চিত্ত-মুকুর/একখানি চিত্র-পট দর্শনে

উইকিসংকলন থেকে

এক খানি চিত্র-পট দর্শনে

অবিকল মূর্ত্তিখানি! সুন্দর অঙ্কিত!
সৌন্দর্য্য সকলি তার হয়েছে চিত্রিত।
এমনি সুন্দর বটে তাহার বদন!
এমনি বিস্ত‌ৃত বটে তাহার নয়ন!
এমনি গম্ভীর বটে প্রকৃতি তাহার!
তাহার ঈষৎ হাঁসি এমনি সুধার!
গ্রন্থ হাতে রূপ তার এমনি সুন্দর!
ঠিক যেন সেই এই, ধন্য চিত্রকর!
টানা নয়ন দুটি অর্দ্ধ নিমিলিত,
বঙ্কিম নিবিড় কেশে ভ্র‌ূযুগ শোভিত।

অনতি-প্রশস্ত ভাল, চম্পক উজ্জ্বল,
কালিম তরঙ্গে তায় শোভিছে কুন্তল।
সূক্ষশ্বেত রেখা সিঁথি, অতি সাবধানে
বিভাগি সুমঞ্জ‌ু, কেশ অঙ্কিত যতনে।
সুবর্ণ মাকড়ি কর্ণে হীরক উজ্জ্বল,
পড়িয়ে নিটোল গণ্ডে চমকে চঞ্চল।
সুন্দর নাসিকারন্ধ্রে নোলক অচল,
ওষ্ঠাধর সূক্ষ্ম রেখা প্রেভেদে কেবল।
সেই অঙ্গ সে বরণ, সেই ভাব সে গঠন,
সজীব প্রতিমা যেন সম্মুখে আমার।
চিত্রপটে সব রয় কেবল চেতন নয়
চিত্রণের এ অভাব বড় অত্যাচার!


দেখিব না—দেখি যদি সুধুই দেখিব;
এবার মানস মম টলিতে না দিব।
দগ্ধ করি চিত্রপট জ্বলন্ত অনলে,
বিসর্জ্জিব স্মৃতিচিহ্ন বিস্মৃতির জলে।
ভাবিব না!—চিত্ত বড় অবস এখন,
ভাবিলে তাহায় সুধু হইবে স্মরণ।
দিবারাত্রি অন্য মনে রব জাগরণে,
নিদ্রায় তাহারে পাছে নিরখি স্বপনে।

কাব্য উপাখ্যান পুন পড়িব না আর;
পাতায় পাতায় প্রেম জাগিবে তাহার।
সকলি হইল—কিন্তু প্রাণের ভিতরে—
আশার সমুদ্র বল নিবারি কি করে!
নবীন বয়সে হয় তাপস কজন!
আপনার বশ বল কজনার মন!
যেখানে আঁখির তৃপ্তি, বাসনা সেথায়,
যেখানে বাসনা, আঁখি অতৃপ্ত সেথায়।
দুই যন্ত্রণার—তবু প্রত্যেক অন্তরে
স্বভাবের হেন ভাব কিহেতু বিহরে?
যেখানে গভীর ব্যথা, কেন চিত্ত ধায় সেথা,
দুর্লভ রতনে কেন এত প্রলোভন।
যেখানে নৈরাশ্য যত, সেখানে বাসনা তত,
মানবের হেন মোহ কিসের কারণ?


সংসারের পরিবর্ত্ত দেখি সর্ব্ব ঠাঁই,
হতাশ হৃদয়ে কেন পরিবর্ত্ত নাই!
শুষ্ক তরু-মূলে কর সলিল সিঞ্চন,
শাখায় শাখায় তার ধরিবে প্রসূন।
অতি জীর্ণ অট্টালিকা করহ সংস্কার,
তাহাও মোহিনী মূর্ত্তি ধরিবে আবার।

শুষ্ক সরসীর পঙ্ক করহ উদ্ধার,
কুমুদ কমল তায় ফুটিবে আবার।
মুমূর্ষে করাও যদি ঔষধ সেবন,
কালেতে সবল-দেহ হইবে সে পুন।
সংসারে যা কিছু ভাঙ্গা জোড়া যদি দাও,
আবার পূর্ব্বের মত দেখিবারে পাও।
ভগ্ন হৃদয়ের কেন পরিবর্ত্ত নাই,
যা গিয়াছে তাহা কেন ফিরিয়া না পাই।
চাহি না পার্থিব সুখ—চাহি না প্রণয়,
চাহি শুধু আমার সে প্রশান্ত হৃদয়।
হারায়েছি যেই মন, নাহি চাহি আর,
ফিরে যদি পাই সেই সন্তোষ আমার।
এ যে চিত্ত মরুময়, নিশ্বাস ঝটিকা বয়,
পলকে পলকে হয় বিষাদে চঞ্চল।
মুদিয়াছি দু নয়ন, তবু হয় উদ্দীপন,
স্মৃতির শলাকা পর্শে প্রাণের অনল।



আর একবার চিত্র করি দশন—
বড়ই দুর্ব্বল কিন্তু হতাশের মন।

বিষম সংযমে চিত্ত করিনু অটল,
নিরখিলে যদি হয় আবার চঞ্চল!
হৃদয়—এ বাসনা কর বিসর্জ্জন,
কাষ নাই তুষানল করি উদ্দীপন।
পারি না যে—একবার—সুধু একবার!
এই বার দেখি চিত্র দেখিব না আর।
নয়ন জন্মের মত কর দরশন,
হৃদয় জম্মের মত কর আকিঞ্চন।
দুর্লভ রতন বলি ভাবিতে যাহারে,
নিভৃতে আলেখ্য তার ধর বক্ষে করে।
মিটাও মনের সাধ করিয়া চুম্বন,
কাঁপ কেন?—ভয় নাই, চিত্র অচেতন।
সিহরিল চিত্র!—না না আমারি হৃদয়,
কাঁপিল আমারি ওষ্ঠ আলেখ্যের নয়।
আর না মিটিল সাধ, জন্মের মতন,
চিত্রের সহিত আশা দিনু বিসর্জ্জন।
চিত্র পট দগ্ধ হ’ল, কিন্তু কই স্মৃতি গেল,
প্রাণের ভিতরে দেখি সেই মূর্ত্তি তার!
এস কাল! মুছে ফেল, কেন মিছে এ জঞ্জাল,
এ ব্যাধির চিকিৎসক তুমিই আমার।