গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক)/অবতরণিকা

উইকিসংকলন থেকে


গৌড়লেখমালা।

অবতরণিকা।

 এ পর্য্যন্ত সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত যে সকল পুরাতন শিলালিপি এবং ধাতুপট্টলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে যাহার সহিত বাঙ্গালার ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্ত্তমান আছে, তাহার সংখ্যা নিতান্ত অধিক না হইলেও, কোন্ লিপি কোন্ গ্রন্থে বা প্রবন্ধে মুদ্রিত হইয়াছে, তাহার সন্ধান লাভ করিতে পরিশ্রান্ত হইতে হইত। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণের[১] চেষ্টায় এই অসুবিধা কিয়ৎপরিমাণে বিদূরিত হইয়াছে। কিন্তু বঙ্গভাষা মাত্র অবলম্বন করিয়া, এই সকল পুরাতন লিপির সম্যক্ পরিচয় লাভের উপায় নাই। তজ্জন্য লেখমালা সঙ্কলনের প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছে।

 আরও একটি কারণ আছে। যে সকল পুরাতন লিপির সহিত বাঙ্গালার ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্ত্তমান থাকা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার সহিত বরেন্দ্রমণ্ডলের সম্পর্কই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। কারণ, তাহার সহিত বরেন্দ্রমণ্ডলের [পালবংশীয় এবং সেনবংশীয়] নরপালগণের সম্পর্ক বর্ত্তমান আছে; অনেক লিপি বরেন্দ্রমণ্ডলেই আবিষ্কৃত হইয়াছে; এবং অনেক লিপির প্রকৃত মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে, বরেন্দ্রমণ্ডলের বিভিন্ন বিপ্লব-কাহিনীর তথ্যানুসন্ধান করিতে হয়। এই সকল লিপি একত্র সঙ্কলিত না হইলে, গৌড়-বিবরণ সঙ্কলনের চেষ্টা সর্ব্বাংশে সফল হইতে পারে না।

 এই লেখমালায় যে সকল প্রাচীন লিপি সঙ্কলিত হইল, তাহা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হইবার যোগ্য। এক শ্রেণী “শিলালিপি” এবং অপর শ্রেণী “তাম্রপট্টলিপি”, নামে কথিত হইতে পারে। “তাম্রপট্টলিপি” অপেক্ষা “শিলালিপির” সংখ্যা অল্প। কিন্তু বঙ্গ-লিপির বিকাশ-পদ্ধতির আলোচনা করিবার পক্ষে “শিলালিপির” মূল্য অধিক বলিয়াই স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে। কারণ, তাহাতে অক্ষরগুলি অপেক্ষাকৃত সুস্পষ্টভাবে উৎকীর্ণ।

 শিলাপট্টে এবং ধাতুপট্টে লিপি উৎকীর্ণ করাইবার প্রথা কত পুরাতন, তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইবার সময় উপস্থিত হয় নাই। কারণ, এখনও বঙ্গদেশে কোনও অতিপুরাতন লিপি আবিষ্কৃত হয় নাই। এ পর্য্যন্ত যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে, তাহাতে ধাতুপট্টলিপি অপেক্ষা শিলাপট্টলিপি যে সমধিক পুরাকালে প্রচলিত হইয়াছিল, তাহারই পরিচয় ভারতবর্ষের নানা স্থানে পুনঃ পুনঃ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। তাহার কারণ কি, তাহা কৌতূহলের বিষয় হইয়া রহিয়াছে।

 এই কৌতূহল চরিতার্থ করিবার আশায় তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে দেখিতে পাওয়া যায়,—শিলাপট্টে উৎকীর্ণ প্রাচীন লিপিগুলি এক শ্রেণীর, এবং ধাতুপট্টে উৎকীর্ণ প্রাচীন লিপিগুলি পৃথক্ শ্রেণীর,—পৃথক্ প্রয়োজনে, পৃথক্ সময়ে উদ্ভাবিত।

 শিলাপট্টে উৎকীর্ণ প্রাচীন লিপিগুলি কোন না কোন শ্রেণীর স্মারক-লিপি। তাহাতে কুল-প্রশস্তি, রাজাজ্ঞা, ব্যক্তিগত-পুণ্যকীর্ত্তি-ঘোষণা, বিজয়-গৌরব অথবা উৎসব-ব্যাপার উৎকীর্ণ হইত। তাহা “স্থাবর” বলিয়াই কথিত হইতে পারে। কারণ, তাহা এক স্থান হইতে অন্য স্থানে—একের নিকট হইতে অন্যের নিকটে—পুনঃ পুনঃ স্থানান্তরিত বা হস্তান্তরিত হইবার প্রয়োজনে উদ্ভাবিত হয় নাই।

 ধাতুপট্টে উৎকীর্ণ প্রাচীন লিপিগুলি সেরূপ নহে। তাহা দানপত্ররূপে অথবা ক্রয়বিক্রয়-ব্যাপারের নিদর্শনপত্ররূপে—একস্থান হইতে অন্য স্থানে, একের নিকট হইতে অন্যের নিকটে,—পুনঃ পুনঃ স্থানান্তরিত বা হস্তান্তরিত হইবার প্রয়োজনেই উদ্ভাবিত হইয়াছিল। সুতরাং এই শ্রেণীর লিপির নিয়ত এক স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকিবার সম্ভাবনা ছিল না। যে প্রদেশের সহিত তাহার যথার্থ সম্বন্ধ, তথা হইতে বহুদূরবর্ত্তী স্থানেও তাহা অনেক সময়ে আবিষ্কৃত হইয়াছে।

 এই শ্রেণীর লিপি ধাতুপট্টে উৎকীর্ণ করাইবার প্রথা কত পুরাতন, এখনও তাহা নিঃসংশয়ে নির্ণীত হইতে পারে নাই। যে লিপি সর্ব্বপ্রাচীন বলিয়া কথিত হইতেছে, সেরূপ একখানি তাম্রপট্টলিপি[২] বরেন্দ্রমণ্ডলেই আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাহা প্রথম কুমারগুপ্তের শাসন-সময়ের ১১৩ গুপ্ত-সংবৎসরে [৪৩৩ খৃষ্টাব্দে] উৎকীর্ণ ভূমিদানপত্র। এরূপ ভূমিদানপত্র “তাম্রশাসন”-নামে, অথবা কেবল “শাসন”-নামেও অভিহিত হইয়া থাকে। “শাসন”-শব্দের ব্যাখ্যা করিতে গিয়া, “মিতাক্ষরা”-টীকায় বিজ্ঞানেশ্বর লিখিয়া গিয়াছেন,—ইহা দ্বারা ভবিষ্যৎকালের নৃপতিবৃন্দ অনু-শাসিত হইবেন বলিয়া, ইহার নাম “শাসন” হইয়াছে। যথা,—

“शिष्यन्तो भविष्यन्तो नृपतयः अनेन।”

 কিরূপে এই সকল “শাসন” উৎকীর্ণ করাইতে হইবে, যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতায় [আচারাধ্যায়ে রাজধর্ম্ম-প্রকরণে] তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহাতে লিখিত আছে—ভবিষ্যতে যে সকল সাধু নরপাল আবির্ভূত হইবেন, তাঁহাদের অবগতির জন্য, রাজা ভূমি দান করিয়া, তাহার একটি লেখ্য প্রস্তুত করাইবেন। পটে অথবা তাম্রপট্টে রাজমুদ্রা-পরিচিহ্নিত করিয়া, রাজা তাহাতে আত্মবংশের কীর্ত্তিকলাপের উল্লেখ করাইবেন। যথা;—

“दत्वा भूमिं निबन्धं वा कृत्वा लेख्यन्तु कारयेत्।
आगामिभद्रनृपति-परिज्ञानाय पार्थिवः॥३१८॥
पटे वा ताम्रपट्टे वा स-मुद्रोपरिचिह्नितं।
अभिलिख्यात्मनो वंश्यानात्मानञ्च महीपतिः॥३१९॥
प्रतिग्रहपरोमाणं दानच्छेदोपवर्णनं।
स्वहस्तकालसम्पन्नं शासनं कारयेत् स्थिरम्”॥३२०॥

টীকাকার বিজ্ঞানেশ্বর এই শাস্ত্র-বাক্যের ব্যাখ্যা করিতে গিয়া, প্রসঙ্গক্রমে তৎকাল-প্রচলিত রীতির পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছেন। তিনি লিখিয়া গিয়াছেন,—“কার্পাস-নির্ম্মিত পটে অথবা তাম্রপট্টে বা ফলকে প্রপিতামহ-পিতামহ-পিতৃদেবের বংশবীর্য্যশ্রুতাদি-গুণাবলীর এবং আত্ম-গুণাবলীর উল্লেখ করাইয়া, গ্রহীতার এবং দত্তভূমির পরিচয়সূচক সীমাচিহ্নাদির বিবরণ লিখাইয়া, গরুড়-বরাহাদি-চিহ্নসংযুক্ত স্বকীয় রাজমুদ্রা সংযুক্ত করাইয়া, শক-বৎসরের এবং আপন রাজ্যাব্দের উল্লেখ করাইয়া, রাজা তাম্রশাসন সুসম্পন্ন করাইবেন। যথা,—

 “कार्पासिके पटे, ताम्रपट्टे, फलके वा, आत्मनो वंश्यान्, प्रपितामह-पितामह-पितॄन्, बहुवचनस्यार्थवत्त्वाय वंशवीर्य्यश्रुतादिगुणोपवर्णनपूर्व्वकं, अभिलेख्यात्मानं, च-शब्दात् प्रतिग्रहीतारं प्रतिग्रहपरिमाणं दानच्छेदोपवर्णनं चाभिलेख्य, प्रतिगृह्यत इति प्रतिग्रहो निबन्धः, तस्य रूपकादिपरिमाणं, दीयते इति दानं क्षेत्रादि, तस्य च्छेदः, छिद्यते अनेनेति छेदः; नद्यावाटौ निवर्त्तनं तत्परिमाणञ्च तस्योपवर्णनं; अमुकनद्या दक्षिणतोऽयं ग्रामः क्षेत्रं वा, पूर्वतोऽमुकग्रामस्यैतावन्निवर्त्तनं इत्यादि निवर्त्तन-परिमाणं च लेख्यं; एवं आवाटस्य नदी-नगर-वर्त्मादेः सञ्चारित्वेन भूमे र्न्यूनाधिक-भावसम्भावात् तन्निवृत्त्यर्थं; स्वहस्तेन स्वहस्त-लिखितेन, मतं मे अमुकनाम्नः अमुकपुत्रस्य यदत्रोपरिलिखितमित्यनेन सम्पन्नं युक्तं; कालेन च द्विविधेन, शकनृपातीत-रूपेण संवत्सर-रूपेण च कालेन, चन्द्रसूर्य्योपरागादिना सम्पन्नं, स्वमुद्रया गरुड़-वाराहादि-रूपयोपरि वहि-श्चिह्नितं अङ्कितं; स्थिरं दृढ़ं, शासनं, शिष्यन्तो भविष्यन्तो नृपतयः अनेन; दानाच्छ्रेयोनुपालनमिति, शासनं कारयेत् महीपति र्न भोगपतिः सन्धिविग्रहादि-कारिणा न येन केनचित्।

सन्धिविग्रहकारी तु भवेत् य स्तस्य लेखकः।
स्वयं राज्ञा समादिष्टः स लिखेत् राज-शासनम्॥

इति स्मरणात्। दानमात्रेणैव दानफले सिद्धे, शासनकारणं भोगाभिवृह्या फलातिशयार्थम्।”

 তাম্রশাসনগুলি যে এইরূপ ভাবেই সম্পাদিত হইত, তাহার পরিচয় সকল তাম্রশাসনেই কিছু কিছু প্রাপ্ত হওয়া যায়। সংস্কৃত কাব্যাদিতেও তাহার পরিচয়ের অভাব নাই। “শিশুপাল বধ” কাব্যের চতুর্দ্দশ সর্গের ৩৬ শ্লোক তাহার একটি সুপরিচিত নিদর্শন। যথা,—

“स स्वहस्तकृतचिह्नशासनः पाकशासन-समानशासनः।
आ-शशाङ्कतपनार्णवस्थिते र्विप्रसादकृत भूयसी र्भुवः॥”

 কোন্ সময় হইতে, কিরূপ ঘটনাচক্রে, এই শ্রেণীর লিপি-ব্যবহার প্রচলিত হইয়াছিল, তাহার কোনরূপ লিখিত প্রমাণ অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। সুতরাং তৎসম্বন্ধে কোনরূপ অভ্রান্ত সিদ্ধান্তের অবতারণা করিবার উপায় নাই।

 যে দেশের লিখিত ইতিহাস বর্ত্তমান নাই, সে দেশের পুরাতত্ত্ব সঙ্কলিত করিতে হইলে, এই শ্রেণীর পুরাতন লিপিকে প্রধান উপাদান বলিয়াই স্বীকার করিতে হইবে। সুতরাং শতবর্ষ পূর্ব্বেই পুরাতন লিপির পাঠোদ্ধারের জন্য নানা চেষ্টা প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। তাহা ক্রমে ক্রমে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে পরিচালিত হইয়া, অনেক পুরাতন-লিপির প্রকৃত পাঠ জনসমাজে সুপরিচিত করিয়া দিয়াছে। এই শ্রেণীর লিপি “ইতিহাস” বলিয়া কথিত হইতে পারে না;—সেরূপ প্রয়োজনেও ইহা উদ্ভাবিত হয় নাই। তথাপি ইহাতে প্রসঙ্গক্রমে সমসাময়িক নানা বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছিল বলিয়া, ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিবার উপায় নাই। এই সকল লিপির পাঠোদ্ধারে ও ব্যাখ্যাকার্য্যে পাণ্ডিত্য এবং অধ্যবসায় প্রকাশিত করিয়া, মনীষিগণ [শত বর্ষের চেষ্টায়] যে সকল ঐতিহাসিক তথ্য সঙ্কলিত করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহার উপরেই পুরাতন রাজবংশ-বিবরণের ভিত্তি সংস্থাপিত হইয়াছে। কেবল তাহাই নয়,—জনশ্রুতি হইতে, পুরাতন সাহিত্য হইতে, পুরাতন মুদ্রা হইতে, পুরাতন স্থাপত্যের ও ভাস্কর্য্যের ধ্বংসাবশিষ্ট নিদর্শন হইতে, পুরাকালের যাহা কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে, তাহার প্রকৃত মর্ম্ম অবগত হইবার পক্ষেও এই সকল প্রাচীন লিপি প্রধান অবলম্বন বলিয়া পরিচিত হইয়াছে।[৩]

 এই সকল পুরাতন লিপি একত্র সঙ্কলিত না হইলে, লিপি-লিখিত সকল বিবরণের প্রকৃত মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম হয় না। এক এক যুগের বহুসংখ্যক প্রাচীন লিপি এক সঙ্গে অধ্যয়ন করিতে পারিলে, সেই সেই যুগের নানা বিবরণের প্রকৃত মর্ম্ম সহজে উদঘাটিত হইয়া পড়ে;—এক লিপি অন্য লিপির পাঠোদ্ধারের ও ব্যাখ্যাসাধনেরও সহায়তা সাধন করিতে পারে। যে লিপি স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হইবার সময়ে অকিঞ্চিৎকর বলিয়া প্রতিভাত হয়, কালক্রমে অন্য লিপির আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে, তাহার ঐতিহাসিক মর্য্যাদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে পারে। অনেকবার ইহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

 বাঙ্গালার ইতিহাসের সহিত কেবল বাঙ্গালা দেশের চতুঃসীমার সম্বন্ধই একমাত্র সম্বন্ধ বলিয়া কথিত হইতে পারে না। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের সহিত, এবং ভারতসীমার বাহিরেও নানা স্থানের সহিত বাঙ্গালার ইতিহাসের নানা সম্বন্ধ বর্ত্তমান ছিল। প্রাচীন লিপি হইতে তাহার সন্ধানলাভ করিতে হইলে, বহুসংখ্যক প্রাচীন লিপি একত্র সঙ্কলিত করিতে হইবে। তাহা বহু শ্রমসাধ্য এবং বহু ব্যয়সাধ্য কঠিন ব্যাপার। প্রথমে তাহাতে হস্তক্ষেপ না করিয়া, বাঙ্গালার রাজবংশনিচয়ের শাসন-সময়ে যে সকল লিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল, তাহাই একত্র সঙ্কলিত হইতেছে।

 এই সকল প্রাচীন লিপি হইতে কোন্ কোন্ শ্রেণীর ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান লাভ করা যাইতে পারে, তাহাই অনুসন্ধানের মুখ্য বিষয়। তাহার সংখ্যা নিতান্ত অল্প হইবে না। কিন্তু আমাদের দেশের ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের প্রথম যুগে, রাজার এবং রাজবংশের পরিচয় সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা সমধিক প্রবল থাকায়, এ পর্য্যন্ত কেবল তাহার কথাই পুনঃ পুনঃ আলোচিত হইয়া আসিতেছে। তজ্জন্য প্রাচীন লিপি-নিহিত অন্যান্য তথ্যের যথাযোগ্য আলোচনার প্রয়োজন অনুভূত হইতে পারে নাই। এখন তাহাতে হস্তক্ষেপ করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে।

 যে সকল প্রাচীন লিপি সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত, তন্মধ্যে কোন কোন লিপি রচনা-মাধুর্য্যে সংস্কৃত কাব্য-শাস্ত্রে উচ্চ স্থান অধিকার করিবার যোগ্য বলিয়াও কথিত হইতে পারে। ভাষার এবং রচনা-পারিপাট্যের প্রতি লক্ষ্য করিলে বুঝিতে পারা যায়, জনসমাজের কথোপকথনের ভাষা যেরূপ থাকুক না কেন, [মুসলমান-শাসন প্রবর্ত্তিত হইবার পূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত] বাঙ্গালা দেশের রাজসভায় এবং বিদ্বৎসমাজে সংস্কৃত ভাষাই রচনাকার্য্যে সমাদর লাভ করিত। তৎকালে এদেশের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট সংস্কৃত ভাষা সুপরিচিত না থাকিলে, এরূপ হইতে পারিত না। রচনা-পারিপাট্যের মধ্যে যেরূপ ভাষাজ্ঞান বিকশিত হইয়া রহিয়াছে, সংস্কৃত-সাহিত্যের অনুশীলন প্রবল না থাকিলে, তাহা সেরূপ বিকশিত হইতে পারিত না। ধর্ম্মসম্প্রদায়গুলির গ্রন্থনিহিত উপদেশ সংস্কৃত ভাষাতেই লিখিত, অধীত এবং অধ্যাপিত হইত। সুতরাং সংস্কৃত শিক্ষাই যে তৎকালে এদেশে উচ্চশিক্ষা বলিয়া সুপরিচিত ছিল, তাহাতে সংশয় নাই। কোন্ শ্রেণীর গ্রন্থ পাঠ করিয়া তৎকালের জনসমাজ উচ্চশিক্ষা লাভ করিত, প্রাচীন লিপিতে প্রসঙ্গক্রমে তাহারও কিছু কিছু আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। কেবল তাহাই নহে,—প্রসঙ্গক্রমে অনেক বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের, পৌরাণিক আখ্যান-বস্তুর, ঐতিহাসিক জনশ্রুতির এবং প্রচলিত লোকব্যবহারেরও পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। যে দেশের লিখিত ইতিহাস বর্ত্তমান নাই, সে দেশের পক্ষে প্রাচীন লিপি হইতে এই সকল বিবরণ সঙ্কলনের প্রয়োজন কত অধিক, তাহা সহজেই অনুভূত হইতে পারে।

 সকল দেশেই দুইটি শক্তি জনসাধারণের উন্নতির এবং অবনতির গতিনির্দ্দেশ করিয়া থাকে। তাহা রাজশক্তি এবং প্রজাশক্তি নামে সুপরিচিত। বাঙ্গালাদেশে এই উভয় শক্তির মধ্যে পুরাকালে কিরূপ সম্বন্ধ বর্ত্তমান ছিল, কি কারণে এই উভয় শক্তির সমন্বয় বা সংঘর্ষ সংঘটিত হইত, কোন্ প্রণালীতে শাসনসংরক্ষণ-কার্য্য পরিচালিত হইত, তাহার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এই সকল প্রাচীন লিপিতেই পুনঃ পুনঃ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা আছে।

 কাহারও প্রার্থনাক্রমেই হউক, অথবা স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়াই হউক, রাজা কাহাকেও ভূমিদান করিতে প্রবৃত্ত হইলে, প্রকৃতিপুঞ্জকে সম্বোধন করিয়া “मतमस्तु भवताम्” বলিয়া তাহাদের সম্মতি গ্রহণ করিতেন। ইহাকে অন্তঃসারশূন্য সৌজন্য-বিজ্ঞাপক শিষ্টাচারমাত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে সাহস হয় না। কোন্ গ্রামে কাহারা বাস করিবে, কাহারা ভূমিকর্ষণ করিবে, কাহারা উৎপন্ন শস্য উপভোগ করিবে, তাহার সহিত প্রথমে রাজার কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিল বলিয়া বোধ হয় না;—গ্রামের লোকই তাহার একমাত্র নিয়ামক ছিল। ভূমিবিক্রয়ের প্রথা প্রচলিত হইবার পর, অনেকদিন পর্য্যন্ত যাহাকে তাহাকে ভূমি বিক্রয় করিবার উপায় ছিল না;—কাহাকে বিক্রয় করিতে হইবে, তদ্বিষয়ে গ্রামের লোকের অনুমতি গ্রহণ করিতে হইত। কাহাকেও ভূমিদানের পাত্র বলিয়া নির্ব্বাচন করিবার অধিকার রাজার ইচ্ছার উপরে নির্ভর করিলেও, প্রাচীন প্রথার মর্য্যাদারক্ষার্থ, ভূমিদান করিবার সময়ে রাজাকেও প্রজাবর্গের সম্মতি গ্রহণ করিতে হইত;—প্রজাশক্তিকে সর্ব্বতোভাবে অস্বীকার করিবার নিয়ম ছিল না। সে শক্তিকে তুচ্ছ করিবার সম্ভাবনাও বড় অধিক ছিল বলিয়া বোধ হয় না। কারণ, সে শক্তি কখন কখন রাজা নির্ব্বাচন করিত,[৪] কখন বা রাজশক্তির অপব্যবহারে অসহিষ্ণু হইয়া, রাজসিংহাসন আক্রমণ করিত।[৫] এরূপ প্রমাণ এই সকল প্রাচীন লিপিতেই প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। তাহা স্মরণ করিলে মনে হয়,—প্রকৃতিপুঞ্জের চিরসঞ্চিত অধিকারসমূহ স্বীকার করিয়া রাজ্যপালন করিতে হইত বলিয়াই, দানকালে তাহাদের সম্মতি গ্রহণের জন্য রাজাকে “मतमस्तु भवतां” বা তদনুরুপ বাক্যাবলী দানপত্রে উৎকীর্ণ করাইতে হইত।

 ভূমি কাহার,—রাজার কি প্রজার,—তাহা লইয়া মানবসমাজে অনেক কলহ বিবাদ হইয়া গিয়াছে। ভারতবর্ষে রাজা ভূমির প্রতিপালক (রক্ষাকর্ত্তা) বলিয়া প্রতিভাত;—রক্ষা করিতেন বলিয়া (প্রতিদানরূপে) উৎপন্ন শস্যের অংশ লাভ করিতেন। শস্য উৎপন্ন হউক বা না হউক, ভূমি অধিকার করিতে হইলেই প্রজাকে নির্দ্দিষ্ট কর প্রদান করিতে হইবে, এরূপ শাসন-নীতি রাজাকেই ভূমির অধিকারী বলিয়া প্রতিপন্ন করে। প্রজা তাহা স্বীকার করিয়া লইয়া, ভূমি কৰ্ষণ করে; তদ্দ্বারা ভূমিতে স্বামিত্ব লাভ করিতে পারে না। এরূপ শাসন-নীতি ভূমির বৰ্গফলের অনুপাতে কর ধার্য্য করিয়া থাকে, তজ্জন্য দানপত্রাদিতেও তাহা উল্লিখিত হয়। পালনরপালগণের তাম্ৰশাসনে ভূমির পরিচয় আছে; চতুঃসীমার উল্লেখ আছে; কিন্তু বৰ্গফলের উল্লেখ নাই। সেকালের রাজস্ব-নীতির প্রকৃতি কিরূপ ছিল, ইহাতে তাহার কিছু আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায় কি না, তাহা চিন্তনীয়।

 শাসন এবং সংরক্ষণ কার্য্য কিরূপে সম্পাদিত হইত, তাম্ৰশাসনে তাহার যথেষ্ট পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। রাজা “মহতী দেবতা”, তিনি “নররূপে” অবনীমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলেও, সাক্ষাৎ সম্বন্ধে প্রজাপালন করেন না। সে কার্য্য নানাশ্রেণীর রাজপুরুষের সাহায্যে সম্পাদিত হইয়া থাকে। তাঁহাদিগের পদবিজ্ঞাপক-উপাধিগুলি তাম্ৰশাসনে উল্লিখিত থাকায়, তাহা হইতে তাঁহাদিগের রাজকার্য্যের পরিচয় লাভ করা যায়। এই সকল পদবিজ্ঞাপক-উপাধি এখন অপ্রচলিত হইয়া পড়িয়াছে বলিয়া, তাহার ব্যাখ্যা-কার্য্যে লিপ্ত হইয়া, সুধীগণ নানা বিচার-বিতণ্ডার অবতারণা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।

 মুদ্রাযন্ত্র প্রচলিত হইবার পর বঙ্গাক্ষর কিরূপ আকার ধারণ করিয়াছে, তাহা সকলের নিকটেই সুপরিচিত। বঙ্গাক্ষরের এরূপ আকার চিরদিন প্রচলিত ছিল না। কিরূপে, কতদিনে, বঙ্গাক্ষর তাহার বর্ত্তমান আকার লাভ করিয়াছে, তাহা সকলের নিকট সুপরিচিত হইতে পারে নাই। তাহার ক্রমবিকাশের পরিচয় প্রাচীন লেখমালায় সন্নিবিষ্ট থাকিয়া, অল্প-সংখ্যক সাহিত্যিকের আলোচনার বিষয় হইয়া রহিয়াছে। বঙ্গ-লিপি কত পুরাতন, তাহার সীমানির্দ্দেশের উপযোগী লিখিত প্রমাণ অধিক আবিষ্কৃত হয় নাই। যাহা কিছু আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা বঙ্গ-লিপিকে একটি পুরাতন প্রাদেশিক লিপি বলিয়াই পরিচয় প্রদান করিতেছে। দৃষ্টান্তস্থলে কোন কোন শিলালিপির আদর্শ মুদ্রিত হইল। যে সকল পুরাতন লিপি সঙ্কলিত হইল, তাহার আবিষ্কার-কাহিনী, পাঠোদ্ধার-কাহিনী, ব্যাখ্যা-কাহিনী, লিপি-পরিচয় ও লিপি-বিবরণী-সংযুক্ত ভূমিকাসহ মূলানুগত পাঠ, এবং বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হইল। বিশুদ্ধ মূলানুগত পাঠ সঙ্কলিত করিবার অন্তরায়ের অভাব নাই। সকল লিপি একস্থানে সুরক্ষিত হইতেছে না; কোন কোন লিপি নিতান্ত জরাজীর্ণ; এবং একখানি লিপি এখন আর সন্ধান করিয়াও বাহির করিবার উপায় নাই; তাহা আবিষ্কৃত হইবার পর, আবার লোকলোচনের অতীত হইয়া পড়িয়াছে! এই সকল প্রাচীন লিপির অনুবাদ-কার্য্য বিলক্ষণ আয়াস-সাধ্য ব্যাপার; যত্ন চেষ্টার অভাব না থাকিলেও, ইহাতে পদে পদে বিড়ম্বিত হইবার আশঙ্কা আছে। কেহ কেহ তজ্জন্য নানা মনঃকল্পিত ব্যাখ্যার অবতারণা করিয়া গিয়াছেন। এইরূপে যে সকল ব্যাখ্যা সূচিত হইয়া, সুধীসমাজে প্রকৃত ব্যাখ্যা বলিয়া প্রচলিত হইয়াছে, তাহার যথাযোগ্য সমালোচনা প্রচলিত হয় নাই। তজ্জন্য অনেক মনঃকল্পিত পাঠ ও ব্যাখ্যা সাহিত্যে পুনঃ পুনঃ উদ্ধৃত হইতেছে। যথাস্থানে তাহার পরিচয় প্রকাশিত হইবে। প্রাচীন লিপির সঙ্কলন ও তাহার ব্যাখ্যাসাধন এরূপ শ্রমসাধ্য কঠিন ব্যাপার যে তাহাতে ভ্রম-ত্রুটি পরিলক্ষিত হইবার আশঙ্কা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় না। তৎসম্বন্ধে নিবেদন—

“शोध्योऽयं करुणावद्भिः कृतिभि र्मे परिश्रमः।”


  1. List of Northern Indian Inscriptions in the Appendix to the Epigraphia Indica Vol. V, by Prof. Kielhorn and Supplement to the same in Vol. VIII. এই তালিকা প্রকাশিত হইবার পরেও অনেক লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। সুতরাং ইহাতেও অসুবিধা সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হইতে পারে নাই।
  2. রাজসাহীর অধীন নাটোর মহকুমার অন্তর্গত ধানাইদহ গ্রামে এই তাম্রপট্টলিপি একটি পুষ্করিণী-খননকালে আবিষ্কৃত হইবার পর, নাটোরের উকীল পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান্ জগদীশ্বর রায় আমাকে ইহার সংবাদ দান করেন। জমিদার শ্রীযুক্ত মৌলবী এরশাদ আলি খাঁ চৌধুরী তাম্রপট্টখানি আমাকে প্রদান করিবার পর, আমার অনুমতিক্রমে শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ইহার পাঠোদ্ধার করিয়া, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় [ষোড়শ ভাগ ১১২ পৃষ্ঠা] প্রকাশিত করিয়াছেন।
  3. Rich as have been their bequests to us in other lines, the Hindus have not transmitted to us any historical works which can be accepted as reliable for any early times. And it is almost entirely from a patient examination of the inscriptions, the start in which was made more than a century ago, that our knowledge of the ancient political history of India has been derived. But we are also ultimately dependant on the inscriptions in every other lime of Indian research. Hardly any defenite dates and identifications can be established except from them. And they regulate everything that we can learn from tradition, literature, coins, art, architecture, or any other source.—J. F. Fleat in the Imperial Gazetteer of India, Vol. II.
  4. পালবংশের প্রথম রাজা গোপালদেব এইরূপে রাজা নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন বলিয়া তারানাথ যে জনশ্রুতির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, গোপালদেবের পুত্র ধর্ম্মপালদেবের [খালিমপুরে আবিষ্কৃত] তাম্ৰশাসনে [চতুর্থ শ্লোকে] তাহা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলিয়াই উল্লিখিত আছে।
  5. দ্বিতীয় মহীপালদেবকে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত করিবার যে আখ্যায়িকা “রামচরিত” কাব্যে উল্লিখিত আছে, রামপালদেবের কীর্ত্তিকলাপের পরিচয় প্রদানের সময়ে, বৈদ্যদেবের [কমৌলিতে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [৪ শ্লোকে] তাহার অভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়।