চরিতাবলী/সিমসন

উইকিসংকলন থেকে

সিমসন


ইংলণ্ড‌ দেশে লীষ্টরশায়র নামে এক প্রদেশ আছে। ঐ প্রদেশের অন্তঃপাতী মার্কেট বসওয়ার্থনামক গ্রামে সিমসনের জন্ম হয়। সিমসনের পিতা তন্তুবায়ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি, প্রথমতঃ, সিমসনকে এক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে পাঠাইয়া দেন। কিন্তু তিনি বিদ্যার গৌরব করিতেন না, এবং বিদ্যা উপার্জন মনুষ্যের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক বলিয়া তাঁহার বোধ ছিল না। এই নিমিত্ত, পুত্রের যৎকিঞ্চিৎ লেখা পড়া শিক্ষা হইবামাত্র, তিনি তাঁহাকে বিদ্যালয় হইতে ছাড়াইয়া লইলেন, এবং তন্তুবায়ের ব্যবসায়ে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।

 অধিক লেখা পড়া শিখায় কোন লাভ নাই, এই বিবেচনা করিয়া, সিমসনের পিতা তাঁহার লেখা পড়া রহিত করিলেন। কিন্তু সিমসন কিছু দিন বিদ্যালয়ে থাকিয়া, বিদ্যার আস্বাদ পাইয়াছিলেন। সুতরাং, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিতে তাঁহার অত্যন্ত অনুরাগ জন্মিয়াছিল। পিতার ইচ্ছানুসারে, বিদ্যালয় ছাড়িয়া, তন্তবায়ের কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেন বটে, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, আমার ভাগ্যে যাহা ঘটুক, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিব। তিনি কর্ম্ম করিয়া অবসর পাইলেই, পড়িতে বসিতেন; কোন নুতন পুস্তক কোন রূপে পাইলে, ব্যগ্র চিত্তে তাহা পাঠ করিতেন। ফলতঃ, তিনি লেখা পড়ায় এত অনুরক্ত হইয়াছিলেন যে, কেবল অবসরকালে পাঠ করিয়া তাহার তৃপ্তি হইত না। কখন কখন, কর্ম্মের সময় কর্ম্ম না করিয়া, তিনি পুস্তক পাঠ করিতেন।

 পুত্রের লেখা পড়ায় অনুরাগ দেখিলে, পিতা কত সন্তুষ্ট হন, কত ভাল বাসেন, কত উৎসাহ দেন। কিন্তু সিমসনের পিতা অতি আশ্চর্ষ্য লোক ছিলেন। তিনি লেখা পড়ায় পুত্রের এইরূপ অনুরাগ দেখিয়া, অতিশয় বিরক্ত হইলেন। উৎসাহ দেওয়া দূরে থাকুক, যাহাতে সিমসন লেখা পড়া ছাড়েন, সাধ্যানুসারে তাহার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। তিনি লেখা পড়া শিখাকে অলসের কর্ম্ম বিবেচনা করিতেন; সুতরাং লেখা পড়ায় অধিক যত্ন করাতে, তাঁহার মতে, সিমসন অলস ও অকর্ম্মণ্য হইয়া যাইতেছিলেন। এই নিমিত্ত, তিনি তাঁহাকে সর্ব্ব‌দা ভৎর্স‌না করিতেন। সিমসন ভৎর্স‌নায় ক্ষান্ত না হওয়াতে, অবশেষে তাঁহার পিতা অতিশয় কুপিত হইয়া কহিলেন, যদি তুমি ভাল চাও, বই খুলিতে পাইবে না, সারা দিন তাঁতের কর্ম্ম করিতে হইবেক।

 যে উদ্দেশ্যে‌‌ সিমসনের পিতা এই অন্যায় আজ্ঞা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা সফল হয় নাই। সিমসন লেখা পড়ায় যেরূপ অনুরক্ত হইয়াছিলেন, তাহাতে তিনি এক বারে লেখা পড়া ছাড়িয়া দিতে পারিবেন কেন। তিনি, কর্ম্ম করিয়া অবসর পাইলেই, পড়িতে বসিতেন; তাঁহার পিতাও, পড়িতে দেখিলে, অত্যন্ত ক্রোধ করিতেন ও গালাগালি দিতেন। ফলতঃ, এই উপলক্ষে পিতা পুত্রে অত্যন্ত বিরোধ ঘটিয়া উঠিল। অবশেষে, তাঁহার পিতা অতিশয় কুপিত হইয়া কহিলেন, তুমি আমার কথা শুন না, আমি যা বারণ করি তাই কর; তোমায় স্পষ্ট কহিতেছি, যদি তুমি পড়ায় ক্ষান্ত না হও, আমি তোমায় বাড়ীতে থাকিতে দিব না।

 সিমসন, বাটী হইতে বাহির হইয়া যাইবেন তাহাও স্বীকার, তথাপি লেখা পড়া ছাড়িবেন না; সুতরাং পিতার আলয় হইতে বহিস্কৃত হইলেন, এবং নিকটবর্তী কোন গ্রামে গিয়া, এক গৃহস্থের বাটীতে বাসা করিলেন।

 এই স্থানে তিনি, তাঁতের কর্ম্ম করিয়া, আপনার অন্ন বস্ত্র সংগ্রহ করিতেন, এবং কাহার নিকট পুস্তক চাহিয়া পাইলে, তাহাই পাঠ করিতেন। কিছু দিন এই রূপে থাকেন।

 এক দিন, সেই গৃহস্থের বাটীতে এক গণক উপস্থিত হইল। এই ব্যক্তির সহিত আলাপ হওয়াতে, সিমসন তাহার নিকট অঙ্কবিদ্যা ও গণনা শিখিতে আরম্ভ করিলেন। অল্প‌ দিনেই, গণনাতে এমন নিপুণ হইয়া উঠিলেন যে, সেই প্রদেশের সকল লোক তাঁহার নিকট ভাল মন্দ গণাইতে আসিত। এই নূতন ব্যবসায় দ্বারা তাঁহার বিলক্ষণ লাভ হইতে লাগিল। তখন তিনি, তাঁতবোনা ছাড়িয়া দিয়া, গণকের ব্যবসায় অবলম্বন করিলেন। এই সময়ে তিনি বিবাহ করেন।

 এই রূপে, গণকের ব্যবসায় অবলম্বন করাতে, সিমসনের অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ দুর হইল বটে, কিন্তু বিশিষ্টরূপ বিদ্যা উপার্জ‌্জ‌নের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মিল। গণক হইয়া পণ্ডিতসমাজে যাইবার পথ ছিল না। পণ্ডিতেরা গণকদিগকে প্রতারক বলিয়া জানিতেন, সুতরাং, অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন। সিমসন অন্ন বস্ত্রের নিমিত্ত অত্যন্ত ক্লেশ পাইয়াছিলেন, এজন্য, অগত্যা ঐ ব্যবসায় অবলম্বন করেন। এক্ষণে তিনি মনস্থ করিলেন, কিছু কিছু লাভ হয় এমন কোন ব্যবসায় অবলম্বন করিতে পারিলেই, এ জঘন্য ব্যবসায় পরিত্যাগ করিব। অবশেষে, এরূপ এক কাণ্ড‌ উপস্থিত হইল যে, তাঁহাকে এক বারে গণকের ব্যবসায় ছাড়িয়া দিতে ও স্থানত্যাগ করিতে হইল।

 এক দিন, একটি স্ত্রীলোক সিমসনের নিকট কোন বিষয় গণাইতে আসিয়াছিল। ঐ গণনাতে চণ্ড নামাইবার আবশ্যকতা ছিল। সিমসন এই অভিপ্রায়ে এক ব্যক্তিকে, বিকট বেশ ধারণ করাইয়া, নিকটবর্তী খড়ের গাদার পাশে বসাইয়া রাখিয়াছিলেন যে, চণ্ডকে আহ্বা‌ন করিলেই, ঐ ব্যক্তি উপস্থিত হইবেক। গণনা আরম্ভ হইল; সিমসন আর আর অনুষ্ঠান করিয়া, চণ্ডকে আহ্বা‌ন করিবামাত্র, ঐ ব্যক্তি বিকট বেশে উপস্থিত হইল। দেখিতে এমন ভয়ানক হইয়াছিল যে, সেই স্ত্রীলোক অবলোকনমাত্র ভয়ে অভিভূত ও অচেতন হইল। এ উপলক্ষে তাহার উৎকট রোগ জন্মিল, এবং বুদ্ধিভ্রংশ হইয়া গেল। এই ব্যাপার ঘটাতে, সমস্ত লোক সিমসনের উপর এত কুপিত হইল যে, তাঁহাকে ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া পলাইতে হইল।

 এই রূপে, ঐ প্রদেশ হইতে পলায়ন করিয়া, সিমসন তথা হইতে পনর ক্রোশ দূর ডর্বিনগরে গিয়া অবস্থিতি করিলেন; প্রতিজ্ঞা করিলেন, আর কখন চণ্ড নামাইব না। কিছু কিছু উপার্জ্জ‌ন না হইলে, সংসার চলে না, এজন্য পুনরায় তন্তবায়বৃত্তি অবলম্বন করিলেন। তিনি দিনের বেলায় তাঁতের কর্ম্ম করিতেন, রাত্রিতে বালকদিগকে শিক্ষা দিতেন। এই রূপে, দিবারাত্র শ্রম ও কষ্ট করিয়া, যৎ, কিঞ্চিৎ যাহা লাভ হইতে লাগিল, তিনি তদ্দ্বা‌রা কষ্টে আপনার ও পরিবারের ভরণ পোষণ নির্বাহ করিতে লাগিলেন। ফলতঃ, এই সময়ে তিনি অত্যন্ত কষ্টভোগ করিয়াছিলেন। পূর্বে একাকী মাত্র ছিলেন, এক্ষণে বিবাহ করিয়া বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন।

 যাহা হউক, তিনি এই সময়ে অন্ন বস্ত্রের নিমিত্ত যত পরিশ্রম করিতেন, বিদ্যা উপার্জ্জ‌ন বিষয়ে তদধিক পরিশ্রম করিতেন। এই পরিশ্রম দ্বারা, অল্প‌ দিনের মধ্যে, তিনি অঙ্কশাস্ত্রে ও পদার্থবিদ্যায় বিলক্ষণ ব্যুৎপন্ন হইয় উঠিলেন; এবং অঙ্কশাস্ত্রের একখানি গ্রন্থ রচনা করিলেন। ঐ গ্রন্থ মুদ্রিত করেন এমন ক্ষমতা নাই; এজন্য ডর্বি‌ নগরে পরিবার রাখিয়া, ইংলণ্ডের রাজধানী লণ্ডন নগরে গমন করিলেন। এই সময়ে তাঁহার বয়ঃক্রম পঁচিশ ছাব্বিশ বৎসর।

 সিমসন, লণ্ডনে উপস্থিত হইয়া, এক অতি সামান্য বাসা ভাড়া করিলেন; এবং দিননির্বাহের জন্য, দিনে তাঁতের কর্ম্ম ও রাত্রিতে বালকদিগকে অঙ্কবিদ্যা শিখাইতে লাগিলেন। অঙ্কবিদ্যা অতি দুরূহ বিদ্যা। কিন্তু শিক্ষাদানবিষয়ে সিমসনের এমন অসধারণ ক্ষমতা ছিল যে, তিনি বালকদিগকে অতিসহজে ও সুন্দর রূপে বুঝাইয়া দিতেন। এজন্য, ত্বরায় তাঁহাকে সকলে জানিতে পারিল এবং অনেকে তাঁহার আত্মীয় হইল। ফলতঃ, অল্প‌ দিনের মধ্যেই, শিক্ষকতাকর্ম্ম দ্বারা তাঁহার এরূপ লাভ হইতে লাগিল যে, তথায় আপন পরিবার পর্য্যন্ত আনিতে পারিলেন। এই সময়েই, তিনি অঙ্কবিদ্যার গ্রন্থও মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন।  এই গ্রন্থ প্রচার অবধি, তাঁহার সৌভাগ্যের দশা উপস্থিত হইল। কিছু দিন পরে, উলউইচের বিদ্যালয়ে গণিতবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত হইলেন। অতঃপর, উত্তরোত্তর তাঁহার খ্যাতি ও সম্পত্তি বৃদ্ধি হইতে লাগিল। কিন্তু খ্যাতি ও সম্পত্তি লাভ করিয়াও, তিনি পরিশ্রমে বিমুখ হয়েন নাই; অহোরাত্র অধ্যয়নে ও গ্রন্থরচনাতে নিবিষ্ট থাকিতেন। তিনি অঙ্কবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। এই রূপে তিনি খ্যাতি, সম্পত্তি ও সম্মান লাভ করিয়া একান্ন বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করেন।

 আন্তরিক যত্ন থাকিলে, ও পরিশ্রম করিলে, অবশ্যই বিদ্যালাভ হয়। দেখ! সিমসনের পিতা তাঁহাকে দিন কয়েক মাত্র বিদ্যালয়ে রাখিয়া ছাড়াইয়া লইলেন; কিন্তু তিনি লেখা পড়া ছাড়িলেন না; তাঁহার পিতা সর্ব্বদা বারণ ও ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন, তিনি তথাপি লেখা পড়া ছাড়িলেন না; অবশেষে, তাঁহার পিতা ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে বাটী হইতে বাহির করিয়া দিলেন, তিনি তথাপি লেখা পড়া ছাড়িলেন না; তৎপরে কত স্থানে কত কষ্ট পাইলেন, তিনি তথাপি লেখা পড়া ছাড়িলেন না। ফলতঃ, লেখা পড়ায়, আন্তরিক যত্ন ছিল ও অত্যন্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনের মত বিদ্যালাভ করিতে পারিয়াছিলেন, এবং সেই বিদ্যার বলে বিলক্ষণ খ্যাতিলাভ, সম্পত্তিলাভ ও সম্মানলাভ করিয়া গিয়াছেন, এবং চিরস্মরণীয় হইয়াছেন।