চিত্ত-মুকুর/সায়হ্ন চিন্তা

উইকিসংকলন থেকে

সায়হ্ন-চিন্তা।

নিদাঘ সায়হ্ন দূর নয়ন সীমায়
স্পর্শিয়াছে যেই খানে আকাশ ভূতল,
অস্তমিত ভানু আভা মিশাইয়া যায়
বিকাশিছে গোধূলির ছায়া সুশীতল।
সেবিতে ছিলাম বায়ু প্রাসাদ শিখরে
গালিচায় বিস্তারিয়া ক্লান্ত কলেবর,


ভার্জিলের গ্রন্থখানি বক্ষের উপরে,
ভাবিতে ছিলাম ভীম ট্রোজন সমর।


মানব চিত্তের গতি বিচিত্র কেমন!
দেখিতে দেখিতে শূন্য সুনীল অম্বরে
লঙ্ঘিয়া জলধি সীমা অনন্ত যোজন,
প্রবেশিল ট্রয়-রাজ্যে মুহূর্ত্ত ভিতরে।
আবার মুহূর্ত্ত নাহি হইতে অতীত,
ফিরিল ভারতবর্ষে বিদ্যুত গমনে।
চক্ষের পলক নাহি হইতে পতিত
অবনীর দুই প্রান্ত হেরিল নয়নে।


ভারতের চিত্রপট সম্মুখে এখন—
স্থির চিত্তে দেখিলাম কতক্ষণ ধরে,
যে ট্রয় দেখিয়া এত বিস্ময়ে মগন।
সেই ট্রয় দেখিলাম নগরে নগরে।
যে বীরত্বে হেক্টর আছিল দুর্জ্জয়,
সে বীরত্ব কুরুক্ষেত্রে রাশিকৃত পড়ে,
যে রূপের তরে ভস্ম হয়েছিল ট্রয়
সে সৌন্দর্য্য ভারতের কুটিরে কুটিরে।




কুরুক্ষেত্র—ভারতের বীরের শ্মশান!
বিঘত প্রমান ভূমি করহ খনন
কত ভগ্নধনু কত রক্তাক্ত কৃপাণ—
দেখিবে কতই ভগ্ন বিচিত্র কেতন।
আর কি দেখিবে?—হায় বিদরে হৃদয়!
হয় ত দেখিবে চুর্ণ অস্থি কয় খান,
যে বিরত্ব ভূমণ্ডলে আছিল দুর্জ্জয়,
চুর্ণ অস্থি মাত্র তার দেখিবে প্রমাণ।


তথাপি বিলাত শ্রেষ্ঠ—বঙ্গের সন্তান।
কে দিল এ মোহমন্ত্র তোমার শ্রবণে?
মন-চক্ষে দেখ দেখি চিত্র দুইখান
কোন চিত্র রম্যতর উদিবে নয়নে।
বীরত্ব, সৌন্দর্য্য, কিম্বা সাহিত্য, প্রণয়,
পরস্পরে মিলাইয়া দেখ একবার,
ভারতের কোন বস্তু হীনপ্রভ হয়,
ভারতবর্ষেতে নাই কোন‍্টি ইহার?


নাহি সে পিণাকধারী কর্ণ ধনঞ্জয়,
নাহি ভীম অভিমন্যু, নাহি গুরু দ্রোণ,
অপভ্রংশ আর্য্যবংশ তবু লুপ্ত নয়—
ভারতে ক্ষত্রিয় জাতি জীবিত এখন(ও)।
পরিচয় দিতে লিপি সরমে সিহঁরে
আর্য্যবংশ অবতংস যে ক্ষত্রিয়গণ,


তথাপি সে আর্য্যজাতি—গর্ব্ব আপনার—
ভুলে নাই, ক্ষীণগতি ধমনী ভিতরে।
আর্য্যের শোণিত স্রোত ছুটিছে তাহার—
সত্য ধর্ম্ম দৃঢ়ব্রত এখনো অন্তরে।
একটি য়ুনানী বীর ক্ষত্র এক জন
দেখ দেখি কিছুক্ষণ নিবিষ্ট অন্তরে,
কাহায় বিরাজে উচ্চ বীরত্ব লক্ষণ
তেজ, বীর্য; ধর্ম্ম-চিহ্ন আছে কোন নরে




পুরুষ অন্তরে থাক্‌, যেখানে রমণী
কৌতুক ভাবিয়া হাসি পশিত সমরে,
কোমল হৃদয়ে ভগ্ন হইত অশনি
তথাপি করিত রণ স্বদেশের তরে।
যদি নিজ পতি কভু ভঙ্গ দিত রণে,
কাপুরুষ ভাবি তায় হেরিত না মুখ।
রণে ভীত পুত্র যদি ফিরিত ভবনে,
কাটিত নিস্তেজ ভাবি স্বীয় স্তনযুগ।


সৌন্দর্য—তাই বা কোথা ভারতে যেমন,—
এমন নিবিড় তনু কোথা ভূমণ্ডলে?
এমন বঙ্কিম ভুরু—বিস্ত‌ৃত নয়ন,
এমন বলিব কিবা আছে কি ভূতলে?
এমন অনন্ত বাহী প্রেম-প্রবাহিনী!
নিস্বার্থ অনন্ত হেন চিত্ত বিনিময়!
প্রণয়ে রমনী—স্নেহে স্বরূপা জননী,
সুধু ইউরোপে কেন—নাহিক ধরায়।

১০


শ্বেতাঙ্গী মহিলা মত চঞ্চলা সাদিনী
অসার আমোদ-মত্তা পাবে না এখানে,



প্রেম, রূপ শোভে যাহে ভারত-রমণী,
পবিত্র প্রকৃত তাহা সুগভীর প্রাণে।
প্রেমে আলিঙ্গন দিবে, সমরে সাদিনী,
সঙ্গিতে ঢালিবে সুধা, আমোদে রঙ্গিনী,
সাহিত্যে হইবে সখী, সংসারে গৃহিণী,
বিপদে হইবে দাসী মরণে সঙ্গিনী।

১১


সাহিত্য বিলুপ্তপ্রায় তথাপি এখানে
ছিন্ন বস্ত্র বিমণ্ডিত তালের পাতায়,
যে কবিত্ব যে পাণ্ডিত্য পড়ে অযতনে,
(ই)উরোপে নাহিক তাহা রয়েল ফর্ম্মায়।
তাপস বাল্মিকী বসি পর্ণের কুটিরে,
যে কবিত্ব স্রোত হায় করেছে সৃজন,
আভনের[১] উচ্চতর প্রাসাদ শিখরে
হয় নাই—হইবে না কভু সে কুজন।

১২


তবু কি বিলাত শ্রেষ্ঠ?—বঙ্গের নন্দন
এখনো যদ্যপি তব ভ্রম নহে দূর—

নহ দোষী তুমি, তব কলঙ্কী নয়ন,
সাধ্য-হীন নিরখিতে দৃশ্য সুমধুর।
বিলাতী শিক্ষায় কিম্বা হৃদয় তোমার,
বিকৃত বিলাতী ছাঁচে হয়েছে গঠিত,
অসনে বসনে ওই লক্ষণ তাহার,
উচ্চ বংশোদ্ভব, কিন্তু শিক্ষায় ঘৃণিত।


  1. Stratford-on-Aron, birth-place of Shakspere.