চিত্রা/মৃত্যুর পরে
আজিকে হয়েছে শান্তি
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে!
রাত্রিদিন ধুক্ধুক্
তরঙ্গিত দুঃখ সুখ
থামিয়াছে বুকে!
যত কিছু ভালমন্দ,
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই!
বল শান্তি, বল শান্তি,
দেহসাথে সব ক্লান্তি
হয়ে যাক্ ছাই!
গুঞ্জরি’ করুণ তান
ধীরে ধীরে কর গান
বসিয়া শিয়রে!
যদি কোথা থাকে লেশ
জীবন-স্বপ্নের শেষ
তাও যাক্ মরে!
তুলিয়া অঞ্চলখানি
মুখ পরে দাও টানি,
ঢেকে দাও দেহ!
করুণ মরণ যথা
ঢাকিয়াছে সব ব্যথা,
সকল সন্দেহ!
বিশ্বের আলোেক যত
দিগ্বিদিকে অবিরত
যাইতেছে বয়ে’,
শুধু ওই আঁখি পরে
নামে তাহা স্নেহভরে
অন্ধকার হয়ে।
জগতের তন্ত্রীরাজি
দিনে উচ্চে উঠে বাজি
রাত্রে চুপে চুপে,
সে শব্দ তাহার পরে
চুম্বনের মত পড়ে
নীরবতা রূপে!
মিছে আনিয়াছ আজি
বসন্ত কুসুমরাজি
দিতে উপহার!
নীরবে আকুল চেখে
ফেলিতেছ বৃথা শোকে
নয়নাশ্রুধার!
ছিলে যারা রোষভরে
বৃথা এত দিন পরে
করিছ মার্জ্জনা!
অসীম নিস্তব্ধ দেশে
চিররাত্রি পেয়েছে সে
অনন্ত সান্ত্বনা!
গিয়েছে কি আছে বসে,
জাগিল কি ঘুমাল সে
কে দিবে উত্তর?
পৃথিবীর শ্রান্তি তারে
ত্যজিল কি একেবারে,
জীবনের জ্বর?
এখনি কি দুঃখ সুখে
কর্ম্মপথ অভিমুখে
চলেছে আবার?
অস্তিত্বের চক্রতলে
একবার বাঁধা পলে
পায় কি নিস্তার?
বসিয়া আপন দ্বারে
ভালমন্দ বল তারে
যাহা ইচ্ছা তাই!
অনন্ত জনম মাঝে
গেছে সে অনন্ত কাজে,
সে আর সে নাই।
আর পরিচিত মুখে
তোমাদের দুখে সুখে
আসিবে না ফিরে,
তবে তার কথা থাক্,
যে গেছে সে চলে যাক্
বিস্মৃতির তীরে!
জানিনা কিসের তরে
যে যাহার কাজ করে
সংসারে আসিয়া,
ভাল মন্দ শেষ করি
যায় জীর্ণ জন্মতরী
কোথায় ভাসিয়া!
দিয়ে যায় যত যাহা
রাখ তাহা ফেল তাহা
যা ইচ্ছা তোমার!
সে ত নহে বেচা-কেনা,
ফিরিবে না ফেরাবে না
জন্ম-উপহার!
কেন এই আনা গোনা,
কেন মিছে দেখাশোনা
দুদিনের তরে;
কেন বুকভরা আশা,
কেন এত ভালবাসা
অন্তরে অন্তরে;
আয়ু যার এতটুক্,
এত দুঃখ এত সুখ
কেন তার মাঝে;
অকস্মাৎ এ সংসারে
কে বাঁধিয়া দিল তারে
শত লক্ষ কাজে;
হেথায় যে অসম্পূর্ণ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত
কোথাও কি একবার
সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত;
জীবনে যা প্রতিদিন
ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি
তারে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থ পূর্ণ করি;
হেথা যারে মনে হয়
শুধু বিফলতাময়
অনিত্য চঞ্চল
সেথায় কি চুপে চুপে
অপূর্ব্ব নুতনরূপে
হয় সে সফল;
চিরকাল এই সব
রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর,
জন্মান্তের নব প্রাতে
সে হয় ত আপনাতে
পেয়েছে উত্তর!
সে হয় ত দেখিয়াছে
পড়ে যাহা ছিল পাছে
আজি তাহা আগে;
ছোট যাহা চিরদিন
ছিল অন্ধকারে লীন,
বড় হয়ে জাগে;
যেথায় ঘৃণার সাথে
মানুষ আপন হাতে
লেপিয়াছে কালী
নূতন নিয়মে সেথা
জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা
কে দিয়াছে জ্বালি!
কত শিক্ষা পৃথিবীর
খসে’ পড়ে জীর্ণচীর,
জীবনের সনে,
সংসারের লজ্জাভয়
নিমেষেতে দগ্ধ হয়
চিতা-হুতাশনে;
সকল অভ্যাস-ছাড়া
সর্ব্ব আবরণ হারা
সদ্য শিশুসম
নগ্নমূর্তি মরণের
নিষ্কলঙ্ক চরণের
সম্মুখে প্রণম’!
আপন মনের মত
সঙ্কীর্ণ বিচার যত
রেখে দাও আজ!
ভুলে যাও কিছুক্ষণ
প্রত্যহের আয়োজন,
সংসারের কাজ!
আজি ক্ষণেকের তরে
বসি বাতায়ন পরে
বাহিরেতে চাহ!
অসীম আকাশ হতে
বহিয়া আসুক্ স্রোতে
বৃহৎ প্রবাহ!
উঠিছে ঝিল্লির গান,
তরুর মর্ম্মর তান,
নদী কলস্বর,
প্রহরের আনাগোনা
যেন রাত্রে যায় শোনা
আকাশের পর!
উঠিতেছে চরাচরে
অনাদি অনন্তস্বরে
সঙ্গীত উদার
সে নিত্য-গানের সনে
মিশাইয়া লহ মনে
জীবন তাহার!
ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে
দেখ তারে সর্ব্বদৃশ্যে
বৃহৎ করিয়া;
জীবনের খুলি ধুয়ে
দেখ তারে দুরে থুয়ে
সম্মুখে ধরিয়া!
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে
ভাগ করি খণ্ডে খণ্ডে
মাপিয়ো না তারে!
থাক্ তব ক্ষুদ্র মাপ
ক্ষুদ্র পুণ্য, ক্ষুদ্র পাপ
সংসারের পারে!
আজ বাদে কাল যারে
ভুলে যাবে একেবারে
পরের মতন
তারে লয়ে আজি কেন
বিচার বিরোধ হেন,
এত আলাপন!
যে বিশ্ব কোলের পরে
চির দিবসের তরে
তুলে নিল তারে
তার মুখে শব্দ নাহি,
প্রশান্ত সে আছে চাহি
ঢাকি আপনারে!
বৃথা তারে প্রশ্ন করি,
বৃথা তার পায়ে ধরি,
বৃথা মরি কেঁদে;—
খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে-
কোন্ অঞ্চলের তলে
নিয়েছে সে বেঁধে;
ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে
ফিরে নিতে চাহি মিছে;—
সে কি আমাদের?
পলেক বিচ্ছেদে হায়
তখনি ত বুঝা যায়
সে যে অনন্তের!
চক্ষের আড়ালে তাই
কত ভয় সংখ্যা নাই;
সহস্র ভাবনা!
মুহূর্ত্ত মিলন হলে
টেনে নিই বুকে কোলে,
অতৃপ্ত কামনা!
পার্শ্বে বসে ধরি মুঠি,
শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি,
চাহি চারিভিতে,
অনন্তের ধনটিরে
আপনার বুক চিরে
চাহি লুকাইতে!
হায়রে নির্ব্বোধ নর,
কোথা তোর আছে ঘর,
কোথা তোর স্থান!
শুধু তোর ওইটুক
অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
ভয়ে কম্পমান!
ঊর্দ্ধে ওই দেখ চেয়ে
সমস্ত আকাশ ছেয়ে
অনন্তের দেশ,
সে যখন একধারে
লুকায়ে রাখিবে তারে
পাবি কি উদ্দেশ?
ওই হের সীমাহারা
গগনেতে গ্রহতারা
অসংখ্য জগৎ,
ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত
হয় ত সে একা পান্থ
খুঁজিতেছে,পথ!
ওই দূর দূরান্তরে
অজ্ঞাত ভুবন পরে
কভু কোন খানে
আর কি গো দেখা হবে,
আর কি সে কথা কবে,
কেহ নাহি জানে!
যা হবার তাই হোক্,
ঘুচে যাক্ সর্ব্বশোক,
সর্ব্ব মরীচিকা!
নিবে যাক্ চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
মর্ত্ত্য জন্ম-শিখা!
সব তর্ক হোক্ শেষ,
সব রাগ সব দ্বেষ,
সকল বালাই!
বল শান্তি বল শান্তি
দেহ সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হোক্ ছাই!