বিষয়বস্তুতে চলুন

ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 এই ভয়ানক দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া হোসেনের মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। অশ্রুপূর্ণ-লোচনে তিনি আদালতের বাহিরে আসিলেন। যে সময় এই মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেল, তখন অপরাহ্ন চারিটা। জজসাহেবের সঙ্গে একজন কো-ইনম্পেক্টার ছিলেন; যে আসামীদ্বয়ের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগকে লইয়া তিনি বিষম বিপদে পড়িলেন। কিরূপে সেই আসামীদ্বয়কে তিনি জেলায় পাঠাইয়া দিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই স্থান হইতে পদব্রজে আসামীগণকে পাঠাইয়া দিলে, তিন চারিদিবসের কম তাহারা সদরে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবে না। বিশেষতঃ গোফুর খাঁর আর চলিবার ক্ষমতা নাই; তাহার উপর পথে বিপদের সম্ভাবনাও আছে।

 কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব এইরূপ গোলযোগে পড়িয়া হোসেনকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন ও কহিলেন, “আপনার মনিবদ্বয়ের অদৃষ্ট্রে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে; কিন্তু যে পর্যন্ত তাহাদিগের জীবন শেষ না হয়, সে পর্য্যন্ত তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া কোনরূপেই কর্ত্তব্য নহে। এখন. ইহাদিগকে অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হইবে; কিন্তু আমি দেখিতেছি যে, হাঁটিবার শক্তি ওসমানের থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু গোফুর খাঁর সে শক্তি নাই। আর উহাদিগকে কোন যানে আরোহণ করাইয়া লইয়া যাইবার খরচার ব্যবস্থাও সরকার হইতে নাই। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি কিছু অর্থ প্রদান করেন, তাহা হইলে যাহাতে উহারা কষ্ট না পান, কোনরূপে আমি সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উহাদিগকে এই স্থান হইতে পাঠাইতে পারি।”

 হোসেন। আমাকে কিরূপ অর্থ সাহায্য করিতে হইবে?

 ইনস্পেক্টার। অধিক অর্থের সাহায্য করিতে হইবে না। ইহারা দুইজন, এবং ইহাদিগের সহিত যে কয়জন প্রহরী গমন করিবে, তাহাদিগকে সদর পর্যন্ত লইয়া যাইতে হইলে গাড়ি প্রভৃতির যাহা কিছু খরচ পড়িবে, তাহাই কেবল তোমাকে দিতে হইবে।

 হোসেন। তাহা আমি দিতে সম্মত আছি, যদি আমাকেও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে দেন।

 ইনস্পেক্টার। আপনিও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে পারেন। কিন্তু একত্র নহে। উহারা যে গাড়িতে গমন করিবেন, আপনি সেই গাড়িতে গমন করিতে পারিবেন না। অপর গাড়ি লইয়া উহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলে, কেহ আপত্তি করিবে না। কিন্তু কেন আপনি উহাদিগের সহিত গমন করিতে চাহেন?  হোসেন। আমি যে কয়দিবস উঁহাদিগের সহিত থাকিতে পারিব, সেই কয়দিবস যাহাতে উঁহাদিগের কোনরূপ আহারাদিন কষ্ট না হয়, তাহা আমি দেখিতে পারিব। তদ্ব্যতীত যখন উভয়েই ফাঁসি যাইতেছেন, তখন ইঁহাদিগের এই অগাধ জমিদারীর কিরূপ বন্দোবস্ত করিব, বা তাহারা ইহা কাহাকে প্রদান করিয়া যাইবেন, এবং পরিবারবর্গেরই বা কিরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে, প্রভৃতি আবশ্যক বিষয় সকল সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব, তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া বা লিখাইয়া লইব।

 ইস্পেক্টার। আপনি উঁহাদিগের সহিত এখন গমন করিতে পারেন, আর তাঁহাদিগের আহারাদি সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিতেও কিছুমাত্র নিষেধ নাই। কিন্তু বিষয়-আদি-সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিবার সময় এখন নহে। জেলায় গমন করিবার পর জেলের মধ্যে উহারা যে কয়দিবস থাকিবেন, তাহার মধ্যে জেল কর্মচারীর সম্মুখে সে সমস্ত বন্দোবস্ত আপনারা করিয়া লইতে পারিবেন।

 হোসেন। জেলায় গমন করিতে উহাদিগের কয়দিবস লাগিবে?

 ইস্পেক্টার। তাহা আমি এখন বলিতে পারিতেছি না। ইহাদিগের সহিত যে সকল প্রহরী গমন করিবে, তাহারা যে কয়দিবসে সুবিধা বিবেচনা করিবে, সেই কয়দিবসে তাহারা উঁহাদিগকে লইয়া যাইবে।

 হোসেন। মহাশয়! আর একটা কথা। রাত্রিকালে উহার যে যে স্থানে অবস্থিতি করিবে, সেই সেই স্থানে রাত্রিযাপন উপযোগী কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে কি?

 ইস্পেক্টার। না, রাত্রিযাপন সম্বন্ধে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়াজন নাই। কারণ, থানা ভিন্ন অপর কোন স্থানে উঁহারা রাত্রিযাপন করিবেন না। সমস্ত দিবস গমন করিয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে যে থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবেন, সেই থানাতেই রাত্রিযাপন করিবেন, ও পরদিন প্রত্যুষে সেই থানা হইতে প্রস্থান করিবেন। এইরূপে গমন করিয়া যে কয়দিবসে সম্ভব, সদরে গিয়া উপস্থিত হইবেন।

 কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, তাঁহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহার সমস্ত ভার হোসেন গ্রহণ করিলেন। সেই দিবস অপরাহ্ন হইয়া আসিয়াছিল বলিয়া, ইনস্পেক্টার সবিশেষরূপ পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া আসামীদ্বয়কে সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন। আর ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস অতি প্রত্যুষে আসামীদ্বয়কে সেই স্থান হইতে পাঠাইয়া দিবেন। আসামীদ্বয় এবং প্রহরীগণকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কয়েকখানি, এক্কার প্রয়োজন হইল, তাহাও সেই রাত্রিতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখা হইল। হোসেন এবং তাহার দুইজনমাত্র ভৃত্যও সেই সঙ্গে গমন করিতে প্রস্তুত হইল। তাহারাও নিজের গমনোপোযোগী একা বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন।

 পরদিবস অতি প্রত্যুষে প্রহরীগণ আসামীদ্বয়কে লইয়া এক্কারোহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। হোসেনও তাঁহার অনুচরদ্বয়ের সহিত অপর এক্কায় আরোহণ করিয়া তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। প্রহরীগণের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্ব্ব প্রধান ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব তাহাকে হোসেনের সহিত পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন ও বলিয়া দিয়াছিলেন, “হোসেন তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিবে। যে স্থানে যে কোন খরচের প্রয়োজন হইবে, তাহা হোসেনই দিবেন। আসামীদ্বয়কে আহারাদি করাইবার নিমিত্ত যে কোন সাহায্যর প্রয়োজন হইবে, হোসেন তৎক্ষণাৎ সেই সকল সাহায্য করিবেন। এক্কা প্রভৃতির যখন যেরূপ ভাড়া লাগিবে, হোসেনকে বলিলে তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা প্রদান করিবেন।”

 কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশ পাইয়া, প্রহরী আর কোন কথা কহিল না। কারণ, সে উত্তমরূপে অবগত ছিল যে, যদি হোসেন বা অপর কোন ব্যক্তি এক্কা প্রভৃতির ভাড়া প্রদান না করে, তাহা হইলে যে কয়দিবসে হউক, তত পথ তাহাদিগকে পদব্রজে গমন করিতে হইবে। প্রহরী-সর্দারের মনে মনে একটু দুরভিসন্ধি ছিল। কোর্ট-ইনস্পেক্টারের সম্মুখে কিন্তু সে তাহা প্রকাশ করিল না। তখন তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আসামীদ্বয় ও হোসেনের সমভিব্যাহারে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইল। কিয়দ্র গমন করিবার পর, পথের এক স্থানে একটা জলাশয় দৃষ্টিগোচর হইল।

 প্রহরী-সর্দ্দারের সেই স্থানে একা থামাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ প্রতিপালিত হইল। এক্কা হইতে অবতরণ করিয়া সকলে সেই স্থানে একটু বিশ্রাম করিলেন, এবং প্রহরীগণ একে একে আপনাপন হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া লইলেন। তাঁহাদিগের সকলের হস্তমুখাদি প্রক্ষালিত হইলে, প্রহরী-সর্দার হোসেনকে কহিলেন, “মহাশয়! আসামীদ্বয়কে লইয়া সদরে উপস্থিত হইতে এক্কা-ভাড়া প্রভৃতি যে সকল খরচ পড়িবে, তাহা আমাদিগকে মিটাইয়া দিন।”  হোসেন। এক্কা-ভাড়া প্রভৃতির জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। যখন আমি আপনাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি, তখন সমস্তই আমি প্রদান করিব।

 সর্দ্দার-প্রহরী। আপনি যে উহা প্রদান করিবেন, তাহা কোর্ট ইনস্পেক্টার সাহেব বলিয়াই দিয়াছেন; কিন্তু বারে বারে আপনার নিকট চাহিয়া লওয়া অপেক্ষা একবারেই উহা আমাদিগকে প্রদান করা উচিত নহে কি?

 হোসেন। যখন আমাকে দিতে হইবে, তখন আপনি একবারেই লউন, বা বারে বারেই লউন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই।

 সঃ প্রহরী। তাহা হইলে উহা আমাকে অগ্রেই প্রদান করুন।

 হোসেন। কত খরচ পড়িবে, তাহা আমি এখন পর্যন্ত জানিতে পারিতেছি না; সুতরাং অগ্রে আমি আপনাকে উহা কি প্রকারে প্রদান করিতে পারি? আপনাদিগের সহিত যে সকল এক্কা আছে, উহারা কি একবারে সদর পর্যন্ত গমন করিতে পারিবে?

 সঃ প্রহরী। উহারা এতদূর কিরূপে গমন করিবে? এক এক থানায় গমন করিবার পর উহাদিগকে ছাড়িয়া দিব ও সেই স্থান হইতে অন্য এক্কা গ্রহণ করিব।

 হোসেন। তাহা হইলে আপনাদিগকে কত টাকা গাড়িভাড়া দিতে হইবে, তাহা আমি এখন কিরূপে জানিতে পারিব? যেমন যে এক্কা ছাড়িয়া দিবেন, অমনি তাহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে চলিবে না?

 সঃ প্রহরী। তাহা কিরূপে হইবে? সে সময় যদি আপনি উপস্থিত না থাকেন, তাহা হইলে কিরূপে ভাড়া প্রদান করিবেন?

 হোসেন। আমি ত আপনাদিগের সহিত উপস্থিত আছি। যখন যাহা বলিবেন, তখনই তাহা প্রদান করিব।  সর্দার-প্রহরী। এখন ত উপস্থিত আছেন দেখিতেছি; কিন্তু রাস্তা হইতে যদি আপনি চলিয়া যান, তাহা হইলে তখন আমি কি করিব? ও সকল গোলযোগেরই এখন প্রয়োজন নাই। আমার নিকট কিছু অর্থ আপনি প্রদান করুন, তাহা হইতে আমি ভাড়া প্রদান করিব। খরচ-পত্র বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা পরিশেষে আমি আপনাকে ফিরাইয়া দিব।

 হোসেন। আচ্ছা মহাশয়, তাহাই হউক। যদি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এই কুড়িটী টাকা আপনার নিকট রাখিয়া দিন।

 সঃ প্রহরী। আমি আপনার নিকট ভিক্ষা করিতে বসি নাই। এখন যদি আপনি পঞ্চাশ টাকা প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি উহা গ্রহণ করিব; নতুবা আমি আসামীদ্বয়কে হাঁটাইয়া লইয়া যাইব।

 হোসেন। হাঁটাইয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই। আমি পঞ্চাশ টাকাই আপনাকে প্রদান করিতেছি, তাহা হইতে আপাততঃ যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হয়, আপনি করুন। পরে যদি আরও কিছু আবশ্যক হয়, তাহাও আমি প্রদান করিব। এই বলিয়া হোসেন পঞ্চাশটী টাকা বাহির করিয়া সেই সর্দারপ্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা গ্রহণ করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন, ও অপর প্রহরীগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “চল ভাই! আর দেরী করিবার প্রয়োজন নাই।”

 সর্দার-প্রহরীর এই কথা শুনিয়া হোসেন কহিলেন, “মহাশয়। আপনারা হস্ত মুখ প্রক্ষালনাদি সকল কার্য্য শেষ করিয়া লইলেন; কিন্তু ইহারা হস্ত মুখাদি ধুইবে কি না, তাহা ত কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন।”  সর্দার-প্রহরী। সে কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই। কোন বিষয়ের আবশ্যক হইলে ইহারা আপনারাই আমাদিগকে বলিবেন। তখন বিবেচনা করিয়া দেখা যাইবে যে, উঁহাদিগের প্রার্থনা শ্রবণ-যোগ্য কি না।

 হোসেন। আপনারা যদি কোন কথা তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা না করেন, তাহা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি। সঃ প্রহরী। উহাদিগের সহিত কথা কহিবার তোমার কোন অধিকার নাই। হত্যাপরাধে যাহাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগের সহিত কথা কহিয়া, তুমি আমাদিগের চাকরী লইতে চাও?

 হোসেন। উহাদিগের সহিত কথা কহিলে, আপনাদিগের চাকরী যাইবে কি প্রকারে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।

 সঃ প্রহরী। চাকরী যাউক, আর না যাউক, উঁহাদিগের সহিত আমি কোনরূপে তোমাকে কথা কহিতে দিব না।

 হোসেন। আপনার অনভিমতেই আমি কথা কহিব কেন? কিন্তু আমি ইহাদিগকে যদি কোন কথাই বলি, তাহা মন্দ কথা নহে। তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই।

 সঃ প্রহরী। আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হউক, বা না হউক, তাহা দেখিবার তোমার কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। মূল কথা, তুমি উঁহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতে পারিবে না।

 হোসেন। যদি আমি ইহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতেই পারিব, তাহা হইলে আপনাদিগের সহিত আমার আসিবার কি প্রয়োজন ছিল?  সর্দ্দার-প্রহরী। প্রয়োজন ত আমি কিছুই দেখি না। না আসিলেই পারিতে।

 হোসেন। আমি না আসিলে, আপনাদিগকে কে গাড়ির ভাড়া প্রদান করিত?

 সঃ প্রহরী। গাড়ি ভাড়া কিছু আমাদিগের উপকারের নিমিত্ত দেও নাই। তোমারই মনিবদ্বয় হাঁটিয়া যাইতে অপারক, তাই তাঁহাদিগের নিমিত্ত গাড়ির ভাড়া প্রদান করিয়াছ। গাড়ি ভাড়া প্রদান না করিলে, আমরা অনায়াসেই উঁহাদিগকে হটাইয়া লইয়া যাইতে পারিতাম।

 হোসেন। বলি, জমাদার সাহেব! ও সকল কথা থাক, এখন আপনাদিগের মনের কথা কি বলুন দেখি। আপনারা যাহা বলিবেন, আমি তাহাতেই প্রস্তুত আছি।

 সঃ প্রহরী। খুনী আসামীর সহিত কথা কহিতে দেওয়া যে কতদুর ঝুঁকির কার্য্য, তাহা ত আপনারা জানেন না। যদি আমাদের কোনরূপ সাধ্য না থাকে, তাহা হইলে আমরা সেই ঝুঁকি কেন গ্রহণ করিব? আপনি বুদ্ধিমান, আপনাকে অধিক আর কি বলিব?

 হোসেন। আমাকে আর বলিতে হইবে না, এ কথা আমাকে পূর্ব্বে বলিলেই পারিতেন। আপনারা কিছু প্রার্থনা করেন, বুঝিয়াছি। বলুন, এখন আমাকে কি দিতে হইবে।

 সঃ প্রহরী। আপনি বড় মানুষ, আপনাকে আমরা আর কি বলিব? আপনি আপনার বিবেচনামত কার্য্য করিলেই চলিবে।

 হোসেন। এখন আর আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নাই, ভালমন্দ বুঝিবার ক্ষমতা এখন দূর হইয়া গিয়াছে। এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত আমাকে কয়টা টাকা দিতে হইবে, তাহা স্পষ্ট করিয়া আমাকে বলুন। আমার সাধ্য হয়, আমি প্রদান করি। আর আমার ক্ষমতার অতীত হয়, তাহা হইলে এই স্থান হইতেই আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করি।

 সর্দ্দার-প্রহরী। আপনাকে কিছু অধিক প্রদান করিতে হইবে না। আমরা পাঁচজন বই আর নয়। আমাকে কুড়ি টাকা ও অপর চারিজনকে দশ টাকা করিয়া চল্লিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা, কেবল ষাট টাকা বৈত নয়!

 হোসেন। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা; কিন্তু আমার পক্ষে ইহা খুব অধিক হইতেছে। আমি অত টাকা দিতে পারি না। আমি আপনাদিগের সম্মান রক্ষার নিমিত্ত্ব ত্রিশ টাকা প্রদান করিতেছি।

 সঃ প্রহরী। এ কার্য্য ত্রিশ টাকায় হইতে পারে না। আপনার ইচ্ছা হয়, ষাট টাকা দিন, ইচ্ছা না হয়, এক টাকা দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি অধিক করিয়া বলি নাই, আমি যেরূপ এক কথার লোক, সেইরূপ এক কথাই বলিয়াছি।

 হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! আমি ষাট টাকাই প্রদান করিতেছি। ইহার পর আমাকে ত আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না?

 সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আপনাকে আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না। কিন্তু আমাদিগের কাহারও সম্মুখে ব্যতীত নির্জনে আপনি উঁহাদিগের সহিত কোনরূপ কথা বলিতে পারিবেন না।  এইরূপ কথাবার্তার পর হোসেন ষাট টাকা প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার আদেশ পাইলেন। কিন্তু সেই সময় বিশেষ কোনরূপ কথা কহিবার অবকাশ পাইলেন। তাঁহাদিগকে তৎক্ষণাৎ এক্কার উপর আরোহণ করিতে হইল। হোসেনও আপন এক্কায় গিয়া আরোহণ করিলেন। এক্কায় আরোহণ করিবার সময় হোসেন কেবলমাত্র তাহাদিগকে কহিলেন, “জজসাহেব আপনাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছেন বলিয়া যে, আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইবেই, তাহা আপনারা মনে করিবেন না। আপনার উপার্জিত বিষয়ের এক পয়সামাত্র অবশিষ্ট থাকিতে, কোনরূপেই আমি আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইতে দিব না। টাকার যথেষ্ট সংগ্রহ করিয়া আমি সঙ্গেই রাখিয়াছি। হাইকোর্ট হইতে যেরূপ উপায়ে হউক, এই হুকুম রদ করাইব। ঈশ্বর যদি একান্তই বিমুখ হন, হাইকোর্ট হইতে যদি কিছু করিয়া উঠিতে না পারি, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিয়া হউক, বড় লাটকে ধরিয়া হউক, বিলাত পর্যন্ত লড়িয়া হউক, কোন না কোনরূপে আপনাদিগকে অব্যাহতি প্রদান করাইব।”

 হোসেনের কথা শুনিয়া গোফুর ও ওসমান কেবল এইমাত্র কহিলেন, “দেখুন, ভরসার মধ্যে ঈশ্বর?”

 ইহার পরেই এক্কা সকল সেই স্থান হইতে চলিল। এক্কাচালক অশ্বগণকে সবলে কষাঘাত করিতে লাগিল। প্রহারের ভয়ে অশ্বগণ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার পথ একণ্টায় চলিতে লাগিল।