চিত্ত-মুকুর

উইকিসংকলন থেকে
চিত্ত-মুকুর

চিত্ত-মুকর।

পদ্য গ্রন্থ।

কলিকাতা

৪৪ নং, বেণিয়াটোলা লেন

রায়যন্ত্রে

শ্রীআশুতোষ ঘোষাল কর্ত্তৃক মুদ্রিত।

সন ১২৮৫।

সূচী পত্র।


বিষয়
পৃষ্ঠাঙ্ক।
২৩
৩০
   
৩৪
৪১
৪৪
৪৮
৬১
৬৯
৭৫
৮০
৮৭
৯১
৯৮
১১১
১১৫
১২১
১২৬
১২৮
১৩৩
১৩৬
১৩৮
১৪১



উৎসর্গ-পত্র।

পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত বাবু হেমচন্দ্র

বন্দ্যোপাধ্যায় অগ্রজ মহাশয়।

আর্য্য!

 সংসারে যদি কাহাকেও দেবতুল্য ভাবিয়া থাকি তবে সে আপনি—যদি সদ্‌গুনের পক্ষপাতী হইয়া কাহাকেও অবনত হৃদয়ে পূজা করিতে ইচ্ছা হইয়া থাকে সেও আপনি—উন্নত প্রকৃতি দেখিয়া যদি কাহারো পদাবনত হইতে ইচ্ছা হইয়া থাকে সেও আপনি। প্রথমত,অগ্রজ বলিয়া চিত্ত-মুকুর আপনারই অর্চ্চনার উপকরণ; দ্বিতীয়ত, যে মহাত্মা এত সদগুণে বিভূষিত তিনিও উপাস্য। ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে চিত্ত-মুকুর আপনাকেই অর্পণ করিলাম; কনিষ্ঠ বলিয়া আমার প্রতি যেরূপ স্নেহদৃষ্টি আছে চিত্তমুকুরের প্রতি সেই স্নেহদৃষ্টি থাকিলে আর একটী নূতন সুখে সুখী হইব।

আপনার স্নেহের
শ্রীঃ—

বিজ্ঞাপন।

 সকল গ্রন্থেরি এক এক উদ্দেশ্য আছে; হয় শিক্ষা, নয় আমোদ। কাব্যের যে উদ্দেশ্য শিক্ষা সে অতি মহৎ সন্দেহ নাই, কিন্তু কাব্য মাত্রেই যে শিক্ষক হইতে হইবে তাহাও নহে অনেকানেক প্রসিদ্ধ কাব্যের উদ্দেশ্য আমোদ। যাঁহারা শিক্ষকতার জন্য কাব্য লিখেন যশঃ তাঁহাদের গৌন উদ্দেশ্য যাহারা সাধারণ বা, নিজের আমোদের জন্য কাব্য লিথেন আমোদই তাঁহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। চিত্তমুকুর লেখকের ন্যায় সামান্য ব্যক্তির পক্ষে শিক্ষকতা বা যশ-প্রত্যাশা দুই আশাতীত। চিত্তমকুরের উদ্দেশ্য ইহার নামেই স্পষ্ট প্রকটিত রহিয়াছে। কবিতা রচনায় গ্রন্থকারের আশৈশব আমোদ বাল্যবস্থা হইতেই বনের ফুল, জলের ঢেউ, আকাশের দামিনী ইত্যাদি বস্তু দেখিয়া গ্রন্থকারের হৃদয় নাচিয়া উঠিত এবং অবসর পাইলেই সেই হৃদয় উচ্ছাশ গুলি, সুধু তাহাই কেন স্নেহ, আশা, নৈরাশ্য, ক্ষোভ ও ভয় প্রভৃতি হৃদয়ের কোমল প্রবৃত্তি গুলি কবিতায় প্রকটিত করিয়া নিজেই আমোদ অনুভব করিত।

 চিত্তমুকুরের অধিকাংশ কবিতাই হয় বন্ধুবর্গের অনুরোধে নয় গ্রন্থকারের নিজের আমোদের জন্য লিখিত হয়; এবং ইহার অনেক গুলি কবিতা বন্ধুবর্গের অনুরোধে ইতি পূর্ব্বে এডুকেশন গেজেট ও বান্ধব পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। পুস্তকাকারে প্রকাশ করিবার উদ্দেশ্যে ইহার কোন কবিতাই লিখিত হয় নাই। বন্ধুবর্গের প্রশংসাবাদে—এ প্রশংসা তাঁহাদের স্নেহবশতই হউক কিম্বা উৎসাহ দিবার জন্যই হউক—গ্রন্থকার সাধারণ সমীপে কবিতা গুলি প্রকাশ করিতে সাহসী হইল। যখন সাধারণের নিকট গ্রন্থকার বলিয়া পরিচয় দিতে হইতেছে তখন যশের কথাটি সর্ব্বাগ্রে স্মরণ করিতে হইবে। কিন্তু বঙ্গীয় কবির যশ বড় দুর্লভ, বিশেষ যে সাহিত্যক্ষেত্রে ভারতচন্দ্র ও মধু সুদন দত্ত প্রভৃতি মহাত্মার কবিতার কুহক ছড়াইয়া গিয়াছেন, সে সাহিত্য ক্ষেত্রে এ গ্রন্থকারের যশের আশা কতটুকু! পাছে সমালোচক দিগের লেখনি প্রহারে চিরকলঙ্কিত হইতে হয় গ্রন্থকারের সেইটিই প্রধান ভয়, কিন্তু লোকে যাহাই বলুক চিত্তের স্বাভাবিক গতি দুর্দ্দমনীয়া।

 কেহ যদি গ্রন্থকারকে জিজ্ঞাসা করেন যে “পাঠক দিগকে এ নরক যন্ত্রনা দেওয়া কেন,” গ্রন্থকার তাঁহাকে এই উত্তর করিবে যে ইহা তাহার অনিচ্ছাকৃত অপরাধ। চিত্রমুকুর সম্বন্ধে গ্রন্থকারের আর অধিক বক্তব্য নাই কেবল এই পর্য্যন্ত যে চিত্তমুকুর তাহার প্রথম উদ্যম।

 উপসংহার কালে শ্রদ্ধাস্পদ বান্ধব সম্পাদক বাবু কালী প্রসন্ন ঘোষ ও প্রসিদ্ধ কবি বাবু নবীন চন্দ্র সেনকে ধন্যবাদ না দিলে অকৃতজ্ঞ হইতে হয়। চিত্তমুকুরের যদি কিছু সম্পত্তি থাকে তবে তাহা তাঁহাদেরই উৎসাহে ইহার অধিক আর বলিবার নাই।

গ্রন্থকারস্য
ঢাকা 
বান্ধব কার্যালয় 
২০ জুলাই ১৮৭৬।

প্রিয় * * বাবু!—

 যদি অপাত্রে অনুগ্রহ করিয়া পরিক্লান্ত হন, তবে আমায় আর স্মরণ করিবেন না; আর যদি এই অহেতুকী শ্রদ্ধাই আপনার প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি হয়, তবে আশা করিতে পারি চির দিনই এইরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন করবেন।

 আপনার অকালকোকিল আমার নিকট রহিয়াছে। আপনাকে বলা বাহুল্য যে আপনার লেখায় যেমন একটু তান আছে, তাহা আমি বড় ভাল বাসি। আপনি একবার কোন ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বন পূর্ব্বক বান্ধবে একটি দীর্ঘ কবিতা দিবেন। ঐ রূপ কবিতা না হইলে আপনার সমুচিত বিকাশ হইবে না। অকালকোকিলের মত আরও দুটি কবিতা আমি উপহার পাইয়াছি। তন্মধ্যে একটি জঘন্য আর একটি উৎকৃষ্ট, কিন্তু আপনার অকাল কোকিলের নিকট হীনপ্রভ হইবে। যখন মুদ্রিত করি, তখন দুইটিই একসঙ্গে মুদ্রিত করিব কি না ভাবিতেছি।

 আপনি যে কয়টি নূতন গ্রাহকের নাম দিয়াছেন তাহাদিগের নিকট বান্ধব পাঠান হইয়াছে।

 আপনার শারীরিক মঙ্গল লিখিয়া সুখী করিবেন।

একান্ত আপনার
শ্রীকালীপ্রসন্ন ঘোষ।
পুরী—সমুদ্র তীর
১৮ই আগষ্ট ১৮৭৮।

প্রিয়***

 বন্ধুদেশে গ্রন্থকারের অভাব থাকুক আর না থাকুক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে সমালোচকের অভাব নাই। বঙ্গদর্শনের ভূতপূর্ব্বে ক্ষণ জন্মা সম্পাদক হইতে ঐ “আড‍্ডা বিহারিণী পত্রিকার” সম্পাদক পর্যন্ত সকলই সমালোচক। অতএব তুমি যদি তোমার কবিতাগুলি প্রকাশ করিবার সঙ্কল্প করিয়া থাক তবে প্রকাশের পূর্ব্বে আমার কি অন্য কাহারো মত জানিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। বিশেষতঃ তোমার কবিতাগুলিতে “যুক্তাক্ষর ট ঠ ড ঢ ণ র য ইত্যাদি অক্ষরের অধিক প্রণয়” আছে কি না আমার স্মরণ নাই। সে দিন মাত্র একজন সমালোচক অনুগ্রহ করিয়া আমাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন যে “সুকবিজনোচিত রচনাতে এরূপ প্রণয় অমার্জনীয়।” এমত অবস্থায় তোমার কবিতা সম্বন্ধে মত প্রকাশ করিয়া কেন আমি তীব্র কটাক্ষ ভাজন হইতে যাইব?

 তবে একটা কথা বোধ হয় বলিতে পারি। তোমার যে সকল কবিতা আমি তোমার মুখে শুনিয়াছি—যুক্তাক্ষর থাকিলে ও তাহাদের কবিত্বে এবং লালিত্বে আমি মোহিত হইয়াছিলাম। আমার বোধ হইয়াছিল যেন কবিতা স্রোতের ন্যায় বহিয়া গিয়াছে, কোন স্থানে কষ্ট কল্পনার চিহ্ন নাই, বরং স্মরণ হয় স্থানে স্থানে কবিত্ব শক্তির সুন্দর বিকাশ দেখিয়াছিলাম। বড় সুখের হইত যদি তোমার সুললিত আবৃত্তি শক্তি এ কবিতার সঙ্গে প্রকাশ করিতে পারিতে।

তোমার বন্ধু তাভিলাষী,
নবীন।
প্রিয় * * * বাবু।

 আপনার পত্র পাইয়া পরম আপ্যায়িত হইলাম। পত্র মধ্যে ** মূল্যের যে টিকিট ছিল, তাহা বান্ধব আফিশে জমা করিয়া নিয়াছে।

 আপনি শিবজীর বিষয় আপাততঃ লিখিবেন না। সকলেই শিবজীর নাম গাহিয়া থাকেন; সুতরাং শিবজীর নামে নূতনত্ব থাকবে না। যদি আমার পরামর্শ গ্রহণ করিয়া করেন, তবে পৃথুরাজের শ্বশৃপতি বীরচূড়ামণি সমরশায়ীকে অবলম্বন করিয়া সুদীর্ঘ একটা কবিতা লিখুন; দুই তিন বারে প্রকাশ করিব। সমরশায়ীর বিষয় টড্ সাহেবের রাজস্থানে সবিস্তার পাইবেন। অথবা আমার বলা অধিকন্তু কারণ এ সকল কথা আমি অপেক্ষা আপনারা অবশ্যই অধিক জানেন। সমরশায়ী স্বদেশের হিতকামনা ঘোরতর সমরব্রত উদযাপন করিয়া কাগ‍্নার নদীর তটে সমৱশয্যায় শয়ান হন। যদি আপনি লিখেন তবে এই একটা কবিতাতেই যশঃস্বী হইবেন; পৃথুরাজের ভগিনীর সহিত সমরশায়ীর প্রেম, সমরসাহী স্বদেশবাৎসল্য, উগ্রতেজ রণনৈপুণ্য ইত্যাদি কথা ঐতিগসিকের লেখনীতেই কবিতার কমলীয় কান্তি লাভ করিয়াছে;—কবির তুলিকায় উহা কিরূপ চিত্রিত হইবে তাহা স্মরণ করিতেই আমার হৃদয় উল্লাসিত হইয়া উঠে।

 বান্ধবের প্রতি আপনার এবং সাহিত্য সমাজের যে সস্নেহ দৃষ্টি রহিয়াছে, ইহা আমার আশার অতীত। ভরসা করি এ অনুগ্রহের স্রোতে শীঘ্রই ভাটা লাগিবে না।

 আমি আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে যে লিখি না সে লজ্জায় শিষ্টাচারের অনুরোধে রোজ মিথ্যা রোজ বলা যায় না। আর “ভাল আছ” বলিয়া লিখিতেও আমার অধিকারনাই। এই তিন চারমাস যাবৎ আমি বড়ই কাহিল আছি আজ একটুকু কালি একটুকু এই অবস্থা।  আপনি কেমন আছেন, লিখিয়া সুখি করিবেন। কোন দিন আপনি যখন সুকবি বলিয়া বঙ্গ সমাজে সমাদৃত হইবেন যশের ঢক্কা একদিনে বাজে না,—তখন বিলুপ্ত নামা বান্ধবকে শ্মরণ হইবে কি?

একান্ত আপনার
শ্রীকালীপ্রসন্ন ঘোষ।

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।