গুপ্ত রহস্য/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 সেই দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। আমি দ্বিতল হইতে সমস্ত দিবসের মধ্যে অবতরণ করিলাম না। সে দিবস আমার মনের গতিক এরূপ অবস্থায় পরিণত হইয়াছিল যে, আমার কিছুই ভাল লাগিল না, এমন কি সে দিবস আহারাদি করিতেও আমার প্রবৃত্তি হইল না। আমি আপন ঘরের মধ্যে অবস্থিতি করিয়াই সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিলাম। সমস্ত দিবস এক স্থানে বসিয়া থাকিতে থাকিতে আমার মন যেন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল। তখন সন্ধা অতীত হইয়া গিয়াছে সেই সময় আমি একবার ঐ বাড়ীর নিম্নতলে অবতরণ করিলাম কিন্তু দেখিতে পাইলাম এক খানি চারপায়ের উপর ঐ মৃত দেহটী একটী ঘরের মধ্যে রক্ষিত আছে। রাত্রিকালে উহার মৃত্যু হইয়াছে, মৃত্যুর পর অবশিষ্ট রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে তাহার পর সমস্ত দিবস গত হইয়া পুনরায় রাত্রি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, ইহার মধ্যে ঐ মৃত দেহের অন্তেষ্টীক্রিয়া হয় নাই কেন? বা উহাকে ঐ ঘর হইতে স্থানান্তরিত করাই রা হয় নাই কেন। মনে মনে আজ নানা চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু সাহস করিয়া আমার মনের কথা কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে সাহসী হইলাম না। আর জিজ্ঞাসা করিলেইবা উহারা আমাকে তাহাদিগের অভিসন্ধির কথা বলিবেই বা কেন? সেই সময়ে আমার মনের যেরূপ অবস্থা হইয়াছিল তাহা আপনারা কিছু মাত্র অনুমান করিতে পারিবেন না। আমি মনে করিলাম ঐ স্ত্রীলোকটীর অবস্থা আমার সম্মুখে যাহা ঘটিল পরে আমার অদৃষ্টেও সেই অবস্থা ঘটিবে। এক দিবস না এক দিবস কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া ইহারা আমাকেও ঐ স্ত্রীলোকটীর অনুগামিনী করিবে। মনে মনে এরূপ ভাবিয়া পুনরায় আমি আপন প্রকোষ্ঠে আগমন করিলাম ও সেই স্থানে শুইয়া নানারূপ চিন্তায় সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। আমি ভয়ানক বিপদে পতিত হইয়া ঐ স্থানে আবদ্ধাবস্থায় অতিবাহিত করিলেও, সময় সময় নিদ্রাদেবী আমার উপর অনুকম্পা প্রকাশ করিতেন, কিন্তু জানিনা কি ভাবিয়া সমস্ত রাত্রির মধ্যে এক বারের নিমিত্ত তিনি আমাকে দর্শন দিলেন না। পর দিবস প্রত্যুষে আমি আপন প্রকোষ্ঠ পরিত্যাগ কঝিয়া পুনরায় নিম্নতলে গমন করিলাম কিন্তু সেই সময় ঐ মৃত দেহ আর সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না। উহা যে কোথায় গেল, কে লইয়া গেল বা কখনই স্থানান্তরিত হইল, তাহাও কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। মনে মনে ভাবিলাম রাত্রিকালে ঐ মৃত দেহের অন্তেষ্ঠী ক্রিয়া সমাপন হইয়া গিয়াছে বলিয়াই বোধ হয় উহাকে আর দেখিতে পাইলাম না।

 যে দিবস প্রত্যুষে ঐ মৃত দেহ ঐ বাড়ীর ভিতর দেখিতে পাইলাম না সেই রাত্রিতে দস্যুগণের মধ্যে আপসে যে সকল কথা হইতেছিল তাহা শুনিয়া আমার তন্দ্রা ভঙ্গ হইল। কিন্তু আমি আমার বিছানা হইতে গাত্রোত্থান না করিয়া উহাদিগের কথা গুলি বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া শুনিতে লাগিলাম। যাহা শুনিলাম তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। এই ভয়ানক বিপদে পড়িয়া, কয়েদীর ন্যায় এই স্থানে বন্দী হইয়া, আমার চির দিবসের উপার্জ্জিত সমস্ত অর্থ হইতে বঞ্চিত হইয়া আমি যেরূপ ভীত হইয়া পড়িয়াছিলাম দস্যুগণের কথা শুনিয়া আমার সেই ভীতি আরও শতগুণে বর্দ্ধিত হইল। মনে হইল উহারা আমার আরও যেরূপ ভয়ানক সর্ব্বনাশ সাধনের চেষ্টা করিতেছে তাহা অপেক্ষা আর কোনরূপ সর্ব্বনাশই সাধিত হইতে পারে না, কিন্তু উহারা কি স্বার্থের উপর নির্ভর করিয়া এই ভয়ানক কার্য্য সাধন করিয়া আসিয়াছে তাহারও কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। উহারা আপসে যে সকল কথাবার্ত্তা কহিতেছিল তাহার সারংশে আমি আপনাদিগের নিকট বলিতেছি, আপনার বিবেচনা করিয়া দেখুন উহাদিগের এরূপ কার্য্যের উদ্দেশ্য কি।

 আমার তন্ত্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে শুনিলাম, একজন দস্যু অপর আর এক জনকে কহিতেছে “অনন্যোপায় হইয়া ঐ মৃত দেহ, আমি এই বাড়ীতে রাখিয়া দিয়াছিলাম, কারণ কবরস্থানে যখন গোল উঠিল, আমাদিগের মনোবাঞ্ছা যখন সেই স্থানে পূর্ণ করিতে পারিলাম না অথবা বুঝিতে পারিলাম যে মৃতদেহের সহিত সেই স্থানে পুলিষের হস্তে পতিত হইলে আমাদিগের আর কোনরূপেই নিষ্কৃতি নাই। তখন অনন্যোপায় হইয়া ঐ মৃতদেহ লইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, ও উহা এই স্থানে লুকাইয়া রাথিয়া সেই সময়ের নিমিত্ত পুলিষের হস্ত হইতে নিষ্কৃিতি লাভ করিলাম। কিন্তু কিরূপ উপায়ে ঐ মৃতদেহের অস্তিত্ব নাশ করিতে পারিব ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। আমরা যে স্থানে বাস করিতেছি সেই স্থান হইতে একটা মৃতদেহের সহজে অস্তিত্ব নষ্ট করা নিতান্ত সহজ নহে। হিন্দু পরিচয়ে শব দাহ করিবার জন্য কোন স্থানে উহাকে লইয়া গেলে সহজে ঐ শব দাহ করিতে সমর্থ হইব না, কারণ ঐ মৃতদেহ যে দর্শন করিবে সেই বলিবে বিষপানই ইহার মৃত্যুর কারণ। সুতরাং পুলিষের বিনা অনুমতিতে কিছুতেই উহারা ঐ মৃত দেহ ভস্মীভূত করিতে দিবে না। অথচ পুলিষের নিকট হইতে অনুমতি প্রাপ্ত হওয়াও সহজ নহে। মৃতদেহ ভষ্মীভূত করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হওয়া দূরের কথা, পুলিশ যখন ইহার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করিবে তখন আমাদিগের জীবন রক্ষা সহজ হইয়া পড়িবে না। আর কবর স্থানে ঐ মৃত দেহ প্রোথিত করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়া ভয়ানক বিপদ হইতে যেরূপে জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহা তুমি নিজেই অবগত আছ; সুতরাং কিরূপ উপায় অবলম্বন করিলে আমরা কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইব না অথচ মৃতদেহের অস্তিত্ব নাশ করিতে সমর্থ হইব তাহাই ভাবিতেছিলাম, কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কোনরূপ উপায় স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আজ মনে করিতেছিলাম, যদি কোনরূপ উপায়ে ঐ মৃতদেহের অস্তিত্ব নাশের কোনরূপ উপায় স্থির করিয়া উঠিতে না পারি তাহা হইলে ঐ মৃতদেহ এই বাড়ীর মধ্যে কবলিত করিয়া এই বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্থানান্তরে প্রস্থান করিব। সে যাহা হউক এখন দেখিতেছি আমাদিগকে আর এই বাড়ী পরিত্যাগ করিতে হইবে না, এই বাড়ী পরিত্যাগ করিলে আমাদিগের কার্য্যের সুবিধাজনক এরূপ বাড়ী আর যে কোন স্থানে সহজে প্রাপ্ত হইব তাহা বোধ হয় না।

 প্রথম ব্যক্তির কথা শুনিয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল আমি একরূপ উপায় করিয়া ঐ মৃত দেহ লুক্কায়িত করিয়া রাখিয়াছি কিন্তু ভবিষ্যতে যে কি হইবে তাহা এখন বলিতে পারিতেছি না।

 প্রথম ব্যক্তি। ঐ মৃতদেহ কোথায় লুক্কায়িত করিয়া রাখিয়া আসিয়াছ?

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। যে বৃদ্ধা আমাদিগের এই বাড়ীতে আবদ্ধা আছে তাহাকে আপনি জানেন তো?

 প্রথম ব্যক্তি। খুব জানি। যাহার ঘরে সিঁদ কাটিয়া যাহার যথা সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছি ও যাহাকে সেই দিবস হইতে কয়েদ করিয়া এই স্থানে রাখিয়া দিয়াছি তাহাকে আর জানি না? ঐ পার্শ্বের ঘরে সে তো এখনও শুইয়া আছে।

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। তাহার ঘরে একটা লোহার সিন্ধুক আছে তাহা আপনার মনে আছে কি?

 প্রথম ব্যক্তি। খুব মনে হয়, যাহা কিছু মূল্যবান দ্রব্য আমরা তাহার বাড়ী হইতে প্রাপ্ত হই, তাহার সমস্তই ঐ সিন্দুকের ভিতর ছিল।

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। ঐ লোহার সিন্ধুকের চাবিও আমরা অপহরণ করিয়া আনিয়াছিলাম।

 প্রথম ব্যক্তি। তাহাও আমার মনে আছে। লোহার সিন্দুক হইতে মূল্যবান দ্রব্য সকল বাহির করিয়া লইয়া পুনরায় ঐ সিন্ধুক আমরা বন্ধ করিয়া দি ও চাবি লইয়া আসি।

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। আজ সন্ধ্যার পর আমি বেড়াইতে বেড়াইতে সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম ও দেখিয়াছিলাম ঐ ঘরে দরওয়াজার বাহির হইতে তালা বন্ধ আছে। যে সিঁদ কাটিয়া আমরা ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম সেই সিঁদ তখন পর্যন্ত বর্ত্তমান আছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিব বিবেচনা করিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া আসি। যে সময় ঐ বাড়ীতে আমরা সিঁদ দিয়া চুরী করিয়াছিলাম, তাহার পূর্ব্ব হইতেই ঐ স্থানের অধিবাসিবর্গের অবস্থা আমরা উত্তমরূপে অবগত হইয়া ছিলাম। জানিতে পারিয়াছিলাম রাত্রি ১২টার পর ঐ পাড়ার ভিতর লোকের চিহ্ন মাত্রও দেখিতে পাওয়া যায় না। রাত্রি ১২টার পর ঐ স্থান হইতে একখানি গৃহ উঠাইয়া লইয়া গেলেও কেহ তাহা জানিতে পারে না। সেই সময় ঐ স্থানের অধিবাসিবর্গ ঘোর নিদ্রায় অভিভূত থাকে।

 ঐ গৃহের অবস্থা দর্শন করিয়া আমি এই স্থানে আগমন করি ও আমাদিগের দলস্থিত অপর কয়েক ব্যক্তির সাহায্যে যে চারিপায়ার উপর ঐ মৃত দেহ রক্ষিত ছিল, সেই চারিপায়ার সহিত আমরা উহাকে লইয়া সেই স্থানে গমন করি। স্থানে স্থানে দুই এক লোকের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইয়াছিল বটে কিন্তু মৃত দেহ বহন করিয়া লইয়া যাইতেছি দেখিয়া কেহ আমাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। ক্রমে আমরা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম ও সিঁদের সন্নিকটে ঐচারিপায়া সন্নিবেশিত করিয়া পরিশেষে ঐ মৃত দেহ লইয়া ঐ সিঁদ পথে আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ঐ ঘরের মধ্যে যে লোহার সিন্দুক ছিল ও চুরি করিবার দিবস যাহার চাবি আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম মৃত দেহ লইয়া যাইবার কালীন ঐ চাবি আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। মৃত দেহের সহিত ঐ ঘরের ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া ঐ চাবির দ্বারা ঐ সিন্ধুক খুলিলাম ও ঐ সিন্ধুকের ভিতর ঐ মৃত দেহ আস্তে আস্তে সংস্থাপিত করিয়া ঐ সিন্ধুকের চাবি বন্ধ করিলাম, ও চাবির সহিত পুনরায় ঐ সিঁদ পথে বহির্গত হইয়া ঐ চারিপায়ার সহিত সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম।

 প্রথম ব্যক্তি। এরূপ ভাবে ঐ মৃত দেহ ঐ স্থানে রাখিয়া আসিবার উদ্দেশ্য কি?

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। বিনা উদ্দেশ্যে কি এই কার্য্য করিয়া আসিয়াছি? প্রথমতঃ এই সিঁদ চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান নিশ্চয়ই পুলিশ করিয়াছে। পুলিশ নিশ্চয়ই এই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া ঐ ঘরের অবস্থা উত্তম রূপে দর্শন করিয়া গিয়াছে। হয় তো লোহার সিন্ধুক খুলিয়া লোহার সিন্ধুকের ভিতর কি আছে না আছে তাহাও দেখিয়া লইয়াছে; এরূপ অবস্থায় দশ পাঁচ দিবসের মধ্যে কে যে ঐ সিন্ধুক আর খুলিবে তাহা বোধ হয় না। দশ পাঁচ দিবস ঐ সিন্দুকের ভিতর ঐ মৃত দেহ থাকিলে ইহা পচিয়া প্রায় গলিয়া যাইবে। সেই অবস্থায় ঐ মৃত দেহ কেহ দেখিতে পাইলেও উহা যে কাহার মৃত দেহ তা জানিবার বা চিনিবার কোনরূপ উপায় থাকিবে না। মৃত দেহ সনাক্ত না হইলে আমাদিগের বিপদের আর কোন রূপ সম্ভাবনা থাকিবে না।

 দ্বিতীয়তঃ তারামণির ঘরে সিঁদ হইয়া চুরি হইয়াছে। তারামণি আমাদিগের এই স্থানে আবদ্ধ আছে সুতরাং তাহার পর আর কেহই তারামণিকে দেখিতে পায় নাই। ইহার পর যদি ঐ মৃত দেহ গলিত ভাবে সিন্ধুক হইতে বহির্গত হয় তাহা হইলে নিশ্চয়ই সকলকে ভাবিতে হইবে যে ঐ মৃত দেহ তারামণির, আর তারামণির গৃহে সিঁদ দিয়া তাহার যথা সর্ব্বস্ব অর্পণ, ও তাহাকে হত্যা করা অপরাধে যদি আমরা কেহ ধৃতই হই তাহা হইলে তারামণির অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে পারিলে কোন বিচারকই আমাদিগকে কোনরূপ দণ্ড প্রদানে সমর্থ হইবেন না। মনে মনে এই অভিসন্ধি স্থির করিয়াই ঐ মৃত দেহটাকে তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর আমরা আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া আসিয়াছি।

 প্রথম ব্যক্তি। তোমরা যে অভিসন্ধি করিয়াছ, তাহা নিতান্ত মন্দ নহে কিন্তু আমাদিগকে এখন আর এই স্থানে থাকিবার প্রয়োজন কি? এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলে বোধ হয় এখন ভাল হয়; কারণ যে উদ্দেশ্যে আমরা এই ঘরটী লইয়াছিলাম, আমাদিগের সেই উদ্দেশ্য অনেক পরিমাণে সফলিত হইয়াছে। এখন বোধ হয় আমাদিগের এই স্থান পরিত্যাগ করাই মঙ্গল।

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমি আপনার এই প্রস্তাবে সম্মত নহি। কারণ সম্প্রতি যে দুইটী কার্য্য আমাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে তাহার যে অনুসন্ধান পুলিশ কর্ত্তৃক হইতেছে না তাহা নহে। কোন্ কোন্ ব্যক্তি দ্বারা এই সকল কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, পুলিশ নিশ্চয়ই তাহার অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। এই রূপ অবস্থায় আমরা যদি হঠাৎ এই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাই, তাহা হইলে পুলিশ নিশ্চয়ই আমাদের উপর সন্দেহ করিবে ও আমাদিগের নাম ধাম অবগত হইতে পারিলে আমরা যে ধৃত হইব না তাহাই বা বলি কি প্রকারে। আমরা এই স্থান হইতে আপনাপন স্থানে গমন করিলে আমরা সকলেই পৃথক হইয়া পড়িব ও পৃথক পৃথক স্থানে প্রত্যেকে পৃথক পৃথক রূপে ধৃত হইলে প্রত্যেকে হয়ত পৃথক কথা বলিয়া প্রত্যেককে বিপদ গ্রস্থ করিয়া ফেলিবে। এদিকে যে কার্য্যের নিমিত্ত আমরা একত্রিত হইয়া এই গৃহ ভাড়া করিয়াছি, সেই কার্য্য আমরা এখনও এই স্থান হইতে বিস্তর সম্পন্ন করিতে পারিব; অথচ এই বাড়ী পরি-ত্যাগ করিলে এই রূপ সুবিধা জনক গৃহ যে আমরা সহজে প্রাপ্ত হইব তাহাও বোধ হয় না।

 উহাদের মধ্যে এইরূপ ভাবে কথা বার্তা হইবার পর আর যে কি কথা হইল তাহা আমি আর বুঝিতে পারিলাম না। ইহার পর হইতেই উহারা যেরূপ আস্তে আস্তে কথা কহিতে আরম্ভ করিল, তাহার এক কথার মর্মও আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু যাহা আমি শুনিলাম তাহাতেই আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। অপরের মৃতদেহ আমার ঘরের মধ্যে, আমার লোহার সিন্ধুকের মধ্যে রাখিয়া আসিয়াছে জানিতে পারিয়া, আমার বুদ্ধি লোপ একে আমার এই সর্বনাশ হইয়াছে তাহার উপর আবার কি সর্ব্বনাশ আসিয়া উপস্থিত হইবে তাহা ভাবিয়াই আমি হতজ্ঞান হইয়া পড়িলাম। যাহা আমি শুনিলাম তাহা আমি কখন স্বপ্নেও ভাবি চোরে চুরি করে, হত্যাকারী হত্যা করে। কিন্তু এরূপ ভাবে এক স্থানের মৃত দেহ অপর স্থানে রাখিয়া আসিতে, বা যাহার ঘরে চুরি করে তাহাকে আবার অন্য স্থানে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে আমি ইতিপূর্বে আর কখনও শ্রবণ করি নাই। আরও কিছু দিবস বাঁচিয়া থাকিলে যে দিন দিন আরও কতই কাণ্ড দেখিতে হইবে তাহার হিসাব নাই।