ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, এক্কা সকল একটী সরাইয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ সেই স্থানে অবতরণ করিয়া সেই সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই স্থানে কোন দ্রব্যেরই অভাব ছিল না। সরাইয়ের মধ্যেই শীতল জল-পূর্ণ একটী প্রকাণ্ড ইঁদারা। সরাইয়ের মধ্যস্থিত একথানি ঘরের মধ্যেই বেনিয়ার দোকান; উহাতে আটা, চাউল, ঘৃত ও তরকারি প্রভৃতি আবশ্যক আহারীয় দ্রব্য এবং হাঁড়ী, কাঠ, কাঁচা সালপাতা প্রভৃতি সমস্তই পাওয়া যায়। প্রহরীগণ সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিয়াই তাহার মধ্যে যে সকল সারি সারি ঘর ছিল, তাহার একখানির মধ্যে আসামীদ্বয়কে রাখিয়া দিল। সেই ঘরের কেবলমাত্র একটা দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা আর কিছুই ছিল না; সুতরাং সেই ঘরকে একরূপ হাজত-গৃহ বলিলেও চলে। সেই ঘরের সম্মুখে দৌড় বারান্দার উপর সারি সারি পাঁচ খানি চারিপায়া আসিয়া পড়িল। প্রহরীগণ সেই স্থানে আপনাপন পোষাক পরিচ্ছদাদি রাখিয়া, সেই চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল; কেহ বা লম্বা হইয়া শয়ন করিল। প্রহরীগণকে শয়ন করিতে দেখিয়া, দুই জন নাপিত (নাউ) আসিয়া তাহাদিগের পদসেবায় প্রবৃত্ত হইল, এবং দুইজন বার-বনিতা আসিয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইল। উহারা এইরূপ সমাগত পথিকগণের সেবা-সুশ্রুষা করিয়া আপনাপন উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে। নাপিতগণের থাকিবার স্থান সেই সরাইয়ের ভিতর না থাকিলেও, দিনরাত্রি তাহারা সকলেই প্রায় সেই স্থানে অবস্থিতি করে; কিন্তু বার-বনিতাগণ সেই সরাইয়ের ভিতরেই একটা একটী ঘর লইয়া, তাহাতেই অবস্থিতি করিয়া থাকে।

 আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ যেস্থানে অবস্থান করিল, তাহার পার্শ্ববর্তী অপর আর একটা কামরাতে হোসেন এবং তাহার ভৃত্যদ্বয় স্থান করিয়া লইলেন।

 হোসেন একজন প্রহরীকে কহিলেন, “আসামীদ্বয়কে যদি দুইখানি চারিপায়া আনাইয়া দেওয়া হয়, তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?”

 প্রহরী। আসামী! তাহাতে খুনী মোকদ্দমার আসামী! তাহারা চারিপায়ার উপর উপবেশন বা শয়ন করিবে! একথা ইতিপূর্বে আমরা আর কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই, দর্শন করা ত দূরের কথা!

 হোসেন। আসামীদ্বয়কে চারিপায়ার উপর বসিতে দিবার নিয়ম নাই বলিতেছেন; কিন্তু যদি চারিপায়া দেওয়া যায়, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি আছে কি?

 প্রহরী। ক্ষতি থাক বা না থাক, যদি ইহাদিগকে চারি পায়া দেওয়া যায়, তাহার ভাড়া কে দিবে?

 হোসেন। চারিপায়ার ভাড়া যাহা লাগিবে, তাহা আমি দিব।

 প্রহরী। আর আমাদিগকে?

 হোসেন। ইহার নিমিত্ত আপনাদিগকে কিছু দিতে হইবে কি?

 প্রহরী। না দিলে চারিপায়া দিতে দিব কেন?  হোসেন। আচ্ছা তাহাই হইবে। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত আমি আপনাদিগকে একটা টাকা প্রদান করিতেছি।

 প্রহরী। এক টাকায় হইবে না, যদি আমাদিগের প্রত্যেককেই একটী করিয়া টাকা দেন, তাহা হইলে উহাদিগকে চারিপায়ার উপর বসিতে অনুমতি দিতে পারি।

 হোসেন। আচ্ছা, তাহাই দিতেছি।

 গোফুর। হোসেন! তুমি এরূপ ভাবে অনর্থক অর্থ ব্যয় করিতেছ কেন?

 হোসেন। এ ব্যয় অনর্থক নহে। বলুন দেখি, ইতিপূর্ব্বে আর কখনও আপনারা মৃত্তিকায় বসিয়াছেন কি?

 গোফুর। এখন আর আমি সেই জমিদার গোফুর খাঁ নহি যে, চারিপায়া ভিন্ন বসিতে পারি না।

 হোসেন। আপনি এখনও সেই গোফুর খাঁ আছেন, ইহা বেশ জানিবেন।

 গোফুর। তাহা হইলে আমাদিগকে এই মিথ্যা মোকদ্দমায় আর ফাঁসি যাইতে হইত না!

 হোসেন। আপনি ভাবিবেন না। উপরে কি ভগবান নাই? আপনাদিগকে কখনই ফাঁসি যাইতে হইবে না। আপনার মনকে স্থির করুন, দেখুন, আপনাদিগকে বাঁচাইয়া লইয়া যাইতে পায় কি না। দুই তিন দিবস আপনাদিগের স্নান হয় নাই, আজ স্নান করিবেন কি?

 গোফুর। আর স্নান করিয়াই বা কি হইবে?

 হোসেন। স্নান করিয়া অনেক ফল হইবে। স্নান করিলে শরীরের অনেক গ্লানি দূর হইবে, মস্তিষ্ক শীতল হইবে, তখন একমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে সমর্থ হইবেন। এক মনে ঈশ্বরকে ডাকিতে পারিলে কোন বিপদ হয় কি?

 গোফুর। প্রহরীরা আমাদিগকে স্নান করিতে দিবে কি?

 হোসেন। সে ভার আমার উপর। যেরূপে হয়, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছি। কেমন গো প্রহরীসাহেব! আপনাদিগের আসামীদ্বয় যদি স্নান করেন, তাহাতে আপনাদিগের, বোধ হয়, কোনরূপ আপত্তি নাই।

 প্রহরী। আসামীদ্বয় স্নান করিবে! তাহা কি কখনও হইতে পারে?

 হোসেন। কেন হইতে পারিবে না? এখানে আর কে তাহা দেখিতে পাইবে বা কেই বা তাহা শুনিতে পাইবে? ইহার জন্য আপনাদিগের প্রত্যেককে আট আনা এবং স্নানের পরে কিছু জল খাবরার নিমিত্ত, আট আনা করিয়া আমি প্রদান করিতেছি। ইহাতে, এখন বোধ হয়, আপনাদিগের আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।

 প্রহরী। কোথায় স্নান করিবে? ইঁদারার নিকট ইহাদিগকে লইয়া যাইতে দিব না; কারণ, কি জানি যদি ইহারা ইঁদারার ভিতর আত্ম-বিসর্জন করে, তাহা হইলে আমাদিগকে কয়েদ হইতে হইবে।

 হোসেন। না, ইহাদিগকে ইঁদারার নিকট লইয়া যাইব না। যে স্থানে বলিবেন, সেই স্থানে বসিয়াই উহারা স্নান করিবেন।

 প্রহরী। জল কোথায় পাইবেন, বা কে আনিয়া দিবে?

 হোসেন। আমার সহিত দুইজন পরিচালক রহিয়াছে, এবং আমি নিজে আছি। তদ্ব্যতীত দুই চারি পয়সা দিলেই জল আনিয়া দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় যেস্থানে বলিবেন, সেই স্থানে জল আনাইয়া দিয়া, উহাদিগকে স্নান করাইয়া দিব।

 প্রহরী। আর আমাদিগকে যাহা দিতে চাহিলেন, তাহা কখন দিবেন?

 “তাহা আমি এখনই দিতেছি,” হোসেন এই বলিয়া চারিপায়া পাইবার, স্নান করিবার এবং কিছু জল খাবার খাইতে পাইবার অনুমতির নিমিত্ত প্রহরীর হস্তে দশ টাকা প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, ইহার পর উক্ত কয়েকটা বিষয়ের নিমিত্ত প্রহরীগণ আর কোনরূপ আপত্তি করিল না। ভৃত্যগণ ইঁদারা হইতে জল উঠাইয়া আনিয়া প্রহরীগণের সম্মুখে তাহাদিগকে স্নান করাইয়া দিল। স্নান করিবার পর হোসেন কিছু জল খাবার আনাইলেন। কিন্তু প্রহরীগণ সে জল খাবার উহাদিগকে খাইতে না দিয়া কহিল, “ইহার ভিতর আপনারা কোনরূপ বিষ প্রদান করিয়াছেন কি না, আমরা তাহা জানি না। সুতরাং আপনাদিগের আনীত জল খাবার ইহাদিগকে কখনই আহার করিতে দিব না। যাহা আনিতে হইবে, তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিন এবং তাহার মূল্য আমাদিগকে প্রদান করুন। আমরা নিজে তাহা খরিদ করিয়া আনিয়া, আসামীদ্বয়কে প্রদান করিব।”

 প্রহরীগণের প্রস্তাবে হোসেন সম্মত হইলেন, এবং জল খাবার আনিবার নিমিত্ত, উহাদিগের একজনের হস্তে একটী টাকা প্রদান করিলেন। তাহাতে যে কিছু আহারীয় দ্রব্য আনিয়া আসামীদ্বয়কে প্রদান করা হইল, আসামীদ্বয় তাহা হইতে অতি অল্পই আহার করিলেন। অবশিষ্ট আহারীয় ও পূর্ব্ব-আনীত আহারীয় সমুদায়ই প্রহরীদিগের হইল। সেই সকল দ্রব্য আহার করিবার সময়, বিষের কথা আর প্রহরীদিগের মনে উদিত হইল না।

 আমি পূর্ব্বেই বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইতেছিল, তাহারা সকলেই মুসলমান।