চাঁদের পাহাড়/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তিন

 নতুন পদ পেয়ে উৎফুল্ল মনে শঙ্কর যখন ষ্টেশনটাতে এসে নাম্‌ল তখন বেলা তিনটে হবে। ষ্টেশন ঘরটা খুব ছোট। মাটীর প্ল্যাটফর্ম্ম, প্ল্যাটফর্ম্ম আর ষ্টেশন ঘরের আশ পাশ কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ষ্টেশন ঘরের পেছনে তার থাক্‌বার কোয়ার্টার। পায়রার খোপের মতো ছোট। যে ট্রেনখানা তাকে বহন করে এনেছিল, সেখানা কিসুমুর দিকে চলে গেল। শঙ্কর যেন অকুল সমুদ্রে পড়ল। এত নির্জ্জন স্থান সে জীবনে কখনো কল্পনা করেনি।

 এই ষ্টেশনে সে-ই একমাত্র কর্ম্মচারী। একটা কুলী পর্য্যন্ত নেই। সেই কুলী, সে-ই পয়েণ্টস্‌ম্যান, সেই সব।

 এ রকম ব্যবস্থার কারণ হচ্চে এই যে, এসব ষ্টেশন এখনও মোটেই আয়কর নয়। এর অস্তিত্ব এখনও পরীক্ষা সাপেক্ষ। এদের পেছনে রেল-কোম্পানী বেশী খরচ করতে রাজী নয়। একখানি ট্রেন সকালে, একখানি এই গেল— আর সারাদিন রাত ট্রেন নেই।

 সুতরাং তার হাতে প্রচুর অবসর আছে। চার্জ্জ বুঝে নিতে হবে এই যা একটু কাজ। আগের ষ্টেশন মাষ্টারটী গুজ্‌রাটী, বেশ ইংরেজী জানে। সে নিজের হাতে চা করে নিয়ে এল। চার্জ্জ বোঝাবার বেশী কিছু নেই। গুজরাটী ষ্টেশন মাষ্টার তাকে পেয়ে খুব খুসি। ভাবে বোধ হোল সে কথা বলবার সঙ্গী পায়নি অনেকদিন। দু’জনে প্ল্যাটফর্ম্মের এদিক ওদিক পায়চারী করলে।

 শঙ্কর বল্লে — কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা কেন?

 গুজরাটি ভদ্রলোকটী বল্লে — ও কিছু নয়। নির্জ্জন জায়গা — তাই।

 শঙ্করের মনে হোল কি একটা কথা লোকটা গোপন করে গেল। শঙ্করও আর পীড়াপীড়ি করলে না। রাত্রে ভদ্রলোক রুটী গড়ে শঙ্করকে খাবার নিমন্ত্রণ করলে। খেতে বসে হঠাৎ লোকটী চেঁচিয়ে উঠল— ঐ যাঃ, ভুলে গিয়েছি।

 - কি হোল?

 - খাবার জল নেই মোটে, ট্রেণ থেকে নিতে একদম ভুলে গিয়েচি।

 - সে কি? এখানে খাবার জল কোথাও পাওয়া যায় না?

 - কোথাও না। একটা কুয়ো আছে, তার জল বেজায় তেতো আর কসা। সে জলে বাসন মাজা ছাড়া আর কোনো কাজ হয় না। খাবার জল ট্রেণ থেকে দিয়ে যায়।

 বেশ জায়গা বটে। খাবার জল নেই, মানুষ-জন নেই। এখানে ষ্টেশন করেছে কেন তা শঙ্কর বুঝতে পারলে না।

 পরদিন সকালে ভূতপূর্ব্ব ষ্টেশন মাস্টার চলে গেল। শঙ্কর পড়ল একা। নিজের কাজ করে, রাঁধে খায়, ট্রেণের সময় প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে দাঁড়ায়। দুপুরে বই পড়ে কি বড় টেবিলটাতে শুয়ে ঘুমোয়। বিকেলের দিকে ছায়া পড়লে প্ল্যাটফর্ম্মে পায়চারী করে।

 ষ্টেশনের চারিধার ঘিরে ধূ ধূ সীমাহীন প্রান্তর, দীর্ঘ ঘাসের বন, মাঝে ইউকা, বাবলা গাছ— দূরে পাহাড়ের সারি সারা চক্রবাল জুড়ে। ভারি সুন্দর দৃশ্য।

 গুজরাটী লোকটী ওকে বারণ করে গিয়েছিল — একা যেন এই সব মাঠে সে না বেড়াতে বার হয়।

 শঙ্কর বলেছিল—কেন?

 সে প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর গুজরাটী ভদ্রলোকটীর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার উত্তর অন্য দিক থেকে সে রাত্রেই মিলল।

 সকাল রাতেই আহারাদি সেরে শঙ্কর ষ্টেশন ঘরে বাতি জ্বালিয়ে বসে ডায়েরী লিখ্চে— ষ্টেশনঘরেই সে শোবে। সামনের কাঁচ-বসানো দরজাটী বন্ধ আছে-কিন্তু আগল দেওয়া নেই, কিসের শব্দ শুনে সে দরজার দিকে চেয়ে দেখে — দরজার ঠিক বাইরে কাঁচে নাক লাগিয়ে প্রকাণ্ড সিংহ! শঙ্কর কাঠের মতো বসে রইল। দরজা একটু জোর করে ঠেললেই খুলে যাবে। সেও সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। টেবিলের ওপর কেবল কাঠের রুলটা মাত্র আছে।

 সিংহটা কিন্তু কৌতূহলের সঙ্গে শঙ্কর ও টেবিলের কেরোসিন বাতিটার দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। খুব বেশীক্ষণ ছিল না, হয়তো মিনিট দুই — কিন্তু শঙ্করের মনে হোল সে আর সিংহটা কতকাল ধরে পরস্পরে পরস্পরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সিংহ ধীরে ধীরে অনাসক্ত ভাবে দরজা থেকে সরে গেল। শঙ্কর হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে পেল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজার আগলটা তুলে দিলে।

 এতক্ষণে সে বুঝতে পারলে ষ্টেশনের চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া কেন। কিন্তু শঙ্কর একটু ভুল করেছিল — সে আংশিক ভাবে বুঝেছিল মাত্র, বাকী উত্তরটা পেতে দুএকদিন বিলম্ব ছিল।

 সেটা এল অন্য দিক থেকে।

 পরদিন সকালের ট্রেণের গার্ডকে সে রাত্রের ঘটনাটা বল্লে। গার্ড লোকটী ভালো, সব শুনে বল্লে — এসব অঞ্চলে সর্বত্রই এমন অবস্থা। এখান থেকে বারো মাইল দূরে আর একটা তোমার মত ছোট ষ্টেশন আছে—সেখানেও এই দশা। এখানে তো যে কাণ্ড —

 সে কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ কথা বন্ধ করে ট্রেণে উঠে পড়ল। যাবার সময় চলন্ত ট্রে্ণে থেকে বলে গেল,বেশ সাবধানে থেকো সর্ব্বদা -

 শঙ্কর চিন্তিত হয়ে পড়ল—এরা কি কথাটা চাপা দিতে চায়? সিংহ ছাড়া আরও কিছু আছে নাকি? যাহোক্, সেদিন থেকে শঙ্কর প্ল্যাটফর্ম্মে ষ্টেশনঘরের সামনে রোজ আগুন জ্বালিয়ে রাখে। সন্ধ্যার আগেই দরজা বন্ধ করে ষ্টেশন ঘরে ঢোকে— অনেক রাত পর্য্যন্ত বসে পড়াশুনো করে বা ডায়েরী লেখে। রাত্রের অভিজ্ঞতা অদ্ভুত। বিস্তৃত প্রান্তরে ঘন অন্ধকার নামে, প্ল্যাটফর্ম্মের ইউকা গাছটার ডালপালার মধ্যে দিয়ে রাত্রির বাতাস বেধে কেমন একটা শব্দ হয়, মাঠের মধ্যে প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে, এক একদিন গভীর রাতে দূরে কোথাও সিংহের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়— অদ্ভুত জীবন!

 ঠিক এই জীবনই সে চেয়েছিল। এ তার রক্তে আছে। এই জনহীন প্রান্তর, এই রহস্যময়ী রাত্রি, অচেনা নক্ষত্রে ভরা আকাশ, এই বিপদের আশঙ্কা— এই তো জীবন! নিরাপদ শান্ত জীবন নিরীহ কেরানির হতে পারে— তার নয়।

 সেদিন বিকেলের ট্রেণ রওনা করে দিয়ে সে নিজের কোয়ার্টারের রান্নাঘরে ঢুকতে যাচ্চে এমন সময়ে খুঁটির গায়ে কি একটা দেখে সে তিন হাত লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল— প্রকাণ্ড একটা হলদে খড়িশ গোখুরা তাকে দেখে ফণা উদ্যত করে খুঁটি থেকে প্রায় এক হাত বাইরে মুখ বাড়িয়েছে! আর দু’সেকেণ্ড পরে যদি শঙ্করের চোখ সেদিকে পড়ত— তাহলে— না, এখন সাপটাকে মারবার কি করা যায়? কিন্তু সাপটা পরমুহূর্ত্তে খুঁটি বেয়ে ওপোরে খড়ের চালের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। বেশ কাণ্ড বটে। ঐ ঘরে গিয়ে শঙ্করকে এখন ভাত রাঁধতে বসতে হবে। এ সিংহ নয় যে দরজা বন্ধ করে আগুন জ্বেলে রাখবে। খানিকটা ইতস্ততঃ করে শঙ্কর অগত্যা রান্নাঘরে ঢুকল এবং কোনোরকমে তাড়াতাড়ি রান্না সেরে সন্ধ্যা হবার আগেই খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে সেখান থেকে বেরিয়ে ষ্টেশনঘরে এল। কিন্তু ষ্টেশনঘরেই বা বিশ্বাস কি? সাপ কখন কোন ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকবে, তাকে কি আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে?

 পরদিন সকালের ট্রেণে গার্ডের গাড়ি থেকে একটি নতুন কুলী তার রসদের বস্তা নামিয়ে দিতে এল। সপ্তাহে দু’দিন মোম্বাসা থেকে চাল আর আলু রেল কোম্পানী এইসব নির্জ্জন ষ্টেশনের কর্ম্মচারীদের পাঠিয়ে দেয়—মাসিক বেতন থেকে এর দাম কেটে নেওয়া হয়।

 যে কুলীটা রসদের বস্তা নামিয়ে দিতে এল সে ভারতীয়, গুজরাট অঞ্চলে বাড়ি। বস্তাটা নামিয়ে সে কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে চাইলে শঙ্করের দিকে, এবং পাছে শঙ্কর তাকে কিছু জিগ্যেস করে, এই ভয়েই যেন তাড়াতাড়ি গাড়ীতে গিয়ে উঠে পড়ল।

 কুলীর সে দৃষ্টি শঙ্করের চোখ এড়ায়নি। কী রহস্য জড়িত আছে যেন এই জায়গাটার সঙ্গে, কেউ তা ওর কাছে প্রকাশ করতে চায় না। প্রকাশ করা যেন বারণ আছে। ব্যাপার কী?

 দিন দুই পরে ট্রেণ পাশ করে সে নিজের কোয়ার্টারে ঢুকতে যাচ্ছে—আর একটু হোলে সাপের ঘাড়ে পা দিয়েছিল আর কি। সেই খড়িশ গোখুরা সাপ। পূর্ব্বদৃষ্ট সাপটাও হোতে পারে, নতুন একটা যে নয় তারও কোনো প্রমাণ নেই।

 শঙ্কর সেই দিন ষ্টেশনঘর, নিজের কোয়ার্টার ও চারিধারের জমি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলে। সারা জায়গায় মাটীতে বড় বড় গর্ত্ত, কোয়ার্টারের উঠোনে, রান্নাঘরের দেওয়ালে, কাঁচা প্ল্যাটফর্ম্মের মাঝে মাঝে সর্ব্বত্র গর্ত্ত ও ফাটল আর ইঁদুরের মাটী। তবুও সে কিছু বুঝতে পারলে না।

 একদিন সে ষ্টেশনঘরে ঘুমিয়ে আছে, রাত অনেক। ঘর অন্ধকার, হঠাৎ শঙ্করের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের বাইরে আর একটা কোন্‌ ইন্দ্রিয় যেন মুহূর্ত্তের জন্যে জাগরিত হয়ে উঠে তাকে জানিয়ে দিলে সে ভয়ানক বিপদে পড়বে। ঘোর অন্ধকার, শঙ্করের সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠল। টর্চ্চটা হাতড়ে পাওয়া যায় না কেন? অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা কিসের অস্পষ্ট শব্দ হচ্চে ঘরের মধ্যে। হঠাৎ টর্চ্চটা তার হাতে ঠেকল, এবং কলের পুতুলের মতো সে সামনের দিকে ঘুরিয়ে টর্চ্চটা জ্বাললে।

 সঙ্গে সঙ্গেই সে ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে টর্চ্চটা ধরে বিছানার ওপরই বসে রইল।

 দেওয়াল ও তার বিছানার মাঝামাঝি জায়গায় মাথা উঁচু করে তুলে ও টর্চ্চের আলো পড়ার দরুন সাময়িক ভাবে আলো-আঁধারি লেগে থ' খেয়ে আছে আফ্রিকার ক্রুর ও হিংস্রতম সর্প‌— কালো মাম্বা! ঘরের মেঝে থেকে সাপটা প্রায় আড়াই হাত উঁচু হয়ে উঠেচে— সেটা এমন কিছু আশ্চর্য নয় যখন ব্ল্যাক মাম্বা সাধারণতঃ মানুষকে তাড়া করে তার ঘাড়ে ছোবল মারে! ব্ল্যাক মাম্বার হাত থেকে রেহাই পাওয়া এক প্রকার পুনর্জ্জন্ম তাও শঙ্কর শুনেছে।

 শঙ্করের একটা গুন বাল্যকাল থেকেই আছে, বিপদে তার সহজে বুদ্ধিভ্রংশ হয় না— আর তার স্নায়ুমণ্ডলীর উপর সে ঘোর বিপদেও কর্ত্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে।

 শঙ্কর বুঝলে হাত যদি তার একটু কেঁপে যায়— তবে যে মুহূর্ত্তে সাপটার চোখ থেকে আলো সরে যাবে— সেই মুহূর্ত্তে ওর আলো— আঁধারি কেটে যাবে এবং তখুনি সে করবে আক্রমণ।  সে বুঝলে তার আয়ু নির্ভর করচে এখন দৃঢ় ও অকম্পিত হাতে টর্চ্চটা সাপের চোখের দিকে ধরে থাকার ওপর। যতক্ষণ সে এরকম ধরে থাকতে পারবে ততক্ষণ সে নিরাপদ। কিন্তু যদি টর্চ্চটা একটু এদিক ওদিক সরে যায়…?

 শঙ্কর টর্চ্চ ধরেই রইল। সাপের চোখ দুটো জ্বলচে যেন দুটো আলোর দানার মতো। কি ভীষণ শক্তি ও রাগ প্রকাশ পাচ্চে চাবুকের মত খাড়া উদ্যত তার কালো, মিশমিশে, সরু দেহটাতে।....

 শঙ্কর ভুলে গেছে চারপাশের সব আসবাবপত্র, আফ্রিকা দেশটা, তার রেলের চাকুরী, মোম্বাসা থেকে কিসুমু লাইনটা, তার দেশ, তার বাবা-মা— সমস্ত জগৎটা শূন্য হয়ে গিয়ে সামনের ঐ দুটো জ্বলজ্বলে আলোর দানায় পরিণত হয়েচে… তার বাইরে সব শূন্য! অন্ধকার! মৃত্যুর মতো শূন্য, প্রলয়ের পরের বিশ্বের মতো অন্ধকার!

 সত্য কেবল এই মহাহিংস্র উদ্যত-ফণা সর্প, যেটা প্রত্যেক ছোবলে ১৫০০ মিলিগ্রাম তীব্র বিষ ক্ষতস্থানে ঢুকিয়ে দিতে পারে এবং দেবার জন্যে ওৎ পেতে রয়েছে…

 শঙ্করের হাত ঝিমঝিম করচে, আঙুল অবশ হয়ে আসচে, কনুই থেকে বগল পর্য্যন্ত হাতের যেন সাড় নেই। কতক্ষণ সে আর টর্চ্চ ধরে থাকবে? আলোর দানা দুটো হয়তো সাপের চোখ নয়… জোনাকী পোকা কিংবা নক্ষত্র… কিংবা…  টর্চ্চের ব্যাটারির তেজ কমে আসচে না? সাদা আলো যেন হলদে ও নিস্তেজ হয়ে আসচে না? … কিন্তু জোনাকী পোকা কিংবা নক্ষত্র দুটো তেমনি জ্বলচে। রাত না দিন? ভোর হবে না সন্ধ্যা হবে?

 শঙ্কর নিজেকে সামলে নিলে। ওই চোখ দুটোর জ্বালাময়ী দৃষ্টি তাকে যেন মোহগ্রস্ত করে তুলচে। সে সজাগ থাকবে। এ তেপান্তরের মাঠে চেঁচালেও কেউ কোথাও নেই সে জানে— তার নিজের স্নায়ুমণ্ডলীর দৃঢ়তার ওপর নির্ভর করছে তার জীবন। কিন্তু সে পারচে না যে, হাত যেন টনটন করে অবশ হয়ে আসচে, আর কতক্ষণ সে টর্চ্চ ধরে থাকবে? সাপে না হয় ছোবল দিক কিন্তু হাতখানা একটু নামিয়ে সে আরাম বোধ করবে এখন।

 তারপরেই ঘড়িতে টং টং করে তিনটে বাজল। ঠিক রাত তিনটে পর্য্যন্তই বোধহয় শঙ্করের আয়ু ছিল, কারণ তিনটে বাজবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত কেঁপে উঠে নড়ে গেল— সামনের আলোর দানা দুটো গেল নিভে। কিন্তু সাপ কই? তাড়া করে এল না কেন?

 পরক্ষণেই শঙ্কর বুঝতে পারলে সাপটাও সাময়িক মোহগ্রস্ত হয়েছে তার মতো। এই অবসর! বিদ্যুতের চেয়েও বেগে সে টেবিল থেকে একলাফ মেরে অন্ধকারের মধ্যে দরজার আগল খুলে ফেলে ঘরের বাইরে গিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলে।  সকালের ট্রেণ এল। শঙ্কর বাকী রাতটা প্ল্যাটফর্ম্মেই কাটিয়েছে। ট্রেণের গার্ডকে বল্লে সব ব্যাপার। গার্ড বল্লে— চলো দেখি ষ্টেশনঘরের মধ্যে। ঘরের মধ্যে কোথাও সাপের চিহ্নও পাওয়া গেল না। গার্ড লোকটা ভালো, বল্লে— বলি তবে শোনো। খুব বেঁচে গিয়েচ কাল রাত্রে। এতদিন কথাটা তোমায় বলিনি, পাছে ভয় পাও। তোমার আগে যিনি ষ্টেশনমাস্টার এখানে ছিলেন— তিনিও সাপের উপদ্রবেই এখান থেকে পালান। তাঁর আগে দু’জন ষ্টেশনমাস্টার এই স্টেশনের কোয়ার্টারে সাপের কামড়ে মরেচে। আফ্রিকার ব্ল্যাক মাম্বা যেখানে থাকে, তার ত্রিসীমানায় লোক আসে না। বন্ধুভাবে কথাটা বল্লাম, ওপরওয়ালাদের বলো না যেন যে আমার কাছ থেকে এ কথা শুনেচ। ট্রান্সফারের দরখাস্ত কর।

 শঙ্কর বল্লে— দরখাস্তের উত্তর আসতেও তো দেরী হবে, তুমি একটা উপকার করো। আমি এখানে একেবারে নিরস্ত্র, আমাকে একটা বন্দুক কি রিভলবার যাবার পথে দিয়ে যাও। আর কিছু কার্ব্বলিক এ্যাসিড। ফিরবার পথেই কার্ব্বলিক এ্যাসিডটা আমায় দিয়ে যেও।

 ট্রেণ থেকে সে একটা কুলীকে নামিয়ে নিলে এবং দু’জনে মিলে সারাদিন সর্ব্বত্র গর্ত্ত বুঁজিয়ে বেড়ালে। পরীক্ষা করে দেখে মনে হোল কাল রাত্রে ষ্টেশনঘরের পশ্চিমের দেওয়ালের কোণে একটা গর্ত্ত থেকে সাপটা বেরিয়েছিল। গর্ত্তগুলো ইঁদুরের, বাইরের সাপ দিনমানে ইঁদুর খাওয়ার লোভে গর্ত্তে ঢুকেছিল হয়তো। গর্ত্তটা বেশ ভালো করে বুজিয়ে দিলে। ডাউন ট্রেণের গার্ডের কাছ থেকে এক বোতল কার্ব্বলিক এ্যাসিড পাওয়া গেল—ঘরের সর্ব্বত্র ও আশেপাশে সে এ্যাসিড ছড়িয়ে দিলে। কুলীটা তাকে একটা বড় লাঠি দিয়ে গেল। দু-তিনদিনের মধ্যেই রেল কোম্পানী থেকে ওকে একটা বন্দুক দিলে।