে আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। অথচ তাহারই মতন—সে যেন রোগশয্যায়— তখন তাহার দেহ শীর্ণ হইয়া গিয়াছিল—এ অনশনক্লিষ্ট দেবীমূর্ত্তি বিধবার সজ্জায় তাহারই মত দেখিতে। টমি কি তাঁহাকে ভাবিয়াই এখানে আসিয়াছে। না,—এ নয়ন-যুগলে সেই পুরাতনভাব যেন সত্যই প্রদীপ্ত রহিয়াছে। ইনি যেন আমার চির-পরিচিত—কতদিন যেন ইঁহাকে দেখিয়াছি।  রমণী ধীরে ধীরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে?”

 “আপনি”—বলিয়া থামিয়া গেলাম; হঠাৎ আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল, “তুমি—তুমি কে?”

 কণ্ঠস্বর শুনিয়া রমণী মূর্ত্তি কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু কোন উত্তর নাই।

 আমি উন্মাদের মত জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলিলাম, “তুমি—তুমি কি মিনি?”

 রমণীমূর্ত্তি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। টমি তখনও তাঁহার কোলে। আমার পায়ের উপর আসিয়া আছড়াইয়া পড়িয়া তিনি কাঁদিয়া বলিলেন, “ওগো আমি তোমারই সেই মিনি, তোমারই মুখের জন্য আমি—” তিনি আর কিছু বলিতে পারিলেন না। মূর্চ্ছিত হইয়া সেই মন্দির-দ্বারে আমার পদতলে পড়িয়া গেলেন।