গুচ্ছ/বিজয়া

উইকিসংকলন থেকে

বিজয়া

 ইচ্ছামতীর তীরে একটী ক্ষুদ্র কুটিরে জয়চাঁদ বাদ করিত। আম ও কাঁঠাল গাছের ছায়ায় তাহার ঠাকুরদাদা এই ঘরখানি বাঁধিয়াছিল। নদীতীরে বাস করিলে সময় বুধিয়া জাল বাহিতে বাহির হওয়া যায়, নৌকাখনির উপরে সর্ব্বদা দৃষ্টি থাকে—এইরূপ নানা রকম সুবিধা বুঝিয়া জয়টাদের পূর্ব্বপুরুষ গ্রাম হইতে দূরে ঘর বাধিয়াছিল। দ্বিপ্রহরে আম ও কাঁঠাল গাছের উপরে বৃহৎ জাল শুকাইতে দেখিয়া সকলেই বুঝিতে পারিত যে ইহা মৎস্যজীবীর গৃহ। এই গৃহে বিধবা কন্যাকে লইয়া জয়চাঁদ একা বাস করিত।

 সে তখন বৃদ্ধ হইয়াছে,কিন্তু ষাট বৎসর বয়সে তাহার মুদীর্ঘ সবল দেহ দেখিলে সকলেই বিস্মিত হইয়া যাইত। যৌবনে সে নৌকা লইয়া দেশে বিদেশে যাইত, রেলপথে দেশ ছাইয়া যাইবার পূর্ব্বে সে কতবার যাত্রী লইয়া গঙ্গা-সাগরে গিয়াছে, দুস্তর ঢোল-সমুদ্র পার হইয়া সাগর-সঙ্গমে উপস্থিত হইয়াছে। দশ বৎসর পূর্ব্বে মহামারিতে স্ত্রী-পুত্র হারাইয়া জয়চাঁদের স্বভাব পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছিল, তাহার পর সে প্রায়ই বিদেশে যাইত ন-বৎসরে দুই একবার মাত্র গ্রামে প্রবেশ করিত। সে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া মাছ ধরিত, প্রভাতে তাহার কন্যা গ্রামে গিয়া তাহা বিক্রয় করিয়া আসিত। বৃদ্ধ জাল বুনিয়া এবং ঘুমাইয়া সমস্ত দিন কাটাইয়া দিত। পুরুষোত্তম বা গঙ্গাসাগর যাত্রার নাম হইলে গ্রামের বৃদ্ধবৃদ্ধাগণ এখনও জয়চাঁদের নাম স্মরণ করেন, ঝড়তুফানে তাহার অসমসাহসিকতার কথা বর্ণনা করেন। যাহারা রেলপথে বা ষ্টিমারে তীর্থে যাইত, তাহারা আশ্চর্য্য হইয়া সেকালের পথের বিপদের কথা শুনিত।

 স্বজাতির রীতি অনুসারে জয়চাঁদ সাতবৎসর বয়সের সময়ই কন্যার বিবাহ দিয়াছিল। তাহার জামাতার বয়স তখন পঞ্চাশ বৎসর। কৈশোর অতিক্রম করিবার পূর্ব্বে বিজয়ী বিধবা হইয়াছিল, বিবাহের পরে তাহাকে কখনও শ্বশুর গৃহে যাইতে হয় নাই, সে আজীবন পিতৃগৃহে বাস করিয়া ছিল। বিজয়ী সুন্দরী; কৈবর্ত্তের গৃহে এত রূপ কেহ কখনও দেখে নাই, জয়চাঁদের গৃহে সত্য সত্যই গোময়ে প্রফুল্ল কমল প্রস্ফুটিত হইয়াছিল। সে যখন মাছের ডালা মাথায় করিয়া গ্রামের মধ্য দিয়া যাইত, গ্রাম্য যুবকগণ স্তব্ধ হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া থাকিত, কিন্তু তাহার গম্ভীর স্বভাবের জন্য এবং পিতার ভয়ে কেহ কখনও তাহাকে কোন অন্যায় কথা বলিতে সাহসী হয় নাই। কেহ কেহ বলিত এতরূপ কৈবর্তের গৃহে সম্ভব নহে, জয়চাঁদ বোধ হয় বিদেশে মেয়েটিকে কুড়াইয়া পাইয়াছিল।

 গ্রামে বড়ই ধূম, শারদা পূজার দিন উপস্থিত। যে সকল গ্রামে অনেকগুলি প্রতিমা হইয়া থাকে, সে সকল গ্রামের লোক পূজার ধুমধাম ভাল করিয়া বুঝিতে পারে না। কিন্তু যে সকল গ্রামে দুই এক খানির বেশী প্রতিমা আসে না, তাহারাই বাঙ্গালীর জাতীয় উৎসবের প্রকৃত আমোদ উপভোগ করিয়া থাকে। লাভপুর গ্রামে একখানি মাত্র পূজা হইয়া থাকে, গ্রামের জমিদার-বংশ ব্যতীত আর কাহারও দুর্গাপূজা করিবার মত অবস্থা নহে। সেই জন্যই গ্রামশুদ্ধ লোক চৌধুরী বাড়ীর পূজায় মাতিয়া যায়। পূজার কয়দিন দিনের বেলায় চৌধুরী বাড়ী ছাড়া অন্য কোন অংশে প্রায় লোক দেখা যায় না।

 কয়দিন বৃষ্টি না হওয়ায় বড়ই গরম পড়িয়াছে, বৃদ্ধ জয়চাঁদ আমগাছের ছায়ায় বসিয়া একখানা বেড়জাল বুনিতেছে, বিজয়া ঘরের দাওয়ায় আঁচল পাতিয়া শুইয়া আছে। তৃতীয় প্রহরে রৌদ্রের তেজ বাড়িয়া উঠিতেছে, বুড়া জাল বুনিতেছে, আর মধ্যে মধ্যে আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিতেছে। মাঝে মাঝে নীল আকাশে ছোট ছোট সাদা মেঘ দেখা যাইতেছে, কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই তাহারা ভাসিয়া চলিয়া যাইতেছে। দূরে গ্রাম হইতে নহবতের শব্দ আসিতেছে, সময়ে সময়ে পূজা-বাড়ীর ঢাকঢোলের বাজনার শব্দ শোনা যাইতেছে। এমন সময়ে বাহিরে কে ডাকিল—“জয়চাঁদ বাড়ী আছ?” বুড়া ব্যস্ত হইয়া সূতা ফেলিয়া উঠিল, বাহিরে আসিয়া দেখিল একটি সুন্দর গৌরবর্ণ যুবক দাঁড়াইয়া আছে। বুড়া দেখিয়া ভূমিষ্ট হইয়া প্রণাম করিল। যুবকের বয়স আন্দাজ সতর আঠার, বেশভূষা পল্লীগ্রামবাসীর ন্যায় নহে; দেখিলে কলিকাতার লোক বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু যুবক সেই গ্রামের অধিবাসী, জমিদার বদনচন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র পুত্র। তিনি কলিকাতায় থাকিয়া পড়াশুনা করেন, সেইজন্য হাবভাব কলিকাতা-বাসীর ন্যায় হইয়া গিয়াছে। বুড়া প্রণাম করিয়া হাত যোড় করিয়া—বলিল “হুকুম!” যুবক হাসিয়া বলিল,— “জয়চাঁদ, বিজয়ার দিন একখানা বাচের নৌকা চাই; কলিকাতা হইতে আমার কয়েকজন বন্ধু আসিয়াছেন, তাঁহাদের বাচ-খেলা দেখাইতে হইবে। বুড়া হাসিয়া উত্তর করিল, “তাহার জন্য আর চিন্তা কি বাবু? আমি কালই ছিপ্‌ ঠিক্‌ করিয়া আসিব।”

 যুবক। আজ গেলে হোত না?

 বৃদ্ধ। না বাবু, আজকের দিনটা মাপ করুন, কাল সকালে আপনার বাড়ী দুই মণ মাছ দিতে হইবে। মাছ কম হইলে কর্ত্তাবাবু পিঠের চামড়া রাখিবেন না।

 যুবক। তবে তুমি কালই যেও।

 বৃদ্ধ। ছোট বাবু, যদি এতদিন বাদে এলেন তো আমার ভিটেয় একবার পায়ের ধূলা দেবেন না?

 যুবক ফিরিতেছিল, বৃদ্ধের অনুরোধে তাহার বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল। বুড়া বাহির হইতে ডাকিয়া বলিল, “বিজয়া, ছোটবাবু আসিয়াছেন একখানা চৌকি বাহির করিয়া দে।” বিজয়া শুইয়াছিল। পিতার কথা শুনিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘরের ভিতর গেল। একখান ছোট জলচৌকি বাহির করিয়া উঠানে রাখিল এবং ভূমিষ্ঠ হইয়া যুবককে প্রণাম করিল। যুবক বসিল, জয়চাঁদও বসিল। এমন সময় বাহির হইতে বামাকণ্ঠস্বরে কে বলিয়া উঠিল,—“কিশোরী, অন্ধকারে কোথা গেলে বাবা। আমাদের যে জোঁকে খেয়ে ফেল্লে।” কিশোরী হাসিয়া উঠিল, বলিল,—“জয়চাঁদ, আমি আজ আসি। আমার বন্ধুরা সব কলিকাতার লোক তাহারা বেশিক্ষণ ইছামতির ধারে বেড়াইলে মরিয়া যাইবে। বুড়া হাসিয়া বলিল,—“আহা, বাবুরা সুখী মানুষ, কষ্ট করা তো অভ্যাস নাই। তাঁরাও একটু বসুন না কেন? বিজয়া, আরও দুইখানা চৌকি বাহির করিয়া দে।” কিশোরী তখন বাড়ীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া চীৎকার করিয়া ডাকিল,—“ওহে সুরেন বাবু, একবার এই দিকে এস। নিকট হইতে উত্তর আসিল,—“এই দিক্‌টা কোনদিক্‌ বাবা, তা ত’ বুঝতে পাচ্ছি না, দিগ্বিদিক্‌ জ্ঞান যে শেয়ালদা ষ্টেসনে রেখে এসেছি।” জয়চাঁদ বলিল,— “আমি বাবুদের নিয়ে আস্‌চি।” তাহার পরক্ষণেই বুড়ার পিছনেই দুইটি অপূর্ব্ব মূর্ত্তির আবির্ভাব হইল। কলিকাতাবাসিগণ সেইরূপ শত শত মূর্ত্তি নিত্য দেখিয়া থাকেন, কিন্তু পল্লীগ্রামে তাঁহাদিগের দর্শন দুর্ল্লভ। তাঁহাদিগের পরণে অত্যন্ত মিহি দেশী ধুতি, তাহার কোঁচা কাদায় লুটাইয়া অপরূপ আকার ধারণ করিয়াছে, গায়ে মিহি আদ্ধির পাঞ্জাবী, তাহার ভিতর হইতে গেঞ্জির গোলাপী রং ফুটিয়া বাহির হইতেছে, পায়ে রেশমের রঙ্গিন মোজা ও কাল বার্ণিস করা পম্‌প্‌সু, তাহাতে এত কাদা জমিয়াছে যে চিনিতে পারা কঠিন। অঙ্গে জরির পাড় ঢাকাই উড়ানী—অধিকাংশ পিছনদিক হইতে কাদায় লুটাইতেছে; তাহ ছাড়া প্রত্যেকের হাতে সৌখীন ছড়ি ও অঙ্গে এসেন্স-সৌরভ। এহেন মূর্ত্তি পল্লীগ্রামে বড়ই দুর্লভ, সেই জন্যই “কলিকাতার বাবু” দেখিতে একপাল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অস্থিচর্ম্মসার লম্বোদর বালক তাহাদিগের সঙ্গ লইয়াছে। বাবুদ্বয় গৃছে প্রবেশ করিয়াই নাকে রুমাল দিলেন ও বলিলেন,—“কিসের গন্ধ হে?” জয়চাঁদ অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বলিল,—“বাবু আমরা জাতিতে জেলে, গাছের উপরে জাল শুকাইতে দিয়াছি, তাহারই গন্ধ বাহির হইয়াছে।” দ্বিতীয় বাবুটি লোলুপ নেত্রে বিজয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন। বিজয়ী নূতন লোক দেখিয়া সরিয়া গিয়াছিল বটে,কিন্তু পল্পীসুলভ চপলতাবশতঃ ঘোমটার ভিতর হইতে তাহাদিগকে দেখিতেছিল। সুরেন্দ্রবাবু এতক্ষণ তাহাকে দেখিতে পান নাই, দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন,—“উঃ!” তাঁহার সঙ্গী মৃদুস্বরে বলিলেন,—“গোবরে পদ্মফুল।” জয়চাঁদ তাহা শুনিতে পাইল না, কিশোরীর মুখ লাল হইয়া উঠিল, সে বলিল—“ওহে, তোমাদের এখানে থাকিয়া কাজ নাই, এখনই জালের গন্ধে মাথা ধরিবে।” সকলেই উঠিলেন। তাহাদিগের চাহনির ভাব দেখিয়া বিজয়া পূর্ব্বেই ঘরের ভিতরে পলায়ন করিয়াছিল।

আজ নবমী। জয়চাঁদ সন্ধ্যার পূর্ব্বেই মাছ ধরিতে গিয়াছে। গ্রামের অনতিদূরে চারি পাঁচটি নদী একত্র মিশিয়া একটি প্রকাণ্ড হ্রদে পরিণত হইয়াছে; গ্রাম্যভাষায় ইহার নাম “বাঁওড়”। এখন নদী-নালা শুকাইয়া গিয়াছে, বর্ষাকালেও পর্য্যাপ্ত পরিমাণ জল হয় না, মৎস্যকুল ত নির্ব্বংশ হইতে চলিয়াছে। সেই জন্যই অধিক মৎস্য প্রয়োজন হইলে ধীবরের “বাঁওড়ে” জাল ফেলিতে আসে। জয়চাঁদ জমিদার-বাড়ী মৎস্য আনিবার জন্য সন্ধ্যার পূর্ব্বেই নৌকা লইয়া বাহির হইয়া গেল, যাইবার সময় বিজয়াকে বলিয়া গেল,—“ওরে আমি বাঁওড়ে যাচ্ছি, ভোরের বেলায় ফিরিব।”

 শরতের নির্ম্মল জ্যোৎস্না যখন রজতধারায় চারিদিক শুভ্র করিয়া তুলিল, তখন গ্রামের কোলাহল নিবৃত্তি হইয়াছে। সন্ধ্যার পূর্ব্বে সন্ধিপূজা শেষ হইয়া গিয়াছে, পূজাবাড়ী ছাড়িয়া দলে দলে নরনারী গৃহে ফিরিয়াছে। কাজের জন্য বিজয়া সেদিন আর ঠাকুর দেখিতে পারে নাই। ভাবিয়াছিল, সন্ধ্যার পরে ভিড় কমিলে যাইবে। কিন্তু যাই যাই করিতে করিতে রাত্রি অধিক হইয়া গেল। প্রথম প্রহরের শেষে একটু বাতাস উঠিল, কয়দিন হইতে তাহার মন খারাপ হইয়াছিল, হাওয়া দেখিয়া ভয় পাইল। রন্ধন কার্য্য শেষ করিয়া দাওয়ায় বসিয়া অন্যমনস্ক হইয়া পিতার কথা ভাবিতে লাগিল। “বাঁওড়” সমুদ্র বিশেষ, একপার হইতে অপরপারে পাড়ি জমাইতে হইলে এক প্রহর কাটিয়া যায়, ঝড়ের সময়ে “বাওড়ে” নৌকার ভারি বিপদ। তাহার বৃদ্ধ পিতা ক্ষুদ্র নৌকা লইয়া এক “বাঁওড়ে” গিয়াছে, ভালয় ভালয় ফিরিলে সে পাঁচ পয়সার হরির লুট দিবে, ঠাকুরের নিকট বার বার এই কামনা করিতেছিল।

 যেখানে ঘরের ছায়া পড়িয়া অন্ধকার হইয়াছিল, সেইখানে একটা কুকুর ডাকিয়া উঠিল, বিজয়া তাহা লক্ষ্য করিল না, সে তখন আপনার ভাবনা লইয়াই ব্যস্ত ছিল। নিঃশব্দে দুইজন লোক দাওয়ার উপরে উঠিল; বিজয়া তাহাও দেখিতে পাইল না, সে তখন একমনে পিতার উদ্ধারের জন্য নায়ায়ণকে ডাকিতেছিল। পশ্চিমে একখানা ঘন কাল মেঘ জ্যোৎস্নার আলোকে আরও কালো দেখাইতেছিল, সে তাহা দেখিয়া ভয়ে অবসন্ন হইয়া পড়িতেছিল। লোক দুইটি পা টিপিয়া টিপিয়া তাহার কাছে সরিয়া আসিল, বিজয়া তাহা জানিতে পারিল না। একজন তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল, দ্বিতীয় ব্যক্তি কাপড় দিয়া তাহার মুখ ও হাত পা বাঁধিয়া ফেলিল, বিজয়া চীৎকার করিবারও অবসর পাইল না। চীৎকার করিলেও কোন ফল হইত না, তাহাদিগের বাড়ীর নিকটে জনমানবের বসতি ছিল না, গ্রাম সেখান হইতে অনেক দূরে। লোক দুইটি তাহাকে কাঁধে করিয়া বাহির হইল।

 মেঘে তখন আকাশ ছাইয়া গিয়াছিল, চাঁদ ঢাকিয়া গিয়াছিল, সুতরাং জ্যোৎস্নাও নিবিয়া গিয়াছিল। তথাপি তাহারা বিজয়াকে লইয়া পথ ছাড়িয়া বন পথে প্রবেশ করিল এবং আম ও কাঁঠাল গাছের ছায়ায় ছায়ায় গ্রামের বিপরীত দিকে চলিয়া গেল।

 হ্রদের প্রশান্ত বক্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচিমালা কৌমুদী লইয়া খেলা করিতেছিল, তখনও মেঘ দেখা দেয় নাই। ডিঙ্গিতে বসিয়া জয়চাঁদ একমনে তাহাই ভাবিতে ছিল, আর মাঝে মাঝে দাঁড় বাহিয়া মৃদু গতিতে নৌকা চালাইতেছিল। পশ্চিমে ধীরে ধীরে যে মেঘখান উঠিতেছিল, তাহা সে লক্ষ্য করে নাই। বাতাস উঠিতে তাহার চৈতন্য হইল। অনেক কষ্টে প্রায় পঞ্চাশ টাকার সূতা খরচ করিয়া জয়চাঁদ একখানি বেড়জাল বুনিয়াছিল, আজ সে সেইখানা লইয়া আসিয়াছে। বেড়জাল লইয়া মাছধরা একজনের দুঃসাধ্য, কিন্তু তাহার জালখানা ছোট বলিয়া এবং লোকেরও অত্যন্ত অভাব বলিয়া সে একাই জাল লইয়া আসিয়াছিল।

 বাতাস কমিল না, বরং উত্তরোত্তর হাওয়ার জোর বাড়িতে লাগিল দেখিয়া বুড়া মনে মনে খুব বিরক্ত হইল। এমন সময়ে একটা দম্‌কা বাতাস আসিয়া নৌকাখানাকে ঘুরাইয়া দিয়া গেল; বুড়া তখন ব্যস্ত হইয়া জাল গুটাইতে বসিল। দেখিতে দেখিতে মেঘ বাড়িয়া উঠিল, চারিদিক্‌ অন্ধকার হইয়া গেল, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়িতে লাগিল; বৃদ্ধের নৌকা তখনও “বাঁওড়ের” মাঝখানে। তাহাতে জয়চাঁদ ভয় পায় নাই, জীবনে সে অনেক ঝড় দেখিয়াছে, ইহা অপেক্ষা ভীষণ ঝড় হইতে নৌকা বাঁচাইয়া আসিয়াছে;—তাহার ভাবনা হইতেছিল জাল খানার জন্য। সে ভাবিতেছিল জালখানা কোন রকমে তুলিতে পারিলে সে ডিঙ্গি লইয়া তীরের মত ছুটয় যাইবে এবং কোন না কোন নদীর মোহানায় আশ্রয় লইবে। কিন্তু তখন সে বৃদ্ধ হইয়াছে, তাহার দেহে আর তত বল নাই, জাল তুলিতে তুলিতে ভীষণ ঝড় উঠিল, নৌকা রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠিল। জাল উঠাইয়া যখন সে নৌকা বাহিতে আরম্ভ করিল তখন চারিদিক্ হইতে দম্‌কা বাতাস আসিয়া ক্ষুদ্র ডিঙ্গিখানিকে অস্থির করিয়া তুলিল। ডিঙ্গি তখন আর বৈঠা মানিতে চাহে না, মাঝে মাঝে ঝড়ের মুখে ডিঙ্গিখানি তীরের মত চুটিয়া যায়, আবার কোথা হইতে একটা দমকা বাতাস আসিয়া ডিঙ্গিখানিকে ঘুরাইয়া দেয়। অনেকক্ষণ পরে জয়চাঁদ বুঝিতে পারিল, ডিঙ্গি কোন নদীর মুখে প্রবেশ করিয়াছে। তাহার পশ্চাতে পর্ব্বতের মত উন্মত্ত তরঙ্গরাশি ছুটিয়া আসিতেছিল বটে, কিন্তু কূলে আঘাত লাগিয়া তাহা ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল, ডিঙ্গির আর কোন ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা ছিল না।

 গ্রাম হইতে একক্রোশ দূরে চৌধুরী মহাশয় একখানি বাগান প্রস্তুত করিয়াছিলেন। তাহাতে ফুলের গাছই অধিক, বহুমূল্য আমের কলমও ছিল, কিন্তু সেগুলি তখনও বড় হয় নাই, কিশোরীর পিতা এই বাগানে একখানি ঘর তৈয়ারী করিয়াছিলেন এবং কখনও কখনও গ্রীষ্মকালে সেইখানে বাস করিতেন। ঝড়ের রাত্রিতে বাগানের ঘরের ভিতরে একটি আলোক দেখা যাইতেছিল, চারিদিকের দরজা-জানালা বন্ধ, ঘরের বারান্দায় দুইজন নীচজাতীয় লোক বসিয়াছিল। তখন প্রবল বেগে ঝড় বহিতেছে, তাহার সহিত মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে, এমন ঝড় বাঙ্গালা দেশে অনেকদিন হয় নাই। ঘরের ভিতরে চারিটী মানুষ ছিল, তাহাদিগের মধ্যে তিন জন পুরুষ একজন স্ত্রীলোক। স্ত্রীলোকটি বিজয়া, তাহার হাত পা বাধা, কিন্তু মুখ খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। বিজয়া কোন কথা কহিতেছে না; কেবল মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতেছে। পুরুষ তিনজনের মধ্যে দুইজন আমাদিগের পূর্ব্ব-পরিচিত, একজন নূতন। সে দুয়ারের নিকট বসিয়া তামাক সাজিতেছিল।

 কিশোরী চৌধুরী মহাশয়ের একমাত্র পুত্র। চৌধুরী মহাশয় বাল্যকালে কলিকাতায় পড়িতে আসিয়াছিলেন, তিনি রিচার্ডসন সাহেবের ছাত্র। সেক্সপীয়ারের নাটকগুলি আদ্যোপান্ত আবৃত্তি করিতে পারিতেন, তাঁহার ধারণা ছিল যে কলিকাতা ভিন্ন আর কোথাও প্রকৃত শিক্ষা হয় না। কিশোরী যখন বড় হইয়া উঠিল, তখন স্কুল কলেজে দেশ ভরিয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও,আত্মীয়স্বজনের অনুরোধ উপেক্ষা করিয়াচৌধুরী মহাশয় তাহাকে কলিকাতায় পাঠাইতে কৃতসংকল্প হইলেন। কিশোরী কলিকাতায় আসিল, কিন্তু সুশিক্ষার পরিবর্ত্তে কুশিক্ষায় মনঃসংযোগ করিল। সে ধনীর সন্তানের ন্যায় বাস করিত, কলিকাতার ধনী সম্প্রদায়ের সন্তানগণের সহিত মিশিত, শিক্ষিত সমাজের দিকে কোন কালেই আকৃষ্ট হয় নাই। দলে পড়িয়া সে অল্প বয়সেই মদ্যপান করিতে শিখিয়াছিল, কুস্থানেও যে যাইত না তাহা নহে।

 একমাত্র পুত্র বলিয়া চৌধুরী মহাশয় তাহার ব্যয়বাহুল্য দেখিয়াও কোন কথা বলিতেন না। কিশোরী কলিকাতায় থাকিয়া মাসে দুই তিন শর্ত টাকা ব্যয় করিত। পূজার সময় কিশোরী তাহার দুই তিন জন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করিয়া গ্রামে আনিয়াছিল, ইহারা তাহার নিত্য সহচর,— কলিকাতার কোন বিখ্যাত বংশজাত হইলেও অত্যন্ত দুশ্চরিত্র। দুয়ারের কাছে বসিয়া যে তামাক সাজিতেছিল, সেই কিশোরীর অধঃপতনের মূল। কিশোরী যখন প্রথম কলিকাতায় যায়, তখন চৌধুরী মহাশয় তাহার সঙ্গে একজন বালকভৃত্য দিয়াছিলেন। নিতাই পিতৃমাতৃহীন, আশৈশব চৌধুরী মহাশয়ের গৃহে পালিত। কলিকাতার গিয়া, মনিবের ন্যায়, সেও পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছিল। সেই কিশোরীর গতিবিধি গোপন করিয়া রাখিত, কিশোরীকে এমন সাবধান করিয়া চলিত যে, চৌধুরী মহাশয় কোন কথাই জানিতে পারিতেন না। নিতাই আর একজন পাইকের সহিত বিজয়াকে ধরিয়া আনিয়াছিল, কিন্তু কিশোরী তাহা জানিত না। নিতাই বলিতেছিল,—"দাদাবাবুর মনটা এখনও নরম আছে, তিনি জেগে থাক্‌লে আমাকে যেতে দিতেন না।” তাহা শুনিয়া একজন বলিলেন, “কিরণ, মেয়েটাকে ছেড়ে দে, কিশোরী শুন্‌লে কি মনে ক’র্‌বে।”

 কিরণ। দেখ্‌ সুরেন, তোর মনে যদি এত ধর্ম্মভাব থাকে ত আমাদের সঙ্গে মিশিস্‌ নি।

 দ্বিতীয় ব্যক্তি কোন উত্তর না দিয়া বিজয়ার বাঁধন খুলিয়া দিল। সে গায়ের কাপড় সামলাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। প্রথম ব্যক্তি মদ্যপান করিতেছিল; সে তাড়াতাড়ি গেলাস রাখিয়া বলিয়া উঠিল,—“দেখ্‌ কিরণ, ন্যাকামি করিস্‌ নি।” নিতাই হাসিয়া বলিয়া উঠিল—“ও যাবে কোথায় বাবু, আমি দোর আগলে বসে আছি।” বিজয় ভরসা পাইয়া চুপ করিয়া ছিল, তাহার কথা শুনিয়া আবার কাঁদিতে আরম্ভ করিল। কিরণবাবু কি বলিতেছিলেন, এমন সময় একটা দম্‌কা বাতাস আসিয়া ঘরখানিকে কাঁপাইয়া তুলিল, বাহিরে একটা ভীষণ শব্দ হইল, তাহার সঙ্গে লোক দুইজন চীৎকার করিয়া উঠিল। নিতাই তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া বাহিরে গেল, সুরেনবাবুও তাহার পিছনে পিছনে দেখিতে গেলেন। বিজয়া দুয়ারের দিকে অগ্রসর হইতেছিল, কিরণ তাড়াতাড়ি তাহার হাত চাপিয়া ধরিল, বাতাসে আলো নিবিয়া গেল। বিজয়া দুই একবার হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল,কিন্তু পারিল না। কোথা হইতে হঠাৎ তাহার দেহে অমানুষী শক্তির আবির্ভাব হইল, সে সজোরে কিরণের বুকে একটা লাথি মারিল। সে তখন মাতাল হইয়াছিল, পড়িয়া গেল। বিজয়া মুক্তি পাইয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 বিজয়া গৃহে ফিরিল না, ভাবিল একা পাইলে নিতাই আবার ধরিয়া লইয়া যাইবে, কোমরে কাপড় জড়াইয়া নদীতীরের দিকে ছুটিল। মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছিল, ঝড়ের শব্দ ব্যতীত আর কিছুই শোনা যাইতেছিল না, অন্ধকারে কিছুই দেখা যাইতেছিল না। বিজয়া জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটতেছিল, বেতের কাঁটায় তাহার সর্ব্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হইল। সে বাধা পাইয়া দুই তিনবার আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেল, কিন্তু উঠিয়া আবার ছুটিতে লাগিল। সে ভাবিতেছিল যে, নিতাই তাহার পিছনে ছুটিয়া আসতেছে।

 বিজয়া নদীতীরে একবার দাঁড়াইল। ঝড়ে ক্ষুদ্র নদীবক্ষ আলোড়িত হইতেছিল। বিজয়া ভাবিল বুঝি নৌকা আসিতেছে, আকুলকণ্ঠে ডাকিল “বাবা!” ঝড়ের শব্দে তাহার কণ্ঠস্বর ডুবিয়া গেল। নিকটে একটা গাছ পড়িল। তাহার শব্দ শুনিয়া বিজয়ী চমকাইয়া উঠিয়া ভাবিল, নিতাই আসিতেছে। সে আবার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া দৌড়াইতে আরম্ভ করিল। ইছামতী আঁকিয়া বাকিয় “বাঁওড়ের” দিকে অগ্রসর হইয়াছে, স্থানে স্থানে জল শুকাইয়া নদীগর্ভ বালুকক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে, আবার স্থানে স্থানে নদীর উভয়তটে গভীর বন। নদীতীর ধরিয়া একক্রোশ পথ চলিলে তবে “বাঁওড়ে” উপস্থিত হওয়া যায়। বিজয় সেই পথেই ছুটিতেছিল।

 সে হঠাৎ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল, দেখিল সম্মুখে বিশাল উর্ম্মিরাশি ভীষণবেগে তটভূমি আক্রমণ করিতে আসিতেছে। তাহাদিগের গভীর শব্দ ঝড়ের বিপুল গর্জ্জন ডুবাইয়া দিতেছে। সম্মুখে “বাঁওড়”। অকস্মাৎ তাহার মনে হইল যে তাহার পিতা নিশ্চয়ই “বাঁওড়ে”র কোন না কোনও স্থানে আছে, তখন তাহার মনে সাহস হইল, সে চীৎকার করিয়া ডাকিল “বাবা!” তরঙ্গের পর তরঙ্গ, প্রবল বাত্যার তাড়নে তীরে লাগিয়া ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল, প্রতিঘাতে প্রতি মুহুর্তে শত শত বজ্রনাদের সৃষ্টি হইতেছিল, তাহা ভেদ করিয়া উঠিবার শক্তি রমণীর কণ্ঠে নাই। বিজয়ী আবার ডাকিল “বাবা!” কে উত্তর দিবে? তরঙ্গের আঘাতে তীরের কিয়দংশ ভাঙ্গিয়া পড়িল, বিজয়া ভাবিল কে আসিতেছে। সে যেমন অগ্রসর হইতে যাইবে অমনই গগন বিদীর্ণ হইয়া বজ্রশিখার উজ্জ্বল আলোকে চারিদিক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, বিজয়া বিস্মিতা হইয়া দেখিল, সম্মুখে একটা শ্বেতবর্ণ জন্তু দাঁড়াইয়া আছে। সে অনেক সহ্য করিয়াছিল— আর পারিল না, বজ্রশিখা নির্ব্বাপিত হইবার পূর্ব্বেই দে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল।

 ভাগ্যচক্রের পরিবর্ত্তন আশ্চর্য্য ও বিস্ময়কর। বিজয়া যেখানে মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িল, তাহার অনতিদূরে একটা কাণানদীর মোহানায় জয়চাঁদ ডিঙ্গি লইয়া আশ্রয় লইয়াছিল। বহুকাল পূর্ব্বে ইচ্ছামতী নদী সেই খাদে প্রবাহিত হইত, নদীর গতি এখন পরিবর্ত্তিত হওয়ায় তাহা বিলে পরিণত হইয়াছে, সেই জন্য লোকে পুরাতন খাদকে কাণানদী বলিত। বিজয়া “বাঁওড়ের” তীরে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, তাহার একপার্শ্বে ইচ্ছামতী ও অপর পার্শ্বে কাণানদী। বিজয়া যখন তীরে দাঁড়াইয়া তাহার পিতাকে ডাকিয়াছিল, তখন জয়চাঁদ ডিঙ্গিতে বসিয়া ভিজিতেছিল। অকস্মাৎ তাহার মনে হইল বিজয়া যেন তাহাকে ডাকিতেছে। জয়চাঁদ উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার মনে হইল বিজয়া যেন আবার তাহাকে ডাকিল। সে স্পষ্ট শুনিতে পাইল যে কে “বাবা” বলিয়া ডাকিতেছে, কিন্তু ক্ষীণ অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর বজ্র-নির্ঘোষে মিলাইয়া গেল, জয়চাঁদ মনে মনে হাসিল— ভাবিল, তাহাকে শমনের গ্রাস হইতে পলাইতে দেখিয়া প্রেতযোনিসমূহ প্রলোভন দেখাইতেছে। তাহাকে কোনমতে আবার বাত্যাবিক্ষুব্ধ উন্মত্ত বীচিমালার মধ্যে লইয়া যাইতে চাহে, তরঙ্গাঘাতে তাহার ক্ষুদ্র নৈৗকাখানি তটভূমিতে নিক্ষেপ করিয়া খণ্ড বিখণ্ড করিতে চাহে। বদ্ধমূল সংস্কার অনুসারে বৃদ্ধ রাম নাম স্মরণ করিতে লাগিল।

 শেষ রাত্রিতে বড় কমিয়া আসিতে লাগিল, বৃদ্ধ কাণানদী হইতে বাহির হইয়া ইচ্ছামতীতে পড়িল, ধীরে ধীরে নৌকা বাহিয়া গ্রামের অভিমুখে চলিল। বহুকষ্টে নৌকাখানিকে তীরে টানিয়া জয়চাঁদ গৃহে ভূলিল, দুয়ারে দাঁড়াইয়া কন্যার নাম ধরিয়া ডাকিল, কিন্তু কেহই উত্তর দিল না, দেখিয়া আশঙ্কায় বৃদ্ধের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। দুয়ারে হাত দিয়া দেখিল দুয়ার খোলা। বৃদ্ধ গৃহে প্রবেশ করিয়া দুই তিনবার কন্যার নাম ধরিয়া ডাকিল, কেহ উত্তর দিল না, দেখিয়া বৃদ্ধ চকমকি কিয় আগুন বাহির করিল, তাহার পর প্রদীপ জ্বালিয়া গৃহের চারিদিকে অনুসন্ধান করিতে লাগিল। খুঁজিতে খুঁজিতে হঠাৎ তাহার কি মনে হইল, সে কাপড় ছাড়িল, ঘরের চাল হইতে একখানা দীর্ঘ ছোরা বাহির করিল, তাহা কাপড়ের মধ্যে লুকাইয়া ঘর ইইতে বাহির হইয়া গেল।

 পূজাবাড়ী নিস্তব্ধ। পরিশ্রান্ত হইয়া যে যেখানে স্থান পাইয়াছে, সে সেইখানে শয়ন করিয়াছে। ঝড়ে আলোগুলি নিবিয়া গিয়াছে। তখনও বাতাস বহিতেছে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়িতেছে, ঘন অন্ধকার জমাট বাঁধিয়া আছে। দুয়ারে কেহই নাই, পূজার দালানে কতকগুলা কুকুর আশ্রয় লইয়াছে।

 একজন লোক কাপড় মুড়ি দিয়া ধীরে ধীরে পূজা বাড়ীতে প্রবেশ করিল, তাহাকে কেহই দেখিতে পাইল না। লোকটি সদর দরজা পার হইয়া গেল, বৈঠক থানার ভিতরে প্রবেশ করিল। বারান্দায় কেহই ছিল না, বৃষ্টির ভয়ে ঘরে আশ্রয় লইয়াছিল, লোকটি একটি একটি করিয়া সকল ঘরে প্রবেশ করিল, আবার বাহির হইয়া আসিল, তাহার পরে বৈঠকখানা পরিত্যাগ করিয়া অন্দরের দিকে চলিল।

 পূজার দালানের সংলগ্ন একটি ঘরে কিশোর বসিত, লোকটি সেই ঘরে প্রবেশ করিল, দেখিল বিছানার উপরে কে একজন শুইয়া আছে, আর ঘরের কোণে মিটমিট করিয়া একটা হরিকেন জ্বলিতেছে। সে ব্যক্তি আলোটি উঠাইয়া লইয়া নিদ্রিতের মুখের নিকট ধরিল, সে বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল “এত ভোরে আমি উঠিতে পারিব না।” এই বলিয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইল,—সে ব্যক্তি কিশোরী। নবাগত ব্যক্তি গায়ের কাপড় খুলিয়া কোমরে বাঁধিল, তাহার পর ছোরা-খানি হাতে লইয়া ফিরিয়া গেল, তাহার পর কিশোরীর ঘাড় ধরিয়া জোরে একটা ধাক্কা দিল। সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল, দেখিল সম্মুখে জয়চাঁদ, তাহার মূর্ত্তি দেখিয়া কিশোরীর ঘুমের ঘোর ছুটয়া পলাইল, সে স্তম্ভিত হইয়া বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিল—“ছোটবাবু বিজয়া কোথায়?” কিশোরী বিস্মিত হইয়া বলিল,—“বিজয়া! বিজয়া কোথায়।” বৃদ্ধ উত্তেজিত হইয়া বলিল—“বিজয়া কোথায় তা তুমিই জান, ছোটবাবু,— বিজয়া কোথায়?” কিশোর বিরক্ত হইয়া উত্তর করিল,—“তা আমি কি জানি!” জয়চাঁদ বলিল—“জান না?” কিশোরী উত্তর করিল “না।” তাহার মুখের কথা শেষ হইবার পূর্বেই বৃদ্ধ ক্ষুধিত ব্যাঘ্র্যের ন্যায় লম্ফ দিয়া তাহার উপরে পড়িল, সুদীর্ঘ ছুরিকা তাহার দেহ ভেদ করিয়া পিঠের দিকে বাহির হইয়া পড়িল। কিশোরীর দেহ শয্যায় লুটাইয়া পড়িল। জয়চাঁদ ছোরখানা বাহির করিয়া লইয়া ঘরের বাহিরে আসিল।

 বৃদ্ধ বদনচৌধুরী অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করিতেন। দশমীর দিনে ঝড়জলে লোকজন উঠিবে না, ভাবিয়া স্বয়ং তাহাদিগকে জাগাইতে আসিতেছিলেন। জয়চাঁদ যখন কিশোরীকে হত্যা করিয়া গৃহের বাহিরে আসিতেছে, ঠিক সেই মুহূর্ত্তে তিনি উঠানে পা দিয়াছেন। তাঁহাকে দেখিয়া জয়চাঁদ দূর হইতে বলিল,—“বাবু, দাঁড়ান।” তাহার বজ্র-গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনিয়া বৃদ্ধ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। তাহার রক্তাক্ত দেহ ও হাতের ছোরা দেখিয়া বৃদ্ধের অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। জয়চাঁদ তাঁহার নিকটে আসিয়া বলিল,—“তোমার কোন ভয় নাই, বাবু। অনেক দিন তোমার রাজ্যে নির্ভয়ে বাস করেছি, কিন্তু তোমার ছেলে হ’তে জয়চাঁদের জাত গেল। তাই তোমায় নির্ব্বংশ করে আস্‌ছি।” এই বলিয়া বৃদ্ধ ছোরা নিজের বুকে বসাইয়া দিল, তাহার দেহ চৌধুরী মহাশয়ের পদতলে লুষ্ঠিত হইয়া পড়িল।  বিজয়া জাগিয়া উঠিয়া দেখিল সে “বাঁওড়ের” ধারে পড়িয়া আছে, তখন পূর্ব্বদিকে উষার আলোক দেখা দিয়াছে মাত্র। সে গৃহে ফিরিল, দেখিল পিতার পরিত্যক্ত বস্ত্র পড়িয়া আছে, আর পুরাতন ছোরাখানির খাপখানি পড়িয়া আছে। বিজয়া সেই অবস্থাতেই বহির হইল, তখন পথে দুই একজন লোক চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন লোক তাহার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া কি বলিল, সে তাহা শুনিতে পাইল না। গ্রামে প্রবেশ করিয়া শুনিল, চৌধুরী বাড়ীর দিকে গোলমাল হইতেছে। সে উৰ্দ্ধশ্বাসে সেই দিকে ছুটিল, দেখিল—উঠানে তাহার পিতার দেহ পড়িয়া আছে। অনেক লোক দাঁড়াইয়া ছিল, সে তাহা দেখিতে পাইল না, চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল “বাবা গো! আমি জাত খোয়াইনি।” এই বলিয়া বিজয়া পিতার মৃত দেহের উপরে ঝাঁপ দিয়া পড়িল, আর উঠিল না। সুদীর্ঘ ছুরিকা জয়চাঁদের দেহ ভেদ করিয়াও প্রায় অৰ্দ্ধ হস্ত বাহির হইয়া ছিল, পতন মাত্র তাহা অনাথার হৃদপিণ্ড বিদ্ধ করিল।

 দশমীর প্রভাতে সানাই বিনাইয়া বিনাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গাহিতে আরম্ভ করিল-

গমন সময়ে উমা, আয় মা একবার কোলে করি।
আবার কবে দেখা হবে কি জানি বাঁচি কি মরি।