বিষয়বস্তুতে চলুন

গুচ্ছ/পরিবর্ত্তন

উইকিসংকলন থেকে

পরিবর্ত্তন।

 “ওমা কি ঘেন্না, কি লজ্জা, এমন তো কখনও দেখিনি! হ'লেই বা সৎ-শাশুড়ী, তাই বলে কি কচি বৌটাকে এমন ক’রে মেরে ফেল্‌তে হয়? আহা! দুধের মেয়ে ওকি কখনও একাদশী কোর্ত্তে পারে! তুই আবার আমাকে শাস্ত্র দেখাতে আসিস্‌, তোর একটু লজ্জা হ’ল না। আমি না তোর মার বয়েসী! শাস্তর। বাচ্‌পোতের মেয়েটা ন’বছর বয়সে রাঁড় হ’ল, হরি বাচ্‌পোত, তখন তার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, সে নিজে হাতে তাকে একাদশীর দিন ভাত খাইয়েছে, তা’ আমি নিজ চক্ষে দেখিছি। আম্বুবতীর তিন দিন আগে থেকে বড় হাঁড়ায় ক’রে ভাত ভিজিয়ে রাখত। মিত্তিররা তা’ না হয় একে বড় লোক, তার কায়েত, তাদের কথা ছেড়েই দিলুম। তুই না মেয়ের মা, পরের মেয়ের সঙ্গে এ রকম ব্যাভার কোর্তে তোর একটু বাধে না গা! তোর মেয়ে কি কখনও রাঁড় হবে না, কখনও একাদশী কোর্ত্তে হবে না? আমি আজকের নই, আমি এখন মরছি নি, আমিই আবার আস্‌বো, দেখে যাবো ধরে এর বিচার করেন কিনা! এই বোশেখ মাসের রদ্দূর, তুই কিন কচি মেয়েটাকে এক ফোঁটা জল না দিয়ে রেখেছি। এর ফল তোকে হাতে হাতে ভূগতে হবে। ধম্মে সইবে না, সইবে না।”

 দম বন্ধ হইবার উপক্রম বামা ঠাকুরঝিকে বাধ্য হইয়া খামিতে হইল। বৈশাখের দ্বিপ্রহরে সূর্য্যের প্রখর উত্তাপে চারিদিক দগ্ধ হইয়া যাইতেছিল। একটি বৃহৎ অট্টালিকার অন্দর মহলে চণ্ডীমণ্ডপের দালানে দাঁড়াইয়া বামা ঠাকুরঝি ভীষণ রণ-রঙ্গের অভিনয় করিতেছিলেন। বামা ঠাকুরঝি বন্দীপুর গ্রামের বধু মাত্রেরই ঠাকুরঝি এবং কন্যা মাত্রে- রই বামা দিদি। বেঁটেখাট গড়ন, পাকা মিসির মত রং, বয়স অনিশ্চিত, যুবতী বলিলেও চলে, অথবা প্রৌঢ়া বলিলেও চলে। ঠাকুরঝি চিরসধবা, পরণে একখানি লাল কস্তা পেড়ে সাড়ী, হাতে দুগাছি অতি প্রাচীন সোনার বালা এবং সীমন্তে সুদীর্ঘ সিন্দুর-লেখা! বামা ঠাকুরঝি সধবা বটে, কিন্তু গ্রামে কেহ কখনও ঠাকুর জামাইকে আসিতে দেখে নাই। গ্রামের বধূরা কখনও ঠাকুর জামাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিতে ভরসা করিত না, যদি কোন প্রগল্‌ভা মেয়ে বাপের বাড়ী আসিয়া বামা দিদিকে ঠাট্টা করিয়া তাহার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করিত, তাহা হইলে বাম তাহাকে বিলক্ষণ দশ কথা শুনাইয়া দিত। কোন্দলে কেহ কখনও বামাকে জিতিতে পারে নাই, সে যেখানে চেঁচাইয়া জিতিতে পারিত না, সেখানে কাঁদিয়া জিতিত। পিতৃ, মাতৃ ভ্রাতৃ, পুত্র-কন্যা-হীনা বন্ধ্যা ব্রাহ্মণকন্যাকে বন্দীপুর গ্রামের সকলেই শমনের ন্যায় ভয় করিত এবং সম্ভব হইলে দূর হইতে দেখিয়া সরিয়া পড়িত।

 এ হেন দিগ্বিজয়ী বামা ঠাকুরঝির সম্মুখে দাঁড়াইয়া হরবল্লভ মুখোপাধ্যায়ের বিধবা পত্নী দারুণ গ্রীয়েও অষ্টমী পূজার জন্য উৎসর্গীকৃত ছাগ শিশুর দ্যায় কাঁপিতেছিলেন।

 বন্দীপুর নদীয়া জেলায় একখানি বিশিষ্ট গ্রাম। গ্রামের মুখোপাধ্যায় বংশ বহুকালের প্রাচীন জমীদার। লোকে বলিত তাঁহারা নবাবী আমলের জমিদার। চারিটি পুত্র রাখিয়া হরবল্লভ মুখোপাধ্যায়ের প্রথমা পত্নী যখন ইহলোক পরিত্যাগ করেন, তখন বাধ্য হইয়া সংসার রক্ষার জন্য মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহ করিতে হইয়াছিল, কারণ হরবল্লভের আপনার বলিতে সংসারে অপর কেহ ছিল না! দেখিয়া শুনিয়া নিজে পছন্দ করিয়া এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের মাতৃহীনা কন্যাকে হরবল্লভ যখন বিবাহ করিয়া লইয়া আসিলেন, তখন তাহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক নহে। গ্রামের লোকে কত কথা বলিল, বৃদ্ধের বলিলেন, হরবল্লভ একটা হা’ঘরের মেয়ে অনিয়াছে, এইবার মুখুয্যেদের অচলা লক্ষ্মী বুঝি চঞ্চলা হইলেন। গ্রাম্য-গেজেটগণ বলিয়া বেড়াইলেন যে নূতন বৌ আসিয়াই ছেলে চারিটার মুখের ভাত কাড়িয়া লইয়া বাড়ী হইতে বিদায় করিয়া দিয়াছে, হরবল্লভ ইহার মধ্যেই ভেড়া হইয়া গিয়াছে! কিন্তু ফলে কাহারও কথা সত্য হইল না, বিমাতার কি এক আশ্চর্য্য গুণে বশীভূত হইয়া মাতৃহীন শিশুচতুষ্টয় বিমাতার প্রতি আকৃষ্ট হইল। মুখুয্যেদের নূতনবধু অঘটন ঘটাইল দেখিয়া গ্রামে যত ঈর্ষান্বিতা পরশ্রীকাতরা রমণী ছিলেন তাঁহারা একেবারে জ্বলিয়া উঠিলেন। পাড়ায় পাড়ায় মজলিস বসিয়া গেল, ঘোরতর তর্কবিতর্কের পর স্থির হইল যে, নূতন বধু নিশ্চয়ই ডাকিনী। যে প্রবল বলে, প্রবল প্রতাপান্বিত হরবল্লভ মুখোপাধ্যায় মেষশাবকে পরিণত হইয়াছেন, তাহার বলে যে মাতৃহীন অনাথ শিশুচতুষ্টর বশীভূত হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্যের কথা কি আছে? স্থির হইয়া গেল, ছেলে চারিটার রক্ষার আর কোনও উপায় নাই! হরবল্লভের নূতন স্ত্রী নীরবে সাধারণ গৃহস্থ বধূর ন্যায় সংসারে মিশিয়া গেল। তাহার ঐশ্বর্য্য, তাহার সুখসম্পদ দেখিয়া যাহারা জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তাহারা তুষের আগুনের ন্যায় ভিতরে ভিতরে পুড়িতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে নূতন বধূ বিবাহিত জীবনের বিশ বৎসর কাটাইয়া দিল, কিন্তু বন্দীপুর গ্রামে তখনও তাহার “নুতন বৌ” নাম ঘুচিল না। হরবল্লভের দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভে দুই তিনটী, সন্তান জন্মিয়াছিল, কিন্তু তাহার মধ্যে একটী কন্যা মাত্র জীবিতা ছিল, পিতা আদর করিয়া তাহার নাম রাখিয়াছিলেন ‘শেফালিকা’। অনুমান পঞ্চাশ বৎসর বয়সে হরবল্লভের মৃত্যু হইয়াছিল, তখন তাঁহার পুত্রচতুষ্টর ও কন্যার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার মৃতুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র হেমচন্দ্র সংসারের ভার লইয়ছিলেন। তিনি ধীর, তীক্ষবুদ্ধি ও শান্তস্বভাব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার একটি বিশেষ দোষ ছিল। কলিকাতায় থাকিয়া পাঠাভ্যাস কালে তিনি সুরাপান করিতে শিখিয়াছিলেন। দেশে ফিরিয়া পিতার সহস্র তিরস্কার ও লাঞ্ছনা সত্ত্বেও তিনি এ অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। সামান্য মাত্র সুরা উদরস্থ হইলে তাঁহার আর জ্ঞান থাকিত না। পিতার মৃত্যুর পরে ছয় মাস কাল হেমচন্দ্র জমিদারীর কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন। এক দিন সন্ধ্যার সময় অত্যধিক সুরাপান হেতু অকস্মাৎ তাঁহার মৃত্যু হয়। একবৎসরের মধ্যে দুইটী শোক পাইয়া হরবল্লভের পত্নী শয্যা গ্রহণ করিলেন। তখন হেমচন্দ্রের পত্নী নয়নমঞ্জরীর বয়ঃক্রম দ্বাবিংশতি বৎসরের কিঞ্চিৎ অধিক হইবে। হরবল্লভের দ্বিতীয় পুত্র পরেশচন্দ্র জন্মাবধি সংসারের প্রতি উদাসীন, তিনি বাল্যকালাবধি সঙ্গীত চর্চ্চায় মনোনিবেশ করিয়াছিলেন, সংসারের বা বিষয়সম্পত্তির ধার ধারিতেন না। তাঁহার ন্যায় সুন্দর, সুপুরুষ, সুকণ্ঠ গায়ক দেশে অত্যন্ত বিরল ছিল। তাঁহার পত্নী নিঃসন্তান বলিয়া মনের দুঃখে কাহারও সহিত মিশিতেন না। তৃতীয় পুত্র নরেশচন্দ্র হরবল্লভ মুখোপাধ্যায়ের পুত্রগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান এবং বিষয়কর্ম্মে পারদর্শী, কিন্তু কুটবুদ্ধির জন্য পিতার প্রিয়পাত্র হইতে পারেন নাই। তিনি ধনীর গৃহে বিবাহ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পত্নী নিরুপমা দেবী পিতার ঐশ্বর্য্যের অহঙ্কারে, এবং শ্বশুরের জীবনকালে দুইটী পুত্রের জননী হইয়া কাহাকেও গ্রাহ্য করিতেন না; তবে শ্বশুর যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন বাধ্য হইয়া স্বামীর বিমাতাকে মানিয়া চলিতেন। হরবল্লভের চতুর্থ পুত্রের নাম যোগেশচন্দ্র, পিতার মৃত্যুর একবৎসর পূর্ব্বে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল। হেমচন্দ্রের মৃত্যুর পর হরবল্লভের পত্নী প্রায় দুই বৎসর কাল সংসারের কার্য্য দেখেন নাই। হেমচন্দ্রের পত্নী তখন সবে বিধবা হইয়াছেন, মধ্যমের পত্নী সন্তান-কামনায় দেবসেবা লইয়া ব্যস্ত থাকিতেন, সংসারের দিকে চাহিয়াও দেখিতেন না। কাজে কাজেই বাধ্য হইয়া সেজ-বৌকে সংসারের ভার লইতে হইল। কর্তৃত্ব বড় মধুর, যাঁহারা একবার ক্ষমতা হাতে পাইয়াছেন, তাঁহারা প্রায়ই তাহা ছাড়িতে পারেন না, বিশেষতঃ একবার গৃহিণী হইয়া পুনরায় ঘোমটার আড়ালে নববধূ সাজিতে পারা যায় না। সেজ-বৌত’ মানুষ বটে, তাহার ত’ রক্ত মাংসের দেহ, সেও পারিল না। হেমচন্দ্রের মৃত্যুর দুইবৎসর পরে শেফালিকা প্রসব করিতে পিত্রালয়ে আসিল, তখন হরবল্লভের পত্নী তাহাকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। ছয় মাসের পুত্র লইয়া কন্যা যখন শ্বশুরালয়ে চলিয়া গেল, তখন কার্য্যাভাবে হরবল্লভের পত্নী সংসারে মনোনিবেশ করিতে গিয়া দেখিলেন যে তাঁহার স্থান অপরে অধিকার করিয়াছে। সেজ-বৌ ছাড়িবার পাত্রী নহেন, তিনি বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি ছাড়িয়া দিবেন না প্রতিজ্ঞা করিলেন; তখন হরবল্লভের পত্নী ভাবিয়া দেখিলেন সংসার ত’ তাঁহার নহে, তিনি স্বামী-পুত্রহীন, স্বামীর মৃত্যুর সহিত সংসারের সকল সম্পর্ক ঘুচিয়া গিয়াছে। পুত্র ও পুত্রবধূগণ তাঁহার নহে, তাঁহার যে আপনার, সে অন্যস্থানে সংসার পাতিয়া বসিয়াছে, তখন তিনি ইহকাল ছাড়িয়া পরকালের কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন। বিধবা বড় বধূকে আগ্‌লাইয়া রাখা ও দেবসেবা করা, তাঁহার জীবনের প্রধান অবলম্বন হইয়া উঠিল। সেজ-বৌ দেখিল যে শাশুড়ী থাকিতে, বড়-বধূ, মেজ-বধূ থাকিতে, তাহার সংসারে কর্ত্রী হইয়া বসা ভাল দেখায় না, তখন সে বড় বধূকে ভাঙ্গাইয়া লইবার জন্য বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে লাগিল।

 একাদশীর দিন প্রাতঃকালে বড়-বধূর মুখে তাম্বুলরাগ দেখিয়া হরবল্লভের পত্নী অত্যন্ত বিস্মিতা হইলেন এবং যৎপরোনাস্তি ভৎসনা করিলেন। বড়-বৌ তখন সেজ-বৌর নিকট বিশেষ ভরসা পাইয়াছে, শাশুড়ীর মুখের উপর কোন কথা বলিল না বটে, কিন্তু সেজ-বৌর ঘরে যাইয়া কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিল। সেজ-বৌও কোন কথা বলিল না বটে, কিন্তু তাহার পর মধ্যাহ্নে রণচণ্ডীরূপে বামা ঠাকুরঝির আবির্ভাব হল।

 “তুই ভেবেছিস্‌ কি যে এর ফল তোকে ভুগ্‌তে হবে না, ঘোর কলি হ’লেও এখনও ধর্ম্ম আছেন, এখনও চন্দর সূর্য্যি উঠছে, এই দুধের মেয়েকে একাদশী করান—তোর কি ভাল হবে ভেবেছিস্—তুই কি ভালোর মাথা খাবিনি!’ যাতনা-ক্লিষ্টা বিধবা আর সহ্য করিতে না পারিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বসিয়া পড়িলেন। এমন সময়ে মেজ-বৌ পূজার ঘর হইতে বাহির হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁগা বামা পিসি, তুমি এত কোরে কাকে বল্‌চো গা?” মেজ-বৌকে দেখিয়াই বামাপিসি রাগে গরগর করিয়া বকিতে বকিতে দ্রুতবেগে সেজ-বৌএর ঘরে প্রবেশ করিলেন।

 মেজ-বৌকে দেখিয়া বামা পিসির পলায়নের একটু বিশেষ কারণ ছিল, বড়-বধূর পিত্রালয়ের দরুণ তাহার সহিত বামা পিসির একটু সম্পর্ক ছিল। একদিন সন্ধ্যার পর বামা পিসি যখন বড়-বধূর ঘর হইতে বাহির হইতেছেন, তখন মেজ-বৌ, তাহাকে, নারায়ণের শীতলের জন্য কলিকাতা হইতে আনীত পঁচিশটি ল্যাংড়া আমের সহিত গ্রেপ্তার করিয়া ফেলিয়াছিল, তদবধি বামা পিসির ন্যায় জাঁহাবাজ্‌ মেয়েও মেজ-বধূকে দেখিয়া শিহরিয়া উঠিত।

 মেজ-বৌ আসিয়া শাশুড়ীর হাত ধরিয়া উঠাইল, দেখিল ঘামে শাশুড়ীর সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গিয়াছে, আর চোখ্‌ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতেছে। হরবল্লভের স্ত্রী মেজ-বৌএর সাহায্যে শয়নকক্ষে যাইয়া শয্যাগ্রহণ করিলেন, মেজ-বৌ অনেক সাধ্যসাধনা করিয়াও কোন কথা জানিতে পারিল না। হতাশ হইয়া যখন ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল, তখন সেজ-বৌএর ঘর হইতে উচ্চহাস্যধ্বনিত উঠিয়া মুখোপাধ্যায়দিগের চক্‌ মিলান দালানে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল। মেজ-বৌ বুঝিল ইহা সেজবৌএর বিজয়-দুন্দুভির নিনাদ।

 সন্ধ্যাকালে মেজ-বৌ বিস্মিত হইয়া দেখিল যে, বামা ঠাকুরঝির ভোজনের জন্য রান্নাঘরে বিরাট আয়োজন হইয়াছে। কোন কথা না বলিয়া মেজ-বৌ ধীরে ধীরে শয়নঘরে প্রবেশ করিয়া অর্গল বন্ধ করিয়া দিল, সংসারে তাহার কোনই অধিকার ছিল না, কারণ তাহার স্বামী তাহার কোন কথায় কর্ণপাত করিতেন না।  “মা, ওমা, ওঠ না মা, তোমার পায়ে পড়ি, ওঠ না মা, বেলা যে এক প্রহর হতে চোল্লো, ওঠ না মা, তুমি না উঠ্‌লে যে ঠাকুর ঘরে যেতে পার্‌ছি না।”

 দ্বাদশীর দিন প্রভাতে সিক্তবস্ত্রে মেজ-বৌ শাশুড়ীর শয়নকক্ষের দ্বারে দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে ডাকিতেছে। ছোট-বধূ পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছে। বৈশাখের বেলা, তখন রৌদ্র বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে, দারুণ উত্তাপে আকাশে সীসার রং ধরিয়াছে। পূজার ঘরের সম্মুখে পুরোহিত আসিয়া আশ্চর্য্য হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। দেখিতেছেন যে, শিবমন্দির ও নারায়ণের গৃহ তখনও পরিস্কৃত হয় নাই। পুরোহিত তাঁহার জীবনে কখনও এরূপ বিশৃঙ্খলা দেখেন নাই। সেজ-বৌ ও বড়-বৌ ব্যস্ত হইয়া সমস্ত অন্দরময় ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে, কিন্তু ঠাকুরঘরের দিকে চাহিয়াও দেখিতেছে না। এমন সময় একখানা বড় গাড়ী আসিয়া অন্দরের দেউড়িতে দাঁড়াইল, কে যেন নামিয়া আসিয়া করুণ বামাকণ্ঠে ডাকিল “মা”। কণ্ঠস্বর শুনিয়া মেজ-বৌ, ছোট-বৌ কে বলিল “ছোট-বৌ, তুই শীগ্‌গির নেমে যা, শিউলি এসেছে, তাকে তোর ঘরে নিয়ে যা, আমি ততক্ষণ মাকে বার করছি।” তাহার পর দরজায় খুব জোরে ধাক্কা দিয়া, জোরে বলিয়া উঠিল “ওমা, শিউলি এসেছে মা, শীগ্‌গির দোর খোল, ওর সাম্‌নে আমাদের মুখ আর পুড়িও না।” রুদ্ধ দ্বার তথাপিও মুক্ত হইল না।

 শেফালিকা ননদ সঙ্গে করিয়া দেবরের বিবাহ উপলক্ষে পিত্রালয়ে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছিল। তাহার পুত্রটি আসিয়া বাড়ীময় মাতামহীকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। মাতামহীকে কোথাও না পাইয়া শয়নকক্ষের দ্বারে গিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিল “দি’মা, ওদি’মা!” মেজ-বৌ তখন অভিমান ভরে বলিয়া উঠিল “মা নসু ডাক্‌ছে।” এমন সময় দেখিতে দেখিতে শেফালিকা উপরে আসিয়া পড়িল। সে মাতার একমাত্র সন্তান, বহুদিন আদর্শনের পর জননীকে দেখিবার জন্য তাহার প্রাণ আকুল হইয়া পড়িয়াছে। ছোট-বৌ তাহাকে নিজে ধরিয়া রাখিতে পারিল না, বরঞ্চ সে ছোট-বৌকে ধরিয়া লইয়া উপরে আসিল। ছোটবৌ তখন তাড়াতাড়ি তাহার হাত ছাড়াইয়া কুটুম্বিনীর অভ্যর্থনার জন্য নীচে চলিয়া গেল।

 শেফালিকা আসিয়া দেখিল যে মাতার শয়নকক্ষের দ্বার রুদ্ধ, দ্বারের পার্শ্বে মেজ-বৌ অবনত মস্তকে দাঁড়াইয়া আছে, আর নসু তাহার ছোট ছোট হাত দুখানি দিয়া দুয়ারে ধাক্কা মারিতেছে ও ডাকিতেছে “দি’মা, ও দিমা।” শেফালিকা থম্‌কিয়া দাঁড়াইল, তাহার পর আকুলকণ্ঠে ডাকিল “মা।” ভগ্নহৃদয়ের কোন ছিন্নতন্ত্রীতে সস্তানের করুণ আহ্বান আঘাত করিয়া কি এক অভিনব ভাবের সৃষ্টি করে, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারিয়াছে! হরবল্লভের পত্নী আর থাকিতে পারিলেন না, এইবার রুদ্ধদ্বার মুক্ত হইল। কন্যাকে দেখিয়া মনের বাধ ভাঙ্গিয়া গেল, মাতাপুত্রী দৃঢ় আলিঙ্গন-বদ্ধ হইয়া নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিল, আর মেজ-বৌ কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় দ্বারে দাঁড়াইয়া রহিল।

 নসু দেখিল তাহারই বিলক্ষণ লোক্‌সান্‌। সে ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, তখন মেজ-বৌ তাহাকে উঠাইয়া লইয়া তাহার মাতামহীর ক্রোড়ে দিল, নসু কাঁদিয়া জিতিল এবং সকলের ক্রন্দন থামাইল। তখন শিউলি মেজ-বৌকে বসাইয় সে যতদূর জানিত তাহ শুনিল, তাহার পরে হরবল্লভের পত্নী অশ্রজলের সঙ্গে মিশাইয় অবশিষ্টটুকু বলিয়া দিলেন।

 ইত্যবসরে ছোট-বৌ শেফালিকার ননদকে লইয়া সেজ-বৌ এর ঘরে, যাইয়া দেখিল যে সে মুড়ি দিয়া বিছানায় গুইয়া আছে, আর বড়-বৌ তাহার মাথা টিপিতেছে। ব্যাপার দেখিয়া ছোট-বৌ স্তম্ভিত হইয়া গেল, কারণ অর্দ্ধদও পূর্ব্বে সেজ-বৌ এর চীৎকারে বাড়ীতে কাক-কোকিল বসিতে পারিতেছিল না। সেজ-বৌ বাধ্য হইয়া শেফালিকার ননদকে অভ্যর্থনা করিল। ননদ শেফালিকাকে অনেকক্ষণ না দেখিয়া চঞ্চল হইতেছিল, কিন্তু ছোটবধূ তাহাকে সেখানে রাখিয়া পলায়ন করিয়াছিল।

 মাতার শয়নকক্ষে শেফালিকা মাতাকে বলিতেছিল “মা, তবে আর কিসের জন্য থাকা, তুমি আমার সঙ্গে চল।” মাতা উত্তর করিলেন “তাই যাব মা, স্বামীর সংসার ব’লে তাই এতদিন পড়েছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি আমাকে না তাড়ালে এরা তিষ্ঠিতে পারবে না। আমি স্বামীপুত্রহীন, এদের সংসারে আর আমার কোন প্রয়োজন নাই।” মেজ-বৌ স্থির হইয়া বসিয়াছিল, মাঝে মাঝে চম্‌কিয়া উঠিতেছিল, সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল “মা তুমি কি সত্যসত্যই আমাদের ছেড়ে যাবে?” তাহার কথা শুনিয়া হরবল্লভের পত্নীর চক্ষু আবার জলে ভরিয়া আসিল, “আমি না গেলে তোদের সংসারে শান্তি আসবে না মা। তাঁর সঙ্গে আমার দিনও ফুরাইয়াছে, তোমাদের হাতে ক’রে মানুষ করিছি, এখন তোমরা নিজের সংসার বুঝে সুঝে নাও।” মেজ-বৌ শাশুড়ীর পা জড়াইয়া কাঁদিয়া পড়িল, বলিল “তুমি যেও না মা, তোমায় ছেড়ে আমি থাকতে পারব না, আমার যে আর কেউ নেই মা!” শ্বশ্রু বন্ধ্যা পুত্রবধূকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।

 শেফালিকা ধীরে ধীরে উঠিয়া সেজ-বৌ এর ঘরে গেল, তাহাকে দেখিয়া কেহ কথা কহিল না, তাহার ইসারায় তাহার ননদ উঠিয়া আসিল। পথে ননন্দা ও ভ্রাতৃবধূতে যে কথোপকথন হইল, তাহা শুনিয়া ননন্দার কর্ণমূল পর্য্যন্ত আরক্ত হইয়া গেল। তখন উভয়ে উপরে যাইয়া হরবল্লভের পত্নীর কক্ষে প্রবেশ করিলেন, শেফালিকা ও তাহার ননদের নির্ব্বন্ধতিশয়ে হরবল্লভের পত্নী তখনই বন্দীপুর ত্যাগ করিয়া যাইতে প্রস্তুত হইলেন। ছোট-বৌ ঠাকুর ঘরের কাজ সারিয়া শাশুড়ীর নিকট আসিয়া বসিল। পরেশচন্দ্র ও যোগেশচন্দ্র আহার করিতে আসিয়া বিস্মিত হইয়া দেখিলেন যে, আহারের সময়ে মাতা তাঁহাদিগের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন না, দুই ভাই নীরবে আহার করিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন। দ্বিপ্রহরের পর নরেশচন্দ্র আসিয়া শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন, আহারান্তে পুনরায় বাহিরে চলিয়া গেলেন, কি হইয়াছে তাহা কেহই জানিল না। হরবল্লভের পত্নী যখন চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছেন তখন মেজ-বৌ ও ছোট-বউ কাঁদিয়া কহিল “মা তুমি যদি যাবে ত দ্বাদশীর দিন নিরম্বু উপবাস করিয়া যেও না, আমাদিগের অকল্যাণ কোরো না।” হরবল্লভের পত্নী কি ভাবিয়া আহার করিতে সম্মতা হইলেন। তৃতীয় প্রহরে সকলের আহার সমাপ্ত হইল।

 শেফালিকার সহিত মা চলিয়া যাইতেছেন, মেজ-বৌ এই সংবাদ স্বামী ও দেবরগণের নিকট পাঠাইয়া দিল। সংবাদ আসিল, মেজ-বাবু ভিন্নগ্রামে যাত্রা শুনিতে গিয়াছেন, ছোট-বাবু মাছ ধরিতে গিয়াছেন, সেজবাবু বলিয়া পাঠাইয়াছেন “শিউলির মা যদি চলিয়া যান ত’ আমি কি তাঁহাকে বঁধিয়া রাখতে পারিব?” লজ্জায় ঘৃণায় মেজ-বৌএর মুখ লাল হইয়া গেল। হরপ্পভের পত্নী স্বামীর শয়নকক্ষে ও ঠাকুরঘরে প্রণাম করিয়া ধীরপদে গাড়ীতে উঠিলেন, শেফালিকা তাহার পুত্র ও ননদ লইয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ উঠিল, মেজ-বৌ ও ছোট-বৌ কাঁদিতে কাঁদিতে গাড়ীতে তুলিয়া দিতে আসিল। তখন সেজ-বৌ এর ঘরে মস্ত তাসের আড্ডা বসিয়াছে, হাসির ফোয়ারা ছুটিয়াছে। যখন চোখ্‌ মুছিতে মুছিতে মেজবৌ ও ছোট-বৌ অন্দরে প্রবেশ করিল তখন বামা ঠাকুরঝি উঠানে পানের পিক্‌ ফেলিতে আসিয়াছিল, তিনি তাঁহাদিগকে দেখিয়া একগাল হাসিয়া বলিলেন “বলি তোদের আবার হলো কি, ‘সৎ-শাশুড়ী বিদেয় হলো, ওতো ফোড়া গ’ল্‌ল্‌, তার জন্যে আবার চোখে নোনা-পানি কেন?”

 শরতের শেষ বড়ই মধুর, বড়ই সুন্দর। এই সময়ে বৈদ্যনাথ মধুপুর অঞ্চলে অনেক বাঙ্গালীর সমাগম হইয়া থাকে। বৈদ্যনাথে ও মধুপুরে একটি আশ্চর্য্য জিনিষ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহা বাঙ্গালী রমণীর স্বাধীনতা। কোন কোন শৈলাবাসে বঙ্গদেশীয় মহিলাগণ কিছু কিছু স্বাধীনতা পাইয়া থাকেন বটে, কিন্তু বৈদ্যনাথ বা মধুপুরের নিয়মের সহিত তাহার তুলনাই হইতে পারে না। এই দুই স্থানে আসিয়া বাঙ্গলা দেশের অবরোধ প্রথা যেন উঠিয়া যায়, বরঞ্চ পুরুষদিগকে সস্কুচিত হইয়া পথ চলিতে হয়। দাড়োয়া নদীর তীরে মহিলাদিগের বেড়াইবার অতি রমণীয় স্থান। অপরাহ্ন হইয়া আসিয়াছে এমন সময়ে একটি বর্ষীয়সী বিধবা মহিলা নদীতীরে দাঁড়াইয়া একটি বালককে ডাকিতেছেন। বালক কোনমতেই উঠবে না, সে কেবল জল ঘাঁটিতেছে আর অপরাপর বালকবালিকাগণের সহিত উল্লাসে বালি ছড়াইতেছে। তৃণ-শয্যায় বসিয়া কতকগুলি যুবতী কথাবার্ত্তা কহিতেছিলেন। বালক কোনমতেই তাঁহার কথা শুনিল না দেখিয়া, বৃদ্ধা নিরুপায় হইয়া তাহাদিগের মধ্যে একজনকে ডাকিয়া কহিলেন “ও শিউলি, দেখ্‌না মা, নসু আমার কথা শুনে না, কেবল জল ঘাঁট্‌ছে।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও বালকের মাতা উঠিয়া আসিল, মাতার কণ্ঠস্বর শুনিবামাত্র বালক খেলা ছাড়িয়া আসিয়া মাতামহীর ক্রোড়ে আশ্রয় লইল।

 এমন সময়ে একখানি বড় জুড়িগাড়ী আসিয়া দাড়োয়া-তীরে দাঁড়াইল। দুইটি সুসজ্জিতা যুবতী ল্যাণ্ডো হইতে অবতরণ করিলেন। বৃদ্ধা একমনে তাহাদিগকে দেখিতেছিলেন। তাঁহার মনে হইতেছিল যে, তাহারা যেন তাঁহার চিরপরিচিত, অথচ ভরসা করিয়া তাহাদিগের সহিত কথা কহিতে পারিতেছিলেন না। নবাগতাদিগের মধ্যে একজনকে দেখিলে হিন্দুরমণী বলিয়া বোধ হয়, কারণ তাহার সীমস্তে সিন্দুর-রেখা এবং প্রকোষ্ঠে সোণার ‘নোয়া’ দেখা যাইতেছিল। দ্বিতীয়া উভয়ের মধ্যে অধিক সুন্দরী, যে রূপে নয়ন ঝল্‌সিয়া যায়, তাঁহার সৌন্দর্য্য সেই জাতীয়। তাঁহাকে দেখিলে বোধ হয় যে তিনি ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজভুক্ত, মাথায় এলবার্ট সিঁথি, প্রকোষ্ঠে হীরকমণ্ডিত ব্রেস্‌লেট, কোমল চরণদ্বয় গ্লাসি কিডের হাইহিল বুটের মধ্যে বন্দী। পশ্চাৎ হইতে কন্যা ডাকিল “মা” বৃদ্ধার চমক ভাঙ্গিল, তিনি উত্তর দিলেন “যাই”। কার্সটেয়ার্স টাউনের পথে ফিরিতে মাতা কণ্ঠাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “হ্যাঁরে শিউলি, বিবি দুটি দেখিতে বড়-বৌ ও সেজ-বৌএর মত না?” কন্যা উত্তর করিল ‘বড়-বৌ আর সেজ-বৌই বটে, আমি অনেকক্ষণ চিনেছি, তোমার মনে কষ্ট হবে বলে বলিনি।” বৃদ্ধা ললাটে করাঘাত করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, বলিলেন “ওরে আমার হেমের বৌএর বরাতে এই ছিল?”

 হরবল্লভের পত্নী অনেকদিন কাশীবাস করিয়াছেন, বৎসরান্তে কন্যা, জামাতা ও দৌহিত্র তাঁহাকে দেখিতে আসে। বৃদ্ধা প্রভাতের কার্য্য শেষ করিয়া রন্ধনের উদ্যোগ করিতেছেন, কন্যা নিকটে বসিয়া আছেন; মাতা বলিতেছেন “দ্যাখ্‌ শিউলি, এখন আর চোখে ভাল দেখতে পাই না, কোনদিন রাঁধতে রাঁধতে পুড়ে মরব, তুই জামাইকে বলে একটি ভদ্রবংশের ব্রাহ্মণের মেয়ে ঠিক করে দিতে পারিস্‌?” কন্যা স্বামীকে বলিয়া মাতার জন্য পাচিকা ঠিক করিল, যথাসময়ে পাচিকা, রন্ধন করিতে আসিল। পাচিকার প্রথম যৌবন অতীত হইয়াছে, দেখিলে বোধ হয় এককালে তাহার রূপ ছিল, কিন্তু সমস্তই যেন জ্বলিয়া গিয়াছে, অগ্নি নির্ব্বাপিত হইয়াছে, অঙ্গারমাত্র অবশিষ্ট আছে। মাতাপুত্রী জানালায় বসিয়া জনস্রোত দেখিতেছিলেন, পাচিকা রন্ধন করিতে করিতে সতৃষ্ণ নয়নে তাঁহাদিগকে দেখিতেছিলেন। কন্যা বলিতেছে “মা বামুন ঠাক্‌রুণকে যেন কোথায় দেখিয়াছি।” মাতা উত্তর করিলেন “আমারও যেন তাই মনে হয় মা, কিন্তু ভরসা করে কিছু ব’ল্‌তে পারছি না, জীবনে কত লোকই দেখলুম, কত লোকই এলো গেল, বিশ্বেশ্বর কেবল আমায় ভুলে রয়েছেন, কবে যে দয়া কর্ব্বেন তা জানি না।” শেফালিকার সন্দেহ দূর হইল না, সে উঠিয়া গিয়া পাচিকাকে ডাকিয়া আনিল। পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় সে আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিল না, কাঁদিয়া বৃদ্ধার চরণতলে লুটাইয়া পড়িয়া বলিল “মা আমি তোমারই বড় বৌ, মুখ পোড়াইয়া কাশীবাস করিতে আসিয়াছি, আমাকে চরণে ঠাঁই দেও।” মাতা ও পুত্রী পতিতার অশ্রুজলের সহিত অশ্রুধারা মিশাইয় তাহাকে বুকে টানিয়া লইলেন!

 * * * * * *

 উষাকাল হইতে বারাণসীর প্রধান প্রধান মন্দিরের পথে শত শত অভাগিনী রমণী ভিক্ষার জন্য বস্ত্রাঞ্চল বিছাইয়া বসিয়া থাকে। অগ্রহায়ণ মাস সবে আরম্ভ হইয়াছে, প্রভাতে বেশ শীত অনুভূত হয়। কেদার-ঘাটের পথে দাঁড়াইয়া একটি বাঙ্গালী রমণী চীৎকার করিয়া যাত্রীদিগকে উত্যক্ত করিতেছে “ওগো লক্ষ্মী মা, দুটী ভিক্ষে দাও মা, আমার কেউ নাই মা।” কমণ্ডলু ও পুষ্পপাত্র হাতে লইয়া জনৈক বর্ষীয়সী বিধবা কেদার দর্শনে যাইতেছিলেন, তাঁহার পট্টবস্ত্রের অঞ্চল ধরিয়া একটি দ্বাদশবর্ষীয় গৌরবর্ণ বালক তাঁহার অনুগমন করিতেছিল। বৃদ্ধাকে দেখিয়া রমণী আরও চীৎকার করিতে লাগিল। বৃদ্ধা তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া চমকিয়া দাঁড়াইলেন, দয়ার্দ্রচিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার নাম কি মা, বাড়ী কোথায়?” রমণী উত্তর করিল, “মাগো। আমার নাম বাম, আমার বাড়ী ন’দে জেলা, বন্দীপুর, আমার সবই ছিল মা, বরাতের দোষে এমন হ’য়েছে।” বৃদ্ধার পশ্চাতে নম্ন আসিতেছিল, বৃদ্ধ তাহাকে বলিলেন “নসু একে একটা টাকা দেও দাদা।” বালক ভিখারিণীকে একটি টাকা দিল, বৃদ্ধার নয়নদ্বয় হইতে দুইটি উষ্ণ বারিবিন্দু পতিত হইল।