ঘর-পোড়া লোক (শেষ অংশ)/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ঘর-পোড়া লোক।

(শেষ অংশ)

______

প্রথম পরিচ্ছেদ।

______

 আসামীদ্বয় থানায় উপস্থিত হইলে পর, সেই সময় থানায় যে কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তিনি আসামীদ্বয়কে হাজতগৃহে বদ্ধ করিয়া রাখিলেন।

 থানায় হাজত-গৃহ কিরূপ, তাহা পাঠকগণ অবগত আছেন কি? থানার ভিতর থানার কর্ম্মচারীগণ যে স্থানে বসিয়া সর্ব্বদা কায-কর্ম্ম বা লেখা-পড়া করিয়া থাকেন, তাহার দুই পার্শ্বে বা তাহার সন্নিকটে ছোট ছোট দুইটী গৃহ প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়; উহাই থানার হাজত-গৃহ। উহার একটী পুরুষ-কয়েদী এবং অপরটী স্ত্রী-কয়েদীর নিমিত্ত প্রায়ই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। সেই সকল গৃহে কেবল একটীমাত্র দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা প্রায়ই থাকে না। চোর বলুন, মাতাল বলুন, হত্যাকারী বলুন, বা যে কোন অপরাধের আসামী বলুন, সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে যাহারা ধৃত হইয়া থানায় আইসে, তাহাদিগের সকলকেই একত্র সেই গৃহের ভিতর থাকিতে হয়। বিছানার নিমিত্ত উহার মধ্যে একখানি কম্বল থাকে মাত্র।  গোফুর খাঁ ওসমান সেইরূপ একটা হাজত-গৃহের ভিতর আবদ্ধ হইলেন। সেই সময় হোসেন তাঁহাদিগের সহিত কথাবার্তা কহিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, তাহার সমভিব্যাহারী সেই প্রহরী কহিল, “যে পর্য্যন্ত আসামী থানার ভিতর থাকিবে, সেই পর্যন্ত আসামী সম্বন্ধে কোন কথা বলা আমাদিগের ক্ষমতার অতীত। এখন যদি আপনি আসামীদ্বয়কে কিছু বলিতে চাহেন, বা উহারা আপনাকে কিছু বলিতে চাহেন, তাহা হইলে এখন এই থানায় কে কর্মচারী উপস্থিত আছেন, তাঁহার আদেশ লইবার প্রয়োজন। কারণ, যে পর্যন্ত আসামীদ্বয় থানার ভিতর থাকিবেন, সেই পর্য্যন্ত সেই আসামীদ্বয়ের সহিত আমাদিগের কোনরূপ সংস্রব নাই। এখন সেই আসামীদ্বয় সম্বন্ধে যাহা কিছু জবাবদিহি, তাহা এই থানার উপস্থিত কর্মচারীকে করিতে হইবে।”

 প্রহরীর নিকট হইতে এই কথা শুনিয়া হোসেন ভাবিলেন, এ বড় মন কথা নহে। আসামীদ্বয়ের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আমি একবার উহাদিগকে অর্থ প্রদান করিয়াছি; কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমি সেই অর্থ বৃথা নষ্ট করিয়াছি। ইহাদিগের সহিত যদি আবার কথা কহিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি, তাহা হইলে এই থানায় এখন যে কর্মচারী উপস্থিত আছেন, তিনি যে আবার কত অর্থ প্রার্থনা করিবেন, তাহাই বা এখন কে বলিতে পারে? এরূপ ভাবে নিরর্থক কতবার অর্থ নষ্ট করা যাইতে পারে? ইহাদিগের সহিত এখন আর কোন কথাই করিব না। কল্য প্রাতঃকালে প্রহরীগণ যখন উঁহাদিগকে থানা হইতে বাহির করিয়া লইয়া যাইবে, সেই সময় সুযোগমত পথের মধ্যে উহাদিগের সহিত কথা কহিলেই হইতে পারিবে।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া হোসেন আপনার ভৃত্যদ্বয়ের সহিত সেই থানার ভিতর এক স্থানে শয়ন করিলেন।

 সেই সময় থানায় যে কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাহার হাতের কার্য্য সম্পন্ন করিয়া, একবার তিনি তাঁহার আফিস হইতে বাহির হইয়া আসামীদ্বয়কে দেখিবার নিমিত্ত সেই হাজত-গৃহের নিকট গমন করিলেন। সেই হাজত-গৃহের চাবি যে প্রহরীর নিকট ছিল, কর্ম্মচারীর আদেশমত সে সেই হাজত-গৃহ খুলিয়া দিল। কর্ম্মচারী হাজত-গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আসামীদ্বয়ের একটু শুভদৃষ্ট বলিতে হইবে যে, সেই দিবস সেই হাজত-গৃহের ভিতর সেই দুইটী আসামী ভিন্ন আর কোন আসামী ছিল না।

 কর্ম্মচারী হাজত-গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?”

 গোফুর। আমার নাম গোফুর খাঁ।

 কর্ম্মচারী। তোমার কত দিবসের নিমিত্ত কারাদণ্ডের হুকুম হইয়াছে?

 গোফুর। আমার কারাদণ্ডের আদেশ হয় নাই, জীবনদণ্ডের আদেশ হইয়াছে।

 কর্ম্মচারী। (ওসমানের প্রতি) আর তোমার?

 ওসমান। আমারও তাহাই।

 কর্ম্মচারী। তোমরা কি করিয়াছিলে, হত্যা করিয়াছিলে কি?  ওসমান। হত্যা না করিলে আর আমাদের জীবনদণ্ডের আদেশ হইবে কেন?

 কর্ম্মচারী। তোমাদিগকে এই স্থানে রাত্রিযাপন করিতে হইবে। ওই কম্বল লইয়া তোমর অনায়াসে তাহার উপর শয়ন করিতে পার।

 এই বলিয়া কর্ম্মচারী সেই হাজত-গৃহ হইতে বাহির হইলেন। প্রহরী সেই গৃহ পুনরায় তালাবদ্ধ করিয়া দিল।

 বাহিরে আনিয়াই কর্ম্মচারী দেখিতে পাইলেন, একটু দুরে তিনজন লোক শয়ন করিয়া আছে। উহাদিগকে দেখিয়া তিনি তাহাদিগের নিকট গমন করিলেন ও কহিলেন, “তোমরা কে এখানে শয়ন করিয়া আছ?”

 হোসেন। আমরা।

 কর্ম্মচারী। আমরা কে?

 হোসেন। আমি ও আমার দুইজন পরিচারক।

 কর্ম্মচারী। তুমি কে?

 হোসেন। আমার নাম হোসেন।

 কর্ম্মচারী। তোমরা কোথায় থাক?

 হোসেন। আমাদিগের বাসস্থান এখানে নহে।

 কর্ম্মচারী। তবে তোমরা এখানে কি নিমিত্ত আসিয়াছ?

 হোসেন। আমরা ওই আসামীদিগের সহিত আসিয়াছি।

 কর্ম্মচারী। কোন্ আসামী?

 হোসেন। যাহারা হাজতে আছেন।

 কর্ম্মচারী। তাই বল না কেন, তোমরা প্রহরী; সেই আসামীদ্বয়কে এখানে আনিয়াছ। .

 হোসেন। না মহাশয়! আমরা প্রহরী নহি। প্রহরীগণ আসামীদ্বয়কে লইয়া আসিয়াছে, আমরা তাহাদিগের সঙ্গে আসিয়াছি মাত্র।

 কর্ম্মচারী। তোমাদিগের সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন?

 হোসেন। সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন আছে বলিয়াই আসিয়াছি। উহার আমাদিগের মনিব।

 কর্ম্মচারী। কি! আসামীদ্বয় তোমাদিগের মনিব?

 হোসেন। হ মহাশয়!

 কর্ম্মচারী। তোমার মনিবদ্বয় চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছে, এরূপ অবস্থায় তাহাদিগের সহিত তোমাদিগকে একত্র গমন করিতে কে আদেশ প্রদান করিয়াছে? কাহার হুকুমে তোমরা তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছ?

 হোসেন। কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশমত আমরা ইহাদিগের সহিত গমন করিতেছি।

 কর্ম্মচারী। কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব আসামীদ্বয়ের সমভিব্যাহারে তোমাদিগকে গমন করিতে যে আদেশ করিয়াছেন, তাহা আসামীদ্বয়ের সমভিব্যাহারী প্রহরীগণ অবগত আছে কি?

 হোসেন। তাহারা অবগত আছে। তদ্ব্যতীত ইহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কোন অর্থের প্রয়োজন হইতেছে, তাহা আমাকে প্রদান করিতে বলিয়া দিয়াছেন, আমিও তাহা দিয়া আসিতেছি।

 কর্ম্মচারী। কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব আসামীদ্বয়ের সহিত গমন করিবার আদেশ দিয়াছেন সত্য; কিন্তু থানার ভিতর রাত্রিকালে শুইয়া থাকিবার নিমিত্ত আদেশ দিয়াছেন কি?

 হোসেন। এরূপ কথা কিছু বিশেষ করিয়া বলেন নাই।

 কর্ম্মচারী। এরূপ অবস্থায় আমি আপনাদিগকে এই স্থানে শয়ন করিয়া থাকিবার নিমিত্ত কোন প্রকারেই আদেশ প্রদান করিতে পারি না।

 হোসেন। আমাদিগের অপরাধ?

 কর্ম্মচারী। তোমাদিগের অপরাধ না থাকিলেও তোমরা যখন খুনী আসামীর সঙ্গের লোক, তখন তোমরা একরূপ অপরাধী।

 হোসেন। স্বীকার করিলাম আমরা অপরাধী। তাহাতেই বা ক্ষতি কি?

 কর্ম্মচারী। তোমাদিগের মনে কি আছে, তাহা তোমরাই বলিতে পার। রাত্রিকালে সকলে শয়ন করিলে যদি কোনরূপে তোমর আসামীদ্বয়কে পলাইবার উপায় করিয়া দেও, তাহা হইলে কি হইবে বল দেখি?

 হোসেন। না মহাশয়! আমরা সেরূপ চেষ্টা কখনই করিব না। এরূপ কথা আমাদিগের মনে এ পর্যন্ত উদয় হয় নাই। আর যদি এখন আমাদিগের সেইরূপ ইচ্ছাই হয়, তাহা হইলে আমাদিগের সে ক্ষমতা কোথায়?

 কর্মচারী। সে যাহা হউক, রাত্রিকালে তোমাদিগকে আমি কোনরূপেই থানার ভিতর থাকিতে দিব না।